প্রবাসের কোনো কোনো অলস মুহূর্তে ছোট বেলার অনেক স্মৃতি ভেসে উঠে মনের পর্দায়। সেই সব স্মৃতির কিছু কিছু খুব আনন্দদায়ক, আবার কিছু স্মৃতি মনকে করে তুলে ভারাক্রান্ত। ইচ্ছে হয় ভিডিও এডিট করার মতোই সেই সব স্মৃতিগুলোকে পরিমার্জন করে নুতন করে দেখি। ছোট বেলায় খাবার নিয়ে আম্মার সাথে মেজাজ দেখানো এমনি এক মন খারাপ করা স্মৃতি। কেন জানি না, খাবারের বিষয়ে খুব খুঁতখুতে স্বভাবের ছিলাম। ভাত বেশি নরম হওয়া, তরকারি পছন্দ না হওয়া সহ নানা অজুহাতে আম্মার উপর রাগ দেখাতাম। চুপচাপ সব সহ্য করেও হাসিমুখেই বলতেন, “বড় হও, নিজে রান্না করলে তখন বুঝতে পারবা।” বড় হয়ে প্রবাসে এসে এখন সত্যিই বুঝি একটি তরকারী রান্নার পিছনেও মিশে আছে কতটা সময়, শ্রম এবং একাগ্রতা। কষ্ট পাই এই ভেবে যে দিনের পর দিন মাকে একই কষ্ট দিয়ে গেছি কিন্তু সেটা বুঝার সামর্থ্য তখন ছিলোনা। শুধু খাবার নিয়েই না, স্কুলের পড়ার বইয়ের ভিতর লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ি জেনেও কোনোদিন গল্পের বই কেনার জন্য টাকার অভাবের কথা বলেননি। যদিও মধ্যবিত্তের জীবন ছিল আমাদের। পারিবারিকভাবে অনেক সময় টানাপোড়েনের মধ্যে দিন অতিক্রান্ত হলেও কোনোদিন অভাব অনটন, দুঃখ কষ্ট বুঝতে দেননি। নিঃস্বার্থ বটবৃক্ষের মতোই সব কিছু আড়াল করে রেখে প্রশান্তির ছায়া দিয়ে গেছেন অবিরাম। এখনো তাই করে যাচ্ছেন। জীবন, জগত, সন্তানের কাছে কোনো প্রত্যাশাহীন এই মা নীরবে চোঁখের পানি ফেললেও আমাদের তিন ভাইকে তা কখনো বুঝতে দেননা। এখনো ফোন করে কি লাগবে জানতে চাইলে উত্তরে বলেন, “আমার কিছুই লাগবে না। আল্লাহ্পাক তোমাদেরকে নিরাপদে রাখুন, শান্তিতে রাখুন।” উনিই আমার মা, আমাদের মা – চিরায়ত বাংলার শাশ্বত জননী।
এই মায়াময়ী মায়েদের হাসির আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে তাদের বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা কষ্টের পাহাড়। হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও তারা সবার আগে অনুভব করেন সন্তানের মঙ্গল বা অমঙ্গলের আভাষ। দুহাত তুলে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনার সময়ও নিজের জন্য নয় বরং সন্তানের সমৃদ্ধিই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠে। জনম জনম ধরে চেষ্টা করলেও এই আদি, অকৃত্তিম, অমূল্য ভালোবাসার ঋণ কি কখনো পরিশোধ করা যায় ?
জগতের সব মায়েদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে