টরন্টো থেকে:-
২০১১ সালে মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের গিয়েছিলাম কয়েক সপ্তাহের জন্য । তখন আমার গাড়ি কেনা হয়নি। বাংলা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে একটা ভ্যান ভাড়া করলাম এয়ারপোর্ট এ পৌছে দেয়ার জন্য। যাত্রা শুরুর দিনে নির্ধারিত সময়ে আমার বাসার সামনে একটি ভ্যান দেখতে পেলাম। আমার স্ত্রী পুত্র ও লাগেজ পত্র সহ ভান এ আরোহন করলাম। ভ্যান পিয়ারসন এয়ারপোর্ট অভিমুখে যাত্রা শুরু করলো। হটাৎ আমার মনে হলো এ ভ্যান চালক কে আমি কোথাও দেখেছি ! তাত্ক্ষণিক সেটা মনে করতে পারলাম না, তবে স্মৃতির পাতা উল্টাতে শুরু করলাম।যাইহোক, সে সময়মত আমাদের এয়ারপোর্ট পৌছে দিল।
ভাড়ার টাকা দেয়ার সময় আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মনে হয় আগে আপনাকে বোধহয় আগে কোথাও দেখেছি ! আমার প্রশ্ন শুনে তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন ইয়ে ,মানে হাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে !
আমি বললাম, আপনি তুতিয়ার রহমান সাহেব না ? তিনি বললেন, জী হাঁ , আপনি তো কৃষি ও পানি উন্নয়ন মন্ত্রী মহোদয়ের পি আর ও ছিলেন, তাই না ? আমি বললাম, হ্যা ঠিকই ধরেছেন , কিন্তু আপনি টরন্টোতে কখন ও কিভাবে এলেন ?
তিনি বললেন, আমার ছেলেরা এখানে থাকে। তারাই আমাকে নিয়ে এসেছে।
তার সাথে আর কথা এগোলো না, কারণ আমার ইতোমধ্যে লেট হয়ে গেছিল। ছেলে এ বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। কাজেই আমি চেক ইন করতে রওয়ানা হলাম। তুতিয়ার সাহেব কে শুধু বললাম , দেশ থেকে ফিরে পরে যোগাযোগ হবে।
প্লেনে উঠে তুতিয়ার সাহেবে কথা মনে করে পুরানো দিনের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আপন মনে হাসছিলাম সেসব কথা মনে করে। ছোটকাল থেকেই আমরা কয়েক বন্ধু ভীষণ পোংটা ছিলাম। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আমার বাল্য বন্ধু ও আত্বীয় পরবাসী ব্লগের একজন একান্ত ভক্ত (আমার স্ত্রীর চাচাতো ভাই), আমার বন্ধু (আমার স্ত্রীর সেজো ভাই) ,আমার স্ত্রীর আর এক ফুপাতো ভাই ও আরো কয়েকজন বন্ধু বান্ধব। আমরা অনেক লোকের নাম বিভিন্নভাবে বিকৃত করে ডাকতাম ! তাদের চেহারা ও চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমরা এসব নাম করণ করতাম!! (আল্লাহ মাফ করুন, মানুষের নাম বিকৃতি করা পাপ। কিন্তু কি করব,শয়তান যে পিছে লেগে থাকে!!)
১৯৯৪ সালে সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি উন্নয়ন মন্ত্রনালয়ে (এ মন্ত্রনালয়ের নাম এখন পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়) যখন প্রথম তুতিয়ার সাহেব কে দেখি তখন তার একটা নামকরণ করছিলাম আমার পুরানো অভ্যসবশত। তার নামের প্রথম অক্ষর ‘তু’ বাদ দিয়ে ‘অন্য একটি অক্ষর’ দিয়ে উচ্চারণ করতাম। শুধু আমি নই ,মন্ত্রনালয়ের অনেকই আড়ালে তাকে ঐভাবে ডাকতেন।
তুতিয়ার রহমান ছিলেন মোটাসোটা ও পরিষ্কার টাক বিশিষ্ট চেহারার একজন নিতান্ত বিনয়ী ও ভদ্রলোক। তিনি পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের অধীন নদী গবেষণা ও ড্রেজিং উন্নয়ন বিভাগের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী। মোটামুটি মধ্যম মাপের একজন কর্মকর্তা। দফতরের কাজে অনেক সময় তাকে মন্ত্রনালয়ে আসতে হত। মন্ত্রীর দফতরে কাজ না থাকলেও মন্ত্রীর পি এস ,এ পি এস বা পি আর ও সাহেবদের রুমের দরজা সামান্য একটু খুলে কে সালাম দিয়ে যেতেন। কোনো কোনো সময় আমরা দেখেও না দেখার ভান করতাম। বিভিন্ন দফতর/পরিদফ্তরে এ ধরনের কিছু কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকে মন্ত্রনালয়ের সাথে লিয়াজো রক্ষা করার জন্য। মন্ত্রী/সচিবদের বাক্তিগত কর্মকর্তাদের গাড়ী ও ‘অন্যান্য’ সুবিধা দিয়ে খুশি করার জন্য একপায়ে খাড়া থাকতেন। আমাদের অনেকেই তার কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিয়েছি। বিনিময়ে তার দফতরের যে কাজ সেটা সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে করে দিয়েছি। আজ এতদিন পরে এসে তার বিষয়ে বলতে যেয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেব না। তুতিয়ার সাহেব কে ফোন করে বলে অনেক সময় নুতন পাজেরো গাড়ি এনে পুরো উইকএন্ড ঘুরে বেড়িয়ে পরে ফেরত দিয়েছি। তার দেয়া গাড়ী নিয়ে আমার ছোট সম্মন্দীর বিয়ের বরযাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়া আসা করেছি।
একবার তুতিয়ার রহমানের বাক্তিগত একটা কাজে একদিন হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে এলেন। এ সময় মন্ত্রী মহোদয়ের একান্ত সচিব (পি এস) ছুটিতে থাকাকালীন আমি পি এস এর অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলাম। কাজটা হলো , “তুতিয়ার সাহেবের ছয় সপ্তাহের একটি প্রোগ্রামে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার বিষয়ে মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন সংক্রান্ত।” নথিটি সচিব মহোদয় সেদিনই মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়েছেন। সেখানে রওয়ানা হবার মাত্র দুদিন বাকি আছে। নথিটি এখন মন্ত্রী মহোদয়ের একান্ত সচিব অর্থাৎ আমার কাছে। আজকের মধ্যে মন্ত্রী মহোদয় এটি অনুমোদন না করলে এবং এ সংক্রান্ত মন্ত্রনালয়ের আদেশ জারী না হলে তার বিদেশ যাওয়া বাতিল হয়ে যাবে ।
তুতিয়ার সাহেব সচিবের দফতর থেকে সব খবর নিয়ে এসেছেন। প্রায় কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন , পি আর ও সাহেব, মন্ত্রী মহোদয়কে বলে আমার নথিটি কি আজ অনুমোদন করিয়ে দেবেন ? আপনি এটা না করে দিলে আমার ট্রেনিং প্রোগ্রামটা বাতিল হয়ে যাবে।
আমি তাকে বললাম , আপনি সিওর যে নথি আমার কাছে এসেছে ?
তিনি বললেন,আমি এইমাত্র সচিবের দফতর থেকে জেনে আসলাম যে নথিটি মন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে।
আমি দেখলাম আমার টেবিলে ১৫/১৬ টি নথি রাখা আছে। সেগুলি কাছে টেনে নিয়ে দেখলাম যে তুতিয়ার সহেবের বিদেশে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নথিটিও সেখানে আছে। নথিটি তে আমি একটি জরুরী লেখা ট্যাগ লাগিয়ে দিলাম। তাকে বললাম অপেক্ষা করুন ,দেখি কি করা যায়।
তখন সময় বেলা তিনটা। অফিস আওয়ার শেষ হবে বিকাল পাচটায়। আমি উঠে মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষে কেউ আছে কিনা সেটা তার পি এ কে জিজ্ঞাসা করলাম। পি এ বললো ,স্যারের রুমে এখন প্রতিমন্ত্রী মহোদয় ও কয়েকজন এম পি আছেন। আমি তাকে বললাম, ঠিক আছে, আমার রুমের নথি গুলো মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষে এখনই পাঠিয়ে দিন। আর উনারা বেরিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন।
আমার রুমে এসে দেখি তুতিয়ার সাহেব অঝর ধারায় ঘামছেন! আমি বিরক্ত হয়ে বললাম ,এত অস্থির হবেন না তো ! যান বাইরে যেয়ে কিছুক্ষণ ফ্রেশ হওয়া খেয়ে আসুন !! আমার তাড়া খেয়ে তিনি একটু চুপসে গেলেন এবং আমার রুমের বাইরে যেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
প্রায় আধাঘন্টা পরে মন্ত্রী মহোদয়ের পি এ ইন্টারকমে বললেন স্যার , উনারা চলে গেছেন। মন্ত্রী মহোদয় এখন একা আছেন। নথিগুলি তার টেবিলে দেয়া হয়েছে। আমি মন্ত্রী মহোদয় কে ফ্রেশ হওয়ার জন্য কিছু সময় দিয়ে তার কক্ষে ঢুকলাম। দেখলাম তিনি ফাইল দেখতে শুরু করেছেন। আমাকে ঢুকতে দেখে বললেন, কি ,কিছু বলবে নাকি ?
আমি বললাম ,স্যার একটা জরুরী নথি আছে। আপনি ওটা আগে দেখলে ভালো হয়।
মন্ত্রী মহোদয় বললেন,কই সেটা ?
আমি নথিগুলির মধ্য থেকে তুতিয়ার সাহেবের নথিটি বের করে তার সামনে দিলাম। মন্ত্রী মহোদয় নথিটি খুলে দেখতে লাগলেন। বললেন, মাত্র দুদিন সময় আছে, কিভাবে সে সব ফর্মালিটি শেষ করে রওয়ানা হবে ?
আমি বললাম ,সে এখন আপনার কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করছে ,আপনি অনুমোদন করলে হাতে হাতে সে সব করে নেবে।
মন্ত্রী মহোদয় বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তিনি আর কিছু না বলে নথিতে অনুমোদন করে সচিব মহোদয়কে না দিয়ে সরাসরি সংশ্লিষ্ট শাখার সহকারী সচিব কে মার্ক করে দিলেন। নথিটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, এখনই এটি পাঠিয়ে দিন।
আমি রুমের বাহিরে এসে মন্ত্রী মহোদয়ের পি এ কে নথিটি দিয়ে বললাম, এটি সংশ্লিষ্ট শাখায় দিয়ে আসুন। তাদের বলবেল ,মন্ত্রী মহোদয় আজই এটার আদেশ জারী করতে বলেছেন।
আমার রুমে এসে তুতিয়ার সাহেব কে না দেখে অন্য কাজে মনোনিবেশ করলাম। কিছুক্ষণ পরে তুতিয়ার সাহেব এসে হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, পি আর ও সাহেব, আমার নথিটি কি স্যার দেখেছেন ?
আমি বললাম হাঁ, মন্ত্রী মহোদয় সেট অনুমোদন দিয়েছেন। নথি ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট শাখায় চলেও গেছে।
তুতিয়ার সাহেব খুশিতে বাগ বাগ ! বললেন, সবই আপনার জন্য সম্ভব হয়েছে, আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো !!
আমি বললাম, আচ্ছা আচ্ছা , ধন্যবাদ পরে দেবেন। এখন আপনার সফরের আদেশ জারীর জন্য ঐ শাখায় যেয়ে তদ্বির করুন।
এর মাস দু’এক পরে তুতিয়ার সাহেব একদিন আমার রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তার হাত ব্যাগ থেকে একটা কমপ্লিট সুটের কাপড়ের পিস বের করে বললেন ,এটা আমি লন্ডন থেকে ট্রেনিং শেষ করে আসার সময় আপনার জন্য এনেছি। আপনি নিলে খুব খুশি হব।
আমি বললাম, এটার কোনো দরকার নাই। আপনি ফেরত নিয়ে যান। আমার মনে হলো তিনি আহত হলেন এবং ভীষণ মুষড়ে পড়লেন।
এসময় আমি তথ্য অধিদফতরে (পি আই ডি) আমাদের মাসিক সমন্বয় সভায় যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। সভা শেষ আর করে দু’ঘন্টা পরে আমার অফিস এ এসে বসেছি। এমন সময় তুতিয়ার সাহেব আবার এসে আমাকে একই অনুরোধ করলেন। বললেন, আপনি এটা নিলে আমি খুবই খুশি হব। আপনাকে দেব বলেই এটা আমি কিনেছি। লোকটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওটা আমি না নিলে সে আসলেই কষ্ট পাবে। তাকে বললাম, ঠিক আছে, রেখে যান। তিনি মহা খুশি হয়ে একটা সালাম দিয়ে চলে গেলেন।
সেই তুতিয়ার রহমান কে কানাডায় ভ্যান চালক হিসেবে দেখে আমি বেশ আশ্চার্য হয়েছিলাম। পরে দেশ থেকে ফিরে একদিন বাংলা পত্রিকা পড়তে যেয়ে ভ্যান ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে আবার তুতিয়ার সাহেবের কথা মনে হল। ঠিক কোন নম্বরে ফোন করে তাকে পেয়েছিলাম সেটা মনে করতে পারলাম না। বিজ্ঞাপন দেখে কয়েকটি নম্বরে ফোন করেও তার সন্ধান পেলাম না। পরে আবারও ফোন করেছি কিন্তু তুতিয়ার সাহেব কে আর পাইনি। তাই বাংলাদেশে নির্বাহী প্রকৌশূলীর চাকুরী থেকে তিনি কিভাবে কানাডায় এসে ভ্যান চালক হয়েছিলেন তা আর জানা হয়নি। তবে আমি এখনো তাকে খুজি। তিনি কখন কিভাবে কানাডা এসেছিলেন এবং কতটুকু শান্তিতে আছেন জানতে ইচ্ছে করে।
পুরানো দিনের কথা মনে করিয়ে দিলে।
হাঃ হাঃ হাঃ ….মাঝে মাঝে পুরানো স্মৃতি ঝালাই করতে হয়।অনেক সময় মানুষের পুরানো দিনের স্মৃতিই তাকে বর্তমানের কঠিন ও কর্মময় জীবনে ক্ষনিকের জন্য হলেও আনন্দ দান করে।
অভিবাসনের পরিক্রমায় বিভিন্ন রখম পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই চলে আমাদের জীবন প্রবাহ. আপনার পেশাগত জীবনকে ফিরে দেখার বর্ণনার মধ্যে তুতিয়ার সাহেবের এই পরিবর্তনের চিত্রটি কিছুটা হলেও উঠে এসেছে. অনেক ধন্যবাদ মনির ভাই.