টরন্টো থেকে:-

PR-microphones

১৯৮৪ সালে বিসিএস করে তথ্য কাডারে চাকুতিতে যোগদান করি। তার পরে কানাডা আসার আগে পর্যন্ত ২০০৫ সালের মে মাস পর্যন্ত তথ্য কাডারের কর্মকর্তা হিসাবে তথ্য মন্ত্রনালয় সহ সরকারের  বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে কাজ করেছি। এ সময়ে অর্জন করেছি বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা । তবে শুধু সংবাদ কক্ষের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়েই আজকের লেখা ।

প্রায় বিশ বছর চাকুরী  জীবনের মধ্যে দুই দফা কাজ করেছি পিআইডি’র (Press Information Department/তথ্য অধিদফতর সংক্ষেপে-PID/পিআইডি) সংবাদ কক্ষে। পিআইডি সরকারের প্রধান প্রচার মুখপাত্র ও প্রচার কাজের প্রধান সম্মনয়্কারী সংস্থা ।  পিআইডির সংবাদ কক্ষ প্রতিদিন সরকারের প্রধানমন্ত্রী,মন্ত্রী ও বিভিন্ন সরকারী দফতর বা সংস্থার যাবতীয় সংবাদ প্রস্তুত ,সম্পাদনা ও বিতরণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। সরকারী প্রেসনোট ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ ও অবস্থান প্রচার মাধ্যমে প্রেরণ করা পিআইডির একটি অন্যতম প্রধান কাজ। এ কাজ গুলি যেমন ঝুকিপূর্ণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদ কক্ষে কর্মরত কর্মকর্তাদের বিকাল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত পিক আওয়ার। একটা মুহূর্তও রেস্ট পাওয়া যায় না। প্রতি শিফটে একজন ডিউটি অফিসার বা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অধীনে ৫/৬ জন তথ্য অফিসার,কয়েকজন সহকারী তথ্য অফিসার,তথ্য সহকারী ও অন্যান্য কর্মচারী যেমন টেলেক্স বা ফ্যাক্স অপারেটর,কম্পিউটার অপারেটর ডুপলিকেটিং মেশিন অপারেটর ,ডেসপাশ রাইডার ও কয়েকজন এমএলএসএস  সংবাদ কক্ষে প্রতিদিন দুই শিফটে কাজ করে। ডিউটি অফিসার কে অনেকে শিফট ইনচার্জও বলে থাকেন।

সংবাদ কক্ষের তিনটি টেলিফোন,একটি নীল্ টেলিফোন ,ফ্যাক্স ও টেলেক্স, ডুপ্লিকেটিং মেশিনের যেন কোন বিরতি নেই। টেলিফোন গুলি প্রায় প্রতি মিনিটে একবার করে বেজে উঠে। কখনো কোন মন্ত্রনালয়ের পি আর ও, কখনো কোনো পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ,কখনো রেডিও বা টেলিভিশনের সংবাদ কক্ষ থেকে বা কখনো স্বয়ং কোনো মন্ত্রী বা সচিব মহোদয় বা কোনো মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি প্রতিনিয়ত পিআইডির সংবাদ কক্ষে ফোন করেন কোনো না কোনো বিষয়ে। একহাতে সংবাদ এডিটিংএর প্রিন্টআউট অন্য হাতে টেলিফোন ,পাশে দন্ডায়মান টেলেক্স অপারেটর এবং ওপর টেলিফোনে আর এক সহকর্মী অন্য কারো সাথে কোনো নিউজের বিষয়ে কথা বলছেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ফটো এডিটিং এর কপি হাতে ফটো শাখার কেউ হয়তো আরেক পাশে অপেক্ষা করছেন। এরকমই সংবাদ কক্ষের ডিউটি অফিসার বা শিফট ইনচার্জ এর দৈনন্দিন কাজের একটি চিত্র। আমার চাকুরী জীবনে  পিআইডি সংবাদ কক্ষের এই পরিবেশে দুইবার কাজ করেছি।

পিআইডির রাতের পালার শিফট ইনচার্জ কে প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়। কোনো সংবাদ বা প্রেস নোট বা যে কোনো বিষয়ে ভুল হলে তার দায়দায়িত্ব শিফট ইনচার্জ কেই বহন করতে হয়। পিআইডির আরেকটি অপ্রিয় কাজ ছিল ” প্রেস এডভাইস ।” প্রেস এডভাইস কথাটা শুনতে  ভালো লাগলেও কাজটা ছিল খুবই অপ্রিয়। সরকারের জন্য বিব্রতকর  কোনো সংবাদ যাতে পত্রিকায় না ছাপানো হয় সে বিষয়ে পত্রিকার উপর বিধি নিষেধ আরোপ করাকেই প্রেস এডভাইস বলা হয়। এটা একটা  অপ্রিয় বা অসস্তিকর কাজ এই জন্য যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঠিক সংবাদ থেকে জনসাধারণ কে অন্ধকারে রাখা হয়।   সম্ভবত ১৯৯৬ এর আগে পর্যন্ত এই প্রেস এডভাইস এর কাজটা পিআইডি’র সংবাদ কক্ষ থেকে করা হত। পরবর্তিতে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা উত্তরতর বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষিতে এই অপ্রিয় কাজটা করা থেকে পিআইডি’কে সরকার অব্বাহতি দেয়।

এই “প্রেস এডভাইস” করা নিয়ে আমাকে একবার বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল আমারই এক আত্তীয় সাংবাদিক। আমি তখন (সম্ভবত ১৯৯১ সাল) খুলনা আঞ্চলিক তথ্য অফিস কর্মরত। ঢাকা পিআইডির কেন্দ্রীয় সংবাদ কক্ষ থেকে ডিউটি অফিসার আমাকে ফোন করে বললেন যে,”…….অমুক বিষয়ে ……….. গোলাগুলিতে আহত বা নিহতের কোনো সংবাদ ছাপানো যাবে না। ” এই প্রেস এডভাইসটি খুলনা বিভাগের থেকে প্রকাশিত  সকল সংবাদপত্র বা অন্যান্য প্রচার মাধ্যমকে প্রেস এডভাইস করে জানিয়ে দিতে হবে।

তখন খুলনা বিভাগে খুলনা মহানগরীর থেকে ১১টি দৈনিক পত্রিকাসহ যশোর কুষ্টিয়া বরিশাল পটুয়াখালী ও অন্যান্য জেলা থেকে ৩২/৩৩টি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হত। আমার দুই সহকর্মী টেলিফোন নিয়ে বসে গেলাম প্রেস এডভাইসটি সকল সংবাদপত্র অফিস ফোন করে জানানোর জন্য। আমার ঐ আত্তীয় যশোর জেলা থেকে প্রকাশিত একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। ব্যাক্তিগত জীবনে বাম রাজনৈতিক ধারার সাথে জড়িত ছিলেন এবং একজন নির্ভীক সাংবাদিক হিসাবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। প্রেস এডভাইস জানানোর জন্য তাকে ফোন করলে প্রথমে আত্তীয় সুলভ কুশলাদি বিনিময়ের পর প্রেস এডভাইসটি তাকে জানালাম। তিনি হাসতে হাসতে আমাকে বললেন,’আচ্ছা দেখা যাবে তোমার এডভাইস পালন করতে পারি কি না।’

যাইহোক ,পরের দিন অফিস এসে ঢাকা থেকে পিআইডির সর্বোচ্চ কর্ণধার প্রধান তথ্য অফিসার মহোদয়ের টেলিফোন পেলাম। তিনি বললেন, “কি ব্যাপার বাপু ! ( তিনি অনেক সময় অধস্তন  কর্মরর্তাদের বাপু বলে সম্বোধন করতেন) তোমার কি যশোরের  সাংবাদিকদের সাথে সম্পর্ক খুব  খারাপ নাকি ? তুমি যা বলেছো তা  তো  হুবহু ছাপিয়ে দিয়েছে ? তুমি কি বুঝতে পারছ কি রকম ডামেজ করেছে সে তোমাকে ও সেইসাথে পিআইডি বা সরকারকে?”

আমি তখনও অন্ধকারে। বললাম, স্যার আসলে কি ঘটেছে ? তিনি বললেন, “আজকের পত্রিকা গুলি দেখো ,তার পর আমাকে ফোন কর”।

টেলিফোন রেখে টেবিল থেকে সেদিনের প্রকাশিত পত্রিকাগুলি টেনে নিলাম। দেখলাম আমার ঐ আত্তীয় তার পত্রিকায় আমার দেয়া প্রেস এডভাইসটি আমার নাম পদবী উল্লেখ করে হুবহু ছেপে দিয়েছে। যতদুর মনে পড়ে সে পত্রিকার ডান পাশের কলামে বড় হরফে লিখেছিল , “…….অমুক বিষয়ে ……….. গোলাগুলিতে আহত বা নিহতের কোনো সংবাদ ছাপানো যাবে না”। সেই সাথে আমার অনুরোধ সংবাদটি যেন না ছাপানো হয় সেটাও উল্লেখ করে বলেছে, এটাই ছিল পিআইডি থেকে গতরাতের প্রেস এডভাইস !!

সংবাদটি পড়ে আমি যশোরে আমার ঐ সাংবাদিক আত্তীয়কে টেলিফোন করে বললাম , এটা কি করলেন ভাই? এতে আমার কি ক্ষতি হয়েছে তা কি অনুমান করতে পারছেন? তিনি তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন,আরে নাহ ! এতে আর কি হবে ? এতে তোমার চাকরী যাবে না….বলেই আবার হাহ হাহ হাঃ করে এক রাউন্ড হাসলেন। আমি আর তার সাথে কথা না বাড়িয়ে টেলিফোন রেখে আবার ঢাকা অফিস যোগাযোগ করলাম পরিস্থিতি বাখা করতে।

ঢাকা থেকেও প্রধান তথ্য অফিসার মহোদয় আমার ঐ আত্তীয়কে টেলিফোন করেছিলেন এবং তিনি কি জবাব দিয়েছিলেন আমার জানা নাই। পরে জেনেছিলাম তার পত্রিকায় বেশ কিছুদিনের জন্য সরকারী বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ রাখা হয়।তার পত্রিকার সকল সাংবাদিকের একরিডিটেশন কার্ড দেয়ার ক্ষেত্রেও অলিখিত ভাবে কড়াকড়ি আরোপ করা কয়েছিল। তবে এতে তার খুব একটা ক্ষতি হয়নি ,কারণ তার পত্রিকাটি যশোর থেকে প্রকাশিত সব পত্রিকার থেকে অনেক বেশি চলতো। সে সময় তার পত্রিকার বিক্রয় ছিল সর্বাধিক। আমার এই আত্তীয় সাংবাদিক পরে ১৯৯৮ সালে যশোর শহরে আততায়ীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন।

এভাবে পিআইডি সংবাদ কক্ষের কাজে কর্মকর্তাদের অনেক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি ও ঝুকির মধ্যে কাজ করতে হয়। আমার সংবাদ কক্ষে দুই মেয়াদে কাজের সময় আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। সেসব ঘটনাবলী একদিকে যেমন আমার শান্তি নষ্ট করেছিল তেমনি আবার অনেক ক্ষেত্রে সুনামও বয়ে এনেছিল। পরবর্তিতে সেসব বিষয়ে আবারও লেখার ইচ্ছা রইলো।

2 মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন