ফ্লোরিডা থেকে:-
সেই দিনগুলোতে ইন্টারনেট , সেলফোন কিছু ছিলোনা।
চিঠি আসতে মাস মাস লাগতো। কোন প্রশ্ন করে চিঠি পাঠালে উত্তর পাওয়া যেত দুমাস পরে। মায়ের , বাবার মৃত্যু সংবাদ গুলো এলো তারা চলে যাবার কত পরে । অর্থাৎ আমি যখন জানতাম তারা আছেন , তারা আসলে ছিলেন না ।
আমি যখন জানতাম সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র আছে , তখন তা ছিলনা , ছিল মিথ্যার উপরে ভিত্তি করা একটি কৃত্রিম সমাজ, যেখানে সাময়িক ভাবে জবরদস্তির মাধ্যমে কিছু মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল অন্য কিছু মৌলিক অধিকার খর্ব করার বিনিময়ে। জবরদস্তির পনীর বেশী দিন খাওয়ানো যায়না ।
তাই ওরা যখন বলে ওই দেশটা গর্বাচভ ভেঙেছে , ওরা আসল সত্যটি বোঝেনি , ওরা আবারও গোজামিল দিয়ে বোঝানের চেষ্টা করে। গর্বাচভ কারণ নয় , গর্বাচভ রেজাল্ট।
ওই দেশটা ভেঙে গেছে কারণ কিছু মানুষকে কিছুদিনের জন্য বোকা বানানো যায়, সব মানুষকে সবদিনের জন্য বোকা বানানো যায় না। ওরা নিজেরাই এই কথাটিকে হাজার লক্ষ বার বলে কিন্তু কি বলে ওরা নিজেরাই তা বোঝেনা।
তাই ওরা সহজ পথটা বেছে নিয়ে আমাকে গালি দেয়।
তার মানে কি ক্যাপিটালিজম ভালো? আমি তা কোথায় বলেছি? কম করে হলেও চারশ বছর আমরা ক্যাপিটালিজমে বাস করে জানি এই দানবের নাম ধাম চেহারা চরিত্র কি? কিন্তু ইনিয়ে বিনিয়ে ওরা গোজামিল দিয়ে বোঝাতে চায় যে আমি ক্যাপিটালিজমের গুনগান গাইছি। যেন ক্যাপিটালিজম আমার গুনগান না হলে আজই ইডিপাসের স্ফীংসের মত ঝাপ দিয়ে পড়ে মরে যাবে।
ওরা এত বড় পন্ডিত যে ক্যাপিটালিজমের জীবন চাবি কাঠিটি কোন সমুদ্রের নীচে কোন দৈত্যের পেটে আছে তা না বুঝেই বড় বড় থিওরি কপচিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ।
ওরা জানে খালি প্যাঁচাতে , সফিস্টদের মত কথা বলতে , আর ভাঙতে । ভাঙতে, ভাঙতে, ভাঙতে। ওরা পার্টি ভাঙে, বন্ধুত্ব ভাঙে এমন কি যা ভাঙা উচিত নয়, আমাদের সংস্কৃতির ধারক বাহক উদীচী অবাচী গুলোও ভাঙে। ভাঙ্গনে ওদের তুলনায় কেউ এত পারঙ্গম নয় , এমনকি ভাঙ্গনের সর্দার বৃটিশরাও নয়।
পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেল বিদেশ বিদেশে। ওভিদকে দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি, আমার কোন বাঁধা নেই।
আমিই আমার জেলখানা, শিকল, তালা আর চাবি।
আস্তে আস্তে আমার শহর আমাকে ভুলে গেল , আমিও সবাইকে ভুলে গেলাম। যে জামাল, বুলবুল, মোস্তফা মানিকের পবিত্র ছায়া আমার শরীর ঘেষে হেঁটেছে রোমের সাহসী বালক মুসিয়াসের মত, আমারই সত্তার বহু ব্যাপী রেজোন্যান্স হয়ে বাংলার আকাশ বাতাস মাটিও জল হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইল আমি ওদের চেহারা গুলো আর মনে করতে পারলামনা। আমার সহস্র শতাব্দীর বয়সী যে মাতৃবতা শীতলক্ষ্যার জল ছিল স্বচ্ছ তা ঘোলাটে হয়ে গেল ক্যাটারাকট আক্রান্ত দৃষ্টির মত। তার জলে মহাকালের দুর্গন্ধগুলো জেকে বসলো অভিশপ্ত ডাইনীর মত । আমার যে বন্ধুর সুন্দর , বুদ্ধি দীপ্ত একটি ছেলে আমার সেই বয়সেরই প্রতিবিম্ব ও নিষ্পাপ, সেই তাকে জল্লাদেরা নিয়ে গেল দু:সময়ের কসাইখানায় এবং খুনীরা হেঁটে বেড়াতে লাগলো দৃপ্ত স্বাধীনতায়। আর আমার শহর নিস্পৃহ দাঁড়িয়ে রইল তার ইমারত গুলো নিয়ে, তার যানবাহন , হর্ণ, হিংস্রতা, বেশ্যাখানা, পল্যুশন, ক্রয় ,বিক্রয়, ধর্ম ও বিবেক নিয়ে।
ভেঙে পড়লনা , আর্মেনিয়ার স্পিতাকের ( ডিসেম্বর ৭,১৯৮৮ সাল) মত হিংস্র ভূমিকম্পের তীব্রতায়।
তারপর হঠাৎ করে বিশাল পৃথিবীতে একদিন আমার নদীর সাথে দেখা হল ।
আশ্চর্য্য এত সুন্দর ও মানুষ থাকে দীর্ঘ দাহন শেষে?
আশ্চর্য্য এত সুন্দর ও দেখায় পরিপক্ক ধানের ক্ষেত?
এবং সে আমাকে ভালোবাসার কথা মনে করাতে যেয়ে মনে করিয়ে দিল আকবর বাদশার কথা।
আমি ঢাকা থাকতেই নাকি সে ওকে অনেক বিরক্ত করতো। ওকে এবং ওর বাবা মাকে ,যারা আমাকে খুব স্নেহ করতো ,বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে আমি মদ ,গাঁজা , ড্রাগ নিয়ে শ্মশ্মানে পড়ে থাকি । পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে একজন ফুলটাইম বাউন্ডেলে হয়ে গেছি, আমাকে দেখে নাকি আর চেনাই যায়না।
আমার জন্য এ ছিল এক ভীষন কৌতুহল উদ্রেক কারী তথ্য। একদিন সে নাকি আমার হোস্টেলের সেই ছাত্র নেতা ও তার পিস্তল নিয়ে যেয়ে হানা দিয়েছিল ওর বাসায় এবং বলেছিল আমি বেইমান এবং সে আমাকে সেই পিস্তল দিয়ে হত্যা করবে ।
আমি প্রশ্ন করেছিলাম , “আমি দেশে ছিলাম, তুমি আমাকে এসব কথা জানাওনি কেন?”
সে বলেছিল , দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে আমি তার সাথে যোগাযোগ রাখিনি। তাদের পক্ষে সত্য মিথ্যা জানা সম্ভব ছিলনা। তারা জানতো যে আকবর বাদশা আমার ঘনিষ্ট বন্ধু এবং তাকে বিশ্বাস না করার কোন প্রয়োজন ছিলোনা।
আমি প্রশ্ন করেছিলাম ,” ওটা ছিল তো ডাহা মিথ্যে কথা, ওর এসব করার কারণ কি ?”
ও বলেছিল ,যে আকবর বাদশা তার কাছে প্রেম নিবেদন করেছিল কিন্তু সে তাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল যে সে আমাকেই ভালোবাসে ।
আকবর বাদশা বলেছিল ,”আমি তাকে কোনদিন ভালোবাসিনি, আমি একজন স্বার্থপর, এর বেশী কিছু নই।”
ওর বাবা মা খুব কষ্ট পেয়েছিল “এত মেধাবী ছেলেটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেছে বলে”,কিন্তু তাকে সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করেছে মদ গাঁজা খাওয়া আমার সাথে ।
আমি প্রশ্ন করেছিলাম ,”তুমি ওকে বললে আমাকে ভালোবাসতে ,অথচ ৫ বছরে একবারও আমাকে তা বলোনি কেন? “
“কেনই আমি থাকতে তুমি ওকে বিশ্বাস করলে? “
“আমাকে খুঁজে পাওয়া তো মোটেই অসম্ভব ছিলোনা, আমার বাড়ীর লোকজনকে তুমি চিনতে।”
আমি অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলেছিলাম এক নি:শ্বাসে ।
হয়তো উচিত হয়নি। সুন্দর যারা,বেশী প্রশ্নে তারা থতমত খেয়ে চিন্তার সূত্র হারিয়ে ফেলে এবং এমন সব উত্তর দিয়ে ফেলে যার কোন অর্থ হয়না।
সে কি যেন উত্তর দিয়েছিল। সত্য মিথ্যার ব্যপার নয় ,এত দীর্ঘদিন পরে, বয়স ও অভিজ্ঞতার আলোকে আমার উত্তরটি অযৌক্তিক মনে হয়েছিল। সম্ভবত সে কারণেই আমার স্মৃতি তাকে সাপ্রেস করে ফেলেছে। আরও সারপ্রাইজ ছিল যখন জানতে পারি যে আমার ঘনিষ্ট আরো দুজন বন্ধুও নাকি তাকে ভালোবেসে ছিল। আমার সবকিছুই সাধারণ মানুষের চেয়ে উল্টা। এই কথা শুনে হঠাৎ আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিল, আমি যার প্রেমে এত উন্মন ছিলাম, আমার প্রিয় বন্ধুরাও তাকে ভালোবাসতো ! তার মানে , সে ভালোবাসা পাবার মতই একজন অপ্সরী । তারমানে আমার প্রেম বৃথা নয়, এবং আমি ততটা বোকা ছিলামনা যতটা আমার সারা জীবন মনে হয়েছে!
আমরা সবাই মিলে দূরের সেই দিনগুলোতে যাকে ভালোবেসেছিলাম সবার অজ্ঞাতে কোন এক রাজপুত্র ককেশিয়ার বাজপাখী যেমন অনেক উঁচু থেকে সা করে নীচে এসে ছো মেরে তার শিকার ধরে নিয়ে যায় পাহাড়ের চুড়ায় , ঠিক তেমনি নিয়ে গিয়েছিল তাকে। অথচ তৈমুরের সুতীক্ষ্ণ খন্জর হয়ে বুকে বিঁধে যা , তা হল সে কোনদিন সুখী হয়নি । আমি আপাদ মস্তক সুখী ও বিক্রীত একজন মানুষ ! অথচ সে সারা জীবন আমাকে ভালোবেসেছে, আমাকেই, যে তাকে ঘিরে ছিল যৌবনের প্রতিটা দিন, তারপর একদিন হঠাৎ নিঁখোজ হয়ে যেয়ে বুঝতে দিয়েছিল তার অনুপস্থিতির শূন্যতার গভীরতা …..
৩৫ বছর বড় দীর্ঘ সময় , পৃথিবীর নয়, একটি অতৃপ্ত ভালোবাসার বয়সের মাপে।
আকবর বাদশার রোগের প্রকোপ বেড়ে গিয়েছিল। প্রায়ই ঘোরের মধ্যে থাকতো। অনেক সময় কারো সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও যেন চিনতে পারতোনা। পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের বাসায় গেলে বা সুযোগ পেলেই জিনিসপত্র খোয়া যেত। ঘড়ি , হারমোনিয়াম , জামা কাপড় কোন কিছুতেই ওর অরুচি ছিলোনা। যার কারনে প্রায় সবাই আস্তে আস্তে ওর সাহচর্য এড়াতে শুরু করে। ও প্রায়শই নিজের কক্ষে ১-২ দিনের জন্য দরজা বন্ধ করে ঘুমাতো। তারপর দরজা খুলে বের হতো যখন ইচ্ছে হতো। ওর মা তখনও জীবিত ছিল কিন্তু ওর অত্যাচারে এত বেশী ভয় পেত যে যতদূর সম্ভব নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে চলতো । চেষ্টা করতো ওর ঘুমে ডিস্টার্ব না করতে, না জাগাতে।
এমনি একবার সে ঘুমিয়ে পড়ে দরজা জানালা বন্ধ করে ।
তার কক্ষে শেলফ গুলো ভরা ছিল অমূল্য সব বই। মানব সভ্যতা ও মানব জাতির জ্ঞানের আলোর মশাল ওই বইগুলোতে ধুলো জমে গিয়েছিল কয়েকস্তর। দীর্ঘদিন সেই বই গুলো কেউ স্পর্শ করেনি , কিছু বই যদিও সে বিক্রি করে দিয়েছে টাকার প্রয়োজনে কিন্তু বই কেনার মানুষ তখন কম ছিল।
তিনদিন পরে ওর ঘরের থেকে দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসতে থাকলে লোকজন ডেকে দরজা ভাঙা হয় । তার দেহ ততদিনে গলতে পচতে শুরু করেছে ।
ওর বয়েস ছিল মাত্র ছাব্বিশ।
আকবর বাদশা, “দীন ই ইলাহী ” যদিও তুমি প্রচার করনি, “দীন ই ইলাহী ” কিন্তু আর কিছুই নয়, মানুষকে ভালোবাসার এক মহাকাব্যিক গল্প , যে গল্পের সমুদ্রের সমান বিশাল দিঘিটি সভ্য অসভ্যতার ড্রেজার মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে । সে আর শ্বাস নিতে পারছেনা। তার কষ্ট হচ্ছে।
তুমি , আমি এবং আরও কত মানুষ এই পৃথিবীতে মানুষের কল্যানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছি , অথচ…..
আমি কাঁদছি।
হেলসিংকি থেকে সেইন্ট পিটার্সবাগের পথে
সেপ্টেম্বর ১৭,২০১৬
রাত ১১:৪৫