অভিবাসনের রোলার কোস্টার রাইডএ কম বেশি আমরা অনেকেই হয়তো চড়েছি। প্রতীকী অর্থে এতে চড়ার অভিজ্ঞতা একেক জনের এক এক রখম। কেউ কেউ অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মোটামুটি একটা লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। ভাগ্যবান অল্প কজন আছেন যাদের হয়তো কোনো প্রতিবন্দকতারই মুখোমুখি হতে হয়নি। আবার অনেকেই আছেন লক্ষ্য অর্জনের রাস্তায় যারা এখনো হেটে চলেছেন অবিরাম। বিচিত্র অনেক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় এই সময়ে। এমনি কিছু অম্ল মধুর অভিজ্ঞতা নিয়ে আজকের লেখা।
ড্রাইভিং: সবে তখন কানাডা এসেছি। দুই রুমের ছোট এক বাসায় ভাড়া থাকি। গাড়ি নেই, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও নেই। চাল, ডাল, পিয়াজ বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য শপিং কার্ট ঠেলে ঠেলে নিকটস্থ শপিং মলে যাই। প্রচন্ড শীত এবং রাস্তা ও সাইড ওয়াকের উপর প্রায় চার পাঁচ ইঞ্চি তুষার পড়া অবস্থায় শপিং কার্ট ঠেলতে দেখে হেসে একবার একজন মন্তব্য করলেন, “Man, you need winter tire for your shopping cart”। উইন্টার টায়ার এর মাজেজা তখনও বুঝে উঠতে পারিনি। তুষারে আবৃত সাইড ওয়াক দিয়ে শপিং কার্ট নিয়ে কয়েকদিন বাজার করার পর বুঝলাম গাড়ি কেনা এবং চালানোর কোনো বিকল্প নেই। এবার ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর খুঁজা শুরু। তখন যে এলাকায় থাকি সেখানে শ্রীলংকান এক মহিলা গাড়ি চালনা শিখাতেন। সিদ্ধান্ত নিলাম তার কাছেই প্রশিক্ষণ শুরু করবো। প্রথম দিনের প্রথম লেসনের পরে উনার ব্যবহার এবং ধমকি ধামকিতে যা বুঝলাম তাতে মনে হলো গাড়ি চালনা মহাকাশ বিজ্ঞানের মতোই কঠিন একটি বিষয় এবং সবার পক্ষে তা আয়ত্ত করাও সম্ভব নয়। মন খারাপ করে বাড়ি ফেরার পথে একজন পরামর্শ দিলেন টরোন্টোর বাংলাদেশী অধ্যুষিত ডেনফোর্থে যেয়ে শিখতে। ডেনফোর্তে যার কাছে প্রশিক্ষণ শুরু করি তিনি একজন বাংলাদেশি, অমায়িক একজন মানুষ। কিন্তু ভদ্র লোকের সমস্যা হলো উনি গাড়ি স্টার্ট করার সাথে সাথেই আমাদের ফোক গানের শিল্পী মমতাজের “আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেলো রে মরার কোকিলে” গান চালিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। আমি ভয়ে ভয়ে গাড়ি চালাই আর ভাবি মরার কোকিল দিয়ে যদি দিনের শুরু হয় তাহলে এই দিনের শেষ হবে কি দিয়ে। মরার ড্রাইভার দিয়ে ?
“ভাই, সামনের গাড়ির লাইসেন্স প্লেটে নয়, আরো দূরে তাকান। যেদিকে তাকাবেন, গাড়ি সেই দিকেই যাবে।” সম্বিৎ ফিরে আসে তার ডাকে। শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাই। তিন লেসন নেয়ার পর উপলব্দি করলাম উনার কাছে আমার প্রশিক্ষণ অনন্ত কাল ধরে চলবে। এ যেন অনেকটা ‘পরীক্ষা পাশ নয়, জ্ঞান অর্জনই বড় কথা’। জি ২ এর প্রথম রোড টেস্টে ফেল করলাম ছোট ছোট অনেক ভুলের কারণে। আত্ম বিশ্বাসে কিছুটা ঘাটতি দেখা দেয়া শুরু হলো। ঠিক এই সময়টাতেই পরিচয় হলো ডেনফোর্তের আর এক প্রশিক্ষক পাপন ভাইয়ের সাথে। বাড়ি এবং জন্ম কোনোটাই সিলেটে নয়, অথচ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষ পেলে নিখুঁত, খাস সিলেটিতে কথা বলতে পারেন অনর্গল। প্রথম লেসনেই উনি চিহ্নিত করে দিলেন আমার দুর্বলতার জায়গাগুলো। পরবর্তী দুই লেসনে তা কাটিয়ে উঠার উপর জোর দিলেন, অভয় দিলেন যে এটি স্রেফ অনুশীলনের ব্যাপার। অথচ এর আগের কোনো প্রশিক্ষকই সমস্যা চিহ্নিতকরণের প্রতি জোর দেননি। বলাবাহুল্য, জি ২ লাইসেন্স পেতে আর বেগ পেতে হয়নি। পরবর্তীতে আমার এবং আমার স্ত্রীর জি লাইসেন্স পেতেও পাপন ভাইয়ের ভূমিকা ছিল তুলনাহীন। গাড়ি চালনা প্রশিক্ষণে অসাধারণ দক্ষ, গুণী এই মানুষটির কাছে আমরা দুজনেই কৃতজ্ঞ। পাপন ভাই, আপনার জন্য অনেক, অনেক শুভ কামনা।
হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ টুডে : তখন আমরা রোলার কোষ্টার রাইড এর দ্বিতীয় ধাপে। অর্থাৎ চমকিত হওয়া শেষ, কঠিন বাস্তবতার শুরু। চাকরি খুঁজছি। সঠিক পেশাগত কর্মসংস্থানের প্রক্রিয়া, কৌশল নিয়ে সাধারণ পরামর্শ দেবার মতো ও কেউ নেই। নিজে থেকে খুঁজে বের করলাম এক কল সেন্টার। এক মোবাইল ফোন কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিসে লোক নিবে। ইন্টারভিউ এবং রেফারেন্স চেক শেষে চাকরি হয়ে গেলো। এক সপ্তাহের ট্রেনিং শেষে মূল কাজ শুরু। কাস্টমাররা হাজারো সমস্যা নিয়ে ফোন করবে, আর আমাদের কাজ ধৈর্য সহকারে শুনে তা সমাধান করা, সাথে সাথে নতুন প্ল্যান অথবা এড অন সার্ভিস গুলো বিক্রি করা। অনেকটা যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্রন্ট লাইন সৈনিকদের মতো। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ভুল ভ্রান্তির খেসারত, কাস্টমারদের ক্ষোভের ঝড় ঝাপটা সব আমাদের উপর দিয়ে যায়। ধৈর্য এবং বিনয়ের অবতার না হতে পারলে এই কাজ বেশি দিন করা যায়না। আমি জানি অনেকেই এই কাজটি যথেষ্ট দক্ষতা এবং সুনামের সাথে করে যাচ্ছেন, কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে স্নায়ুচাপ বৃদ্ধিকারী সবচেয়ে কঠিন কাজগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে কল সেন্টারের কাজ। প্রয়োজন এবং প্রকৃতি বিচিত্র নিয়মে মানুষকে তার পরিবেশের উপযোগী করে গড়ে তুলে। বৈরী সময় হার মানে মানুষের কাছে। মন না মানলেও আমি এই কাজটি করে গেছি প্রায় এক বছর। হটাৎ একদিন শিফট শেষ হবার দু ঘন্টা আগেই সবার ডাক পড়লো কনফারেন্স রুমে। বিষয় কি ? দেখলাম সবার হাতে একটি করে চিঠি ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। না, এটি পদোন্নতি বা বেতন বাড়ার চিঠি নয় । প্রজেক্ট শেষ, সবাইকে লে অফ করা হচ্ছে। দুদিন পর থেকে কারো চাকুরী নেই। নিতান্তই মন খারাপ করা সংবাদ। কিন্তু মজার বিষয় হলো আমি মনের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভূব করছি। টিম হর্টন থেকে এক কাপ ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা নিয়ে নিকটস্থ সাবওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে ধীর পায়ে হাটতে হাটতে ভাবি, কাল থেকে আমাকে আর ফোন উঠিয়ে বলতে হবে না, “——কাস্টমার সার্ভিস, হাসান স্পিকিং, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ টুডে?” চাকরি হারানো যে এতো আনন্দময় অনুভূতির বিষয় হতে পারে তা জীবনে এই প্রথম উপলদ্দি করি।
মানুষ যত বিপত্তি ও প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়, বৃহত্তর অর্থে তার সমৃদ্ধির রাস্তা সম্ভবত ততটাই প্রশস্ত হতে থাকে। আমার মায়ের ভাষায়, ‘যত মুশকিল, ততো আসান’। কল সেন্টারের কাজের পর নিজের আখাংখিত পেশায় ফিরে আসার প্রয়াস আরো বেশি প্রবল হয়ে উঠে। সব মনোযোগ, উদ্যম এবং চেষ্টা কেন্দ্রীভূত হয় এক জায়গায়। কৃতজ্ঞচিত্তে বলতে পারি, আল্লাহ্পাক নিরাশ করেননি।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে