১৯৫০-১৯৬০র দিকে পল্লী গ্রামে পড়াশুনার তেমন কোনো পরিবেশ ছিল না।  প্রতি  ৪-৫টা গ্রাম মিলে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল এবং গুরু ট্রেনিং প্রাপ্ত   শিক্ষক  যাদের পড়াশুনা ৪-৫ ক্লাসের বেশি নয়, ওদের দিয়ে পড়ানো  হতো, তবে ওরা নিবেদিত শিক্ষক এবং মনোযোগ দিয়ে শিক্ষা দিতো।  সন্ধ্যা হলেই গ্রামে ভুতুরে অন্ধকার নেমে আসতো,কেরোসিনের চেরাগ সবাই ব্যবহার করতো।  অনেকের ঘরেই  হারিকেন  ছিল না,চেরাগ বা মাটির কফি ব্যবহার করতো ; বাহিরে গেলে ডুলার মধ্যে চেরাগ বা কফি ঢুকিয়ে বাহিরে বাতাসের  হাত থেকে রক্ষা করতো । রাতে ঘর থেকে বের হয়ে দূরে কোথায় ও যাবেন জোনাকি পোকার আলোতে পথ দেখে যেতে হতো।হাতে একটা লাঠি অবশ্যই থাকতো   -কোথায় বেয়াদব সাপ  শুয়ে আছে , অল্প অল্প আলোতে দেখা যায় সাপ  চলে যাচ্ছে।বর্ষার অতি বৃষ্টির ফলে মাঠ ঘাট,ঝোপ জঙ্গল থেকে  শুরু করে বাড়ির উঠান এবং ঘরের মেঝেতে পানি উঠে যেত ,এ অবস্থায় সাপ  উঁচু জায়গা খুঁজে না পেয়ে মানুষের ঘরে এমন কি বিছানায় পর্যন্ত উঠে। আমার এক আন্টিকে রাতে ঘুমে বিছানায় সাপে ধ্বংসন করেছিল, বহু ওজা দিয়ে সাপের বিষ নামানোর চেষ্টা করে ও ব্যর্থ হয়ে  মারা যায়।  এই ঘটনা গ্রাম বাংলার সর্বত্রই দেখা যায়, বিশেষ করে রাতে চলাফেরা করতে অধিক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। বর্ষা শুরু হলে গুরুতর সমস্যা দেখা দিতো, এই বাড়ি থেকে সেই বাড়ি যাবেন তো নৌকা,তালের কোন্দা,এমন কি কলাগাছের তৈরী ভেলা ও ব্যবহার করা হতো।  প্রতিটি বাড়ি ছোট ছোট খালের দ্বারা বিচ্ছিন্ন, সরু বাঁশের সাকুর উপর দিয়ে খাল পার হওয়া সে ও ভালো প্রশিক্ষণ না থাকলে নিচে পড়ে  যেতে পারেন। বৃষ্টি শুরু হলে সে তো আর এক সমস্যা -বৃষ্টির থামাথামি নেই- কয়েক সপ্তাহ এবং মাস বৃষ্টি, তালপাতার পাতলা নিয়ে ঘরের বের হতে হতো। 

এর মধ্যে দেখা গেলো বলা নেই, কহা নেই, বেয়াই বেয়াইন এক নৌকা লোক নিয়ে  অনাহূতের মতো   এসে হাজির।নিজেদের দাঁড়ানোর ব্যবস্থা নেই – আবার মেহমান ! বৃষ্টির দিনে মা- চাচিদের  বিপদ, ভিজে ভিজে এই ঘর থেকে সেই ঘর, রান্না তো করতেই হবে। ঘরে মুরগি , চাল,ডাল,নারিকেল যা আছে, আবার পিঠা না বানালে কিভাবে চলে ?  কিছু দরকার থাকলে এ ঘর, সে ঘর থেকে এনে জোড়াতালি দিয়ে মেহমানদারী করা হতো ।  

সে যুগের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে অনেক অনেক পার্থক্য; গ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির  সঙ্গে  বিদ্যুৎ, টেলিভশন,  স্কুল কলেজ, হাতে হাতে মোবাইল ,মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরে আপনজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় – দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আস্তে আস্তে শুরু হয়ে-আজ এ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। সেদিন বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের  এক মহিলার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হচ্ছিলো;বলে ভাই -আপনার চেহেরাতো দেখি না। ১৯৮৬-৮৭, সুদূর আমেরিকাকে  থেকে চিঠি দিলে দুই মাস পরে উত্তর পাওয়া যেত -আজকাল মুহূর্তের মধ্যে কথা বলা  যায় এবং কথার সঙ্গে হান্ডিপাতিল নাড়াচাড়ার আওয়াজ ও শুনা যায় -আবার চেহেরা ..! ভাবতে অবাক লাগে।  

তবে এখনও গ্রামের মানুষের মন মানসিকতা  তেমন পরিবর্তন হয় নি।  লোকে  বলে  গ্রাম বাংলার মানুষ অতিশয় সহজ সরল,কারো  দুঃখে দুঃখী,সুখে সুখী, এবং সবাই  মিলেমিশে এক সাথে বাস করে। গ্রামের মানুষ পরিশ্রম করে ফসল ফলায়- শহরে মানুষ খেয়ে বেঁচে আছে।  গ্রামের কুম্ভকার মাটির পাতিল,খেলনা জাতীয় জিনিস,  যা শহরে এবং দেশে বিদেশে  অনেকের শোকেসে শোভা পায়।  তবে গ্রামের মানুষ দুধে ধোওয়া বা তুলসী পাতায় জলে ধোওয়া, তা বলছি না।  আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে  বলি গ্রাম বাংলার  মানুষ  যে গন্ডির মধ্যে বাস করে সেখানে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি, দলীয় কোন্দল,কেউ একটু ভালো করলো বা মন্দ করলো অমনি  আলোচনা এবং সমালোচনায় মেতে উঠে ।

১৯৫০-১৯৬০র বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন ।  সে যুগে মানুষ ছনের,মাটির বা টিনের ঘরে বাস করতো।  নিজেদের বাপদাদার জমিজমার উপর নির্ভর করতো , যার যত বেশি জমি জমা, তার সে হারে বেশি পদমর্যাদা ।সন্ধ্যা হলে  বাতি নিবিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো  । গ্রামের মোড়ল,প্রধানিয়া শ্রেণীর লোক যারা গ্রামের শালিসী, দরবার করতো ,ওরা গ্রামে ধনী প্রতাপশালী লোক ছিল,লোকজন তাদের মান্য  করতো । তবে গ্রামে জমিজমা নিয়ে  জোর দখল, মারামারি,একজনের ভিটেমাটির উপর দিয়ে অন্যদের হাঁটাচলা করতে দেয় নি, এমন কি মানুষ মারা গিয়েছে, লাশ কবরে নিয়ে যাবে, ওতে ও বাধা দিয়েছে- এ জাতীয় ঘটনা ঘটেছে  ।     সে যুগে বর্ষায় নৌকা ব্যতীত চলাচল করা যেত না।  জমিতে দুই ফসল ধান (আউস ও আমন ) ফলানো হতো। অগ্রহায়ণ -পৌষ মাসে ধান কাটার পর রবি শস্য- তিল,তিসি,সরিষা, আলু ,পিয়াজ ও রসুন ফলানো হতো। আমাদের মতো ছেলেরা সুদিনে ঘুড়ি উড়ানো,কাবাডি (হাডুডু ) ফুটবল খেলতো ।  মা-চাচিদের কাজ, ধান মাড়ানো, ধান সিদ্ধ , শীতের পিঠা বানানো,এ সব কাজের জন্য ঢেকি ব্যবহার করা হতো।  আজকাল এর  অনেক পরিবর্তন হয়েছে, ঢেকির পরিবর্তে মেশিন ব্যবহার করা হয়।  

প্রতিবেশী ভারত আন্তর্জাতিক নদীর  গতি রোধ করে নিজেদের দেশে পানি সরবরাহ করে কৃষির উন্নতি করতে গিয়ে  বাংলাদেশে নদীগুলি শুকিয়ে ফেলেছে  । গোমতী নদী প্রতি বৎসর পাহাড়ি ঢলে পাড় ভেঙে বন্যা হতো, আজকাল পানি হয় না, প্রতিবেশী ভারত নদীর গতি ডাইভার্ট করে পানি নিজেদের কাজে ব্যবহার করে।  ১৯৭৬ সনে মাওলানা  আব্দুল হামিদ খান ভাসানী “লং মার্চ – ফারাক্কা” এক প্রতিবাদ মিছিল করেছিলেন।  

গ্রামের  সিদা  সরল লোক যাদের পদে পদে বিপদ,তাদের সবাই ঠকায় -এই যেমন  আমাকে সবাই ঠকায় ।  ভাবখানা এরূপ যে আমি এনায়েতপুর গ্রামের কেউ না, এ দেশে আমার কোনো অধিকার নেই। আমাদের গ্রাম বাংলায় কিছু কিছু ব্যতিক্রম আমি মনে করেছি :

১ ) ১৯৫০-১৯৬০র দিকে  গ্রামে বিয়েশাদি হলে ৫০ জন দাওয়াত দিলে ১০০ জন গিয়ে উপস্থিত হতো । খাওয়াদাওয়া একটু এ দিক সেদিক হলে সমালোচনা শুরু, কেউ মনে করে না আয়োজক তার  সাধ্যানুযায়ী খাওয়াদাওয়া তৈরি করেছে। 

২ ) কোনো বিবাদ বেঁধে গেলে পুরা গ্রামের মানুষ দুই দলে  বিভক্ত হয়ে ঝগড়া থেকে লড়াই- যা মীমাংসা করা কঠিন। ২০ -২৫  বৎসর হবে একটা বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনায় আমি উপস্থিত ছিলাম, ১০০ থেকে ১৫০ লোক ছেলে পক্ষ  হাজির করেছে এবং সে অনুপাতে মেয়েপক্ষ ও লোক উপস্থিত করে সারা গ্রামে একটা ভীতির সৃষ্টি করেছে, যা ছিল অনাকাঙ্খিত ।  

৩ ) প্রায় ৪০ -৪৫  বৎসর পূর্বেকার একটি ঘটনা : একটা মেয়ে ঘটিত ব্যাপারে কয়েক গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তি মীমাংসা করতে না পেরে কচুয়া থানা কতৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করে কোনোরকমে মিমাংসা করে।  সে বৎসর আমাদের গ্রামে ঈদগায় দুই পক্ষের লড়াইয়ের জন্য  কোনো ঈদের নামাজ পড়া হয় নি।  

৪ )   এ ছাড়া জমি সংক্রান্ত সমস্যা তো বিরাট সমস্যা : যেমন লাঙ্গল  দিয়ে জমির আইল উঠিয়ে দেয়া, বাড়িতে এক পরিবার অন্য্ পরিবারকে পুকুরে যাইতে না দেয়া।  একজনের গাছের ফল অন্য্ জন জোর করে নিয়ে যাওয়া। আমিন ডেকে সারা বৎসর বাড়ি মাফামফি করা,মারামারি কাটাকাটি থেকে সত্যমিথ্যা জড়িয়ে আইন আদালত – হরহামেশাই  লেগে থাকতো। আমি একটা এ জাতীয় মোকদ্দমা ঘরোয়া ভাবে মীমাংসা করে দিয়েছিলাম – এই মামলায়  দিনের বেলা লোকসমোক্ষে মহিলা ধর্ষণ  পর্যন্ত দেখানো হয়েছিল। 

৫ ) এইতো সেদিন শুনলাম:   জরিফে একজনের জমি অন্যের নামে উঠিয়ে দিয়ে  ঝগড়া, মারামারি এবং আইন আদালত, এখন পর্যন্ত চলছে।  

৬   ) আজকাল গ্রামে স্থানে স্থানে  চায়ের  দোকান হয়েছে, ছেলে-বুড়োদের  জটলা, সবাই রাজনীতিবিদ,  আপনি সরল মানুষ,সাবধান ঝামেলায় জড়াতে পারেন।  

৭  ) অনেক দিন আগের কথা, ফতেপুর আড়ং বাজারে চায়ের দোকানে বসেছি।  আমাকে কয়েকজন বলে চাচা  চলেন – কোথায় যাবো ? ওই সামনের বাড়িতে একটা মজার দরবার আছে -আচ্ছা চলো।  মহিলা এবং তার মেয়ে ঘর থেকে বের হতে পারে না বখাটে ছেলেদের যন্ত্রনায় -মহিলার দোষ  ছেলেদের ঝাড়ু নিয়ে তাড়া  করেছে।   মহিলা এতগুলি লোক দেখে ভয়ে  কান্নাকাটি শুরু করেছে -সে যাইহোক, আমি অবস্থা উপলব্দি করলাম,ছেলেপেলেদের শাসিয়ে দিয়ে চলে আসলাম।  

৮  ) সে যুগে প্রতিটি গ্রামে একটি মসজিদ ছিল এবং মুখে আজান দিয়ে  মুসল্লিদের ডেকে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা হতো , আজকাল বাড়ি বাড়ি  মসজিদ হয়েছে, এক বাড়ির মুসল্লি অন্য্ বাড়ির মসজিদে যায় না  এবং একত্রে মাইকে  আজান দিয়ে শোরগোলের সৃষ্টি করে। বৃদ্ধ,অন্যধর্মালম্বী,  বা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভোরে ঘুমায়-প্রতিটি মসজিদ থেকে একসময় আজান এবং মাইকে সবাই জোরে জোরে ওয়াজ করতে থাকে।  যদি এতগুলি মাইক একত্রে ব্যবহার না করে, একটি মসজিদে মাইক ব্যবহার করে,তাতে  কি কোনো অসুবিধা আছে ? আপনি উপদেশ দিতে যাবেন -নিজে বিপদ টেনে আনবেন।  

৯ )আজকাল গ্রামে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে।  তবে শিক্ষার সেই পরিবেশ ফিরে  আসে নি।  

দেশে আইন হয়তো আছে, তবে তার প্রয়োগ নেই, যে জন্য জনগণ নিরাপদে নেই।   

 আমাদের দেশে সে যুগে বা এ যুগে স্কুলে  কাউন্সেলিং ব্যবস্থা  ছিল না বা নাই ; এ সব দেশে(কানাডায়) প্রতিটি  স্কুলে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা  আছে, ওরা ক্লাসে ছেলেমেয়েদের সমস্যা বিশেষভাবে লক্ষ্য  করে এবং সময় সময় ছেলেমেয়ে এবং ওদের মাবাবাকে ডেকে পরামর্শ দিয়ে থাকে।  তাছাড়া মিনিসিপালিটির অধীনে প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডে কয়েকজন শিক্ষা ট্রাস্টি জনগণের  ভোটে নিয়োগ দিয়ে থাকে যারা  স্কুলে  টিচার এবং ছেলেমেয়েদের সমস্যাদি অবগত হয় ও সময়মতো ব্যবস্থা  নিয়ে থাকে।  আমাদের দেশগুলিতে এ ব্যবস্থা নাই বলে ছেলেমেয়েরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ।  তাছাড়া এ দেশে প্রতিটি কমিউনিটিতে ও কাউন্সেলিং ব্যবস্থা আছে। শিক্ষকদের পরামর্শ দেয়ার জন্য অভিবাবক থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হয় যারা প্রতিনিয়ত এ সব খেয়াল রাখে।    

আমাদের গ্রামবাংলার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনুরোধ রাখলাম : “কম খাবেন, আরামকে হারাম করবেন,  কোন কিছুতেই  অধর্য্য না হয়ে  সৎ চিন্তা ও অধিক পরিশ্রম করুন – আপনি ভালো থাকবেন।” 

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধমায়ের অকৃত্রিম স্নেহ
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন