কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য আমি সচরাচর ব্যবহার করি টরোন্টোর ‘পাবলিক ট্রানজিট’ বা গণপরিবহন। মূলত সাবওয়ে, স্ট্রিটকার আর বাস নিয়েই এই গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যাত্রীসেবার গুণগত সার্বিক মান বজায় রেখে ঘড়ি ধরেই চলছে টরোন্টোর পাবলিক ট্রানজিট সিস্টেম। গড়ে প্রতি কর্মদিবসে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন মানুষকে বহনকারী টরন্টো ট্রানজিট কর্পোরেশন মেক্সিকো সিটি এবং নিউইয়র্ক শহরের পরে উত্তর আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম পাবলিক ট্রানজিট সিস্টেম। নানা সংস্কৃতির বহুবিধ ভাষার মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যবহার করেন এই ট্রানজিট। একেকজন একেক মিশন নিয়ে ছুটে চলেছেন এক গন্তব্য থেকে আরেক গন্তব্যে। অবাক বিস্ময় নিয়ে আমি প্রতিদিন লক্ষ্য করি সাবওয়ে, স্ট্রিটকার এবং বাসে যাতায়াতকারী অনেক মানুষকে। পুলকিত হই ছুটে চলা এসব মানুষদের হটাৎ থেমে যাওয়া দেখে। একজন বৃদ্ধ মানুষ যখন একহাতে সাবওয়েতে নামার সিঁড়ি ধরে আরেক হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমশিম খান, সেই সময় স্যুটেড বুটেড হয়ে অফিসগামী আরেকজন বিনা বাক্য ব্যয়ে পরম মমতায় বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। নিজের কাঁধে বিশাল ব্যাগ বয়ে বেড়ালেও কাউকে কাউকে দেখি ছোট বাচ্চা সহ বাস থেকে স্ট্রলার নামানোর জন্য কোনো অপরিচিত যাত্রীকে সাহায্য করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই এগিয়ে আসেন। শুধু পাবলিক ট্রানজিটই নয়,আরো অনেক জায়গাতেই এরকম ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়গুলো লক্ষ্য করা যায়। মানুষের এই ছোট ছোট ‘Random act of Kindness’ বা ‘সহৃদয়তার আকস্মিক বহিঃপ্রকাশ’ আমি অসীম আগ্রহ নিয়ে দেখি। সম্ভব হলে নিজেও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার চেষ্টা করি। এই কাজগুলো আপাত দৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হলেও এর গুরুত্ম অনেক। কারণ এই কাজ করা নির্ভর করে ‘split second decision’ এর উপর। এখানে চিন্তা ভাবনা করা বা ভাবাভাবির কোনো অবকাশ নেই। তাৎক্ষণিক এই কাজের জন্য নেই বাহবা বা প্রতিদান পাওয়ারও কোনো সুযোগ। আমার কাছে এই কাজটি সহৃদয়তার নির্ভেজাল, উৎকৃষ্ট বহিঃপ্রকাশ।
Concept হিসেবে ‘Random act of kindness’ ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে ১৯৮২ সালে, Sausalito নামে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ছোট শহরের রেস্টুরেন্টে। সেই সময়ে সংবাদ মাধ্যমে বার বার সংবাদ শিরোনাম হিসেবে আসা ‘Random violence and senseless acts of cruelty‘ এর বিপরীত ধারণা হিসেবে Anne Herbert নামে এক ভদ্রমহিলা রেস্টুরেন্টের place mat বা টেবিল মেটের উপর লিখেন, “Practice random acts of kindness and senseless acts of beauty”। রেস্টুরেন্টের প্লেসমেটের উপর লেখা এই ছোট ধারণাটি একসময় ব্যাপক এক শ্লোগানে পরিণত হয়, মানুষ তাদের গাড়ির বাম্পার স্টিকারেও এই স্লোগান লাগাতে শুরু করে। কমসময়েই অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করে Random Act of Kindness এর ধারণা। ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় Anne Herbert এর বিখ্যাত বই, “Random Kindness and Senseless Acts of Beauty“। এই বইয়ের কারণে তৈরী হয় একধরণের চেইন রিঅ্যাকশন। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে আমেরিকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে অসংখ্য নিবন্দ্ব প্রকাশিত হয়, রেডিও স্টেশন এবং পরবর্তীতে টিভি চ্যানেলগুলোও সহৃদয়তা বিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচি সম্প্রচার শুরু করে। প্রতিষ্টিত হয় RAK বা Random Acts of Kindness Foundation। যুক্তরাষ্ট্র ও নিউজিলান্ডে যথাক্রমে নভেম্বর ও সেপ্টেম্বরে এখন National Random Acts of Kindness Day উদযাপিত হয়। মোটকথা রেস্টুরেন্টের টেবিল মেটের উপর লেখা দিয়ে যে ধারণার প্রচার শুরু হয়, তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন নামে।
Anne Herbert এর কল্যানে জনপ্রিয়তা লাভ করলেও এটি নুতন কোনো ধারণা নয়। অধিকাংশ ধর্মের অন্যতম মূল ভিত্তি হচ্ছে ‘Act of kindness’। কোনো ধর্মেই সৃষ্টিকে অবজ্ঞা করে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের চেষ্টাকে উৎসাহিত করা হয়নি। পবিত্র কোরআন এর বিভিন্ন সূরার অন্তত দুইশত আয়াতে সহৃদয়তার বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। সূরা মাউনে যেমন বলা হয়েছে, “হে নবী!) তুমি কি কখনো চিন্তা করেছ, কোন ধরনের লোকেরা কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করে ? এ ধরনের লোকেরা এতিমের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে, অভাবগ্রস্তকে অন্নদানে কোনো আগ্রহ বোধ করে না বা অন্যকেও উৎসাহিত করে না। আর দুর্ভোগ সেই নামাজীদের জন্যে, যারা সচেতনভাবেই নামাজে অমনোযোগী, শুধু লোক দেখানোর জন্যে নামাজে শামিল হয়। (দুর্ভোগ তাদের জন্যেও) যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় ছোটখাটো সাহায্য দানেও বিরত থাকে।” ( আয়াত ১-৭). রাসূলে পাক (সা) এর অন্যতম একটি বিশুদ্ধ হাদিস হচ্ছে, “Every act of kindness is a charity”। Random বা এলোপাথাড়ি, অপরিকল্পিতভাবে নয়, এই কাজটি সচেতনভাবে সব সময়ই করে যাওয়ার উৎসাহ দেয়া হয়েছে। শুধু ইসলামেই নয় অন্যান্য ধর্মেও সহৃদয়তার বিষয়টিতে কোনো ছাড় দেয়া হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাই লামার একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, “My religion is simple. My religion is kindness”। মহাভারতে বলা হয়েছে, “যে আচরণ তোমার নিজের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়, সেই আচরণ তুমি অন্য মানুষের সাথে করতে পারো না। এটাই নৈতিকথার সারবস্তু।“। খৃষ্ট ধর্মেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে, “Be kind to one another, tender-hearted, forgiving each other, just as God in Christ also has forgiven you.”। সব ধর্মেই যেখানে kindness এর এতো জয়গান, তাহলে সমস্যা কোথায় ? সমস্যা হলো আমরা ধর্মের অন্তর্নিহিত মূল ভিত্তিকে ভুলে শুধু আনুষ্টানিক অংশটুকু সম্পাদন করে নিজেদেরকে পরিপূর্ণ মনে করি। ফলে ঢাকা পড়ে যায় ধর্মের মূল আবেদন।
জনপ্রিয় অভিনেতা মরগ্যান ফ্রিম্যান অভিনীত “Evan Almighty” ছবিটি যারা দেখেছেন তারা হয়তো মনে রাখতে পারেন যে ‘God’ এর ভূমিকায় অভিনয় করা মরগ্যান ফ্রিম্যান ছবির মূল চরিত্র ‘Evan’ কে প্রশ্ন করেছিলেন, “How do we change the world ?” Evan Baxter এর উত্তর ছিল, “One single act of random kindness at a time.” সারা দুনিয়া হয়তো বদলে দেয়া সম্ভব না, কিন্তু এই Random Act of Kindness দিয়ে নিজেদেরকে এবং আমাদের আশেপাশের মানুষদেরকে বদলে দেয়া সম্ভব। জাগিয়ে তোলা সম্ভব নুতন দিনের আবির্ভাবের সম্ভাবনাকে। যে যার জায়গা থেকে সাধ্যমতো না হয় সেই চেষ্টাই করে যাই।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে,