উসমান সাম্রাজ্য ১২৯৯ সালের দিকে প্রথম ওসমান বা ওসমান গাজী নামে পরিচিত এক  ওঘুজ তুর্কি উপজাতীয় নেতা  উসমানীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । তিনি প্রথমে  বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের দক্ষিণে উত্তর-পশ্চিম এশিয়া মাইনরে উসমানীয়  আমিরাত প্রতিষ্ঠা করেন। সময়ের সাথে সাথে, অটোমানরা তাদের অঞ্চল প্রসারিত করে, ১৩২৬ সালে নিকটবর্তী বুরসা দখল করে এবং  ইউরোপে প্রবেশ করে।

উৎপত্তি সম্প্রসারণ:

তুর্কি সাম্রাজ্য নামে পরিচিত উসমানীয় সাম্রাজ্য এক সময়  দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল । এই সাম্রাজ্যটি বর্তমান হাঙ্গেরি, বলকান অঞ্চল, গ্রীস এবং ইউক্রেনের কিছু অংশ সহ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ অংশ ভিয়েনার দরজা পর্যন্ত ঘিরে রেখেছিল; এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশ,বর্তমান  ইরাক, সিরিয়া, ইসরায়েল ; উত্তর আফ্রিকা  পশ্চিমে আলজেরিয়া; এবং আরব উপদ্বীপের বড় অংশ সহ এই সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল  ।

১২৯৯ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে মোট ৩৬ জন সুলতান উসমানীয় সাম্রাজ্য শাসন করেন।বেশিরভাগ পণ্ডিত একমত যে অটোমান তুর্কি শাসকরা অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহনশীল ছিলেন। এরা কোনো ধর্মের লোককে জোরপূর্বক নিজের ধর্মে টেনে নেয়ার চেষ্টা করে নি।  

সংক্ষেপে, অটোমান সাম্রাজ্য বিশ্ব ইতিহাসে একটি অমোচনীয় চিহ্ন রেখে গেছে; ৬০০  বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনটি মহাদেশের(এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা )  সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং সমাজ নীতির  রূপদান করেছে। 

তারা বেশ কয়েকটি অস্ত্রোপচারের যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন যা আজও ব্যবহৃত হয়, যেমন ফরসেপস, ক্যাথেটার, স্ক্যাল্পেল, পিনসার এবং ল্যানসেট। উপরন্তু, কঠিন কঠিন রোগের ঔষধের কিছু অগ্রগতি অটোমানদের দ্বারা  হয়েছিল।

উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ও তার কারণ : 

১৬০০ শতকের শুরুতে উসমানীয় ( অটোমান ) সাম্রাজ্য ইউরোপের উপর তার অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য হারাতে শুরু করে।

ইউরোপীয় ইতিহাসে  রোমান সভ্যতার পতন থেকে শুরু করে  রেনেসাঁর সময়কাল পর্যন্ত ( ১৩ থেকে  ১৫শ শতাব্দী)  অপরিসীম সৃজনশীলতা  এবং সাংস্কৃতিক রূপান্তরের একটি সময় যা আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এটি মহান চিন্তাবিদ, শিল্পী এবং অভিযাত্রীদের সামনে নিয়ে এসেছিল যারা ইতিহাসের গতিপথকে রূপ দিয়েছিল।

রেনেসাঁর সঙ্গে সঙ্গে  শিল্প বিপ্লব যথা  কৃষি ও হস্তশিল্প অর্থনীতি থেকে শিল্প ও মেশিন উৎপাদন  দ্বারা প্রভাবিত অর্থনীতিতে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নামে  পরিচিত ।শিল্পের প্রসার আধুনিক ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সূচনার মধ্যবর্তী সময়কাল ১৫ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৮ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।অপরদিকে উসমানীয় সাম্রাজ্যে এই বিপ্লবের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে স্বক্ষম হয়ে উঠে নি। 

পতন ও শেষ :   

ক) অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, তার একমাত্র কারণ হলো ইউরোপের রেনেসাঁ এবং শিল্প বিপ্লব; ইউরোপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অপারগতা,বহিরাগত দেশের আধুনিকরণ  যুদ্ধ সরঞ্জাম   ব্যবহারের সঙ্গে  পরাজয় বরণ,  ফলে ধীরে ধীরে পতন ঘটে।

খ) অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বহিরাগত দ্বন্দ্ব এবং বৈশ্বিক গতিশীলতার পরিবর্তনের মতো কারণগুলি এর দুর্বলতার জন্য অবদান রেখেছিল।

গ) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় চিহ্নিত করেছিল যার ফলে অধিকাংশ উসমানীয় অঞ্চলগুলি  ব্রিটেন, ফ্রান্স, গ্রীস এবং রাশিয়ার মধ্যে বিভক্ত করে। কামাল আতাতুর্কের দূরদর্শিতার ফলে বর্তমান তুরস্ক বেঁচে যায় এবং ১৯২২ সালে অটোমান সাম্রাজ্য আধুনিক তুর্কি প্রজাতন্ত্র  প্রতিস্থাপিত হয়।

উনিশ শতকের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যকে প্রায়শই “ইউরোপের অসুস্থ মানুষ” হিসাবে উল্লেখ করা হত। এর পতন অব্যাহত ছিল এবং এটি তার পূর্বের গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করেছিল। শেষ পর্যন্ত, এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দ্বারা আরোপিত চ্যালেঞ্জগুলি থেকে বাঁচতে পারেনি ।

অর্থনৈতিক সমস্যা, দুর্নীতি, সামরিক বিপর্যয়, দুর্বল কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব এবং বহিরাগত দ্বন্দ্বের সংমিশ্রণ কয়েক শতাব্দী ধরে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনে অবদান রেখেছিল। 

আতাতুর্ক, যিনি মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক নামেও পরিচিত, একজন অসাধারণ নেতা যিনি তুরস্ককে অটোমান সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশ থেকে একটি আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার সংস্কারগুলি দেশের রাজনৈতিক, আইনগত, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দৃশ্যপট গঠনে সহায়ক ছিল। 

আসুন এই রূপান্তরিত সময়ে আতাতুর্ক কীভাবে দেশ পরিচালনা করেছিলেন তার কয়েকটি মূল দিক সন্ধান করা যাক:

১. ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধুনিকায়ন : ধর্ম নিরপেক্ষতা,আইন প্রশাসন,রাজনৈতিক ও তুর্কি জাতীয়তাবাদ আধুনিকরণ   ।

২. সালতানাত ও খিলাফতের উচ্ছেদ ছিল উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি উসমানীয় সালতানাত বিলুপ্ত করে, যা প্রায় ১২৯৯ সাল থেকে স্থায়ী হয়েছিল।

৩. তিনি ইউরোপীয় আইন ও আইনশাস্ত্রের সাথে খাপ খাইয়ে আইন ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করেছিলেন।

৪. তাঁর দেশে  আধুনিক  শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আতাতুর্ক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার উপর জোর দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

৫. আতাতুর্কের রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) একদলীয় রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক শাসন করে।

৬. আতাতুর্ক শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করেন।

৭. তাঁর চিন্তাধারায় পাশ্চাত্যকরণ একটি মূল থিম ছিল। আতাতুর্ক পোশাক, জীবনধারা এবং স্থাপত্য সহ ইউরোপীয় অনুশীলন গ্রহণকে উত্সাহিত করেছিলেন। এমনকি মুসলমানদের নাম রাখার ব্যাপারে ও ইউরোপীয় ধারা অব্যাহত রাখেন ।  

৮. তিনি নারীর অধিকারের পক্ষে ছিলেন, তাদের ভোটাধিকার দিয়েছিলেন এবং অফিসে প্রার্থী হওয়ার অধিকার দিয়েছিলেন।

তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রথম বছরগুলিতে আতাতুর্কের নেতৃত্ব সাহসী সংস্কারের দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল যা জাতিকে ভিন্ন রূপে রূপান্তরিত করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা, শিক্ষা এবং আধুনিকীকরণের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার একটি স্থায়ী উত্তরাধিকার হিসাবে রয়ে গেছে ।

তুরস্ক ১৯৫২ সাল থেকে ন্যাটোর সদস্য, এর দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী রয়েছে এবং মিত্র ল্যান্ড কমান্ডের সদর দফতরের হোস্ট।

মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১০ নভেম্বর ১৯৩৮ (বয়স ৫৭) মৃত্যুবরণ করেন, তার নীতি আজ ও বিদ্যমান রয়েছে  । মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের বিচক্ষণতা এবং পরবর্তী সরকারের সু-শাসনের প্রভাবে তুরুস্ক ১৯৫২ সন থেকে ন্যাটো সদস্য হিসাবে  সম্মানের সঙ্গে ইউরোপে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে আছে।  একজন নেতার সাহসী নেতৃত্ব  প্রমান করে একটি দেশের ভবিষ্যৎ চলার পথ কতখানি মসৃন হবে।  

সমাপ্ত

পূর্ববর্তী নিবন্ধহৃদয়ে বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধপবিত্র ঈদুল আজহা
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন