বিদেশে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করবো তা কখনও ভাবিনি, অনার্স পরীক্ষা শেষে জীবনের প্রথমবারের মতো বোনের বাসায় লন্ডন শহরে বেড়াতে যাবার সুযোগ হয়। অবাক বিস্ময়ে লন্ডনের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা গুলো দেখে মনে মনে ভেবে ছিলাম এত পরিষ্কার শহর কিভাবে হয়? এখন যখন ভোরবেলা টরেন্টো শহরের রাস্তায় সিটি করপোরেশনের গাড়ী গুলো শহর পরিষ্কার করে যায় তখন আমার সেই প্রথম বারের বিদেশ ভ্রমণের স্মৃতি মনে হয়। আসলে জীবনে প্রথম বারের মতো কোন কিছু দেখা বা পাওয়ার অনুভূতি বোধয় সত্যিই স্মরণীয় হয়ে থাকে।
এমিগ্রেশন নিয়ে কানাডা আসার ট্রিগার বাটন কি ছিল তা মনে করতে পারছি না। তবে বিয়ে হয়ে ঢাকা শহরে আসার পর পরই কেন যেন মনে হতে লাগলো মেট্রোপলিটন বড় শহরটি ছোট্ট শহরের মেয়েকে আপন করে নিতে পারেনি। অযথা অন্যভাবে বলা যায় আমি এই শহরটিকে নিজের করে নিতে পারিনি। এতো এতো দালানের মধ্যে আমার মনে হতো আমি আমার চেনা আকাশকে খুজে পাচ্ছিনা। আমায় ভালবাসার শান্ত পরিচিত নিরাপদ সিলেট শহরের সাথে এই শহরের কোন মিল নেই। স্বাধীন ভাবে বড় হওয়া জীবন হটাৎ কার স্তদ্ভ হয়ে যায়, তার মধ্যে ঘটে যায় ছিনতাই সহ কিছু অপ্রিতিকর ঘটনা। সব মিলিয়ে ভীষণ নীরাপত্তা হীনতায় ভুগছিলাম, এরই ফলশ্রুতিতে বিকল্প বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলাম।
২০০৫ এর শেষের দিকে আমরা এদেশে এলাম। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আমাদের স্বামী স্ত্রীর নতুন জীবন শুরু হলো টরেন্টোতে। ভীষণ খুশীতে ইমিগ্রেশনের হানিমুন Phase শুরু হলো। (ইমিগ্রেশনের ভাষায় প্রথম কয়েকমাস সময়কে হানিমুন Phase বলা হয়।)
টরেন্টো শহরে বসবাসের প্রথম যে জিনিসটা আমাকে ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করতো তা হলো এখানকার মাল্টিকালচারিজম। আমি এ অনুভুতি আগে কখনো পাইনি। মনে হলো গোটা পৃথিবীর সব দেশের মানুষ এখানে বসবাস করে। সবাই সবার ধর্ম, আচার, কৃষ্টি নিয়ে চলছে, একে অন্যকে সাহায্য করছে, কারো সাথে কারো বিবাদ নেই। অদ্ভুত সৌন্দর্য না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
প্রথম প্রথম খুবই অবাক লাগতো এই সম্প্রীতি, এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আল্লাহর অশেষ মেহের বানীতে কানাডা আসার ১ বছরের মধ্যে আমি আমার Social Work লাইনে কাজও পেয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে নতুন জীবনের চড়াই, উতড়াই পেরিয়ে দ্রুতগতির এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
আরও একটা জিনিস এখানে আমার ভীষণ মন ছুয়ে যায়, যখন দেখি একটি এম্বুলেন্স অথবা ফায়ার ট্রাকের গাড়ি গেলে গোটা শহরের মানুষ এক পাশে সরে গিয়ে গাড়ীটিকে যাবার রাস্তা করে দেয়। সব কিছুর উর্ধ্বে মানুষের প্রতি মানুষের এই ভালবাসা আমার অসাধারণ লাগে। অবশ্য অনেকে এটিকে আইন লঙ্ঘনের ভয়ের কারণ হিসেবেও মনে করেন।
এদেশে আসার পর পরই বাংলাদেশের যে জিনিসটা আমি সবচেয়ে প্রথম মিস করি তা হলো আজান শুনা। সারা জীবন যেখানে মসজিদ থেকে পাঁচ ওয়াক্তের আজান শুনেছি। আজ সেই সু-মধুর ধ্বনি ছাড়া আমি কিভাবে পরবাসে আমার জীবন শুরু করব। প্রথম কয়েক মাসের মধ্যে আমার হাজবেন্ট মসজিদ থেকে একটি আজানের ঘড়ি কিনে আনল। আজ ৯ বছর থেকে ঘড়িটি আমাদের পরিবারের একটি অংশ হয়ে আছে।
আরও একটি সময় আমি ভীষণ ভাবে দেশকে মিস করি, তা হলো রমজান মাস। প্রতিটি বছর এই মাসটিতে ভীষণ ভাবে দেশকে অনুভব করি। ইফতারের বিভিন্ন আয়োজন, এবাড়ি থেকে ও বাড়িতে ইফতার বিতরণ, দোকানে বিভিন্ন ইফতারের সমাহার, সেহরীর ডাক প্রতিটি শব্দ, মুহুর্ত যেন আজও কানে বাজে। আর মনে মনে ভাবি আমার বাচ্চারা কখনই এ অনুভূতি পাবে না।
আজ যখন নিজের এই অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবী, মাঝে মাঝে নিজের মনের সাথে বন্ধ হয়, আমি কি ঠিক করেছি?
ভাইবোনদের মধ্যে সবার শেষে আমি দেশ ছাড়ি। আজ মনে হয় যদি না আসতাম তাহলে হয়তো বাবার শেষ সময়ে দেশে থাকতে পারতাম। আবার ভাবি আল্লাহর হুকুম ছাড়া তো কিছুই সম্ভব নয়। আজ এ দেশে আশায় আল্লাহর প্রতি টান, নিজেকে, নিজের ধর্মকে আরও ভালভাবে জানা ও অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছে। যার জন্যে আমি কানাডার কাছে কৃতজ্ঞ।
আসলে কানাডা না আসলে আমি কখনই জানতাম না আমি আমার নিজের দেশকে কতটা ভালবাসি। আমার মনে হয় নিজ দেশের প্রতি মানুষের ভালবাসা আর টান বোধয় সরে গেলে আরও গভীর হয়।
তবে আমি বিশ্বাস করি দেশের প্রতি ভালবাসা দেখাতে হলে শুধু দেশে থাকতে হবে এমন কথা নেই। পৃথিবীর যে কোন জায়গায় থেকেও আমি আমার চিন্তায়, কর্মে, আচার আচরণ দিয়ে দেশকে সবার সামনে সম্মানিত করে তুলতে পারি। এর জন্য আমার শারিরিক উপস্থিতির চেয়ে আন্তরিক চেষ্টাই মুখ্য।
আর আমি তা আমৃত্যু করে যাব। আমি বাংলাদেশী এতো আমার গর্ব আমার বিরাট অহংকার।
নওশিন হামিদ চৌধুরী
টরেন্টো
সুন্দর একটা লেখার জন্য ধন্যবাদ । আর একটি নতুন লেখার অপেক্ষায়…