অনেক দিন আগের কথা, একটা রিসার্চ এর উদ্দেশ্যে রংপুর জেলখানায় গিয়েছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, যারা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করে জেলে আছে তাদের চিন্তাচেতনা, মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা সম্পর্কে জানা। আমরা কয়েদীদের কিছু pre-structured open ended প্রশ্ন করতাম তাদের চিন্তাচেতনা, মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা নিয়ে এবং তাদের মতামতগুলো লিখতাম। পরে সেটা একটা বড় রিসার্চ পাবলিকেশন হয়েছিল বলে জানি। আমার লেখার বিষয় সেটা না। সেখানে আমরা সেখানকার জেলখানার প্রধান এর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। উনি খুব কথা বলা পছন্দ করতো। উনি যেটা বলেছিলেন আর তা হল, আমি যা জানি তা আমি শেয়ার করবো এর থেকে যদি একজনও তার কথা শুনে এবং সেটা যদি কেও ১০ বছর পরেও কারও কাজে আসে, তাহলে তার সেটা ওনেক ভাল লাগে। তিনি বিশ্বাস করতেন আমরা যা জানি তা অবশ্যই শেয়ার করা উচিৎ এটা মানুষ সেই মুহূর্তে রিস্পন্স দিক আর না দিক। মানুষ এক সময় না এক সময় যদি তার প্রয়োজনে কাজে লাগায় বা লাগে তাহলে তার তাৎপর্য অনেক।
আমার ব্যক্তিগতভাবে একটা সময় ছিল যখন মনে হত মানুষকে শুধু টাকা দিয়েই সাহায্য করা যায়। পরে জেনেছি টাকা দিয়ে সাহায্য করার চেয়ে আপনি যদি কোন পরামর্শ দেন তার কোন সঙ্কটময় সময়ে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমি প্রতিনিয়ত আমার যাদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে তাদের ফিডব্যাক থেকে পাই, যা আমাকে আরও বেশি শেয়ার করতে অনুপ্রানিত করে। আমি কয়েকদিন ধরে মানসিক স্বাস্থ্য, অভিবাসীদের সুখ দুঃখ ও সিধান্তহীনতা নিয়ে লিখছি। খুব যে বেশি রিস্পন্স পাচ্ছি তা না, তবে যেটুকু পাচ্ছি তাই আমাকে এই বিষয়ে আরও লিখতে উৎসাহিত করছে। আমি জানি এখানে আমরা সবাই অনেক বিষয় শেয়ার করতে চাই। অনেকেই বিভিন্ন ব্যস্ততার কারনে তা পারিনা। আমি জানি আমার এমন এক সময় ছিল যখন fulltime লেখাপড়া ও ফুল টাইম জব করতাম, সাথে অনেক সময় আবার পার্ট-টাইম জবও করতে হত, ফ্যামিলি তো ছিলই। তাই সবকিছু সামাল দিয়ে সময় বের করা জটিল হয়ে যেত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও।
এখন অনেক সময় পাই stable জব এর কারনে। তাই এই বিষয়গুলো লেখার চেষ্টা করি। যেহেতু আমি এই বিষয়ে লেখাপড়া এবং কাজ করার সুযোগ হয়েছে তাই আমার দায়িত্ব আরও বেশি। একটা গল্প পরেছিলাম, গল্পটা এমন যে গ্রামে একটা সাঁকো দরকার। যে যার অবস্থান থেকে সাহায্য করে সাঁকোটা করার প্রস্তুতি নিল। যার সামর্থ্য ছিল সে টাকা দিয়ে সাহায্য করলো, যার টাকা বা অন্যান্য সামর্থ্য নাই সে নিজে গায়ে খেটে পরিশ্রম করলো। গল্পটা আমরা সবাই জানি। আমার এখানে বলার কারন আমি এই বিষয়গুলো জানার সুযোগ হয়েছে বলে। তাই এটা আমি করতেই পারি। যদিও আমাকে এর জন্য অনেক সময় ব্যায় করতে হয় বাংলায় লিখার জন্য(বাংলায় কেন লিখি তা নিয়ে আরেকদিন বলবো……)। আমার তাতেও আপত্তি নাই যদি কারও উপকার হয়। আবার কানাডা এর আবহাওয়া একটা কারন। আপনি ইচ্ছা করলেও আবহাওয়ার কারনে বাইরে গিয়ে সময় কাটাতে পারবেন না এখানে এই শীতে। আমি জানি যারা সাহায্য করতে চায়, হয়তোবা তাদের সবারই একটা stable অবস্থায় আছে তাই তারা সাহায্য করতে চাচ্ছেন। আবার stable অবস্থা ব্যক্তি ভেদে আলাদা হয়। কেও দেখি একটা ভাল জব পেলে এবং থাকার জায়গা থাকলেই খুশি, আবার কেও অনেক কিছু করার বা থাকার পর ও stable না। আমার মতে কানাডা তে একটা full time permanent job এবং থাকার জায়গা থাকলেই অনেক ভাল থাকা যায়, আবার অনেকে যে অবস্থায় থাকুক না কেন তারা সাহায্য করবেই।
তবে মানুষ যখন সংকটপূর্ণ অবস্থায় থাকে তখন সে সাধারণত balanced চিন্তা ভাবনা করতে পারেনা তাদের cognitive distortion এর কারনে। এই সময়ে কেও তাকে ভাল কিছু বললেও তা সহ্য করতে পারেনা। তার নিজের ভালো দিক গুলো চাপা পরে যায় অন্যান্য কম ভাল বিষয় দ্বারা। তারা অর্ধেক গ্লাস পানি আছে না বলে বা না দেখে তারা বলে অর্ধেক গ্লাস পানি নাই এভাবে দেখে, অর্থাৎ না পাওয়ার বিষয়টি তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায়। বিষয়টি এতই জটিল আকার ধারন করে যে নিজের সম্বন্ধে ধারনা (self-esteem) তলানিতে পরে যায়। ঢাকা ইউনিভার্সিটি Clinical Psychology তে পড়ার সময় স্টুডেন্টদের মধ্যে suicide এর হার এক সময় খুব বেশি বেড়ে গিয়েছিল। একদিন ক্লাস এ এটা নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে আমাদের রোকেয়া madam (উনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি Clinical Psychology এর বিখ্যাত Clinical Psychologist এবং প্রফেসর ছিলেন) এই বিষয়ে বলেন। আমি এটা নিয়ে পরে অনেক জনের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমি আমার নিজের জীবনের ক্ষেত্রে দেখেছি বিষয়টি অনেক বাস্তব এবং সত্য।
বিষয়টি হল, আমাদের জীবনে যখন একটা খারাপ ও অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে তখন সেটা automatic ভাবে আমাদের জীবনের আগে ঘটে যাওয়া আরও অনেক খারাপ ঘটনাগুলোকে উদ্রেক করে। যেমন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া একজন স্টুডেন্ট যখন তার গার্ল বা বয়ফ্রেন্ড দ্বারা reject হয়, তখন সে তার সাথে ক্লাস এর খারাপ result, ফ্যামিলি বা টাকার প্রবলেম, অন্যান্য ফ্রেন্ড দের সাথে প্রবলেম এবং এর সাথে তার অনেক আগে ঘটে যাওয়া কোন দুঃখজনক ঘটনার সংযোগ ঘটান। তার এই চিন্তা ভাবনাগুলো ( Negetive Automatic Thoughts= NAT) একেকটার সাথে আরেকটার connection এত প্রবল হয় যে, তার আর জীবনের বেঁচে থাকার অর্থ খুজে পান না। সে তার জীবনের ভাল ঘটনাগুলো (সে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ভাল একটা সাবজেক্ট এ পড়ে, তার ভাল supportive কিছু বন্ধু বান্ধব আছে) ভুলে যায় বা এই সময়ে মাথায় আসেনা। ফলে সে আত্মহত্যার মতো কঠিন সিধান্ত নেন। আমি এই ধরনের কথাগুলো অনেক বিষণ্ণতা আক্রান্ত মানুষের কাছে শুনেছি। আবার অনেকে হয়তোবা সেই পর্যায়ে যান না, কিন্তু না শেয়ার করার কারনে ধীরে ধীরে তাকে আরও বিষণ্ণতা গ্রাস করে। তখন তার স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা সেভাবে কাজ করেনা। মানুষের ভাল উপদেশ তাদের আর ভাল লাগেনা।
তাহলে আপনি কি করবেন? আমি জানি, এটা আরও প্রকট আকার ধারণ করে আমাদের অভিবাসীদের ক্ষেত্রে। অভিবাসীদের অনেক systematic and induvidualistic barriers মধ্যে যেতে হয় যা আমি আমার আগের লেখাগুলোতে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। যেহেতু আপনার এই বিষণ্ণতার cycle টা ভেঙ্গে ফেলা দরকার, যেটা আপনি করতে পারেন অনেক উপায়েঃ কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই আপনাকে শেয়ার করতে হবে। যেমন আপনি যদি আপনার অপ্রত্যাশিত অবস্থার কথা শেয়ার করেন আপনার কোন বন্ধুর কাছে, তাহলে সে কি বলে? বেশির ভাগ সময়েই বলবে, “চিন্তা করিস না, তুই এইটা নিয়ে, ভালমত লেখাপড়া কর, ওর চেয়ে আরও ভাল বয় বা গার্ল ফ্রেন্ড পাবি”। অর্থাৎ আপনার শেয়ার করার কারনে আপনার বন্ধু আপনার বিষণ্ণতার cycle টা ভেঙ্গে ফেলতে এবং এর সাথে আপনার ভাল দিকগুলো তুলে ধরতে সাহায্য করে। তবে সেভাবে বিশ্বস্ত বন্ধু পাওয়াটা অত সহজ না, অথবা অনেক সময় বন্ধুর সেইভাবে সময় দেয়ার সময় নাই। যে এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যায় সেই শুধু জানে বিষয়টা অত সহজ না। বিষয়টা যেহেতু অনেক জটিল, আপনি বিভিন্ন প্রোফেসনালদের সাহায্য নিতে পারেন। তবে হ্যাঁ না বললে মানুষ জানবে কেমনে …………..
চলবে …………..