উচ্চারণ বিভ্রাট : “এ বিয়ার” : আমাদের মেয়ে লামিয়া তখন গ্রেড ওয়ান এ পড়ে .মেয়েকে স্কুল এ নামিয়ে কাজে যাব, গাড়ি নিয়ে স্কুলের কাছাকাছি আসতেই উক্তেজিত কন্ঠে মেয়ের চিত্কার,
” ড্যাডি লুক, ইটস এবিয়ার”. এমনভাবে ও বলে যাচ্ছে যে তাতে মনে হবে যে চোখের সামন দিয়ে সত্যি কোনো ভালুক হেটে যাচ্ছে. জোরে ব্রেক কষে রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে বললাম, ” এই কনক্রিট এর জঙ্গলে তুমি বিয়ার পেলে কোথায় ? উত্তরে আমি শুনছি,”ন ড্যাডি, ন, থিস ইজ এবিয়ার”. আসলেই এ কোন বিয়ার যা Islington এর রাস্তায় নেমে এসেছে, তা দেখার জন্য যখন মেয়ের নির্দেশিত স্কুল এর পশ্চিম কোনে তাকালাম, তখন বুজলাম, মনযুগ দিয়ে না শুনলে উচ্চারণ বিভ্রাটে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে. তাকিয়ে দেখি, স্কুল এর কাছে দাড়িয়ে আছে সদ্য বাংলাদেশ থেকে বেড়িয়ে আসা আমাদের এক প্রতিবেশীর ছেলে “আবির”
Unlearning: আমরা যারা বাংলাদেশ বা দক্ষিন এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে কানাডায় এসেছি, সৌজন্যবোধ জনিত কিছু রিফ্লেক্স আমাদের মধ্যে সব সময় কাজ করে. তার একটি হলো সিনিয়র কাউকে দেখলে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ানো. ২০০৮ সাল. তখন কাজ করি অন্টারিও মিনিস্ট্রি অফ হেলথ প্রমোশন এর মানব সম্পদ বিভাগে. সদ্য জয়েন করেছি, সুতরাং আগ্রহ এবং একনিষ্টথা প্রমানের চেষ্টার অন্ত ছিলনা. সব মনোযোগ ঢেলে একদিন কাজ করছি মাননীয় প্রতি মন্ত্রীর Presentation এর জন্য. বিষয় হলো “Strategic Diversity Framework” যা মন্ত্রনালয়ের সব বিভাগে অনুসৃত হবে. হটাথ দরজায় টুকা শুনে, তাকিয়ে দেখি প্রতিমন্ত্রী নিজেই হাজির জরুরি কিছু নির্দেশনা দেবার জন্য. এরপর তিনি আরো কয়েকবার এসেছেন একই বিষয়ের জন্য. যত বার সামনে আসেন, আমি ততবারই চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাড়াই. বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রতিমন্ত্রী সহাস্স্যে বলেন, “Hasan , i understand where it is coming from, but you don’t need to do it. Perhaps unlearning certain things may help you feel more comfortable”.
বাঙালি স্বভাবজাত সৌজন্যবোধ ভুলে যাওয়া কতটুকু সম্ভব জানিনা, কিন্তু একজন কর্মীর সাথে একটি মন্ত্রনালয়ের সবূচ্ছ পধবিধারী একজন অসাধারণ মানুষের সাধারণ আচরণ আজ ও শ্রদ্ধার সাথে সরণ করি. কফির জন্য কলেজ পার্কের টিম হর্টনের লাইনে দাড়ানো অসীম ক্ষমতাবান এসব মানুষের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্তা নেই, নেই সব মানুষের রাস্তা বন্ধ করে নিজে অফিসএ যাবার সুরক্ষিত আয়োজন.
ক্ষমতার দাপট, রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি, তদ্বিরবাজদের ভিড় এসবের কিছুই চোখে পড়েনি. সবকিছুই চলছে নিয়ম মাফিক. সবাই করে যাচ্চে যার যার নির্ধারিত কাজ. নিজের কাজ বাদ দিয়ে দলীয় পদলেহনের সুযোগ এবং সহায়তা কোনটাই নেই. অবাক বিস্ময়ে ভাবি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে সুশাসনের এই ভিত কবে তৈরী হবে.
Purpose in Life: মানসিক সাস্থ্যজনিত চ্যালেঞ্জ এবং আসক্তি আক্রান্ত মানুষদের সাথে কাজ করার সুবাদে অনেক সময় বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হই. এমন অনেক মানুষকে দেখি যারা জীবনের উদ্দেশ্য খুজতে খুজতে এক সময় জীবনের ঘুরপাকেই হারিয়ে যায়. ডিসেম্বর মাস. চারদিকে খ্রিস্টমাস এর জমজমাট আয়োজন. যে হাউসিং সাইট এ কাজ করি, সেখানে ক্লায়েন্টদের আত্তীয়সজনরা খ্রীষ্টমাস এর গিফট নিয়ে আসছে. অনেকে আবার প্যাকেট খুলে গিফট বের করে অফিস এ এসে স্টাফকে দেখাচ্ছে. শুধু একজনকে দেখলাম বারান্দার কোনে একাকী বসে কথা বলছে নিজের সাথেই. কয়েকদিনেও তার কাছে গিফটের প্যাকেট নিয়ে কাউকে আসতে দেখিনি. আগ্রহী হয়ে তার পাশে যেয়ে বসে কুশলাদি জিগ্যেস করে জানতে চাইলাম তার খ্রীষ্টমাস প্লান. উত্তরে বলল, ” can you tell me what is the purpose in life ?” “জীবনের উদ্দেশ্যই যেখানে হারিয়ে ফেলেছি, সেখানে খ্রিস্টমাস এর প্লান আর কি থাকবে ?” ধীরে ধীরে জানতে পারলাম তার অতীত জীবনের অনেক অধ্যায়. প্রাচুর্যের শীর্ষ সোপানে বসে ড্রাগ আসক্তি, পারিবারিক,আর্থিক ধস, মানসিক বিপর্যয় এবংএকসময় গৃহহীন মানুষে পরিনত হওয়া. পনের বছর আগের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল বাধ ভাঙ্গা অশ্রু. কর্মী হিসেবে বুযতে পারছিলাম তার জীবনের ভার বইতে না পারার যন্ত্রণা. এদের জীবনে খ্রিস্টমাস আসে, খ্রিস্টমাস যায়, কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য আর ফিরে আসে না.
অসহায়, দুখী এসব মানুষের জীবনে যখন সামান্যতম পরিবর্তন ও লক্ষ্য করি, যখন দেখি এই মানুষগুলি আবার আশার আলো দেখছে, দেখছে দিন বদলের স্বপ্ন, তখন মনে হয়, ” My purpose in life is achieved”.
বিক্ষিপ্ত ভাবনাটা সঠিক জায়গাতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
আনেক দিন পর দেখলাম ব্লগে।