মোস্তফা অভি
4 অন্যান্য লেখা
0 মন্তব্য
��এই আমার পরিচয়��
>>>>>>><<<<<<<<<<
সত্য স্বীকারোক্তি এবং একটি বাস্তবতা
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে আমার ধরনীতে আগমন। জন্ম হয়েছিল সলিতার আলোয়। ধাত্রী যমুনার মা। যমুনার মা নিপুণ ধাত্রী, তবু তার কেন যেন মনে হয়েছিল পৃথিবীর মুখ দেখতে আমি নারাজ ছিলাম। স্বভাবতই শিশুরা জন্মের পর কাঁদে, কিন্তু আমি নাকি কান্নাই করিনি। হয়তবা করিইনি অথবা করছি কিন্তু অস্ফুটবাক। তাই বুঝি এখনো কম কথা বলি। যা হোক, কুপির আলোটা নিভে গিয়েছিল একবার। তখনি হয়ত পৃথিবীর প্রথম অন্ধকারের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। তাই বুঝি এখনো নির্জনতাই আমার বেশী পছন্দ। আলো আঁধারের জীবন দারুন উপভোগ করছি। উত্থান পতন তো থাকবেই জীবনে।
ছেলে বেলার অনেক কথাই তো মনে পড়ে। আমি জন্মেছি যৌথ পরিবারে। আমার বাবা মেঝ ছিলেন বিধায় পরিবারের কর্তা প্রধান বড় চাচার ছেলে মেয়েদের প্রাধান্য ছিল বেশি। আমি ছিলাম সংসারের জীব মাত্র। মা ছিলেন কাজের জন্য প্রশংসাধন্য আর কাকি ছিলেন অকারণেই সংসার প্রধান। আগেই বলেছি আমি ছিলাম সংসারের একটা জীব মাত্র। মা আমাকে ছেড়ে দিয়ে কত কাজ করতেন কিন্তু আমি হামাগুড়ি দিয়ে কোথায় চলে যেতাম! সংসারে অতগুলো মানুষ থাকতে আমি জীবের খবর আর কে রাখে! অনেক ধান হত আমাদের। মা ধান সিদ্ধকরা, রোদে শুকানো, বারা ভানা ইত্যাদি নিয়ে প্রায়ই ব্যস্ত থাকতেন। আমি আমার মত করে হামাগুড়ি দিয়ে চলতাম ইচ্ছেমত।
একবার হল কি, মা কাজে খুব ব্যস্ত। আমি আপন মনে চলে গেলাম আঙিনার প্রান্তদেশে। ওখানে দাদীর কয়েকটি ছাগমাতা পোষ্য ছিল। ভারারের কোনেই তাদের বাস। পোষ্যরা ম্যা ম্যা,,,,,,,,,,, করে ডাকত আর নিপুণ কারিগরের মত পশ্চাদদেশ থেকে বড়ি গুলো ছেড়ে দিত। অবাক নয়নে আমি লম্বাটে গোল বড়ি গুলোকে দেখতাম। আর বাম হাত দিয়ে মুখে পুড়ে খেতে থাকতাম। জানিনা কত ছাগের বিষ্ঠা আজও আমার পাকস্থলিতে জমে আছে! যা হোক মা আংগুল দিয়ে আমার খাবার গুলো মুখ থেকে বের করতেন। মনে হয় সেটা আমার ভালো লাগতনা মোটেই। সেই সংসারের কাজের প্রধান মহিলা আমার মা আজও বেঁচে আছেন। মাঝে মাঝে ছাগ বিষ্ঠা ভক্ষণ প্রসঙ্গে বলেন। আমি অবাক হই। তবে সেদিনের কাজের উদ্দমী মানুষটা আজও কাজ করতে চায়। ছাগ বিষ্ঠা ভক্ষণ করা ছেলেটা তা মোটেই চায় না।
আকাশ তোর রং কিরে বল? আকাশ উত্তর দেয়না। উন্মুক্ত উঠানে আকাশের নীলের দিকে তাকিয়ে আব্বা প্রশ্ন করে আর চোখের পলক ফেলে বারবার। তাঁর দেখা হয়নি কিছুই,-------- বাবা ছিলেন অন্ধ।
সংসারে আমাদের মূল্য কম কেননা বাবা ছিলেন কম দৃষ্টি সম্পন্ন বলা চলে অন্ধ। সুন্দর আকাশ, দিগন্তে মাঠ, রূপালী নদী কিছুই দেখা হয়নি তাঁর। শুধু মনের গহীনে দেখেছিলেন ছেলেরা একদিন বড় হবে সব দু:খ ঘুঁচে যাবে সুদিন আসবেই।
পরিবারের আয় নেই, আমি এবং আমার ভাইয়ের জন্মের পরপরই আলাদা সংসারে জীবন শুরু। জমিজমার ধান আর কিছু মৌসুমী ফসল ছিল চলার মতো সম্বল। বছরের ঈদগুলো পানসে হয়ে থাকত বরাবরই। কখনো দেখিনি পোলাও মাংসের জোগাড়। সকালে পান্তা ভাত আর বিঁচি কলাই ছিল প্রথম পছন্দের খাবার। একটা নির্জন গ্রামের অনগ্রসর পল্লীতে বেড়ে ওঠা। যেখানে রাস্তা নেই, বিদ্যুৎ নেই, গ্রামের সবাই সরল আর অশিক্ষিত।
মা রান্না করতেন আর আমাকে অ আ ক খ পড়াতেন। উনানের পাশেই মাদূর পেতে পড়াতেন আর শুকঁনো গাছের পাতা পুড়ে রান্না করতেন। কোনদিন সাচি শাক কখনো কলার মোচা আবার কিছু জোগাড় না হলে খেশাড়ির ডাল। এটাই আমাদের রোজকার খাবার।
স্কুলে ভর্তি হলাম। বেতন ও পরীক্ষার ফির সময় দাঁড়াতে হতো। ক্লাসের সবাই যথা সময়ে টাকা দিলেও আমি কবে দিব তা জানা নেই। বলতাম আব্বা আসবেন। একটা লজ্জা হীনমন্যতা কাজ করত সর্বদা। পরীক্ষার দিন দেখতাম আব্বা স্কুলের বারান্দায় ছোট ছোট পায়ে হাঁটছেন। আমি ক্লাস থেকে বের হয়ে আব্বার হাত ধরে হেড স্যারের রুমে নিয়ে যেতাম। ভাবতাম আব্বা মনে হয় টাকা দিবেন। কিন্তু আব্বা স্যারকে বলতেন মামা, - পোলাডার পরীক্ষা নেন কয়দিন পর টাহা দিমুনে।
অনাটন আমাকে দমাতে পারেনি। মেধা আর প্রতিভার স্বাক্ষর সব সময়ই রেখেছি। বরাবরই ক্লাসে ফার্স অথবা সেকেন্ড হতাম। আরো বড় হলাম। এস এস সি পরীক্ষা নীকটবর্তী হলো। মামার থেকে চাল, খালার থেকে বিছানা, প্রতিবেশীর থেকে ধার করা টাকা দিয়েই পরীক্ষা শেষ হলো। তিনমাস পরে দু'বিষয়ে লেটার মার্কস সহ প্রথম বিভাগ। বস্তুত,অঙ্কে ৮৮ নম্বর পেয়েছিলাম।
শুরু হলো আমার নতুন পথের যাত্রা। এইচ এস সির পথটা যে কতটা কষ্টের ছিল তা প্রকাশ করা অসাধ্য। যে বাড়িতে প্রাইভেট পড়াতাম সে বাড়ীর কর্তার থেকে ধার করে ফরম ফিলাপ করেছিলাম। কিন্তু টাকা শোধ দেওয়া আজও হয়নি। যখন দেয়া যেত তখন সামর্থ্য ছিলনা। যখন সময় হলো তখন তিনি বেঁচে নেই। তাঁর উত্তরসূরীরা টাকাটা নিতে বলায় কি পরিমান লজ্জা পান বলাবাহূল্য। তবে তাঁদের আদর ভালোবাসায় আমি সিক্ত।
ঢাকায় পাড়ি জমালাম। ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেবার সাহস শক্তি কিছুই ছিলনা। কারণ যেখানে গ্রামের স্কুলের টাকা যোগাড় করাই কষ্ট সাধ্য সেখানে আবার ভার্সিটিতে পড়া। বাধ্য হয়েই কলেজে ভর্তি হলাম। টিউশনি করে নিজে চলতাম আর পারলে মাঝে মাঝে আব্বাকে কিছু পাঠাতাম। আমার আরো তিনটা বোন আছে। তাদের নিয়ে তো অন্ধকার দেখছিলাম সবাই। কিন্তু ভাগ্য আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছিল তাই সব ভাই বোনই আজ উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত আমরা।
অনার্স সহ এম এ পাশটা করলাম ঢাকা কলেজ থেকে টেনেটুনে। মামু খালু নেই তাই বি সি এস দিয়েও হেরেছি। সরকারি হাইস্বুলের সহকারী শিক্ষকের ভাইবা, অর্থ মন্ত্রনালয়ের ভাইবা, এমনকি প্রাইমারীর ভাইবা দিয়েও চাকুরী জোটেনি। অবশেষে কি মনে করে একটি বেসরকারি ব্যাংক অফিসার পদে চাকুরী দিল জানিনা। আমার মতো সব ভাইবায় অযোগ্য ছেলেকে এতবড় প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক কি করে যোগ্য মনে করেছে তা মাথায় ধরেনা। এবার একটু একটু করে জীবনের পথে হাঁটতে শুরু করলাম। ছোট ভাই বোন গুলোকে পড়াতে থাকলাম। বোন দুটোকে ভালো পরিবারে বিয়ে দিলাম। একজন এখনো ভার্সিটিতে পড়ছে।
পালে লাগা দক্ষিণা বাতাশের মতো মাত্র সূখের হাওয়া পরিবারে বইতে শুরু করেছে। আমি চাকুরি করছি আর ভাইটা বিদেশে কাজ করে। এর মধ্যেই কোথাথেকে নাক মোটা একটা মেয়ে জীবনের সাথে জড়িয়ে গেল। বড় ভালোবেসে ফেললাম। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। সে ধনী বব্যবসায়ীর একমাত্র কন্যা। জাত ঢাকার স্থানীয় মানুষ। একটা সিনেমেটিক বিষয় হয়ে গেল, গরীবের ছেলের সাথে ধনীর মেয়ের প্রেম। অনেক ঝামেলা অনেক বাধা কিন্তু মোটা নাকের মেয়েটা পিছপা হয়নি। অবশেষে উভয় পরিবারের সম্মতিতে মহা ধূমধামে ঢাকার উত্তরায় আমাদের বিয়ে। প্রায় আড়াই হাজার মানুষের বিশাল আয়োজন। সত্য কথা বলতে আমার জীবনে আড়াইশ মানুষের কোনো অনুষ্ঠানই আমি দেখিনি------!!!!
বিয়েটা ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারী। বিয়ে করেই নববঁধূকে নিয়ে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে পটুয়াখালীর গ্রামের পথে যাত্রা। মহা ধূমধাম। নববঁধূকে নিয়ে গ্রামে কি পরিমান বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম তা বলে শেষ করা যাবেনা। বস্তুত, সে চার তলা থেকে নিচতলায় কখনো থাকেনি, কোনোদিন ঢাকার বাইরে যায়নি আর কোনো গ্রামও দেখেনি। গরীবখানা, কাঁচা ঘর, কাঁচা টয়লেট সবকিছু তার কাছে আজব মনে হয়। কিন্তু তার ভালোবাসার কারণে সবকিছুই সহজ হয়েছিল সেদিন। সেজন্য অজরা নূরের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা।
সংসারে এখন অনেক সূখ। নতুন ঘর হয়েছে যা এলাকার সেরাই বলা চলে। উচ্চ শিক্ষিত পদস্থ অফিসার মেয়ের জামাই। বড় ছেলে চাকুরে, মেঝ ছেলে প্রবাসে আয় করে। সব চলছিল ঠিকঠাক এই সংসারে। নিরক্ষর মা আর অন্ধ বাবার মুখে আনন্দের শেষ নেই। কিন্তু ভাগ্য এবার অন্য কিছু নিয়ে অপেক্ষা করছে।
২০১৩ আগস্ট মাসে রোজার ঈদ ছিল, শুক্রবার। নতুন বউয়ের প্রথম গ্রামে ঈদ। সাথে মেয়ে জামাইও এসেছে। প্রবাসী ছেলেও দেশে। এত আনন্দ এই পরিবার জীবনে কখনো দেখেনি। ঈদের পরের দিন আব্বা আমার স্ত্রী অর্থাৎ অজরা নূরকে বললেন,-;- মা আমি হাটে যাবো তুমি কি খাবে বল? অজরা কিছু খবনা বলে পরে পেয়ারা আনেন বলেছিল। আব্বা রাস্তার পাশ ধরে চলতে পারতেন এটা তাঁর ছোটবেলা থেকে অভ্যাস। তাই বাজার নিজে করাটা তাঁর খুব আনন্দের ছিল। বাজারে যাবে কিছু সওদা আনবে আর বউয়ের জন্য পেয়ারা। বাড়ি থেকে শুভ্র পাঞ্জাবি পরে মাথায় টুপি ও রুমাল দিয়ে রওয়ানা দিলেন। আমরা সবাই খোশ গল্পে মগ্ন। সময় বয়ে যায় নতুন বউ এবং আমরা দুপুরে খাবো তাই আব্বার অপেক্ষা করছি। এ সময়ই প্রতিবেশী একটা ছেলে আমাকে বলল, আপনের আব্বায় রাস্তায় এক্সিডেন করচে----
আমি, ভাই এবং ভগ্নিপতি দৌঁড়ে গেলাম। দুপুরবেলা রাস্তায় কিছুনেই তাই যেতে একটু দেরী হলো। কিন্তু যে বাড়ীর সামনে এক্নিডেন্ট হয়েছে সে বাড়ির মানুষ কাঁদছে। দেখেই প্রাণ শুঁকিয়ে গেল। আব্বাকে নিয়ে বাজারে ডাক্তারখানা নিয়ে গেছে। তবুও মনে মনে ভরসা পেলাম, অটোরিক্সার চাপায় যাহোক মরবেনা।
নিয়তি হয়ত তখন হাসছে। বাজারে গিয়ে দেখি আব্বার নিথর দেহটা একটা টুলের উপর শোয়ানো। হাত দিয়ে দেখলাম শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। বুকটা রক্তে ভেজা। চোখদুটো বন্ধ হচ্ছে না। বুঝতে আর বাকী নেই এই দু:খী স্বপ্ন দেখা মানুষটা আর ফিরে আসবেনা কোনদিন।
বোনেরা কান্না জুড়ে দিল। অজরা নতুন বউ তবুও গ্রামের কাঁদা মাখা ফসলের ক্ষেত পেরিয়ে রাস্তায় এসে আব্বার পায়ের উপর লুটিয়ে কান্না জুড়ে দিল। মনে হয় এই ক্ষত কোনোদিন ওর হৃদয় থেকে মুছে যাবেনা।
প্রকৃতি বড় অসহায়। একটা স্বপ্ন দেখা মানুষ কিছুটা স্বপ্নের পথে এগিয়ে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
সবার কাছে আব্বার রূহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া প্রার্থনা করছি
আপনাদের ভালোবাসার অভি
বরিশাল।
১০.০১.২০১৭ইং