তমাল আর তিথিদের প্লেনটি যখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রান ওয়েতে প্রকান্ড শব্দতুলে খানিকটা যেয়ে উর্ধমুখী হলো তমাল ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে দু হাতের তালু দিয়ে দুই কান বন্ধ করে দোয়া দরূদ পড়তে থাকলো। অথচ ভয় পাবার কথা ওদের নয় বছরের এক মাত্র সন্তান তিতাসের, কিন্তু তিতাস মনের আনন্দে সীটের সামনে রাখা হেড ফোনের প্যাকেট খুলে কানে লাগিয়ে সীটের সামনে ছোট স্ক্রিনে কি যেন দেখার চেষ্টা করেছে। তিথি তমালের কান্ড দেখে খিল খিল করে হাসতে হাসতে তমালের সাথে মজা করে বললো, ‘এই একেবারে বাচ্চাদের মতো করছো কেন, চোখ খোলো, দেখো এই উপর থেকে ঢাকা শহর কেমন লাগে’। তমাল বাধ্য স্বামীর মতো একটু একটু করে চোখ খুলে প্লেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। চোখের নিমিষে যে এতো বড় একটি প্লেন এতো উপরে উঠতে পারে তমালের কল্পনার মধ্যেই ছিল না। বাংলাদেশে তখন একেবারে শেষ রাত, সম্ভবত রাত্রি তিনটা সাড়ে তিনটার মতো বাজে। এতো উপর থেকে নিচের দিকে শুধুমাত্র টিম টিম করে অসংখ্য ইলেকট্রিক লাইট দেখা যাচ্ছে। একসময় তাও মিলিয়ে গেলো। চোখের সামনে বৃত্ত থেকে বিন্দু হয়ে শূণ্যে মিলিয়ে মেঘের রাজ্জ্যে ঢেকে গেলো ঢাকা শহর । সোঁ সোঁ শব্দ তুলে ঝড়ের বেগে আকাশ, তারা, মেঘের পাশাপাশি তমালদের প্লেনটি সুদূর কানাডা অভিমুখে দ্রুতই এগিয়ে চললো।
তমালের ভয়ের ভাবটা কাটতে আরো কিছক্ষন সময় লাগলো। সময়টি আরো বেশি লম্বা হতে পারতো , তবে তিথির কিছু হালকা রসিকতা ও গল্প শুনতে শুনতে তমাল অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। তিথির অনেক ভাল গুনের মধ্যে একটি হচ্ছে অসম্ভব বিপদেও সে ভেঙে না পরে হাসিমুখে সব সামলে নিতে পারে। ওকে দেখে বুঝার উপায় নেই তমালের মতো তিথিরও এটিই প্রথম প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা । তমাল জীবনে কখনো প্লেন কাছ থেকেই দেখে নি। তবে তমাল প্লেনে উঠার মস্তবড় এক সুযোগ একেবারে কাছে পেয়োও তা ফসকে গিয়েছিলো। তখন তমাল একটি পেস্টিসাইড কোম্পানিতে বগুড়াতে কাজ করতো। চট্টগ্রামে তার ও আরেক সকর্মীর ট্রেনিং। অফিস থেকে প্লেনের টিকিট কেটে দিয়েছে। পরের দিন সকালে সাড়ে দশটায় রাজশাহী থেকে প্লেন ছাড়বে। বগুড়া থেকে খুব সকালে বি আর টিসি ফার্স্ট বাসে রাজশাহীতে গিয়ে সেখান থেকে প্লেনে উঠার কথা। জীবনের প্রথম প্লেনে উঠবে এই আনন্দে যখন রাতে তমাল ব্যাগ গোছাচ্ছিল ঠিক তখন এসার নামাজ পড়ার জন্য তমালের মা বাথরুমে ওযু করতে যেতে পা পিছলে চিৎ পটাং। মাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে তমালের প্লেনের চড়ার শখ সেবারের মতো অতৃপ্তিই থেকে গেলো।
আজ প্লেনের জানালা দিয়ে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে তমালের শরৎ বাবুর মতো আঁধারের রূপ দেখতে যেয়ে তার মায়েরকথা মনে পড়ে গেলো , প্লেনে উঠার আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় যখন মায়ের কাছে গেলো, তার মা মলিন মুখে তমালের মাথায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলছিলেন ,’ বাবা , খিষ্টানের দেশে যাচ্ছ বৌমা কে নিয়ে নামাজ রোজা করবে। আমার নাতিকে ভালো ডাক্তার দেখাবে।’
তমালরা যখন দীর্ঘ যাত্রাপথে বুক ভরা আশা নিয়ে অজানা অচেনা এক দেশ কানাডার অভিমুখে চলছে ততক্ষনে ওদের সম্পর্কে আরো একটু জেনে নেওয়া যাক। তমাল রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে বোটানিতে মাস্টার্স কমপ্লিট করে হন্যে হয়ে চাকরি চেষ্টা করছে। একই ইউনিভার্সিটির সোসোলজি ডিপার্টমেন্টের সেরা ছাত্রী তিথির সাথে তমাল ইতিমধ্যে কিভাবে কিভাবে যেন এক বন্ধুর কল্যানে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। ওদিকে মধ্যবিত্ত পরিবারের ভয়ঙ্কর ধরণের রূপবতী তিথির বিয়ে নিয়ে তার বাবা আদা জল খেয়ে নেমেছে। তার বাবার ধারণা ইউনিভার্সিটিতে সুন্দরী মেয়েরা বিয়ে ছাড়া একেবারেই নিরাপদ না। সুতরাং, তমালের জন্য একটি চাকরির বিশেষ প্রয়োজন ছিল। পর পর দুই বার বি সি এস পরীক্ষায় অকৃতকার্য তমাল যখন হতাশার সাগরে নিমজ্জিত, ঠিক তখন তিথি নিজের ডিপার্মেন্টে লেকচারার হিসাবে জয়েন করলো। আরোও ভালো খবর হলো, মাস ছয়েকের মধ্যে ইউনিভার্সিটির এক বড় ভাই এর রেফারেন্স নিয়ে তমাল একটি পেস্টি সাইড কোম্পানিতে জয়েন করলো।
ওদের বিয়ের বছর দেড়েকের মাথায় তিথির একটি মিস ক্যারেজ হওয়ার পরের বছর তিথি যখন একটি মৃত সন্তান প্রসব করলো, সংসারে কিছুটা অশান্তি শুরু হলো। অবশ্য অশান্তি বাড়ির মানুষকে নিয়ে না, বাহিরের মানুষকে নিয়ে । আশেপাশের মানুষজন কানাঘুষা করতে লাগলো, ‘এই মেয়ে অপয়া…ইত্যাদি। তিথি ও তমাল শক্ত হাতে এসব সামাল দিতো, আরোও বছর দুয়েক পরে ওদের কোল জুড়ে তিতাসের জন্ম হলো। প্রায় দেড় বছর হতে চললেও তিতাস কথা বলতে না শেখায় সবাই বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকলো। হাঁটাও শিখলো অনেক পরে। বছর তিনেকের মধ্যে জানা গেলো গেলো তিতাস অটিস্টিক চাইল্ড।
ভীষণ রকমের শক্ত মনের মেয়ে তিথি এবার মানসিকভাবে প্রচন্ড ভাবে যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো , ঠিক তখনি তিথির কলিগরা তিথিকে পরার্মশ দিলেন তিতাসকে দেশের বাহিরে নিয়ে যেতে, উন্নত দেশে অটিস্টিক চাইল্ডদের ছোট থেকে অনেক ভালো ট্রিটমেন্ট করার পরে অনেকেই স্বাভাবিক ছেলেপেলেদের মতো স্কুল কলেজে পড়ে চাকরিবাকরি করে থাকে। তিথির ইতালি প্রবাসী এক মামার পরামর্শ ও সহযোগিতায় তিথি কানাডাতে পার্মানেন্ট রেসিডেন্টের জন্য এপ্লাই করলো এবং বছর দুয়েকের মধ্যে অবিশ্বাস্য ভাবে ওদের কানাডা ইমিগ্রেশনের সবকিছু ঠিকঠাক হয়েও গেলো।
কিন্তু বিপত্তি ঘটলো টাকা পয়সা নিয়ে। তিথি বাবার বাড়ি থেকে, কিছুটা সেই ইতালি প্রবাসী মামার থেকে সব মিলে লাখ সাতেক টাকা জোগাড় করেছে , কিন্তু আরো অন্তত চার পাঁচ লাখ টাকা লাগবে। বগুড়া পৌরসভার অবসর প্রাপ্ত হেড ক্লার্কের মেঝো সন্তান তমালের পক্ষে এতগুলি টাকা জমা করা একেবারে আকাশ কুসুম ব্যাপার। বন্ধু /বান্ধব আত্মীয় স্বজন , কলিগদের কাছ থেকে চেয়ে চিনতে হয়তো বড় জোর লাখ দুয়েক টাকা ম্যানেজ করা সম্ভব, তার পরেও তিন লাখ টাকা শর্ট। তমালদের কাছের আত্মীয় স্বজনদের অনেকের পক্ষেই একাই চার /পাঁচ লাখ টাকা ধার দেয়া কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু তমালের ভাগ্য প্রসন্ন হলো না। এতগুলো টাকা তমালকে কেউই ধার দিতে চাইলেন না। একদিন তমাল অনেক আশা নিয়ে সিলেটে তার বড় বোনের বাসায় যেয়ে টাকার কথা বললো, ‘বুবু দেখিস, একবার শুধু টাকাগুলি দিয়েই দেখ, আমি বিদেশে যেয়ে এক বছরের মধ্যেই তোদের সব টাকা ফেরত দিয়ে দিবো। তমালের বুবু রাতে খাবার টেবিলে তমালের কন্ট্রাক্টার দুলাভাইকে ইনিয়ে বিনিয়ে টাকার কথা বলতেই দুলাভাই বললেন,’শালা বাবু, দেশে যারা কিছু করতে পারে না তারাই বাইরে যায়, বাইরে যেয়ে হোটেল টোটেলে থালা বাসন মাজার চেয়ে নিজের পাড়ায় ডিসের লাইনের ব্যাবসা করো, দেখবে দুই হাত ভোরে টাকা আসছে।’ তমালের কপাল ভালো, ও একা বুবুর বাসায় এসেছিলো, তিথি এলে এসব শুনলে কেঁদে কেটে বুক ভাসাতো। অসুখ-বিসুখ, সাময়িক দারিদ্রতা প্রভৃতি বিপদ আপদে আপন জনকে কত সহজেই না চেনা যায় !!
সাধারণত, পৌরসভায় যারা দীর্ঘ দিন চাকরি করে তাদের টাকা পয়সার অভাব থাকার কথা না থাকলেও তমালের বাবার সততার কারণে আশেপাশের অন্যান্য বাড়ির তুলনায় বেশ মলিন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তমালদের বগুড়া শহরের একতালা টিনের চালের বাড়িটি দেখে তমালদের দারিদ্রতা সম্পর্কে বেশ আচঁ করা যায়। যাহোক, তমালের মায়ের বিশেষ তৎপরতায় তমালদের গ্রামের বাড়ির এক চিলতে জমি বিক্রি করে তমাল তিন লাখ টাকা টাকা জোগাড় করে ফেললো।
অবশেষে সবার কাছ থেকে জোড়াতালি দিয়ে জোগাড় করা পাঁচ লাখ টাকা আর তিথির বাবার বাড়ি থেকে ম্যানেজ করা সাথ লাখ টাকার সাথে মিলিয়ে সর্বমোট বারো লাখ টাকা নিয়ে সোনার হরিণ কানাডা যাওয়ার টিকিট কেটে স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান তিতাস সহ তমাল স্বপ্নের দেশ কানাডার উদ্দেশ্যে রওনা হলো ।
তমালের কল্পনার মধ্যেও ছিলোনা প্লেন জার্নি এতো বিরক্তকর হতে পারে। তবে, খাবারের ব্যাপারটি তমালকে বেশ ভালো লাগছে। ছোট ছোট কন্টেইনারে মজার মজার সব খাবার একের পর এক ট্রেতে করে দিয়ে যাচ্ছে। মাঝ পথে হিথ্রো এয়ারপোর্টে ছয় ঘন্টা বিরতিতে এয়ার কানাডা বিমানে তমালরা এবার সরাসরি টরেন্টোর পথে। ঘুম থেকে উঠে তমাল আড়মোড় ভেঙে দেখে তিতাস নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ওর সামনে ট্রেতে না খাওয়া খাবার গুলি স্তুপ হয়ে পাহাড়ের মতো হয়ে আছে। তিথি সীটের সাথে লাগানো ছোট্ট স্ক্রিনে প্লেনের গতিপথ মন দিয়ে দেখছে। কখন দিন হচ্ছে, কখন রাত হচ্ছে, টের ই পাওয়া যাচ্ছে না। । তিথি তমালকে বললো :
-‘কি যে মজা লাগছে আর প্রায় ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পিয়ারসন এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাবো। এই তোমার মজা লাগছে না ?”
-‘মজা লাগছে তবে তার চেয়ে আশংকার পরিমান একটু বেশি বোধ হচ্ছে । নতুন জায়গা, ইংরেজিতে ভালো করে কথাবার্তা বলা রপ্ত করতে হবে। পরাগ বন্ধুকে বলে রেখেছি বাসা ভাড়া ঠিক করে রাখতে, বলেছি আসার পরে টাকা পয়সা দিবো, পরাগ অবশ্য টেলিফোনে জানিয়েছে বাসার ব্যাবস্থা অলরেডি ঠিক করা হয়েছে, তবে বাসাটা এক বাঙ্গালী ভদ্রলোকের বেজমেন্টে দুই রুমের ইউনিট, আলাদা কিচেন, একটি ফুল ওয়াস রুম। মাটির নিচের বাসা কেমন যে হয় কে জানে, হয়তো সব সময় স্যাতস্যাতে থাকবে, দেখা যাক,কি আছে কপালে; তাছাড়া চাকরি বাকরি-র যে কি অবস্থা আল্লাহ্পাক জানেন।’
তমালকে কিছুটা সান্তনা দিয়ে তিথি বললো ,
-‘ অত বেশি চিন্তা করো নাতো, হবে একটা কিছু, জমানো টাকা দিয়ে যে কয়দিন চলে চলুক , তার পরে একটা কিছু চেষ্টা করা যাবে। কারখানায় চাকরি করলেও চৌদ্দ ডলারের নিচে তো আর দিতে পারবেনা, এসব দেশ হচ্ছে আইনের দেশ। চাকরি যদি নাই হয় প্রয়োজন হলে বেকার ভাতা দিয়ে চালিয়ে নিবো। বাচ্চাটার কথা একবার ভাবো, আমি শুনেছি এখানে অটিস্টিক বাচ্চাদের জন্য স্কুলে বিশেষ স্পেশাল প্রোগ্রাম আছে, দেখো, তিতাসের জন্য অনেক ভালো হবে।আল্লাহ আল্লাহ করে সুস্থ হয়ে গেলে আমাদের চেয়ে সুখী আর কে হবে বোলো।
আমার যে কি খুশি লাগছে, একেবারে কাছ থেকে নায়াগ্রা ফলস দেখবো, ঠান্ডার সময় বরফের উপর দিয়ে স্কেটিং করবো, আহা! কি যে মজা হবে !!’
তমাল খানিকটা দার্শনিকের মতো বললো :
দেখো, রবীন্দ্রনাথের স্কুল যাওয়ার মতো যেন আবার না হয়, আজ কানাডায় আসার জন্য
খুশিতে কাঁদিতেছো, দুদিন পরে হয়তো কানাডা থেকে পালিয়ে ফেলে আসা দেশে যাওয়ার জন্য কাঁদিবে , হাহাহা।’
ওদের হাসা হাসিতে তিতাস ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তিথি তিতাসকে বললো, ‘বাবা, রাতের খাবার খেয়ে নাও, আর ঘন্টা খানিকের মধ্যে আমরা টরন্টোতে পেয়েছে যাবো।’ তিতাস এমনিতেই খুবই কম কথা বলে, তবে প্লেনে আজ মায়ের সাথে কানাডা নিয়ে অনেক কথা শুনেছে, মায়ের কাছ থেকে কানাডা সম্পর্কে অনেক অনেক ধারণা নিয়েছে। এখন আগস্ট মাস, টরন্টোতে সামার চলছে, এখানে সামারে সবাই প্রচুর আনন্দ ফুর্তি করে, শীতের সময় মাঝে মাঝে তুষার ঝড় হয়ে সারা দেশ তুষারে ঢেকে থাকে। বচ্চার স্কুলে স্নো বল বানিয়ে এর ওর গায়ে ছুড়ে আনন্দ করে। সুতরাং তিতাস বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন ওরা টরেন্টোতে ল্যান্ড করবে।
রাত প্রায় সাড়ে আটটার মতো বাজে। তমালের বন্ধু পরাগ এক পরিচিত ড্রাইভারকে কন্ট্রাক্ট করে সাথে করে এয়ারপোর্টে নিয়ে এসেছে। এটি একটি একটি সাত সীটের ভ্যান। আসা যাওয়ায় সব মিলে একশ টাকা দিলেই চলবে। অপেক্ষা করার জন্য আলাদা করে টাকা দিতে হবে না। পরাগ ফুলের তোড়া নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে করতে বার বার সেলফোনে সময় দেখছে। বড় স্ক্রিনে দেখাচ্ছে তমালদের ফ্লাইট ইতিমধ্যে ল্যান্ড করেছে। পরাগ তমালের স্কুল জীবনের বন্ধু। ওরা একই সাথে বগুড়া জিলা স্কুলে পড়তো। পরাগ ইন্টার মিডিয়েট পড়ার পরে কিভাবে কিভাবে আমেরিকাতে পাড়ি জমায়, সেখানে কোনো কাগজ পত্র ছিল না। পরে কানাডায় এসে প্রায় বছর দশেক থাকার পরে এখানকার কাগজ পত্র পেয়েছে। পরাগ একটি ফ্যাক্টারিতে অনেক বছর হলো কাজ করে এখন সেখানে সুপার ভাইজার হয়েছে। অনেক দিন পরে বন্ধুর সাথে দেখা হবে, তাই পরাগ খানিকটা উতালা হয়ে আছে। তবে, অজানা আশংকায় পরাগের মনের ভিতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো, প্রবাস হচ্ছে খুব অদ্ভুত একটি জায়গা, এখানে চাকরি, আবহাওয়ার পাশাপাশি মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কও কেন জানি খুব স্থায়ী হয় না। বিশেষকরে নতুন যারা আসে কিভাবে কিভাবে যেন ভুল বোঝাবুঝি হয়ে অনেকদিনের সম্পর্ক নিমিষে তেতো হয়ে উঠে। তবে, তমালের উপর পরাগের অগাধ আস্থা, এক্ষত্রে সেরকম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে ইমিগ্রেশন ফেস করে তমালরা যখন বাহিরে এলো পরাগ আনন্দে খাস বাংলায় ‘দোস্ত’ বলে চিৎকার করে উঠলো, আসে পাশের মানুষগুলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দুই বন্ধু দুইজনকে কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে থাকলো। তিতাস চোখ বড় বড় করে আসে পাশের সাদা চামড়ার মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে আছে। তিথি একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে। নতুন ইমিগ্রান্টদের প্রচুর লাগেজ থাকে। তাই সাত সীটের ভ্যানে সমস্যা হওয়ার কথা না। পরাগ, তমাল ও ড্রাইভার মিলে ধরাধরি করে সব লাগেজ কিছুটা ভ্যানের পিছনের ট্রাংকে ও কিছুটা ভ্যানের পিছনের সীটে রাখলো । টরেন্টোর লোকাল সময় এখন প্রায় রাত প্রায় এগারোটার মতো বাজে। রাস্তা দেখে বুঝার উপায় নাই, এতো রাত হয়েছে, সারি সারি গাড়ি দ্রুত বেগে ছুঁটে চলেছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, রাস্তা ঘাটে কোনো গাড়ির হর্ন এর শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
হাই ওয়ে ধরে ট্যাক্সি এগিয়ে চলছে। পরাগ বসেছে ড্রাইভারের পাশের সীটে, ঠিক পিছনের সীটে দুই জানলার এক দিকে তিথি, আরেক দিকে তিতাস বসে অবাক বিস্ময়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছে। তমাল বসেছে মাঝখানে। পরাগের জন্য সুবিধাই হয়েছে , ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধুর সাথে বহু দিনের জমানো কথা বলেই চলেছে। ওদের গাড়ি যখন একটা বাংলো বাড়ির সামনে থামলো, পরাগ গাড়ি থেকে নেমে তমালকে বললো, ‘দোস্ত একশো টাকার কন্টাক্ট, দিয়ে দে। ‘
-তমাল অবাক হয়ে বললো,’ দোস্ত কি বলিস, টাকা মানে? , আমি তো টাকা নিয়ে আসেনি আমার সাথে শুধু ইউ এস ডলার।’
– অরে গাধা , আমি টাকা বলতে কানাডিয়ান ডলার মিন করেছি দোস্ত, যাক, আমি দিয়ে দিচ্ছি, তুই পরে একসময় দিয়ে দিস।’
বিষয়টি তমালের ভিতরে কেমন যেন খোঁচ করে লাগলো, তমাল ভেবেছিলো তার বাল্য বন্ধু হয়তো তার গাড়ি নিয়ে বন্ধুকে রিসিভ করার জন্য এয়ারপোর্টে এসেছে, যাহোক, আসতে না আসতেই, এক শত ডলার মানে বাংলাদেশের টাকায় প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় তমালের মুখ কিছুটা বিষন্ন দেখালেও পরাগের চোখে তা ঠিকই ধরা পড়লো, তবে পরাগ তেমন অবাক হলো না। সবে এসেছে , টাকা, ডলার, বাংলাদেশ, কানাডা প্রভৃতি পার্থক্য বুঝে উঠতে অন্ততঃ কিছুদিন সময় লাগবে।
(চলবে)