(সোনামণিদের জন্য সংগ্রহিত রুপকথা)
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে ছিলো এক রাজা ও এক রানী। তাঁদের ছিলেন ফুটফুটে চাঁদের মতো সুন্দর ছোট্ট একটি মেয়ে। তাঁর নাম ছিলো সিনড্রেলা। সিনড্রেলা ছিলেন ভীষন মায়াবী এবং মানবিক একজন শিশু। সে যখন বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন, তখন ফুলেরা তাঁকে সৌরভ ছড়িয়ে দিতেন। ঝাঁক বেঁধে পাখিরা এসে সুর করে গান শোনাতেন। ছোট ছোট ইঁদুর ও ইঁদুর ছানারাও তাঁর সঙ্গী হতেন। প্রিয় কুকুর-ব্রুনো, বিড়াল-লুসিফারও মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গী হতেন। লুসিফার সবসময় ব্রুনোর পেছনে লেগে থাকতেন। আর ইঁদুর ছানারা, লুসিফারকে দেখলেই ভয়ে কুঁকড়ে মুকরে যেতেন। সিনড্রেলা অবশ্য লুসিফারের কাছ থেকে সবাইকেই রক্ষা করতেন। মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করার জন্যে লুসিফারকে শাসনও করতেন।
সেই রাজ দরবারে হাতি শালে ইয়া বড়ো বড়ো হাতি ছদু! ঘোড়া শালে ছিলো ,শক্তিশালী সুন্দর সুন্দর ঘোড়া! সোনা-দানা, মণি-মুক্তা আর সম্পদে পরিপূর্ণ ছিলো রাজ-ভান্ডার। কারোরই কোন অভাব ছিলো না। ছিলো না কোন কষ্ট। প্রজারা সবাই থৈ-থৈ আনন্দের মধ্যে জীবন কাটাতেন। চারদিকে শুধু আনন্দ আর আনন্দ।
আর সিনড্রেলার-তো, সুখের সীমা ছিলো না। রাজা-রানী দু’জনেই সারাক্ষণ সিনড্রেলার যত্ন-আত্তি করতেন। সিনড্রেলা যাতে এতো টুকুনও কষ্ট না পান, সেই দিকে সবাই সবসময় সতর্ক থাকতেন। এভাবেই হাসি আর আনন্দে কেটে যাচ্ছিলেন, ছোট্ট শিশু রাজ কুমারী সিনড্রেলার দিনগুলি।
এ-তো, এ-তো সুখ, হাসি-আনন্দ, সিনড্রেলার জন্যে বেশি দিন স্থায়িত্ব হলো না। রানী মা এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন। কতো বড়ো বড়ো চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসা করালেন। কিন্তু, তিনি আর সুস্থ হলেন না। একদিন এক ঝড়ের রাতে সিনড্রেলার মা মৃত্যুর কোলে ঢ’লে পরলেন। সিনড্রেলা এ-তো অল্প বয়সে মা হাড়ালেন। রাজা সাহেব, তার ফুটফুটে শিশু মেয়েটির মুখের দিকে আর চাইতে পারছিলেন না। সদ্য মা হাড়ানো কচি মুখ খানার দিকে তাকালেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। নিরুপায় রাজা সাহেব, শুধু মাত্র তাঁর অসাধারণ ফুটফুটে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ভান্ত নিলেন।
ভদ্র পড়িবারের, দুটি কন্য সন্তান সহ একজন বিধবা মহিলাকে বিয়ে করে আনলেন। সিনড্রেলা নতুন মা ও মায়ের সঙ্গে দু’জন বোন পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন। নতুন বোনদের মধ্যে বড়টির নাম এনেস্টেশিয়া আর ছোটটির নাম ডিজেলা। প্রথম দিকে সৎ মা সিনড্রেলাকে যথাযথ স্নেহ-মমতায় ভুলিয়ে রাখলেন। নতুন মায়ের এতো আন্তরিকতা দেখে সিনড্রেলার বাবা নির্ভরতা খুঁজে পেলেন এবং তিনি বাণিজ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেলো। বাবা চলে যাবেন বাণিজ্যে। সিনড্রেলার আপনজন বলে আর কেউ রইলো না। নতুন মা, রাজা সাহেব কে অভয় দিলেন যে, বাবা এবং মায়ের কোন অভাবই তিনি সিনড্রেলাকে বুঝতে দিবেন না। সিনড্রেলার সৎ মা ছিলেন শান্ত, স্থির ও হিংস্র একজন মানুষ।
বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে শুরু হলো সিনড্রেলার উপর অমানুষিক নির্যাতন। এক সময় খবর এলো, প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পরে জাহাজ ডুবে গেছেন। সিনড্রেলার বাবাও মারা গেছেন। এবার সিন্ড্রেলার সৎ মা, তার সত্যিকারের মুখোশ উন্মোচন করলেন। সিন্ড্রেলার থাকার ঘর, এনেস্টেশিয়া ও ডিজেলাকে দিয়ে দিলেন। বাড়ির সমস্ত কাজের লোক বিদায় করে দিয়ে, তাঁরা যেসব কাজ করতেন, তার সবকিছুই ছোট্ট সিন্ড্রেলার উপর চাপিয়ে দিলেন। সিনড্রেলাকে থাকেতে দিলেন চিলেকোঠার পরিত্যক্ত ছোট্ট ময়লা আবর্জনায় জর্জরিত ঘরটিতে। সেখানে আলো নেই, বাতাস নেই। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিবেশ। আসবাব-পত্র কিছুই নেই। সিনড্রেলা অনেক ব্যথিত হলেন। তবে ভেঙ্গে পরলেন না। তার ছোট জানালায় মৌটুসি পাখিরা এসে গান শোনাতে লাগলেন। ছোট ইঁদুর ছানা ও ইঁদুরেরাও তাকে সঙ্গ দিতে থাকলেন। আর কুকুর, ব্রুনোতো আছেই। সিন্ড্রেলা সমস্ত কাজ শেষ হলে ঘুমিয়ে পরতেন। আর প্রতিদিনই একটি সুন্দর সকালের স্বপ্ন দেখে ঘুমাতেন। সব কিছু হাড়িয়েও সিনড্রেলা নতুন কিছু পাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকলেন।
এভাবেই কেটে গেলো কিছুকাল। সিনড্রেলা এখন বিয়ের উপযুক্ত হয়েছেন। এরই মধ্যে পাশের এক রাজ কুমারের বিয়ের জন্যে পাত্রী খোঁজা হচ্ছিলো। রাজ কর্মচারীরা ঘোষণা করলেন যে, প্রতিটি বিবাহ যোগ্য কুমারী রাজ কন্যাদের, রাজা সাহেব নিমন্ত্রণ করেছেন। সেখানে এক বিশাল খানা-পিনার আয়োজন করা হবে এবং একজন রাজকুমারীও যেন বাদ না পরেন, সেইভাবেই ঘোষণা দিয়ে গেলেন। সিনড্রেলা ঘোষণা শুনেছেন এবং রানী মায়ের কাছে, রাজ দরবারে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। সিন্ড্রেলার মা বললেন,
-অবশ্যই তুমি যাবে। তবে ঘরের সমস্ত কাজ শেষ করে যদি তুমি সময় পাও, তাহলেই যেতে পারবে।
সিনড্রেলার চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠলো। কৃতজ্ঞতায় বললেন,
-জী, মা, আমি সমস্ত কাজ শেষ করেই যাবো।
মা বললেন,
-অবশ্যই তুমি যাবে।
-জী, আচ্ছা। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মা।
-তোমাকেও ধন্যবাদ সিনড্রেলা।
সিনড্রেলার যাওয়ার কথা শুনে এনেস্টেশিয়া ও ডিজেলা ভীষণ রেগে গেলেন। তাঁরা দু’জনেই সমস্বরে মা’কে বললেন,
-মা, তুমি সিনড্রেলাকে যাওয়ার অনুমতি দিলে?
-দিয়েছি, কিন্তু বলেছি যে, যদি সমস্ত কাজ শেষ করতে পারো তবেই যাবে। তাছাড়া সেখানে যাওয়ার মতো সিনড্রেলার প্রয়োজনীয় পোশাকও নেই। একজন গৃহ পরিচারিকাকে নিশ্চয়ই রাজদরবারে প্রবেশ করতে দিবেন না। এতে তোমাদের ভীত হওয়ার মতো কোন কারণ দেখছি না।
মায়ের কথ শুনে এনেস্টেশিয়া ও ডিজেলা অট্ট হাসিতে ফেটে পরলেন। এবং বলতে থাকেলেন,
-মা বলেছেন, যদি! হা-হা-হি-হি!
এনেস্টেশিয়া আর ডিজেলা সবচেয়ে ভালো ভালো কাপড় খুঁজে বের করলেন। কিছু অপছন্দের কাপড় তাঁরা জানালা দিয়ে ফেলেও দিলেন। ছোট্ট ইঁদুর, ইঁদুর ছানা আর মৌটুসি পাখিরা, সেগুলো কুড়িয়ে নিলেন। সিনড্রেলা তাঁর মায়ের একটি পুরনো সুন্দর পোশাক বের করলেন। পোশাকটি অনেক পুরনো হয়ে গেছে। এটি পরে কি রাজদরবারে যাওয়া যাবে? সিনড্রেলাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছিলো। সিনড্রেলাকে চিন্তিত দেখে মোটুসি পাখি ইঁদুর ছানা আর ছোট ইঁদুরেরা বললেন,
-তুমি মন খারাপ করোনা সিনড্রেলা। কিছু সময় অপেক্ষা করো, দেখো, আমরা কি করি! তারপর মৌটুসি পাখি আর ইঁদুরেরা মিলে সিনড্রেলার মায়ের পুরনো জামাটিতে বিভিন্ন রঙ-বেরঙের পাথর, জরি আর রঙিন রঙিন সূতার সমন্বয়ে অপূর্ব সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুললেন। সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার! সিনড্রেলা খুব খুশি হলেন।পাখি আর ইঁদুরদের আদরে আদরে ভরিয়ে তুললেন।বললেন,
-অনেক ধন্যবাদ তোমাদের। তোমরা সব্বাই আমার অনেক অনেক আপন। আমি আজকের দিনের জন্যে, তোমাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো।
-মোটুসি পাখি ও ইদুরেরাও ভীষণ প্রীত হলেন। তারা সমস্বরে বললেন,
-সিনড্রেলা, তুমি আমাদের মা! তুমি আমাদের কতো ভালোবাসো! সময় মতো খেতে দাও। বুক দিয়ে আগলে রাখো। আমরা কি তোমার জন্যে এইটুকু কাজ করতে পারি না? আমরা ,আমাদের মায়ের অফুরন্ত হাসি আর অনাবিল আনন্দের জীবন দেখতে চাই।
পাখি আর ইঁদুরদের কথা শুনে সিনড্রেলা কেঁদে ফেললেন। ইঁদুর ছানাদের কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেলেন। ব্রুনো ও লুসিফারও সিনড্রেলার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সিনড্রেলা তাঁদের দু’জনের মাথায়ও হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। সিনড্রেলার এমন মায়াবী স্নেহ-মমতায় মৌটুসি পাখির ঝাঁক, ইঁদুর, ইঁদুর ছানা, কুকুর, বিড়াল সবাই বেজায় খুশি হলেন।
রানী মা, এনেস্টেশিয়া আর ডিজেলাকে সঙ্গে নিয়ে রাজ দরবারের নিমন্ত্রণে অংশ গ্রহণের জন্যে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। সিনড্রেলাও তৈরি ছিলেন যাওয়ার জন্যে। যদিও সিন্ড্রেলা খুব সাধারণ কাপড় পরেছেন।তাতেই সিনড্রেলাকে অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছিলো। ঠিক যেন আকাশ থেকে একজন অপ্সরী নেমে এসেছেন। সিনড্রেলাকে দেখার পর রানী মা, এনেস্টেশিয়া এবং ডিজেলা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তাঁরা দু’জনেই দেখলেন, যে সমস্ত কাপড়ের টুকরো, পাঁথর ও পুঁথির পরিত্যক্ত অংশ তাঁরা ফেলে দিয়েছিলেন, তা দিয়েই নকশা করা পোশাকে তাঁদের চেয়েও অনেক অনেক বেশি সুন্দর লাগছে সিনড্রেলাকে। তাঁরা দুজনেই সমস্বরে চেঁচিয়ে বললেন,
-কাজের মেয়ে, চোর!
বলেই দু’জনে মিলে সিন্ড্রেলার পোশাক টেনে ছিড়ে ফেললেন। আর রানী মা ভেতরে ভেতরে ভীষণ পুলক অনুভব করছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন, সিন্ড্রেলা যেন কোনভাবেই রাজ দরবারের নিমন্ত্রণে যেতে না পারেন। তিনি মুখে উপহাসের হাসি দিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে টমটম গাড়ি হাঁকিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। মৌটুসি পাখি্র ঝাঁক, ইঁদুর ছানা,ইদুর, ব্রুনো হত বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাদের কারো মুখেই কোন সাড়া-শব্দ নেই। সিনড্রেলা কষ্টে দুঃখে দিশা হাড়িয়ে ফেললেন। নিমিশেই ছুটে গেলেন তার মায়ের কবরের কাছে। মায়ের কবর জড়িয়ে ধরে বুক ফাটা বেদনায় কান্না করতে লাগলেন। মোটুসি পাখি, ইঁদুর ছানা, ব্রুনোও অঝর ধারায় কাঁদতে থাকলেন। সিনড্রেলার কান্না শুনে আকাশ আলো করে নেমে এলেন এক পরী। মুহূর্তেই সিনড্রেলাকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খেলেন।গভীর মমতায় বললেন,
-তুমি কাঁদছো কেন মামণি? কি হয়েছে তোমার? তুমি শান্ত হও মামণি! কেদো না। তুমি সেখানে যেতে চাও? অবশ্যই যাবে। আমি এখনই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
কথা শেষ করে পরী মা, তাঁর হাতের জাদুর লাঠি ঘুড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে সিনড্রেলার পরণে রাজকীয় পোশাক হয়ে গেলো। মণি-মুক্তা খচিতো সেই পোশাক! পৃথিবীর কারো পক্ষেই হয়তো কেনা সম্ভব হবে না। হীরার গহণা, মাথায় রাজকীয় মুকুট, কাঁচের অপূর্ব জুতা। সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার! সামনে প্রস্তুত রয়েছে টম টম গাড়ি। চালকের পরনেও জরির জামা জুতো। সিনড্রেলার আনন্দের আর সীমা নেই। ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলেন। পরী মা, সিনড্রেলাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং সতর্ক করে দিলেন এই বলে যে,
-শোন মামণি, তোমার এই পোশাক, গাড়ী আর লোকজনের মেয়াদ শুধুমাত্র আজ রাত বারোটা পর্যন্ত স্থায়ী হবে। রাত বারোটার পূর্বেই তোমাকে ওখান থেকে ফিরে আসতে হবে। নইলে তুমি ভীষণ লজ্জায় পরবে। এটা কোনভাবেই তোমাকে ভুলে গেলে চলবে না। মনে রেখো, রাত বারোটা, কেমন?
সিনড্রেলা বললেন,
-জি,পরী মা, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি রাত বারোটার পূর্বেই ফিরে আসবো। আপনি আমার জন্যে দোয়া করবেন।
-অবশ্যই মামণি। অনেক অনেক দোয়া তোমার জন্যে। তুমি আর সময় নষ্ট না করে যাত্রা শুরু করো। এবার তোমার আলোয় আলোয় মুক্তি মিলেবে। ভালো থেকো। বিদায়!
-বিদায়!
সিন্ড্রেলা গাড়ীতে উঠে বসলেন। মুহূর্তেই গাড়ী বাতাসের বেগে ছুটে চললো রাজ দরবারের উদ্দেশে। চারদিকে সুবাস ছড়িয়ে পরতে থাকলো। পরী মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন এবং মনে মনে ভীষণ খুশি হলেন। এবার যদি সিন্ড্রেলার জীবনের কষ্টের দিনের অবশান হয়! কতো কতো রাজকুমারী এসেছে রাজ দরবারে! কতো মণি-মুক্তা খচিত পোশাক পরে তাঁরা এসেছেন! সিনড্রেলার গাড়ী এসে থামলো রাজ দরবারের সদর দরজায়। সিনড্রেলা গাড়ী থেকে নেমে, রাজকীয় কায়দায় সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকলেন। সিনড্রেলাকে দেখে আগত অতিথি, রাজা, প্রজা সবাই-ই হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা ভাবতে থাকলেন, কে এই রাজকুমারী? কি তাঁর পরিচয়? এতো সুন্দর দেখতে! এমন পোশাক, গহণা আর রাজকীয় সবকিছু তাঁরা কখনওই দেখেন নি। সিনড্রেলার রুপের ঝলকে, পুরো রাজ দরবার ঝলমল করতে থাকলো। চারিদিক সুবাস ছড়িয়ে পরলো।
রাজকুমার সিনড্রেলাকে দেখা মাত্রই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। নিজে সিনড্রেলাকে হাত ধরে নিয়ে খাস কামড়ায় চলে এলেন। রাজকুমারের সে-কি আনন্দ! সিনড্রেলাও ভীষণ খুশি হলেন। সমস্ত রাজকুমারীদের আশা নিরাশায় ডুবে গেলো। তাঁরা নিজেরা একে অন্যের সঙ্গে সিনড্রেলার রূপ আর রাজকীয় সবকিছু নিয়ে বলাবলি করতে শুরু করলেন। এদিকে সিনড্রেলা ঘড়ির দিকে তাকাতেই দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো। অল্প সময় বাকী আছে রাত বারোটা বাজতে। সিনড্রেলা রাজকুমারের কাছে থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ফিরে চললেন। রাজকুমার কোন ভাবেই সিন্ড্রেলাকে যেতে দিতে চাচ্ছিলেন না। তবুও সিনড্রেলা সব বাঁধা উপেক্ষা করে ছুটে চললেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সিনড্রেলার পা থেকে একটি জুতা খুলে গেলো। সিনড্রেলা, একবার ভাবলেন জুতাটি তুলে নিবেন। পরে ভাবলেন দেরি হয়ে যাবে। পিছনে রাজকুমার, রাজকর্মচারী- সবাই ছুটছে। কিন্তু সিনড্রেলা থামলেন না। গাড়ীতে বসা মাত্রই চালক ঝরের গতিতে গাড়ী হাঁকালেন। প্রাসাদের কাছা-কাছি যখন এলেন, তখন সবকিছু আগের মতো হয়ে গেলো। সিনড্রেলার চারদিকে মৌটুসি পাখি, ইঁদুর ছানা, ইঁদুর আর ব্রুনো। এরা সবাই বিভিন্ন সাঁজে সিনড্রেলার সঙ্গী হয়েছিলেন। সবাই মিলে ভীষণ খুশি হলেন।
এদিকে আগত রাজকুমারীর খোঁজে রাজ কর্মচারীরা, সমস্ত রাজ্য তন্ন তন্ন করে খোঁজ করতে থাকলেন। সিনড্রেলার নাম, পরিচয় কারোরই জানা ছিলো না। যে জুতাটি সিনড্রেলা ফেলে এসছিলেন, শুধুমাত্র সেটিই রাজ্যের সকল রাজকুমারীরদের পরিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। এ-ই জুতা যাঁর পায়ে লাগবে, সে-ই হবেন রাজকুমারের জীবন সঙ্গিনী।
কিন্তু কারো পায়েই সেই জুতা লাগলো না। সিনড্রেলাদের প্রাসাদেও আসবেন জুতার মাপ নিতে। এনেস্টেশিয় ও ডিজেলা আগে থেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। এদিকে রানী মা সিনড্রেলাকে তাঁর চিলেকোঠার ঘরে আটকে রাখলেন, যাতে সিনড্রেলা জুতার মাপ দিতে না পারেন, সেই উদ্দেশে।
সিনড্রেলা তাঁর কাছে থাকা জুতাটি স্বযত্নে রেখে দিয়েছিলেন এবং সব কিছুই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলেন। সিনড্রেলা নিজের প্রতি ভীষণ আস্থাশীল ছিলেন।
ডিজেলা আর এনেস্টেশিয়া অনেক চেষ্টা করেও জুতার ভিতর তাদের পা প্রবেশ করাতে পারলেন না। রাজ কর্মচারীরা নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। কিছু দূর যেতেই তাঁরা সিনড্রেলার মোলায়েম সুরের অপূর্ব গান শুনতে পেলেন। তাঁরা থামলেন। রানী মা’কে বললেন,
-কে গান গাইছে?
-আমাদের বাড়ির গৃহ পরিচারিকা।
-আমরা তাঁর পায়ের মাপও নিবো।
-তা কি করে হয়? সে-তো একজন সামান্য গৃহ পরিচারিকা। তাঁর কি যোগ্যতা আছে এই জুতার মাপ দেওয়ার?
-আমাদের আদেশ আছে, প্রত্যেক কুমারী মেয়েকে জুতার মাপ দেওয়ার।
রানী মায়ের বাঁধার মুখেও তারা সিনড্রেলার ঘরের দিকে ছুটলেন। এটা দেখামাত্রই রানী মা সিনড্রেলার কাছে রক্ষিত জুতাটি কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেললেন। রানী মায়ের এমন নিষ্ঠুর আচরণে সিনড্রেলা ভীষণ আঘাত পেলেন। এতো দিন ধরে রানী মায়ের সব রকম অত্যাচার নিরবে সহ্য করলেও, আজকে জোড়ালো ভাবে প্রতিবাদ করলেন। বেদনায়, কষ্টে সিনড্রেলা চিৎকার করে বললেন,
-আপনি এটা কেন করলেন? কেন?
ততক্ষণে রাজ কর্মচারীরা সিনড্রেলার ঘরে চলে এসেছেন। তাদের কাছে থাকা জুতাটি সিনড্রেলা, পায়ে দিতেই চমৎকার ভাবে সেটা লেগে গেলো। তাঁরা খুঁজে পেলেন তাদের রাজকুমারের পছন্দের রাজকুমারীকে। সিনড্রেলাকে।
চারিদিকে থৈথৈ আনন্দ। ছোট ইঁদুর ও ইঁদুর ছানারা নাচতে শুরু করলো। মৌটুসী পাখিরা ঝাঁক বেঁধে এসে গান শুরু করলো। ব্রুনো এলো। লুসিফারও এলো বাহারী সাঁজে। শুধুমাত্র রানী মা, এনেস্টেশিয়া এবং ডিজেলা হিংসায় এলেন না। তাতে কি! পরী মা আকাশ থেকে দেখলেন। তাঁরাদের আলো, ধরে ধরে ছড়িয়ে দিলেন। ফুল পরীরা, ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিলো। সমস্ত রাজ প্রাসাদ সৌরভে ভরে গেলো। সাত দিন, সাত রাত খানা-পিনা চলতে থাকলো। সিনড্রেলার দুঃখের অবসান হলো।
(ছোট্ট সোনামণি তোমরা কভিড-১৯ এর জন্যে অনেক দিন ঘরে বসে আছো। তাইতো আমি তোমাদের জন্যে সংগৃহীত রুপকথার গল্প সিনড্রেলা লিখেছি। তোমাদের কেমন লাগলো, তা কমেন্ট বক্সে লিখতে ভুলবে না কিন্তু?)
হাফিজ ভাইর জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভকামনা।
হাফিজ ভাইর জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভকামনা।