পূর্ব প্রকাশের পর:
আমার জন্য চিন্তা করিস না, আমি ভালো হয়ে যাবো।তুমি কি ঔষধ ও খাওয়া দাওয়া ঠিক ভাবে করো ? করি ।আচ্ছা আমি এখন ঘুমাই, রহমান টেলিফোন রেখে দিলো। আজিজ পুনরায় টেলিফোন করে রেনুকে বললো ,ভাবি, তুমি আমাকে বাবার অবস্থা জানাবে । আমি বাবার জন্য অনেক দুশ্চিন্তা করি । বুঝতে পারো,আমি অনেক দূরে থাকি এবং জট করে দেশে আসা যায়না,তার জন্য একটা প্রিপারেশন লাগে । যেই কোম্পানিতে কাজ করি, চাইলেই ছুটি পাওয়া যায়না । তথাপি প্রয়োজনে চলে আসবো । তুমি দুশ্চিন্তা করবানা, আমরা এখানে আছি এবং দেখাশুনা করছি । রেনু লংডিস্ট্যান্স টেলিফোন দীর্ঘায়িত না করে রেখে দিলো । এদিকে দিনার বান্ধবী ও তার মা বাবা রহমানকে দেখতে আসার কথা । তাদেরকে আপ্যায়ণ করার মতো ঘরে তেমন কিছুই নাই । দিনা কল দিয়ে কন্ফার্ম করতো মারুফা এবং তার মা বাবা আসবে কিনা? মা, তুমি সে জন্য চিন্তা করবে না । আমি মারুফাকে বলছি ,যদি আসে পুনরায় কল দিয়ে জানাবে । আমি আরুকে দোকানে পাঠিয়ে কিছু নিয়ে আসি । প্রয়োজনীয় কিছু বিসকুট ও কলা নিয়ে আসতে রেনু কাগজে লিখে আরুকে দোকানে পাঠালো ।বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে , আরু তুই ছাতা নিয়ে যা ।রেনু বসে না থেকে সেমাই, ডালপুরি, চা ঘরে করার জন্য কিচেনে গেল । দিনা বাবাকে ঔষুধ দিয়েছো ? মা আমি এখনই দাদুকে ঔষুধ দিয়েছি এবং থার্মোমিটারে দিয়ে দেখছি জ্বর তেমন নাই । রহমান উঠে বসেছে ।দাদু, তুমি কি ওয়াশরুমে যাবে? যাবো । দিনা দাদুকে হাত ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে আস্তে করে দরজা ভেজিয়ে দিলো এবং বললো,”দাদু তুমি ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করবেনা । ওয়াশরুম সারার পর রহমান কোনো সাহায্য না নিয়ে বিছানায় এসে বসলো । ” দিনা দাদুকে লেবুর শরবত পান করালো ।রহমান দিনার হাত ধরে ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসলো, শরীরটা একটু ভালো লাগছে। তখন ও বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছিলো ।মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকাচ্ছে ।ইলেকট্রিসিটি এই আসে এই যায় ।কিন্তু ঠান্ডা হিমেল হাওয়া রহমানের ভালো লাগছে । তাই কিছু সময় বসে রইলো। আরু প্রায় ভিজে ভিজে দোকান থেকে টুকিটাকি নিয়ে ঘরে ঢুকলো । প্ৰায় এক ঘন্টা বসার পর রহমান বিছানায় এসে বসলো ।রেনু দাদুর জন্য রাতের হালকা খাওয়া নিয়ে আসলো ।কিন্তু রহমানের খাবার রুচি নাই,রাগান্বত স্বরে বললো, খাওয়া নিয়ে যাও ।দিনা ইনসিস্ট করে ও রাজি করাতে পারলো না । তাই সামনে টেবিল এ খাওয়া ঢাকনি দিয়ে রেখে দিলো ।রাত অনেক হয়েছে। মারুফা টেলিফোন করে জানালো যে তার বাবা আফজাল বৃষ্টি অথবা কাজে আটকা পড়েছে তাই আজ আসবে না । রেনু কিচেন থেকে সবার জন্য গরম গরম ডালপুরি ও চা নিয়ে টেবিলে রাখলো । রহমান আগ্রহ নিয়ে চা ও ডালপুরি খাইলো ।
পরদিন সকালে দিনা দাদুকে ঔষুধ ও নাস্তা করিয়ে ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরী হলো। রেনু এসে বললো, তুমি আরও দুই একদিন দাদুর কাছে বাসায় থাকো। মা, আমার আজ কয়েকটা জরুরি ক্লাস আছে ,সেরে রাইট এ ওয়ে বাসায় চলে আসবো।দাদু ওর দিকে হাসি মুখ করে তাকালো ।দিনা ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্বে আর একবার দাদুকে আদর করলো। এতে রহমান সাহেবের চোখে পানিতে চল চল করে উঠলো। আস্তে আস্তে হাত ইশারা করে দিনাকে বিদায় দিলো।
কি জানি কি মনে করে রহমান আজ খানিকটা ইমোশন হয়ে পড়লেন । রেবেকার মৃত্যর পর রহমান বড় একা। রেনু সকালে ঘরের কাজ শেষ করে স্কুলে চলে যায় ও ফিরতে বিকাল ৫টা বাজে । সে গার্লস স্কুলের টিচার ।স্কুলে ক্লাস নেয়া,ওদের হোমওয়ার্ক দেখা, সংসারের দায়িত্ব এ মিলিয়ে ব্যাস্ত থাকতে হয় । ক্লাস শেষে মাঝেমধ্যে নিউ মার্কেট কাঁচা বাজারে চলে যায়,বাজারে প্রচন্ড ভিড়,বাজার সেরে ঘরে ফিরতে দেরি হলে স্কুল থেকে বাসায় জানিয়ে দেয় ।তাছাড়া ঢাকা শহরের রাস্তার জান জোটের যে অবস্থা,তাতে অনেক সময় আসা যাওয়ার জন্য লেগে যায় । এর মধ্যে রহমানকে দেখাশুনার জন্য কাজের ছেলে থাকে।আরু ঘন্টায় ঘন্টায় দাদুর খোঁজ খবর নেয়। তাছাড়া আজিজ ,মজিদ বা সাকিলা কেউ না কেউ টেলিফোন করে।রহমান একা থাকলে দুনিয়ার চিন্তা মাথায় জমা হয়।
১৯৭০সনে দেশের বাড়িতে বাবার জমি বিক্রি করে এবং নিজেদের কষ্টার্জিত সামান্য জমানো দিয়ে ধানমন্ডির ৩কাঠা প্লট খরিদ করে। দুই জনে অনেক পরিশ্রম করে এই একতলা বাড়িটা করেন ।হাউস বিল্ডিং এর লোন ও বাড়ির কাজ এখন ও শেষ হয়নি । রহমানের কাস্টম ইন্সপেক্টর চাকুরী,বাবার কড়া নির্দেশ কোনো ঘুষ নেয়া যাবেনা, এই শর্তে চাকুরীতে যোগ দিয়ে ছিলেন ।সহকর্মীরা সবাই ডানহাত বামহাত করে বড়োলোক হয়েছে।রহমান সাহেব অফিসে অবহেলিত ।সহকর্মীদের অনেকের প্রমোশন হয়েছে।ওরা বড় সাহেবের নেকনজরে ছিল।রহমান সাহেব সাদাসিদে মানুষ। চাকুরী জীবনে তার প্রমোশন হয়নি।কাপড় চোপড়,চলা পেরাতে ছিলেন আনস্মার্ট।এক প্যান্ট এর এক শার্ট তাও কোনোদিন ইস্তিরি করতেন না। দুপুরের লাঞ্চ করার জন্য টিফিন ক্যারিয়ার, রোজ একই খাবার রুটি, ডাল অথবা হালুয়া বা আলু ভাজি আর এক কাপ চা ।সামনেই বসে মিস ডলি, বেশ লম্বা গোলগাল চেহারা স্মার্ট মহিলা ।রোজ নুতন নুতন ড্রেস পরিবর্তন করে অফিসে আসে ।প্রতিদিন লাঞ্চ টাইম এ জিজ্ঞাস করে ,”রহমান ভাই ,আজ কি এনেছেন, রুটি ডাল ?” বড়োই লজ্জা লাগে ,অনেক সময় জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকি । এ জগতে সহজ সরল মানুষের সমস্যা অনেক ।অনেক সময় অন্যদের কাজের বোঝা ও টানতে হতো । অফিসে অনেক হয়রানির স্বীকার ও হতে হয়েছে । সবই সরল ভাবে সহ্য করেছি । কাজ থেকে অবসর নেয়ার এক বৎসর বাকি ।উপরওয়ালা প্রমোশন দিয়ে চিটাগাং বদলি করতে চাইলো । রেবেকা ও ছেলেমেয়েরা বললো তোমার এ প্রমোশন নিয়ে বাহিরে যাওয়া ঠিক হবে না । মনের দুঃখে প্রমোশন একসেপ্ট করলাম না ।
রেবেকার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে কাজ,৩০০ টাকা মাসিক মাইনে এবং নিজের চাকুরী মিলিয়ে কোনোরকমে নুন আন্তে পন্থা পুড়ায় সংসারের অবস্থা ।মাজিদ, আজিজ ও সাকিলার দুধ,জামা কাপড়,নিত্য অসুখ তো লেগেই আছে । তাছাড়া গ্রাম থেকে লোকজন প্রতি মাসে থাকতো,এরা অনেক সময় বিছানা পত্র নিয়ে ও আসতো।কারো চাকুরির ইন্টারভিউ ,তদবির , কারো চিকিৎসা ,কেউ বা চিড়িয়াখানা ও ঘুরে ঘুরে শহর দেখার শখ।একবার বাসায় ঢুকলো আর বের হওয়ার নাম নাই, বললে রাগ করে এবং পাছে দুর্নাম করে । কারো আবার যাওয়ার ভাড়া নাই,পকেট থেকে ২৫ টাকা,৩০ টাকা দাও । অনেক সময় দেখা যেত খেতে বসছি অথবা কালকের পুরানো খাবার দিয়ে আজ শেষ করবো বলে রেবেকা মনস্থির করলো,এসময় বলা নাই কওয়া নাই কেউ এসে বাসার করা নাড়লো ।গেট খুলে দেখলুম দেশ থেকে একজন এসে হাজির সঙ্গে দেশের গাছের কলা বা একটা কাঁঠাল নিয়ে এসেছে.। অনেক দিনের অসুস্থ ,এখনই হাসপাতাল নিতে হবে। এসব পরিস্থিতি রেবেকা আর আমাকে সামলাতে হয়েছে।আমি যদি উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাই ,রেবেকা বাধা দিতো। রোগীতো হসপিটালে পাঠানো হলো, ডিউটি এখানেই শেষ নয়,রোগীর দেখা শুনার জন্য কেউ না কেউ আসছে ।তার থাকা খাওয়ার ব্যাবস্তা,এসব দায়িত্ব এড়ানো যাবেনা ।এতো অনেক দিনের পরিকল্পনা । রেবেকা আমার অবস্থা দেখে হাসতো কারণ এরা সবই আমার লোক ।একদিনের কথা,আমি কাজ থেকে এসেছি,রেবেকা আমাকে দেখেই বলে তুমি বস,আমি ডালপুরি বানাচ্ছি,নিয়ে আসি,একত্রে চা খাবো।ঘরে ঢুকে দেখি কে একজন বিছানা পেতে ফ্লোরে এ ঘুমাচ্ছে । আমি ঘর থেকে রান্নাঘরের দিকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ,উনি কে।রেবেকা হাসতে হাসতে বললো, আমিতো চিনিনা। উনি তোমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ হবে হয়তো।তুমি মাথা ঠান্ডা করো এবং হাতমুখ ধুয়ে বস,আমি ডালপুরি আর চা নিয়ে আসি এবং একত্রে খাবো।আমি ঘরে ঢুকে দেখি উনার ঘুম ভাঙছে,উঠে বসছেন।আরে এতো আলী ভাই! বাড়ি থেকে আমার ঠিকানা নিয়ে এসেছেন, সঙ্গে দুই জোড়া নারিকেল ও গোটা পিঠা নিয়ে এসেছেন । বললেন তোমার ভাবি তোমাদের জন্য গোটা পিঠা তৈরী করে দিয়েছে ।আমি বললাম,ভালো । দেশে জমিজমা নিয়ে সমস্যা,আমাকে দেখাবেন ও মামলা করবেন। আলী ভাই,আমি কাগজপত্র আর মামলা বুঝিনা ।
কলাবাগানে ছোট্ট টিনের ঘরে থাকতাম। ঘর ভাড়া মাসিক ১৫০টাকা ,তখোনো ঢাকায় গ্যাস আসেনি এবংকেরোসিনের স্টোভে রান্না হতো।রেবেকার বেতন ও নিজের মিলিয়ে মাসের প্রথমে ছোট্ট পকেটের মতো ভাগ ভাগ করে রাখা হত যেমন বাড়ি ভাড়া,দৈনিক বাজার, ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা এবং নিজেদের যাতায়াত । প্রতি মাসেই দোকান বাকি। খাওয়া খরচ কমিয়ে দিয়েছি,ভয়ে কম খেতাম ,কোনো আত্মীয় স্বজনের দাওয়াতে ,বিয়ে খরচের ভয়ে যেতাম না।কম খাওয়ার দরুন নিজে,স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা দুর্বল হয়ে গিয়েছে । সবার শরীরের ওজন কমে গিয়েছে । ডাক্তারের কাছে গেলেই অভিযোগ,শরীর অনেক দুর্বল, ভালো খাওয়াদাওয়া করবেন,ভিটামিন বি.কমপ্লেক্স এবং আরও কিছু ট্যাবলেট দিতো ।
ক্রমশ :