রেবেকা সারা রাত ঘুমাতে পারছে না শরীরের ব্যাথা বেদনার জন্য। সে ব্যথায় ও জ্বরে প্রলাপ বকছে,ওই যে দেখো কি সুন্দর সাদা ঘোড়া দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে , ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, আমাকে নিতে এসেছে ।

রহমান সাহেব কাছেই ঘুমানো, উঠে বলে কে তোমাকে নিতে এসেছে?

রেবেকার কপালে হাত দিয়ে দেখে প্রচন্ড জ্বর। ওহ ! তোমার প্রচন্ড জ্বর।

রেবেকা আপন মনে বলেই যাচ্ছে ,ওই যে দেখো সাদা ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে আমাকে নেয়ার জন্য । মজিদ ও রেনু তাদের রুম থেকে এসে বাহিরের দরজা খুলে বলে আম্মু আমরা কিছুই দেখছি না,বাহিরে মুসল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে , সে আওয়াজ তুমি শুনতে পাচ্ছো ।

না, বৃষ্টি না, ওই যে আমাকে নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে !

রহমান বলে এত এত চিকিৎসায় তোমার মায়ের কোনো কাজ হলো না,আমরা আর কি করতে পারি?

মজিদ বলে আম্মুকে একবার ইন্ডিয়া নিয়ে দেখিয়ে আনতে হবে ।

রেবেকার শরীরে আস্তে আস্তে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে । শরীর এত দুর্বল যে ও আজকাল বিছানা থেকে উঠতে ও পারছে না । মজিদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওকে শেষ বারের মতো একবার ইন্ডিয়া চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাবে । রেবেকা বলে আমাকে নিয়ে কেন অযথা টানাটানি করবি?

মজিদ বলে আম্মু, আমাদের মনের সান্তনার জন্য তোমাকে একবার ইন্ডিয়া নিয়ে যাবো এবং দেখিয়ে নিয়ে আসবো ।

রেবেকা বলে তোরা ডাক্তার আজমলকে একবার ডাক, আমি কিছু কথা বলবো এবং তার পর যা কিছু সিদ্ধান্ত নিস্ ।

মজিদ বলে আব্বু তুমি আংকেলকে কাল বলবে একবার বাসায় এসে আম্মুর সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিতে ।

বিকেলে রহমান সাহেব ডাক্তার আজমলের চেম্বারে গিয়ে বলে মজিদ রেবেকাকে নিয়ে একবার ইন্ডিয়া ক্যান্সার হাসপাতালে দেখাতে চায়, তোমার কি অভিমত?

ডাক্তার আজমল বলে তুমি বিকেলে একবার ডাক্তার মনোয়ারার সঙ্গে আলাপ করে দেখো, ওর কাছে সব ধরণের রিপোর্ট আছে, সে যদি বলে ইন্ডিয়া নিয়ে গেলে ভালো হবে, তাহলে নিয়ে যাবে, আমি এর মধ্যে খারাপ কিছু দেখছি না ।

রহমান সাহেব গ্রীন রোডে ডাক্তার মনোয়ারার চেম্বারে গিয়ে সিরিয়েল লাগিয়ে বসে আছে । এক সময় ডাক পড়ে, সব বৃত্তান্ত শুনার পর, ডাক্তার বলে একবার নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনতে পারেন । আমার জানা শুনা ডাক্তার আছে, এক ক্যান্সার হাসপাতালে, মন্দ কি ওর মতামত জেনে নিলেন । আমি ওকে একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি , ওকে এই চিঠি দেবেন যত্ন সহকারে দেখে দেবে । ইন্ডিয়া যাওয়ার পূর্বে, হাসপাতাল থেকে সব রিপোর্ট নিয়ে যাবেন । সে সঙ্গে সঙ্গে একটা চিঠি লিখে দিয়ে বলে গুড লাক ।

রাতে ডাক্তার আজমল বাসায় ফেরার পথে রেবেকাকে দেখতে আসলে ,দিনা দৌড়ে গিয়ে গেট খুলে দিয়ে সালাম দিয়ে বলে দাদা তুমি কেমন আছো?

আমি ভালো, তুমি কেমন আছো?

আমিও ভালো, দাদুর শরীর ভালো যাচ্ছে না সে জন্য সবাই চিন্তিত ।

দোআ করো,আল্লাহ ভালো করে দেবে ।

ডাক্তার আজমল ঘরে ঢুকেই বলে রেনু তোমরা কেমন আছো?

আংকেল,আমরা ভালো, মায়ের জন্য দুশ্চিন্তা করি ।

হুঁ , দুশ্চিন্তা করার ব্যাপার-ই, সে সরাসরি রুমে ঢুকে বলে, ভাবি তোমার কি খবর?

আমি এক রকম-ই ।

এক নজর দেখে বলে রহমান তুমি কি ডাক্তার মনোয়ারার নিকট গিয়েছিলে?

হ্যাঁ!
গিয়েছিলাম, উনি একটা চিঠি দিয়েছেন ডাক্তার পরিমল চক্রবর্তী কে , ক্যান্সার হাসপাতাল, কলিকাতা , ইন্ডিয়া । বলেছে রেবেকাকে নিয়ে একবার দেখিয়ে আনতে ।

বেশতো, একবার গিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসো, এতে বুঝতেও তো পারবে কোথায় ও চিকিৎসার কোনো ত্রুটি আছে কিনা । রেবেকা বলে আমার যাইতে ইচ্ছা করে না । ভাবি, এটা বড়ো ধরণের জার্নি হবে না,এক ফ্লাইটে যাবে আর এক ফ্লাইটে আসবে,রিপোর্টগুলি নিয়ে যাবে এবং দেখিয়ে পর দিন চলে আসবে । কে যাবে মজিদ বোধ হয় গেলে ভালো হয় ,কি বলো?

আঙ্কল আমি- ই যাবো, কাল হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট গুলি সংগ্রহ করে নিয়ে এ সপ্তাহে যাবো ।

ঠিক আছে , ডাক্তার কি বলে আমাকে জানিও ।

ঠিক আছে আংকেল ।

ডাক্তার আজমল চলে যাওয়ার পর রেবেকা বলে তোরা কি বলছিস ?

আম্মু, তোমাকে একবার নিয়ে দেখিয়ে আনলে ভালো হবে, অনেক সময় ডাক্তার ভুল চিকিৎসা দিয়ে থাকে যার জন্যও ঔষুধ কাজ করে না ।

আমার শরীরের অবস্থা কি দেখছিস?

হ্যাঁ, আম্মু দেখি বলেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এর মধ্যে সাকিলা এবং আবিদ এসেছে , সাকিলা বলে তোমরা কি নিয়ে কথা বলছো?

মজিদ বলে ডাক্তার মনোয়ারা একটা চিঠি লিখে দিয়েছে ইন্ডিয়া নিয়ে আম্মুকে একবার দেখানোর জন্য, কিন্তু আম্মু রাজি হয় না ।

আম্মু তুমি কেন রাজি হতে চাও না ?

দেখ জার্নি করার মতো আমার শরীরের অবস্থা নেই, আমাকে নিয়ে টানা টানি করিস না ।

সাকিলা বলে আম্মু আমিও যাবো তোমার সঙ্গে । ঢাকা থেকে কলিকাতা প্লেনে বড়ো জোর দুই ঘন্টার জার্নি, এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে যাবো, দেখিয়ে পরবর্তী প্লেনে চলে আসবো । ভাইয়া তোমার সঙ্গে আমি ও যাবো, আবিদ বলে আমিও যেতে চাই । ভাইয়া তুমি হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট গুলি সংগ্রহ করে নিয়ে এস, আমরা প্লেনের টিকেট কেটে নেবো ।

পর দিন মজিদ হাসপাতালে ডাক্তার মনোয়ারার সঙ্গে দেখা করে সব রিপোর্ট নিয়ে বাসায় রেখে অফিসে গিয়ে ছুটি নিয়ে আসে ।

আবিদ চার জনের রিটার্ন টিকেট নিয়ে এসেছে ,পর দিন সকালের প্লেনে কলিকাতা গিয়ে ডাক্তার পরিমল চক্রবর্তীর সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করে ।

ডাক্তার রেবেকাকে সঙ্গে সঙ্গে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করিয়ে বলে তোমরা রেস্ট নিয়ে দুই ঘন্টা পর আসো । পরিমল দুই জন সহ কর্মীকে নিয়ে রিপোর্ট দেখে আরও কটা ক্স-রে ও ব্লাড রিপোর্ট নিয়ে বসে আলোচনা করে ।

ডাক্তার দেখে শুনে বলে রোগীকে ভর্তি করিয়ে এক সপ্তাহ রেখে একটা সাজেশন দিয়ে ঢাকা পাঠাবো । বিকেলে সাকিলা ও আবিদ আসলে ডাক্তার পরিমল বলে এই রোগীকে এক সপ্তাহ রেখে মন্তব্য করা যাবে।

মজিদ বলে ডাক্তার যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই শুনবো, আমি আম্মুকে নিয়ে যাবো,তোমরা বরং ঢাকা চলে যেতে পারো।

আবিদ ও সাকিলা বলে আমরা ও এক সপ্তাহ থাকবো ।ওরা নিকটস্থ হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছে যাতে যার যার সুবিধা মতো সবাই আম্মুর কাছে থাকতে পারে।

পরদিন ,মজিদ বলে আমি মায়ের দেখা শুনা করবো তোমরা বরং শহরে ঘুরা ঘুরি করো । সাকিলা বলে ভাইয়া তোমাকে এবং আম্মুকে রেখে আমরা কোথায় যাবো ?

রেবেকা বলে তোমরা আমাকে বলে কহে এনেছো একদিনের জন্য, এখন দেখা যাচ্ছে এক সপ্তাহ । তার পরে ডাক্তার কি বলবে, তাতো জানা নেই। মজিদ বলে আম্মু আমরা সবাই কাজ করি, এক সপ্তাহের বেশি থাকা যাবে না । তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকো।মজিদ অনমনীয় এবং বলে আমি আম্মুর কাছে সব সময় থাকবো তোমরা একটু ঘুরা ঘুরি করো।

ওরা পর পর কয়েক দিন কতগুলি ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করে যেমন ব্ল্যাক হোল অফ কলিকাতা যেখানে নবাব সিরাজ দৌলা ব্রিটিশ সৈন্যদের অতি সংকীর্ণ স্থানে কয়েদি হিসাবে রাখে এবং অনেকেই দমবন্ধ হয়ে মারা যায় ।আরও কিছু স্থান যেমন মিউজিয়াম, হাওড়া ব্রিজ, জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি, রাইটার্স বিল্ডিং এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরি দেখে এবং এখানে সেখানে কিছু কেনা কাটা করে ।

এক সপ্তাহ থাকার পর ডাক্তার পরিমল একটা রিপোর্ট ও কিছু মেডিসিন লিখে দিয়ে রেবেকাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে । ওরা ঔষুধ খরিদ করে পর দিন ঢাকা চলে আসে।

এ দিকে রেবেকাকে নিয়ে কলিকাতা যাওয়ার পর রহমান সাহেব মনে মনে চিন্তা করলেন যে এই সুযোগে পীর সাহেবের কাছে গিয়ে কিছুটা তদবির করিয়ে নেই।

রহমান সাহেব পীরের খানকায় গিয়ে বলে হুজুর আমার স্ত্রীকে কলিকাতায় চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছি। ওর ক্যান্সার কিছুতেই ভালো হচ্ছে না, ও সারা রাত ঘুমাতে পারে না, ঘুমের মধ্যে প্রলাপ বকে,ওই যে আমাকে সাদা ঘোড়া নিতে এসেছে, আমাকে যাইতে ডাকে।

পীর সাহেব শুনে বলে এটা বদ জ্বিন, আপনাকে যা বলি তা না শুনে ডাক্তারি চিকিৎসা করান । আপনার ছেলে মেয়েরা আধুনিক যুগের শিক্ষিত , ওরা জ্বিন বলে কিছু বিশ্বাস করে না । কিন্তু কোরানে জ্বিন এবং মানব সম্পর্কে বলা আছে । ওরা কোরানের বাণী শ্রবণ করে না ,সে জন্য আপনার স্ত্রীর চিকিৎসা ও হয় না । রহমান সাহেব বলে হুজুর বাসার কেউ আমার কথা শুনে না , সে জন্য আমি আপনার কথা মত কাজ করতে পারি না । এ সময় আপনি যদি বাড়িতে কোনো তদবীর করতে চান আমি রাজী আছি।

পীর সাহেব বলেন, এই কাজের জন্য আমার হাদিয়া ৫০০ টাকা লাগবে। যদি রাজী হন বাড়ির চারিদিকে চারটি তাবিজ মাটির নিচে রেখে দেব এবং,সারা বাড়ি পানি পড়া দিয়ে ভিজিয়ে দেবো। এতে জ্বিনের বদ নজর থেকে বাড়ি রক্ষা পাবে। রহমান সাহেব স্ত্রীর মমতায় অগত্যা রাজি হয়ে তদবির করিয়ে নেবেন বলে স্বীকৃতি দেন ।

পীর সাহেব নিজে এসে বাড়ির চারিদিকে তাবিজ মাটির নিচে রেখে সারা বাড়ির ভিতর ও বাহির পানি পড়া দিয়ে ভিজেয়ে কিছু পানি আলাদা ভাবে রেখে বলেন অল্প অল্প করে পানির সঙ্গে মিশিয়ে আপনার স্ত্রীকে খাওয়াবেন।

রেনু যদিও জানে যে রহমান সাহেব পীর সাহেবকে দিয়ে বাড়িতে জ্বিনের তদবির করিয়েছেন, কোনও কথাই মজিদ বা শ্বাশুড়ির কানে দেয় নি। সে মনে করে আমার শ্বশুর তাঁর মনের সন্তুষ্টির জন্য করতে চায় করুক।

রেনু তার শ্বাশুড়ী( রেবেকা) বা মজিদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা বলে নি। বলতে গেলে ওরা হয়তো রাগ করবে, সে জন্য মুখ ফুটে কিছু বলছে না । রহমান বরাবর পীরের পানি পড়া অন্য পানির সঙ্গে মিশিয়ে রেবেকা কে খাওয়াচ্ছে। রেনু নিজেও শ্বশুরকে সাহায্য করে এবং যখনই কোনো গ্লাসে পানি দেয় তার সঙ্গে একটু পানি মিশিয়ে
খেতে দেয় ।

রেনু বলে বাবা তুমি এ নিয়ে চিন্তা করো না, আমি রীতিমতো একটু একটু পানি মিশিয়ে খেতে দেব। এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পর পর পীরের বাড়ি গিয়ে রহমান সাহেব রোগের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু ডাক্তারের চিকিৎসা বা পীরের তদবিরে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না । পীর সাহেব বলেন অনেক দিনের পুরানো রোগ সহসায় ভালো হতে চায় না । এতে যদি ভালো না হয়, তবে একটা সাদা গরু ছদকা দিতে হবে , তাতে ভালো হওয়ার সম্ভবনা থাকে। কিন্তু রহমান সাহেব পীরকে আস্তে আস্তে অনেক টাকা দিয়েছেন আর দিতে চাচ্ছেন না ।

আজিজ MBA পাশ করেছে এবং আমেরিকার স্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। সে একটা কাজ জোগাড় করে টেম্পোরারি এমপ্লয়মেন্ট ভিসার জন্য দরখাস্ত করেছে। আম্মুকে দেখার জন্য ইচ্ছে থাকলে ও চাকুরী ও আমেরিকা থাকার স্বার্থে এই মুহূর্তে সে দেশে আসতে পারছে না । তাছাড়া ফ্লোরার সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে উঠেছে।

আজিজ ভাবছে ফ্লোরার পড়াশুনা শেষ হলে ওকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে স্টুডেন্ট ভিসা থেকে এমপ্লয়মেন্ট ভিসা করিয়ে নেবে। ওরা দুই জন্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ফ্লোরার পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর বিয়ে করে নেবে। এ ব্যাপারে ফ্লোরার মাবাবা বা আজিজের মা বাবার কোনো আপত্তি নেই।
আজিজ রাতে টেলিফোন করেছে, দিনা দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন উঠিয়ে বলে চাচ্ছু তুমি
কেমন আছো?
হ্যা, ভালো আছি।
তুমি কেমন আছো ?
ভালো ।
তুমি ধরো আমি দাদুকে দিচ্ছি ।
রেবেকা টেলিফোন উঠিয়ে বলে তুই কেমন আছিস ?
আম্মু আমি ভালো আছি, তোমার ইন্ডিয়া জার্নি কেমন হলো?
বোরিং, সারাক্ষন হাসপাতালে বেডে শুয়ে থাকা। অযথা আবিদ কতগুলি টাকা খরচ করলো।
আম্মু আবিদ কেন টাকা খরচ করবে?
আবিদ কাউকে দেয় নি বিল পে করতে, তাছাড়া সে এয়ার টিকেট ও কিনেছে ।
থাক ও হয়তো খুশি হয়ে খরচ করেছে ।
তোর পরীক্ষার রেজাল্ট কি এসেছে?
হ্যাঁ, আম্মু ওই জন্যই টেলিফোন করেছি, আমি পাশ করেছি এবং ভালো স্কোর করেছি।
যাক শুনে খুশি হয়েছি । তুই এখন কি করবি?
আম্মু আমি একটা কাজ পেয়েছি এবং স্টুডেন্ট ভিসা পরিবর্তন করে এমপ্লয়মেন্ট ভিসার
জন্য দরখাস্ত করেছি।
তোর আব্বুর সঙ্গে কথা বলবি ?
দাও ।
মজিদ সাহেব টেলিফোন দীর্ঘায়িত না করে বলে ভালো থাকিস ।

অবস্থা খারাপ দেখে রেবেকাকে পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য ডাক্তার মনোয়ারা নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু রেবেকা বলে আমি মরে যাবো, কিন্তু আর হাসপাতালে যাবো না । অগত্যা ডাক্তার মনোয়ারা বাসায় এসে দেখে যায় এবং ঔষুধ একটার পর একটা পরিবর্তন করে।

রেবেকার অবস্থা দিনের পর দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সে আজকাল হাঁটা চলাফেরা ও করতে পারে না, তা ছাড়া সারা শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে ।
মজিদকে অফিস থেকে রাজশাহী এক অফিসিয়াল কাজে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ।
রেবেকার শরীরের এ অবস্থায় রেখে তার যাইতে এক দম ইচ্ছে হয় নি । কিন্তু কতদিন অফিসে এই অজুহাত দেখানো যাবে ?
অফিসের কাজ কারো অসুবিধার জন্য বসে থাকে না ।
সে পরদিন রেবেকাকে বলে আম্মু আমি অফিসের কাজে রাজশাহী চলে যাচ্ছি এবং তিন সপ্তাহ থাকতে হবে। রেবেকা বলে যাও, আমার অসুখ বলে তো তোমাদের কাজ বন্ধ থাকতে পারে না । রহমান সাহেব বলে আমরাতো সবাই এখানে আছি।
রহমান সাহেব বলে তুই কত দিনের জন্য যাবি?
মজিদ বলে তিন সপ্তাহের জন্য যাবো, তবে বলতে পারিনা বেশি সময় ও থাকতে পারি ।
কোথায় থাকবে এবং খাওয়া দেওয়ার কি ব্যবস্থা হবে?
সরকারি বাসায় থাকবো এবং রান্না, খাবার ব্যবস্থা থাকবে। তুই বরং রেনুকে নিয়ে যা, আমাদের কাজের মেয়ে হাসু আছে। রেনুকে নিয়ে যাবো না, ও তোমাদের দেখা শুনা করবে। তাছাড়া ও সাকিলার স্কুলে চাকুরীর ইন্টারভিউ দিয়েছে এবং যে কোনো সময় চাকুরী হতে পারে। আচ্ছা ঠিক আছে।

অফিস থেকে গাড়ি দিয়ে মজিদ কে পাঠানো হয়েছে। আরিচা ঘাট থেকে নগর বাড়ি ঘাট পয্যন্ত যেতেই প্রায় দুই ঘন্টা সময় লেগে গেলো। পুরা দিনের জার্নি করে মজিদ ক্লান্ত হয়ে রেস্ট হাউসে গিয়ে উপস্থিত।

দারোয়ান মুসা দেখেই সালাম দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে লাগেজ এনে বেড রুমে রেখে বলে স্যার আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসেন আমি টেবিলে খাওয়া দিচ্ছি। মজিদ বলে তুমি খাওয়া দিয়ে দাও তবে আমি একটু দেরি করে খাবো।
মজিদ কাপড় ছেড়ে খানিক রেস্ট নিয়ে উঠে বাথ রোমে গিয়ে গোছল করে এসে আস্তে টেবিলে গিয়ে দেখে রাতের খাওয়া ইলশা মাছ ভাজি, মুরগির মাংস ও ডাল তৈরী করা হয়েছে। রান্নার অবস্থা দেখে মনে হয় ভালো বাবুর্চি ।
মজিদ বলে মুসা?
মুসা দৌড়ে এসে বলে স্যার আপনি আমাকে ডাকছেন?
হ্যাঁ ।
কে রান্না করেছে?
স্যার, আমাদের বাবুর্চি জরিনা রান্না করেছে ।
কেন স্যার ?
ভালো রান্না হয়েছে ।
স্যার জরিনা ভালো রান্না করে এবং সকালে এসে নাস্তা তৈরী করবে । আমি এখন আপনাকে চা করে দিয়ে চলে যাবো এবং আর একজন রাতের ডিউটিতে থাকবে।
ঠিক আছে ।
মুসার স্থলে মান্নান এসে সালাম দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে সব কিছু গুছিয়ে বেডে মশারি খাটিয়ে দিয়ে বলে স্যার রাতে কোনো কিছু দরকার হলে আমাকে সিকিউরিটি সুইচ টিপলে আমি আসবো ।
ঠিক আছে ।
পর দিন সকালে জরিনা এসে রাতের থালা বাসন পরিষ্কার করে সকালের নাস্তার জন্য রুটি, ভাজি, ডিম্ ও চা করে দিয়ে জিজ্ঞেস করে স্যার দুপুরে কি খাবেন?
মজিদ বলেন করল্লা ভাজি, মাছ ও ডাল করতে পারো।

সকালে ড্রাইভার এসে অফিসে নিয়ে যায় এবং মজিদ গিয়ে বড়ো সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন এবং দুই জনে পুরা কাজের তালিকা তৈরী করে বুঝিয়ে দিয়ে ওর অফিসে পাঠিয়ে দিয়ে বলে আপনার সঙ্গে মিসেস রোকেয়া কাজ করবে এবং যেখানে যা দরকার সাহায্য করবে।
মিসেস রোকেয়া এক্সেকিউটিভ অফিসার সারা অফিস ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলে স্যার আপনার যখন যা দরকার আমাকে বলবেন । ১২:৩০ থেকে ২ টা পয্যন্ত আপনার লাঞ্চ ব্র্যাক ।
মজিদ অফিসে গিয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে পিয়ন চা নিয়ে এসে টেবিলে রেখে যায়। ওর মূল কাজ হলো সারা অফিসের কাজ দেখা এবং হেড অফিসে রিপোর্ট করা।এই ইন্সপেকশনের ফলে অফিসের কোনো অপকর্ম খুঁজে বের করা এবং কোনো কর্মচারীর প্রমোশন, সাময়িক বরখাস্ত এবং নিয়োগ, বদলি সম্পর্কিত তথ্যাদি পাওয়া যাবে। এতে হেড অফিস বাৎসরিক বাজেট সরকারের কাছে পেশ করতে সুবিধা হবে। মজিদ প্রতিদিন কাজ করেন এবং কাজের শেষে বাসায় এসে রিপোর্ট লিখেন।

ফাঁকে ফাঁকে সে ঐতিহাসিক স্থান গুলি প্রায় দেখতে যান যেমন: মহাস্থান গড় , বেহুলা লাক্সমিনদার বাসর ঘর , বুদ্ধ বিহার ও হেরিটেজ বিচ, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি, বিশেষ করে ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসা এবং অবসর সময় পড়াশুনা করা, এ করেই সময় অতিবাহিত করে । প্রতি রাত একবার বাসায় রেনু এবং মায়ের সঙ্গে কথা না বলে ঘুমাতে যাবে না ।

তিন সপ্তাহ কাজ শেষ করার পর রাত জেগে রিপোর্ট লেখা শুরু করেছে, রেনু টেলিফোন করেছে, বলে মায়ের শরীর ভালো যাচ্ছে না, তুমি কি চলে আস্তে পারবে?
মজিদ বলে ঠিক আছে।
পর দিন অফিসে গিয়ে রিপোর্ট বড়ো সাহেবকে দিয়ে এক কপি হেড অফিসার জন্য নিয়ে বলে স্যার, আমার কাজ শেষ হয়ে আসছে এবং আমি কাল কাজ শেষ করে চলে যেতে চাই।

বড় সাহেব বলেন কাজ শেষ হলে চলে যাবেন ।
পর দিন মজিদ দারোয়ানকে দিয়ে বাংলো পরিষ্কার করিয়ে ওদের কিছু টাকা বকশিস দিয়ে ড্রাইভারকে বলে আমাকে বাস স্টপে নামিয়ে দিয়ে এস। মজিদ ইতি পূর্বে বাজারে গিয়ে কিছু কেনা কাটা করে নিয়েছে । অফিসে একটি মাত্র গাড়ি, তাই সে বাস স্টপে গিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে ঢাকার বাসে উঠে বসে।

দুইটার দিকে বাস স্টার্ট দিলো । রাস্তা বেশ পরিষ্কার , নগর বাড়ি পয্যন্ত বেশি ঝামেলা হলো না। নগর বাড়ি ঘাটে বাস লাইনে দাঁড়ালো। আজ ঘাটে অনেক ভিড় । মজিদের মনে হলো সামনে লং উইকেন্ড, বাসের সিরিয়াল নম্বর ৩৯, প্রায় তিন ঘন্টা সময় নিলো ফেরি পারাপার হতে। সন্ধ্যা ৭টায় বাস আরিচা ঘাটে পৌঁছলো। মজিদ রাজশাহী থেকে সিট নিয়ে এসেছে উঠে নিজের সিটে বসে পড়লো।
বাস কন্ডাকটর প্যাসেঞ্জার নিতে নিতে বাসে তিল ধারণের জায়গা ও নেই। কিছু লোক হুড়মুড়ি খেয়ে বাসে ভিড় জমিয়েছে। একজনের উপর আর একজন ঠেলাঠেলি।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এক প্যাসেঞ্জার চিৎকার করে উঠলো, তার পকেট থেকে মানি ব্যাগ চুরি হয়েছে। বাস ড্রাইভার বাস থামালো, লোক জন হৈ চৈ করতেছে। কিন্তু লোকটার মানিব্যাগ আর পাওয়া গেলো না । এতে প্রায় এক ঘন্টা বাস দেরি হলো এবং কিছু লোক বাস থেকে নেমে গেলো।
মজিদ নিজের লাগেজ ও টাকা পয়সার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখছে । কিছু লোক বাসের ঢুকার প্রবেশ পথে এখনো ভিড় জমিয়ে আছে । সাভার আসার পর বাসের ভিড় কমেছে।
রাত ৯টার দিকে বাস ঝিগাতলা বাস স্ট্যান্ডে থামে । মজিদ একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় ঢুকতেই দেখে লোকজনের ভিড় এবং সাকিলা ও অন্যান্যদের কান্না শুনা যাচ্ছে।
দিনা দৌড়ে এসে কেঁদে জড়িয়ে ধরে বলে আব্বু তোমার অনেক দেরি হয়ে গেলো।
সমাপ্ত

 

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধগোলাপ ফুল চাষের কলাকৌশল
পরবর্তী নিবন্ধস্বপ্নের ইমিগ্রেশন-পর্ব ১
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন