(ভূমিকাঃ ‘সংস্কৃতি ও সংগঠন’ নিবন্ধটি লেখার জন্যে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন অকালপ্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণসংগীত শিল্পী ও ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহবুবুল হায়দার মোহন। ক্রান্তি নামে একটি সংকলনের জন্যে তিনি ‘সংস্কৃতি ও সংগঠন’ নামে আমাকে একটি লেখা দেবার জন্য বলেছিলেন। এই লেখাটি তারই ফসল। উল্লেখ্য, আমিও তখন ক্রান্তির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। পরবর্তীতে ‘সংস্কৃতি ও সংগঠন’ নিবন্ধটি দৈনিক সমাচার পত্রিকার সাহিত্যের পাতায় প্রকাশিত হয়।)
ইতিহাসের গোড়ার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সংস্কৃতির জন্ম বা চর্চা শুরু হয়েছে সেই আদিকাল থেকেই। মানব ইতিহাসের শুরুতে মেহনতী মানুষই ছিল সংস্কৃতির মূলাধার। প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিবৃত্ত নিয়ে যারা আলোচনা করেছেন তারা দেখিয়েছেন যে, প্রস্তর যুগেও মানুষ সংস্কৃতি বিবর্জিত ছিলো না। এসব সংস্কৃতির ঐতিহাসিকতা, বিচিত্র প্রবাহ, সমৃদ্ধি ও গভীরতার ক্রমাভিব্যক্তি প্রমাণিত করেছে যে, মানুষ তার সাংস্কৃতিক জগতে চির বিপ্লবী (রনেশ দাশগুপ্ত ১৯৭০)।
সংস্কৃতি শব্দের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। তা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের প্রতিটি দিকই নির্দেশ করে। তাই সংস্কৃতি মানে মানুষের বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, ভাবধারা, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, অভ্যাস প্রভৃতির এক সমন্বিত রূপ। সুষ্ঠু ও উন্নত সংস্কৃতির প্রভাবেই কোনো দেশ ও জাতির সঠিক সুন্দর জীবন প্রক্রিয়া গড়ে উঠতে পারে (জেসমিন ১৯৯৪)। সকল দেশের সকল যুগে সংস্কৃতি চর্চার কোনো না কোনো প্রেরণার উৎস থাকে। সে উৎস ব্যক্তিও হতে পারে, সংগঠনও হতে পারে। উৎসের প্রভাবে সংস্কৃতি শত ধারায় নির্ঝরনীর মতো প্রবাহিত হয়। আর এর ফলে দেশের ও কালের সংস্কৃতি সম্পদশালী হয়ে উঠে শতগুণে। এরকম অসংখ্য ব্যক্তি ও সংগঠনের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকার সংখ্যা অতি নগণ্য।
আমাদের সমাজে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, বিভেদ আর হানা-হানিতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, সেখানে সংস্কৃতির সৌন্দর্যলক্ষ্মী সম্বন্ধে ধ্যান করে কোনো বিশেষ সংগঠনের ভাবধারায় স্নাত হওয়া কঠিন। সমস্যাসংকুল পৃথিবীতে, চাওয়া-পাওয়ার দুস্তর ব্যবধানে যারা সতত উচ্চকিত থাকে তাদের কথা অবশ্য আলাদা। ওই কতিপয় ব্যক্তির জন্যেই, এখনও হাতে গোনা কতিপয় সংগঠন টিকে আছে।
আজকাল প্রায়ই একটা কথা উচ্চারিত হয় যে, কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনটি বড়? এ প্রশটি আরও বেশি বড় হয়ে দেখা দেয় যখন সংগঠক বা কর্মীর চেয়ে সমালোচকের সংখ্যাধিক্য ঘটে এবং তথাকথিত সংগঠকরা তাড়িত হন হিংসা বা নোংরা রাজনীতি দ্বারা। তবে সংগঠন বড়-ছোটর চেয়ে মুখ্য হওয়া উচিৎ সংগঠনের কাজকর্ম। সংগঠন কী ধরনের কাজ করছে, মূল ধারায় আছে না কী বিকৃত সংস্কৃতির চর্চা করছে, কোন শ্রেণীর লোকের কথা বলছে — এ সকল বিষয়ই মুখ্য হওয়া উচিৎ। এখানটায় পরিমাণের (কোয়ানটিটির) চেয়ে গুণগত মানের (কোয়ালিটির) ওপরই জোর দেয়া বাঞ্ছনীয়। আর এ দুটিরই সমন্বয় যদি হয়ে যায়, তা হলে সেটি তো সৌভাগ্যের বিষয়।
অপসংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনাই আধুনিক কালে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর বিকাশকে রুদ্ধ করছে। এর সাথে যোগ হয়েছে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ, নেতৃত্বের প্রতি মোহ এবং অশুভ রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি।
সংস্কৃতির প্রাণ হলো তার মাটি। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, আটষট্টি হাজার গ্রামের চালচিত্রকে ধারণ করতে না পারলে সংস্কৃতি চর্চা হবে না। এর জন্যে প্রয়োজন কমিটমেন্ট, শ্রম ও একাগ্রতা।
ম্যাক্সিম গোর্কি বলতেন, মেহনতই হচ্ছে সংস্কৃতির মূল উৎস। গোর্কির সাথে সুর মিলিয়ে বলতে পারি, সংস্কৃতির মূল নায়ক হবে মেহনতী জনসাধারণ। ‘কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি চর্চা স্বাধীন গনতান্ত্রিক কাঠামোয় এসেও চরিত্র বিচারে একান্তভাবেই বুদ্ধিজীবীর সংস্কৃতি চর্চার গন্ডি বন্ধ তৎপরতায় আবদ্ধ হয়ে আছে। নাগরিক জীবনের বাইরে এর প্রকাশ সামান্য’
(আহমদ রফিক ১৯৯৯) ।
লেনিন তার সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘আন্তর্জাতিকভাব শ্রমিক শ্রেণির কাছে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারে শুধু তখনই যখন শ্রমিক যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষায় তা অভিযোজিত হয়, এবং শ্রমিক যে নির্দিষ্ট জাতীয় পরিস্থিতিতে বাস করে, তাতে প্রযুক্ত হয়। নিজ জাতীয় সংস্কৃতির আস্হা ও বিকাশ সম্পর্কে শ্রমিকদের উদাসীন থাকা চলে না, কেননা এর মধ্য দিয়েই এবং শুধু এরমধ্যে দিয়ে গনতন্ত্রের এবং বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনের আন্তর্জাতিক সংস্কৃতিতে অংশ নেয়ার সুযোগ সে পায়।’
উল্লেখ্য, আমাদের সাংস্কৃতিক নির্মাণের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো গ্রামের সমস্যা। গ্রামের গরীবদের সঙ্গে শহরের শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক ও আত্নিক বন্দিদশার প্রতিবাদে সংগ্রাম করতে হয়৷ এ পদ্ধতির উৎস কোনদিন শুষ্ক হয় না। কারণ মানুষের সংগে মানুষের সহযোগিতার সম্ভাবনা কোনদিন নিঃশেষিত হয় না, হতে পারে না। বরং, সংস্কৃতি ও সংগ্রামী সহযোগিতার স্রোতধারা চির প্রসারমান।
মূলতঃ সংস্কৃতি কোনো ব্যক্তি বিশেষের নয়, গণমানুষের এবং একান্তই গণমানুষের সম্পত্তি। সাংস্কৃতিকসংগঠনের প্রধান লক্ষ্য হলো দর্শক-শ্রোতা, জনগন। সংগঠনের সদস্যরা নিজে নিজে আনন্দ পাবার জন্যে যা করেন তাই সংস্কৃতি নয়। মনে রাখতে হবে, সংগঠনের সদস্যদের অনুভূতি ব্যক্তিগত হলেও এর একটা সর্বজনীন রূপ থাকতে হবে। সংস্কৃতিতে মেহনতী মানুষের চরিত্র চিত্রনে প্রগাঢ় নিষ্ঠা, অকপট আন্তরিকতা ও হৃদয়ের ব্যাকুলতা মর্মস্পর্শীভাবে ব্যক্ত না হলে সে সংস্কৃতি যথার্থ সংস্কৃতি নয়। রনেশ দাশগুপ্ত শিল্পীদের প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন যে, ‘শিল্পীর পরিচয় সে সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এবং অন্যান্য মানুষের সঙ্গে যুক্ত। এই মানুষকে স্বাধীন হতে হয় এবং সক্রিয় হতে হয়। শিল্পী ও জনতাকে একই সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়।’ তিনি অন্যত্র বলেছেন, শিল্পীকে বুকের রক্ত ঢালতে হয় রাজপথে। শোষনহীন সমাজের জন্যে, সর্বাত্মক মুক্তুির জন্যে। প্রচলিত বৃত্তকে ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য শিল্পীরা যুগে যুগে সাধনা ও সংগ্রাম করে এসেছে। শিল্পীর অঙ্গীকার চির নতুনের অঙ্গীকার।
সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের যুগে আদর্শিক ও গনতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ‘আজ একদিকে চলছে রাজনৈতিক প্রহসন। অন্যদিকে রক্তলোলুপ অর্থনীতি আর অবক্ষয়ী সমাজ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাদের’ (কামাল লোহানী ১৯৯৮)।
আমাদের দেশের গনতান্ত্রিক সংস্কৃতির বর্তমান সংকট ও সংস্কৃতির অবক্ষয়কালে সীমিত শক্তি নিয়ে হলেও দু’একটি সংগঠন আজও অব্যাহত গতিতে গণমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছে। তাদের এ গণমুখী যাত্রা অব্যাহত থাকুক। শুভ শক্তির জয় হোক। জয় হোক মানুষের।