চৈত্রের কোন এক কাক ফাটা দুপুরে নীলা কলেজের বাবলা তলায় আড্ডা দিচ্ছিলো বান্ধবীদের সাথে। কথা চলছিল কলেজের নির্বাচন নিয়ে। কোন দলের প্রার্থী কেমন? কে কতটা হান্ডসাম ? ভোট নিজে চেয়েছে কিনা এসব নিয়ে। দূরে বসে আনমনে কি যেন ভাবছে শুভময়। নীলাদের ডিপার্টমেন্টের এক ইয়ার সিনিয়র ভাই । ওর নামের মত ও একটু অন্যরকম। কারো সাথে আগে থেকে কথা বলে না বা আড্ডা দেয় না। একটু লাজুক প্রকৃতির ভাল ছেলে। অনার্সে খুব ভাল রেজাল্ট করেছে সে। নিলা কি মনে করে বান্ধবীদের বলল “ চল আজ শুভ ভাইকে ভয় পাইয়ে দেই। উনি কেন আমাদের সঙ্গে কথা বলে না দেখি।“ যেমনি ভাবা ওম্নি কাজ। নীলা, ছন্দা আর ঝুমু উঠে গিয়ে বসে শুভর পাশে। শুভ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে “ কি ব্যাপার ওখান থেকে উঠে এলে যে। নীলা সাথে সাথে বলল “ আজ আমরা আপনার সাথে আড্ডা দিব ভাবছি । ক্লাশ শেষ। বাস আসতে সময় লাগবে। আপনার অসুবিধা নেই তো?” শুভ বলে” না না অসুবিধা থাকবে কেন? তোমরা বল আমি শুনছি ।‘’ ছন্দা বলে না শুভ ভাই আজ আপনি বলবেন আমরা শুনবো। আপনি অনার্সে এত ভাল রেজাল্ট কি করে করলেন? সারাক্ষন কি পড়াশুনা নিয়েই চিন্তা করেন! আমাদের কে কিছু টিপস দেন না। শুভময় লজ্জা পেয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর বলে ও কিছু না। আমি আসলে পড়াশুনা নিয়ে কখনোই চিন্তা করি না। দেখ তোমরাও অনেক ভাল রেজাল্ট করবে। পাশ দিয়ে বাদাম ওয়ালা যাচ্ছিল। শুভময় হাত দিয়ে ইশারা করতেই বাদাম ওয়ালা কাছে এল। সে সবার জন্য বাদাম নিল। এভাবে বাদাম খেতে খেতে কথা বলতে বলতে বাস চলে এসেছে সবাই তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ল বাস ধরার জন্য । শুভময় কে উঠতে না দেখে নীলা বলল আপনি বাসে যাবেন না? শুভ না সূচক মাথা নেড়ে বলল আমার হাটতে ভাল লাগে। নীলা, ছন্দা আর ঝুমু এগিয়ে গেল বাস শাপলার দিকে।
এভাবে দিন যেতে যেতে শুভময়ের সাথে নীলাদের খুব ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠে । তারা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে । মাঝে মাঝে রিপনের দোকানের চা খেতে যায় । ক্লাশের পাঠ্য বিষয় নিয়ে কথা বলে। শুভময় ওর সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে ওদের প্রশ্নের উত্তর দিতে। এখন মাঠে তিন বান্ধবীকে বসা দেখলে শুভ নিজে থেকে এগিয়ে আসে কথা বলতে। মাঠে বসে গল্প করার সময় নীলা হঠাৎ প্রশ্ন করে “ আচ্ছা শুভ ভাই আপনি কি হিন্দু না মুসলমান ? আপনার নামটার মধ্যে কেমন একটা হিন্দু হিন্দু ভাব আছে । শুভময় কিছুই না বলে অন্য দিকে তাকায় । ঝুমু বলে কি উল্টা পাল্টা কথা বলছিস। নাম তো ঠিকই আছে। তোর এমন মনে হয় কেন আমার তো এমন মনে হয় না। বাদ দে তো। গান শুনবি । আমার গান গাইতে ইচ্ছা করছে। শুভ ভাই একটা গান গাইলে কিছু মনে করবেন । শুভ বলে না না কিছু মনে করব কেন? তুমি যে গান জান তাতো জানি না। গাও গাও । শুনে দেখি। ঝুমু গান শুরু করে “ আনন্দধারা বহিছে ভুবনে …“ ঝুমুর গানের সাথে সাথে সবার হৃদয় যেন ভরে যায় আনন্দের বন্যায়।
অনার্সের শেষ বর্ষে স্ট্যাটাস্টিক নতুন যোগ হওয়ায় সবারই খুব অস্থির অবস্থা সবার। ছন্দা আর ঝুমুর পড়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কিন্তু নীলার কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় ওর খুব মন খারাপ। চুপচাপ বসে আছে মাঠে। আজ ছন্দা আর ঝুমু আসেনি কলেজে। শুভময় ওকে একা বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো “ কি ব্যাপার মন খারাপ করে বসে আছো কেন? নীলা ওর সমস্যার কথা বলার পর সে বলল এটা কোন মন খারাপের বিষয় হলো আমি তোমাকে শিখাব। নীলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “ আপনি শিখাবেন? তাহলে তো সমাধান হয়েই গেল। কিন্তু তার পরিবর্তে কিন্তু পারিশ্রমিক নিতে হবে। জানেন তো ডাক্তারের ফি না দিলে রোগী ভাল হয় না। আর শিক্ষকের বেতন না দিলে শিক্ষার্থীর শিক্ষা হয় না। শুভময় বলে তুমি যেভাবে ভাল মনে কর। নীলা ঠিক করে দিল সপ্তাহের কোন দুদিন সে পড়াতে যাবে ওদের বাসায়। শুভময় খুব খুশি নীলার প্রস্তাবে।
নীলা কে পরিসংখ্যান শিখাতে গিয়ে শুভ পরিচিত হয় নীলার পরিবারের সাথে। নীলার মা খুব আদর করেন শুভকে। অনেক সময় তিনি নিজে বসে বসে গল্প করেন শুভর সাথে। এভাবে ওদের দিন গুলো কলেজ আর বাসায় ভালই কেটে যাচ্ছিলো। একদিন পড়ানোর শেষে শুভ নীলাকে বলে “ তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলে আমার নাম নিয়ে। মনে আছে?ঐদিন আমি তোমাকে কোন উত্তর দিতে পারিনি সবার সামনে। কিন্তু আজ দিব । নীলা তাকায় বিস্ময় নিয়ে। শুভময় বলতে থাকে আমার মা মুসলমান আর বাবা হিন্দু ব্রাহ্মণ। তারা সমাজ আর সংসারকে উপেক্ষা করে পালিয়ে বিয়ে করে মুসলিম মতে। মা স্কুলে চাকুরী করেন আর বাবা বেঁচে নেই। তিনিও কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তাই আমার নামটা এমন। আমি যে চুপচাপ থাকতাম বা একাএকা থাকতাম এটাও তার একটা কারণ। কেননা সব জায়গায়ই আমাকে এই প্রশ্নটার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় ছোটবেলা থেকেই। যখন দাদা বাড়ী কখনো বেড়াতে যেতাম অনেকেই জিজ্ঞেস করত আমি গরু খাই কিনা! নামাজ পড়ি কিনা। আবার নানা বাড়ীতে গেলেও একই ধরনের প্রশ্ন শুনতে হয়। এ জন্য আমার বাবা মায়ের প্রতি আমার একধরনের রাগ কাজ করে। কেন উনাদের এমন করতে হয়েছিল? এখন তাদের জন্য আমাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। খুব ছোট লাগে নিজেকে।
নীলা শুভময়ের কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল একমনে। খুব কষ্ট হচ্ছিল ওর। কি বলবে বুঝতে পারছিল না। নীলা শুভকে পছন্দ করে বড় ভাই হিসাবে শিক্ষক হিসাবে। ও কোন সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। শুভময় নিজের মনের কথা গুলো বলতে পেরে খুব হাল্কাবোধ করছিল।
শুভর মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ । সে ঢাকায় চলে গেছে কাজ খুঁজতে । আর নীলাদের পরীক্ষার মাস খানেক বাকী আছে। নীলার সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই । একদিন পড়াশুনার খোঁজ জন্যই শুভময় ফোন করেছে নীলাকে। নীলা ফোন ধরে স্বাভাবিক ভাবেই কুশলাদি জিজ্ঞেস করে জানালো ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সঙ্গে। পরীক্ষা শেষ হলে বিয়ে। কার্ড ছাপানো হয়ে গেছে। শুভকে কোন ঠিকানায় কার্ড পাঠাবে ! শুভময় যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে নীলাকে বলল এসব কি বলছো? আমি আমার মাকে তোমাদের বাসায় পাঠাবো। তুমি কি তোমার বাবা মাকে বলে বিয়েটা বন্ধ করতে পার? প্লিজ নীলা আমি তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। নীলা বলে শুভ ভাই আমি তো কখনো আপনাকে অন্যভাবে চিন্তা করিনি। ভালবাসা আর বন্ধুত্ব তো এক না। আমাকে মাফ করবেন প্লিজ। এখন আমি কিছুই করতে পারবো না। শুভময় কখনো তার পছন্দের কথা বলেনি। তার বুক ফেটে কান্না আসছিল। সে ভেবেছিল নীলা তাকে বুঝতে পারে।
যথাসময়ে নীলার বিয়েটা হয়ে গেল । বাবার বাড়ির পাঠ চুকিয়ে সে ঢাকায় তার নতুন সংসার শুরু করেছে। একদিন দুপুরে সে নিউমার্কেট গিয়েছে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনতে। হঠাৎশুনতেপায় পিছন থেকে কে যেন ডাকছে। তাকাতেই দেখে শুভময়। সে দ্রুত এগিয়ে আসে নীলার দিকে। হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করে নতুন সংসার কেমন কাটছে! ঠিকমত সবকিছু সামলাতে পারছে কিনা! তারপর কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করে কাল একটু আমাকে সময় দিতে পারবে। আমি মনুবসু স্ক্লারশীপ নিয়ে জাপান চলে যাচ্ছি। কিন্তু তোমার একটা জিনিষ আমার কাছে রয়ে গেছে। সেটা ফেরত দিতে চাই। নীলা বুঝতে পারে না কি জিনিশ! সে কখনো ত কোন কিছু দেয়নি। নীলা বলে ঠিক আছে আসব।
শুভময় একটা আইসক্রিম পার্লারে অপেক্ষা করছিল নীলার জন্য। নীলা ঢুকতেই সে তিন রঙের আইসক্রীম অর্ডার দেয়। তারপর ব্যাগ থেকে নীলার একটা ছবি হাতে দিতে দিতে বলে সরি নীলা তোমাকে না বলে তোমার বাসা থেকে এই ছবিটা নিয়েছিলাম। অনেক চিন্তা করে দেখলাম মন্দিরের জিনিষ মন্দিরেই থাকা ভাল আমি হয়ত এর সঠিক মূল্য দিতে পারবো না।তাই ফিরিয়ে দিলাম। ছবিটা হাতে নিতে নিতে নীলার চোখ ঝাপসা হয়ে এল।।
(ছবি:-সৌজন্যে all-free-download)