অনেক রাত হয়েছে। অশেষ বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছেন। ঘুম আসছেনা। কতো কি মনে পড়ছে! সেদিন ছিল রাখিপূর্ণিমার রাত। সন্ধ্যার পর বরকে সঙ্গে নিয়ে নারানী এসেছিলেন। দিনটির কথা খুব মনে পড়ে গেলো।

নারানী বিয়ের পর প্রথম বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। কিছুদিন হলো ওর বিয়ে হয়েছে। নারানীর বরও সঙ্গে এসেছেন। বড়ো হওয়ার পর থেকে প্রতি শিবরাত্রিতে, নারানী নিয়ম করে শিবের পায়ে জল ঢেলে প্রার্থনা করতেন, শিবের মতো বর পাওয়ার জন্য। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি কুমারী মেয়েই এই পুজো করে থাকেন। নারানীর বরকে দেখে অনেকটা পাথরের তৈরী শিবের মতোই লাগছে।

ধুতি-পাজামা পড়েছেন। দেখতেও সুদর্শন এবং সুঠাম দেহের অধিকারী। বলতে হবে নারানীর প্রতিভাগ্য ভালোই। বিয়ের পর নারানীর সঙ্গে এই প্রথম দেখা হলো।

নারানীকে দেখে বোঝার উপায় নেই, এই কি তাঁর শৈশব- কৈশোরের খেলার সাথী চিরচেনা সেই নারানী! এ-তো একেবারে আকাশ থেকে নেমে আসা অপূর্ব দেখতে কোন পরী! কপালে জ্বল-জ্বল করছে টকটকে লাল সিঁদুর। ফর্সা হাত আরো সুন্দর লাগছে সাদা রঙের শাখা, সোনার কাঁকন এবং লালা রঙের পলার সৌন্দর্যে। চওড়া লালপেড়ে বাসন্তী রঙের গরদের শাড়ি যেন নারানীর জন্যই তৈরি হয়েছে।

নারানী পূর্বর মতোই চঞ্চল পাখির উচ্ছলতা নিয়ে অনেকটা উড়ে আসার মতো করে অশেষের ঘরে ঢুকেই প্রণাম জানালেন। পেছন পেছন ওর বরও এসেছেন।
-তুুমি ভালো আছো অশেষ দাদা?
এ-ই প্রথম নারানী অশেষকে তুমি বলে সম্বোধন করছেন। অশেষের কাছে বেশ লাগছে শুনতে।
-এই আছি, ভালোই। তুই কেমন আছিস? জামাইবাবু আপনি?
নারানী বললেন,
-দেখতেই-তো পাচ্ছো, বেশ ভালো আছি। এ-তো সুন্দর বর আমার! খুব ভালো মানুষ আমার বর।
-সেতো দেখতেই পাচ্ছি। জামাইবাবু, কেমন লাগছে আপনার কাছে আমাদের গ্রাম?
-দারুণ! সব্বাই এ-তো ভালো। আপনার মা ভীষণ ভালো মানুষ! খুব আদর করেছেন আমাদের। একবার সময় করে মাকে সঙ্গে করে বেড়াতে আসবেন আমাদের ওখানে।
-জি, আচ্ছা। আসবো।

সেদিন নারানী যাওয়ার সময় আরো বলেছিলেন,
-তুমি বিয়ে করবেনা অশেষ দাদা?
-আমি বিয়ে করবো! কি বলছিস তুই? আমাকে বিয়ে করতে কে রাজি হবে বল? তারপর পরিচয়হীন একজন অনাথ আমি!
-এভাবে বলোনা অশেষ দাদা, মাসিমা শুনলে মনে মনে খুব কষ্ট পাবেন। তিনি কিন্তুু তোমাকে মায়ের মতোই আগলে রেখেছেন।
-তা অবশ্য তুই ঠিক বলেছিস। মা, আসলেই খুব ভালো মানুষ। আর এই কারণেই আমার এই জীবনটা বয়ে বেড়ানো। নইলে অনেক আগেই নিজেকে শেষ করে দিতাম।

কভিড-১৯ এর ঢেউ তছনছ করে দিয়েছে অশেষের সবকিছু। মা, এখন ভীষণ অসুস্থ। চারপাশের মানুগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকট দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন। তবুও পথচলা থামালে চলবেনা। এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। অনেকের অনেক কিছু থাকে। অনেকেই থাকে। অশেষের সেসব নাইবা থাকলো। সবার সবকিছু থাকতে নেই। অশেষেরও নেই।

(চলবে)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন