কটা বাজে? সকালটা খুব উজ্জ্বল। রোদটায়ও কেমন একটা সবুজাভ ভাব। এমন রোদ এর পূর্বে কখনো দেখেছে কিনা মনে করতে পারছে না সুফিয়ান। রাস্তার পাশের একটি বেঞ্চিতে বসে আছে সে। কতক্ষণ? তারও কোনো মালুম নেই!

শহরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা। ঘরগুলো দূরে দূরে। মানুষগুলোর গতিবিধিও কেমন নিস্তরঙ্গ, অনাবিল। একটা বাস এসে থামলো অদূরের স্টেশনে। বেশ কয়েকজন যাত্রী নেমে হাঁটা শুরু করলো। সম্ভবত তাদের গন্তব্য কয়েকশো গজ দূরের বড় ঐ ঘরটাই। ঐ ঘরটাকে কেন্দ্র করেই যেন যাকিছু মানুষের আনাগোনা চলছে এখানে। সুফিয়ানের অবয়বে একটা হতবিহ্বল ভাব। সবকিছুই অপরিচিত, এমনকি ঘর-বাড়ীগুলোর গঠন প্রক্রিয়াও!

একেবারে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের একটা দল হঠাৎ মনে হচ্ছে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। দেখে সুফিয়ানের হতবিহ্বল ভাবটা যেন আরও বেড়ে গেলো। এদের মাঝে একটি মেয়ে নিশ্চিত পদক্ষেপে প্রায় তার কাছাকাছি চলে এসেছে। অন্যদের মাঝে কেমন একটা ইতস্তত ভাব। তার মধ্যে একজন আবার বলে উঠলো যাসনে তিথিয়া। কি হবে কথা বলে? চলে আয় এটা কমিউনিটি লোকদের দায়িত্ব। কিন্তু তিথিয়া মেয়েটি তার কথাকে আমলে নিলো বলে মনে হ’লো না। সে একেবারে তার পাশে এসে দুই হাত বুকে জড়ো করে কয়েক মুহুর্ত তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো—
— তুমি কোথা থেকে এসেছো? তোমাকে দেখে তো এখানকার লোক মনে হচ্ছে না?
সুফিয়ান এবারে একেবারেই হতচকিত হয়ে গেলো! মেয়েটির বয়স আর কতো হবে? তোরো-চৌদ্দ? অথচ কন্ঠে কেমন এক মায়াবী কর্তৃত্ব ঝরে পড়ছে। আরও আশ্চর্য তার মতো একজন বয়স্ক লোককে সে অনায়াসে তুমি বলে সম্বোধন করছে! হয়তো এটাই এখানকার রীতি? সে বিরবির করে শুধু বলতে পারলো তার সঠিক কিছু মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল প্রতিদিনের মতো। হঠাৎ সামনে একটা বাস। ভুলটা আমারই ছিলো। আমি খেয়াল করিনি, আমি খেয়াল করিনি, ভুলটা…
— মেয়েটি থামিয়ে দিয়ে বললো তুমি কি বাস একসিডেন্টের কথা বলছো? কিন্তু তোমার শরীরে তো তার কোনো চিহ্ন নেই? আর তুমি এখানেই বা এলে কী করে?
— তাতো জানি না!
— তুমি হাঁটতে পারবে তো? চলো তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই। খুব বেশি দূরে নয়।

ইতিমধ্যে অন্যসবাই ও ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুফিয়ান কিছু বলার আগেই আরেকটা মেয়ে বলে উঠলো কী করছিস তুই? বললাম না এটা আমাদের কাজ নয়। কোথাও নিতে হ’লে কমিউনিটি অফিসে নিয়ে যা। যা ব্যবস্থা করার ওরাই করবে।

মেয়েটি বললো ও আগে আমাদের বাসায় যাবে। তারপরে আমার বাবা ওকে কমিউনিটি অফিসে নিয়ে যাবে। এই বলে ও আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সুফিয়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো ওঠো আমার হাত ধরো। ভয় নেই আমার মা-বাবা খুব ভালো মানুষ!

সুফিয়ান ফ্যালফ্যাল করে মেয়েটির মুখের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকলো। কী মিষ্টি মায়াবী একটি মুখ। এ মুখ কি পূর্বে কোথাও কখনো সে দেখেছে? মনে করতে পারছে না কিছুই। তার বুকের ভিতরটায় কেমন এক অনুভূতি যেন অবশ করে ফেলছে সবকিছু! এর কোনো নাম, কোনো ব্যাখ্যা তার জানা নেই। হয়তো মায়া, হয়তো ভালোবাসা, হয়তো এক নিরঙ্কুশ নিশ্চিন্ত সমর্পণ, হয়তো এক বৃদ্ধের হঠাৎ শিশু হয়ে যাওয়া কিংবা এই সবকিছুরই এক সংমিশ্রণ এ অনুভূতি। সে জানে না কিছুই। শুধু অপলক তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে।
মেয়েটি আবারও বলে কই ওঠো? এই বলে সে এবার নিজেই তার একটি হাত ধরে। নিরুত্তর আজ্ঞাবহের মতো সুফিয়ান শুধু উঠে দাঁড়ায়।

মেয়েটি ওর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলে তোরা তাহলে যা। বিকেলে আমাদের আবার দেখা হবে।
কিছুদূর এগিয়ে রাস্তাটা ডানে বাঁক নিয়েছে। মাঝে মধ্যে দু’একটা গাড়ি হুঁশহাশ চলে যাচ্ছে। রাস্তার দু’পাশের হাঁটার রাস্তাও বেশ চওড়া। পরিচ্ছন্ন। প্রায় নির্দিষ্ট বিরতিতে বড় বড় গাছগুলোর মাঝের জায়গায় ছোট্ট বুশ জাতীয় গাছ আর বাহারী রংয়ের ফুল বিছানা। কিছুদূর পরপর বসার জন্যে বেঞ্চ পাতানো। তার অনতিদূরে পানির ট্যাপ। ভীষণ মনকাড়া সবটাই!

পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে তারা। চুপচাপই বলা যায় দু’জন। এর মাঝে দু’একজনের কিঞ্চিৎ কৌতুহলী দৃষ্টি তাদের দিকে। তাতে সুফিয়ানের অস্বস্তি আরও বেড়ে গেলো। গোটা পরিবেশটায়-ই নিজেকে খুব বেমানান লাগছে তার! নীরবতা ভেঙে মেয়েটা বললো—
— ওহ্ আমার নাম তিথিয়া। তোমার নাম কী?
—- একটু চমকে উঠে সুফিয়ান বললো, আমার নাম? আমার নাম সুফি, মানে সুফিয়ান।
—- ওহ্। তুমি ভয় পেয়ো না। এখানে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। তুমি চাইলে আমরা বাসে করেও যেতে পারি তবে সেক্ষেত্রেও একটু ঝামেলা আছে। তাই হেঁটে যাচ্ছি। খুব বেশিক্ষণ লাগবে না।
— এবার সুফিয়ান বললো তুমি তোমার বন্ধুদের সাথেই যাচ্ছিলে কেন অনর্থক আমাকে নিয়ে…
— ওটা তেমন বিশেষ কিছু নয়। আমরা একসাথে প্রতি ছুটির দিনেই ওখানটায় যাই।
— ওটা কি তোমাদের উপাসনার ঘর?
— তা একরকম বলতে পারো।
— আমি কি জানতে পারি তোমরা কোন ধর্মে বিশ্বাস করো?
— ধর্ম? আমাদের এখানে তো তেমন কোনো ধর্ম নেই। ঘরটার বিভিন্ন কক্ষের দেয়ালগুলোতে লিখিত আকারে এই জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণার কথা লেখা আছে এবং তাকে সুখী রাখতে সবার দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে কিছু নির্দেশাবলীও ওখানে সচিত্র উল্লেখ করা আছে। যার যখন ইচ্ছে সে ওখানে গিয়ে ওগুলো পরে এবং আপন সত্তায় সবসময় তা ধারণ করে রাখার চেষ্টা করে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমরা বন্ধুরা মিলে তাই ওখানে যাই। একসাথে বসে গল্প করি। কখনো বাইরের চত্বরটা ঘুরে বেড়াই। এইসব আর কী।
ধর্মীয় কোনো গ্রুপ নেই! এটা কী করে হয়? সুফিয়ান ঠিক বুঝতে পারছে না সে ঠিক শুনছে নাকি তিথিয়া তার প্রশ্নটি বুঝতে পারেনি। সে আবারও জিজ্ঞেস করলো—
— তুমি বলছো এখানে কেউ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না?
— বলতে পারো অনেকটা তেমনই। তবে তুমি কি আরেকটু পরিস্কার করে বলবে ধর্ম বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও?
— এই যে সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ ঈশ্বর, মৃত্যুর পরে আমাদের আত্মার অবস্থা, মানে স্বর্গ-নরক এইসব নিয়ে ভাবনা এবং বিশ্বাস।
— ওহ্ হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। এগুলোও আছে তবে তা একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে। ওগুলো নিয়ে জোট বদ্ধ হওয়া বা সামাজিক ভাবে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে যাওয়া এখানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। স্বর্গ-নরক সম্পর্কে প্রথমেই বলা আছে—এই যে আমরা এখন এখানে আছি, এই সমাজ, এই জীবন, এখানে সবাইকে, সব প্রাণকে সুখী রাখতে পারলে এখানেই তো স্বর্গ এবং তাতে ব্যর্থ হ’লেই তো নেমে আসবে নরক যন্ত্রণা। সুতরাং ভালোটা সবাই মিলে এখানেই প্রতিফলিত করার চেষ্টা করো। এবং সেই সত্তাকে নিয়ে মৃত্যু হ’লে সেখানেও আমরা ঈশ্বরের আশীর্বাদ এবং স্বর্গীয় অনুভূতিতে থাকবো। বর্তমানকে অসুখী রেখে অতোটা দূরের ভাবনা নিয়ে ব্যকুল হয়ে লাভ নেই। আমাদের এখানে সুখ বলতে সিংহভাগ প্রাণী সুখী থাকলেই কেবল তাকে সুখ বলা হয়। এর অন্যথা মানে সমাজে কেউ সুখী না।
— জোটবদ্ধ হয়ে বিশ্বাস ব্রত পালন করা যাবে না! কেন এমন নিয়ম হয়েছে বলতে পারবে?
— নিশ্চয়ই। শুনেছি বহু বহুকাল পূর্বে এখানে লোকজন এমনই বিশ্বাস করতো এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা ঈশ্বরে উপাসনা করতো। কিন্তু সেই বিশ্বাসের পথে তারা তাদের নিজেদের বিশ্বাসকেই শ্রেয় মনে করতো এবং প্রায়শঃই হিংসাত্মক ঘটনায় লিপ্ত হয়ে পড়তো। হাজার হাজার বছর ধরে চলমান উপাসনার এমন প্রথায়ও তারা আত্মিক শুদ্ধি আনতে ব্যর্থ হয়। তাই আইন প্রণয়ন করে প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে এই ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদেরকে শিখানো হয় এই বিশ্বাসগুলোর ব্যাখ্যা একেক জনের কাছে একেক রকম। এমন কী একই ধর্ম ভুক্ত মানুষের মাঝেও এর ভিন্নতা দেখা যায়। তাই এগুলো নিয়ে ভাবা বা কোনো বিশ্বাসে উপনীত হওয়া নিষিদ্ধ নয় কিন্তু এ নিয়ে গ্রুপ বদ্ধ হওয়া বা অন্যের সাথে তর্কে লিপ্ত হওয়া নিষিদ্ধ।
— তোমাদের এই ধারণাটা সঠিক। এ নিয়ে যে কলহের সৃষ্টি হয় পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষেরা তার থেকে কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি! তোমরা ওখানে গিয়ে তাহলে কী শেখো একটু বলবে?
— অবশ্যই। এই যে ধরো প্রথমেই লেখা থাকে-
‘আমাদের এই জীবন একটি আশীর্বাদ। একে সুন্দর এবং সার্থক করে তুলতে হ’লে আমাদের কী কী করা উচিত এবং উচিত নয় এমন কিছু নীতিমালা, এই সমাজের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের কী কী অধিকার থাকা উচিত এবং সমাজ তথা অন্যসব প্রাণীদের প্রতি আমাদের প্রধান দায়িত্বগুলো কী এই সবের একটা তালিকা, এই বিষয়গুলো ওখানে গিয়ে আমরা অধ্যায়ন করি।
— পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্মের মূল কথাগুলোও কিন্তু প্রায় এ ধরনের। কিন্তু তারা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ থেকে কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি!
— কেন পারলো না তার কারণটা জানো?
— কারণ অনেক তবে প্রধান সমস্যা হ’লো মোহ গ্রস্ততা এবং আত্মশুদ্ধির সংকট থেকে তারা উত্তরণ ঘটাতে পারেনি!
— ওহ্ তাই বলো। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি পৃথিবী সম্পর্কে অনেক কিছু জানো?
— হুম। তা বলতে পারো। কিছুটাতো অবশ্যই।
— আমার বাবা এ নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে খুব পছন্দ করবে।
— নিরুত্তর থেকে সুফিয়ান রাস্তার দু’পাশটায় খয়নিকটা দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। সবকিছু কেমন এক মায়ায় জড়ানো সুন্দর। কোনো এক অজানা আবেশে অন্তর ছুঁয়ে যায়। যা শুধু অনুভবের, প্রকাশের নয়!

রাস্তার ওপাশ থেকে বয়স্ক মতন একটি লোক তিথিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছিস? সাথে কে? একটু অন্যরকম দেখতে লাগছে? ভালো আছি আঙ্কেল। বাসায় ফেরার পথে এনাকে দেখতে পেলাম। রাস্তা পাশের বেঞ্চে বসে ছিলো। বাসায় নিয়ে যাচ্ছি, আব্বুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো। পরিচিত মহলের বয়স্ক সবাই-ই তিথিয়াকে খুব আদর করে। ওর নরম মন আর নুতন কোনোকিছুতে কৌতুহলও এরা সবাই জানেন। তাই লোকটি শুধু বললো, ও আচ্ছা! তোর আব্বুকে ফোন করতে বলিস। জ্বী বলবো। বলেই সে সুফিয়ানের দিকে মনযোগ দিলো। সুফিয়ান কিছু জানতে না চাইলেও নিজের থেকে বললো, আমার চাচা, আব্বুর বড় ভাই উনি।
— ওহ্। তোমাকে খুব আদর করেন বুঝি?
— হ্যাঁ। প্রায়ই আসেন আমাদের বাসায়।

সুফিয়ানের শরীরটা কেমন কাঁপছে। ওরা যে জায়গাটায় চলে এসেছে তা একটা জাংশন পয়েন্টের মতো। বিশাল একটা গোল চক্র যার কেন্দ্রটা ভূমি থেকে অনেকটাই উপরে উঠে গেছে। চক্রটির চারদিক থেকে চারটি রাস্তা চলে গেছে। বিভিন্ন রংঙের বাহারি সব ফুল, শ্রাব আর বৃক্ষে মনোরম করে সাজানো চক্রটি। ঢালের চারপাশটায় বেশকিছু ভাস্কর্য। সবই শহরের কোনো না কোনো বাসিন্দাদের বলেই মনে হয়। ওরা যে পাশটায় তার উল্টোদিকে অনেক বড় একটি জায়গা নিয়ে দোকানের মতো অনেকগুলো ঘর, বেশ দূরে একটি ফোয়ারা দেখা যায়, তার চারপাশেই অনেকে বসে আছে, অনেক শিশু কিশোরেরা খেলছে। তারই অনতি দূরে একটা মঞ্চের উপরে কিছু একটা দৃশ্যায়িত হচ্ছে যাকে ঘিরেও বসে এবং দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক। সবকিছু মিলিয়ে কেমন আনন্দময় ফুরফুরে মেজাজের একটি সকাল! স্থানটাকে একটা প্লাজা চত্বরের মতো মনে হয়। সুফিয়ানের পা জোড়া আর চলতে চাচ্ছিলো না। খুব ক্লান্ত লাগছে। রোদটা ক্রমশ বেশ জানান দিচ্ছে তার উত্তাপ। পাশেই একটা বেঞ্চ দেখে তিথিয়াকে জিজ্ঞেস করলো খানিকক্ষণ বসতে পারে কিনা?
— নিশ্চয়ই। বসো। আমিও বসছি তোমার পাশে।
— তোমার বাসায় ফিরতে দেরী হয়ে যাবে না তো?
— তা হবে। তবে সমস্যা নেই আমি আম্মুকে জানিয়ে দিচ্ছি।
বেঞ্চিতে বসে চারপাশটা চেখে চেখে দেখতে লাগলো সুফিয়ান। কিছুটা যেন স্বগোতক্তির মতো করেই সে বললো, তোমাদের শহরটা খুব সুন্দর, মায়াময়!
— তোমার খুব ভালো লেগেছে?
— খুব! এমন সুন্দর শহর আমি এর পূর্বে কখনো দেখিনি।
— ওহ্ আচ্ছা!
— তোমাদের এখানে পোশাকআশাকে সবাইকেই প্রায় একরকম লাগছে, বাড়ি গাড়ি একটি থেকে আরেকটির তেমন কোনো তফাত দেখছি না। তোমাদের এখানে কি সবাই একইরকম স্বচ্ছল ও রুচির?
— না, ঠিক তেমনটি নয়। তফাত আছে তবে জীবন যাপনে ধনী-গরিবের মাঝে পার্থক্য এখানে তেমন বেশি নয়।
— কেন?
— আমাদের এখানে বিশ্বাস এবং আইন হ’লো ব্যক্তিগত চেষ্টায় কেউ অনেক ধনী হ’লেও তার সেই অর্থ সে চাইলেই অতি বিলাসের জন্যে যেকোনো ভাবে খরচ করতে পারবে না। এখানে প্রতিবছরই সর্বোচ্চ খরচের একটা সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
—- এতো অল্প বয়সেই মেয়েটা সামাজিক নিয়মগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখে দেখে সুফিয়ান বেশ বিস্মিত হ’লো। সে বললো কেন এমন নিয়ম?
— তার কারণ হ’লো আমরা সবাই বিশ্বাস করি আমাদের সব সম্পদেরই একমাত্র উৎস হ’লো এই মাটি, আমাদের প্রিয় এই গ্রহ। সুতরাং কেউ অনেক ধনী হ’লেও তার সেই সম্পদে এই গ্রহের সকল প্রাণীরই কম-বেশি অধিকার আছে।
— ও আচ্ছা, খুব ভালো নিয়ম। তাহলে কারোর যদি এমন বাড়তি সম্পদ থাকে তবে সেগুলোর কী হয়?
— প্রশাসনের সাথে আলাপ করে তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় ঐ সম্পদ কোন ক্ষেত্রে কিভাবে খরচ করলে সমাজ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। তা শিক্ষা, কল-কারখানা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রয়োজন বুঝে যেকোনো ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হ’তে পারে। আর এর পুরস্কার হিসেবে রাষ্ট্রীয় ভাবে তাদেরকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়। আমাদের এখানে এই সম্মানে ভূষিত লোকদের সবাই খুব শ্রদ্ধা করে। আর এই গৌরবটুকুকেই তারা উপভোগ করে বেশি।
— খুবই সুন্দর নিয়ম এবং মানসিকতা তোমাদের। ঐ যে সুন্দর সুন্দর মূর্তিগুলো গোল চত্বরের চারপাশে ওগুলো কি এই সব ব্যক্তিদের?
— ওখানে এ ধরনের ব্যক্তিদের মূর্তির সাথে কিছু বিখ্যাত শিল্পী সাহিত্যিকদের মূর্তিও আছে।
— তোমার কি বিশেষ কোনো লক্ষ্য আছে? তুমি বড় হয়ে কী হ’তে চাও?
— এখনো ঠিক জানি না। তবে আমার সাহিত্য এবং দর্শনের বিষয়গুলো ভালো লাগে।
— খুবই ভালো। সাহিত্য, দর্শন আমাদের দৃষ্টিকে খুলে দেয়, মনোজগতকে উন্নত করে।
— তোমার দেখি এ বিষয়ে বেশ ধারণা আছে!
— হ্যাঁ, তা কিছুটা আছে হয়তো।

কথা বলার ফাঁকে আরও একদল তরুণ তরুণী ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলো। তিথিয়াকে দেখে হাত উঁচিয়ে হায় বললো দু’জনে।

কথার ফাঁকে ফাঁকে চারপাশের দৃশ্যাবলি আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো সুফিয়ান। বাতাসের বেগটা একটু বেড়েছে মনে হয়। বৃক্ষের শাখায় দোল খাওয়া পাতার প্রচ্ছদে রোদের সবুজাভ আভা দৃষ্টিকে ধরে রাখে অপার মহিমায়। দূরে একটু নিচু হয়ে নেমে যাওয়া প্রান্তর, তার ওপাশে উপত্যকার মতো মাথা উঁচিয়ে ঘন বৃক্ষের সারি। তাদের সাথে হাতে হাত রেখে আছে নেমে আসা নীল সবুজাভ আকাশ! ওরা যেখানটায় বসেছে তার থেকে একটু দূরে ঢাল হয়ে নেমে গেছে যে রাস্তাটা, কিছুটা পথ গিয়ে ওটারই পাশ ঘেঁষে ডোমের মতো বিশাল আকৃতির একটি স্থাপত্য কর্ম। তার মনযোগে ছেদ ঘটিয়ে তিথিয়া জিজ্ঞেস করলো—
— কী দেখছো এমন নিবিষ্ট হ’য়ে?
— ঐ যে ডোমের মতো বড় বিল্ডিংটা ওটা কি কোনো খেলার মাঠ?
— না। খেলার মাঠগুলো অন্যদিকে এখান থেকে আরও একটু দূরে?
— ওহ্, দেখে মনে হচ্ছে তেমনি কিছু।
— ওটাকে আমরা বলি শাস্তি কেন্দ্র।
— শাস্তি কেন্দ্র? মানে জেলখানা?
— হ্যাঁ। অনেকটাই তেমন। যারা কোনো অপরাধ করে তাদের শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনার জন্যে ওখানে বন্দী করে রাখা হয়। তবে ওর ভিতরেও খেলাধুলা এবং শরীর চর্চা করার ব্যবস্থা আছে।
— কিভাবে তাদের শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনা হয় তুমি জানো? বলবে একটু?
— নিশ্চয়ই। অপরাধ প্রমাণিত হ’লে তার মাত্রা বুঝে তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে ওর ভিতরে যে কক্ষগুলো রয়েছে তাতে বন্দী করে রাখা হয়। শুনেছি কক্ষের দেয়ালে কয়েক ধরণের ছবি লাগিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ করে মুখমন্ডলের ছবি। এর মধ্যে বিশেষ দু’টা ছবি হ’লো অপরাধীর নিজের বাহ্যিক চেহারার আর অন্যটি হ’লো অপরাধ করার সময় তার ভিতরের যে রূপ ছিলো তাকে মুখমন্ডলে রূপ দেয়া ছবি। দু’টা ছবিকে পাশাপাশি রেখে তাকে বলা হয় তোমার ভিতরটা প্রকৃত অর্থে দেখতে এমন। এবং তুমি দেখতে এমনই থাকবে যদি নিজেকে শুদ্ধ করতে না পারো।
— তুমি বলছো অপরাধীর অন্তর্গত রূপটাকে তার চেহারার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে তার সামনে রাখা হয়? এতো খুব অভিনব পদ্ধতির এক শাস্তি!
— তুমি ঠিকই ধরেছো। অপরাধের ধরনের উপরই নির্ভর করে তার ভেতরের প্রকৃতির ছাপটা কেমন হবে। হিংস্র, কদাকার, মিন ( mean ), এ ধরনের কোনো রূপ আর কী।
— অপরাধীকে শুধরানোর জন্যে এই পদ্ধতি কি কার্যকরী হয়?
— নিশ্চয়ই হয়, তাইতো তারা এটা প্রয়োগ করে আসছে।
— তোমাদের এখানে কোনো অপরাধের জন্যে কাউকে কি মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়?
— না। তবে আমাদের এখানে তেমন মারাত্মক কোনো অপরাধও খুব একটা ঘটে না।
— খুব সুন্দর তোমাদের সামাজিক ব্যবস্থা তিথিয়া। শুনে আমার খুব ভালো লাগলো।
— তোমার ক্লান্তি কি কিছুটা কমেছে? এখন কি যেতে পারবে? খুব বেশি পথ আর বাকী নেই।
— তা পারবো। কিন্তু আজ না হয় না-ই যাই? বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো সুফিয়ান।
— কেন? তোমাকে দেখলে আব্বু-আম্মু খুব খুশি হবেন।
— সে আমি বুঝতে পারছি। তুমি খুব ভালো মা-বাবার সন্তান মা। কিন্তু আমাকে যে এখন চলে যেতে হবে!
— কোথায়? কোথায় যেতে হবে তোমাকে?

এ প্রশ্নের আর কোনো উত্তর দিলো না সুফিয়ান। সে দুই হাতে তিথিয়ার মাথায় এবং মুখমন্ডলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো— তুমি এক মায়াবতী রাজকন্যা মা। প্রভু তোমাকে সুখী রাখবেন আমি আশীর্বাদ করে গেলাম। সুফিয়ানের দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো। তিথিয়ার চোখও ছলছল হয়ে উঠছে। সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে শুধু বলতে পারলো— তুমি কাঁদছো কেন? নিরুত্তর সুফিয়ান তিথিয়াকে তার বুকের আরেকটু কাছে টেনে এনে তার মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে বিরবির করে বললো— প্রভুকে ধন্যবাদ। এইটুকু দেখার জন্যেই আমি এতোটা বছর অপেক্ষায় ছিলাম মা। আমার আর কোনো আক্ষেপ নেই, আর কোনো কষ্ট নেই! এখন আমি আসি মা, তোমরা সুখী হও বলে আরেকবার তিথিয়ার মাথায় চুমু খেয়ে যে পথ ধরে তারা এসেছে সেই পথ ধরে ফিরে যেতে লাগলো সে।

তিথিয়া ডাকলো সুফিয়ান, সুফিয়ান তুমি কি আবারও আসবে? বলে যাও সুফিয়ান! সুফিয়ান আর ফিরে তাকালো না! তিথিয়ার চোখ জোড়া একেবারে ঝাপসা হয়ে গেলো। তার দৃষ্টির সামনেই একটি শরীর ছায়ার মতোন কেমন অশরীরী হয়ে নিমিষে মিলিয়ে গেল! কেমন এক অজানা কষ্ট, অজানা বিহ্বলতা, বিমূঢ়তা তাকে একেবারে আড়ষ্ট করে ফেলছে। এ অভিজ্ঞতা তার জীবনে যে এই-ই প্রথম!

আশা ছেড়ে দিয়েছেন ডাক্তাররা। আজ আটদিন হ’য়ে গেলো সুফিয়ানের জ্ঞান ফিরে আসছে না! লাইফ সাপোর্টে আছে। দূর্ঘটনার পর থেকেই তার স্ত্রী শারমিন প্রত্যাহিক সব কাজকর্ম ফেলে দিয়ে এই বিছনার পাশেই বসে থাকেন। ডাক্তাররা তাকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার জন্যে। রুমে এখন তাদের মেয়ে সাঁওতালি, শারমিনের এক বোন এবং আরও দুজন কাছের আত্মীয়। সবাই শারমিনকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। তার চোখের কোণ গড়িয়ে নামা জল যেকোনো শ্রাবণ ধারাকে হার মানায়। সাঁওতালি নিজেও কাঁদছে, তারপরও একটু পরপর সে মায়ের চোখের জল মুছে দিচ্ছে! কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলতে গিয়ে বারবার থেমে যাচ্ছিল শারমিনের কন্ঠ। শেষ পর্যন্ত সে যা বললো সে হয়তো কোনো ভাষা নয়, এক বুক ভাঙা ব্যথার গোঙানি! — ‘ আমি তাকে যেতে দিবো না। তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর- সারাটা জীবন সে আমার ন্যায় অন্যায় কোনো আবদারেই না করেনি। আর এই একটি আবদার- আমি যে তাকে কতোবার বললাম, এই কঠিন পৃথিবীতে সে যেন আমাকে একা রেখে আগে চলে না যায়, এটা সে শুনলো না কেন? জিজ্ঞেস কর, আমি তাকে যেতে দিবো না, যেতে দিবো না! যেতে…! বিছানার একেবারে কাছে ঝুঁকে পড়েছে শারমিনের মাথা। ডান হাত দিয়ে সুফিয়ানের ডান হাতটি ধরে রেখেছে সে। হাঁটু গেড়ে বসে তার বোন মাথাটাকে যতোটা সম্ভব শক্ত করে বুকের কাছে ধরে রেখেছে! সাঁওতালি কেঁদে কেঁদে ডেকে যাচ্ছে মা মা মা!—

শারমিনের আর কোনো সাড়া নেই। সে সম্বিৎ এ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না! পশ্চিমের জানালার বাইরে একটা উজ্জ্বল বিকেলের আলো ক্রমশ নিভে যাচ্ছে সন্ধ্যার গ্রাসে! কোথাও অনর্গল ডেকে যাচ্ছে একটা ব্লু জে (Blue Jay)। হয়তো সে সাথীহারা, হয়তো সে বিপন্ন!

(‘নক্ষত্রহীন রাতের আকাশ’ এর একটি উপস্থাপন / A presentation from ‘Starless Night Sky’)

_______© ফরিদ / নভেম্বর ৮, ২০২৪

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন