কথায় কথায় কখন যে পশ্চিমাকাশের কোণে সূর্যমামা অস্তাচলে ঢলে পড়েছিল, টেরই পাইনি। হঠাৎ ট্রেনের বাঁশি আর ঝিকঝিক শব্দে আমরা দুজনেই চমকে উঠি। পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে দেখলাম, মুখের মলিন হাসিটুকু মিলিয়ে গেছে নির্মলার। অসহায় ওর চোখের দৃষ্টি। নৈঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কষ্ঠ হচ্ছে জেনেও ওকে শান্তনা দেবার মতো একটা শব্দও আমার উচ্চারিত হোলো না। বলার মতোও কোনো ভাষাও খুঁজে পেলাম না। বুকের ভিতরটা আমার বার বার মোচড় দিয়ে উঠছিল, ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। শ’পাঁচেক টাকা ছিল ব্যাগে, ওর হাতে গুঁজে দিতেই আমায় জড়িয়ে ধরে। ভাবলাম, কেঁদে ভাসিয়ে দিলো বোধহয়। অথচ ওর চোখে একফোঁটা জল নেই, কিন্তু বুকের ভিতরটা যে কাঁন্নায় ভেসে যাচ্ছিল, তা ওর প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রঃশ্বাসে আমি দৃঢ়ভাবে সেদিন অনুভব করেছিলাম।
একসময় আমার পিঠে মৃদু হস্ত সঞ্চাণল করে বলল,-‘কষ্ট পেলি, তাই না! কি করি বল! সবই আমার দুর্ভাগ্য! মনে কষ্ট নিসনা। আজকের দিনটা তোর মাটি করে দিলাম। তবে যে আনন্দটুকু সঞ্চয় করলাম, সেটুকুই জীবনের বাকী দিনগুলিতে আমার বেঁচে থাকার একটা উপকরণ হয়ে থাকবে। কোনদিন ভুলবো না। যদি পারিস একদিন আমাদের আশ্রমে ঘুরে যাস, আমার ছানাপোনাগুলোকেও একটু দেখে যাস্। কি রে, চুপ করে আছিস? বল না, আসবি তো!’
কম্পিত স্বরে বললাম,-‘হ্যাঁ আসবো। ভালো থাকিস।’
বলে অবিলম্বে ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে আসতেই পুরোনো স্বভাব ওর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ফিক্ করে হেসে বলে,-‘এই শোন শোন, দেখি তোর পেটটা?’
একগাল হেসে বলল,-‘পেটটা একটু বড় লাগছে মনে হচ্ছে! আবার হবে টবে না কি রে?’
বলে হি হি করে হেসে ওঠে। আমি বোবা দৃষ্টি মেলে হাঁ করে থাকি। মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় হয়ে পড়লেও হাসি চেপে রাখতে পারিনি। আমিও হেসে ফেলি। কিন্তু ওর হাসি আর বন্ধ হয়না। পাগলের মতো দাঁতকপাটি বার করে হেসেই চলেছে। হাসতে হাসতে একেবারে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। ষ্টেশনের লোকজন সবাই ওর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছিল, ভদ্রমহিলার মাথা খারাপ কিংবা পাগলই হবে হয়তো! নইলে হাওড়া রেলষ্টেশনে বিশাল জন-সমুদ্রের মাঝে এভাবে তামাশাই বা করবে কেন!
মনে মনে ভাবলাম, হয়তো এমনি করেই বুকের জ্বালা যন্ত্রণা মিটাতে জন-অরণ্যের মাঝে না জানি কত অজস্র দিবস রজনী অতিবাহিত করেছে, কে জানে! কিন্তু কেউ না বুঝুক, সেদিন ওর মনের ব্যথাটা গহীন অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম, জীবনের পরম আকাক্সিক্ষত চাহিদা অপূরণের কারণেই নির্মলার ঐ নির্মম পরিণতি।
ওর ওই দৃশ্য দেখে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি। পরক্ষণেই বাচ্চা শিশুর মতো শান্ত হয়ে গেল নির্মলা। হাসিটাও মিলিয়ে গেল। আমি পারলাম না ওর সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে। ‘সাবধনে থাকিস, আমি আসছি।’ বলে দ্রুত ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছুদূর এসে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, প্ল্যাটফর্মে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে নির্মলা। ঠিক যেন পথের প্রান্তে পড়ে থাকা মলিন বৃক্ষলতার মতো। ক্রমাগত আগন্তুক যাত্রীর পদতলে যেন পিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। অথচ ওর কোনো বিকার নেই। উদ্বেগ নেই। নেই বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া। যার কৈফেয়ৎ চাইবার মতোও কোনো স্বজন নেই যে, উদ্বিগ্ন হয়ে ওর অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকবে।
হঠাৎ চোখের নিমিষে সংসারচ্যুত নির্মলা বিশাল জন সমুদ্রের মাঝে কোথায় যে মিলিয়ে গেল আর দেখতে পেলাম না।
নির্মলা চলে গেল, যেন বুকভাঙ্গা কান্না এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার বুকের মাঝে। ষ্টেশনের একটা বেঞ্চিতে বসে ব্যাগ খুলে একটা রুমাল বার করে হু হু করে বেরিয়ে আসা চোখের জল মুছতে লাগলাম। হঠাৎ পিছন থেকে সিকিউরিটির পোষাক পড়া একটা বয়স্ক ভদ্রলোক ডেকে বললেন,-‘ম্যাডাম, আপনার কত টাকা গেল আজ?’
চমকে উঠে রূঢ়ভাবে বললাম,-‘কে আপনি? তাতে আপনার কি এসে যায়? ও আমার বন্ধু।’
ভদ্রলোক গোঁফের নীচে ফিক্ করে হাসলেন। হাসিটা বজায় রেখে খানিকটা পরিহাস করে বললেন,-‘ও তাই না কি, মহিলাটি আপনার বন্ধু! ওকে আপনি ভালো করে চেনেন তো?’ বলে হাতের ডান্ডাটা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে কেমন কৌতূক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। কর্কশ কণ্ঠে বললাম,-‘তার জন্যে আপনার মাথা ঘামাতে হবে না। আপনি আপনার নিজের ডিউটি পালন করুন, যান!’
কিন্তু দেখলাম, বড় বেশরম লোক। তাও গেল না। উল্টে জিজ্ঞ্যেস করলেন, -‘উর্মিলার বয়স কত জানেন?’
অবাক কণ্ঠ বললাম, -‘উর্মিলা? কে উর্মিলা?’
-‘ঐ যে, এতক্ষণ হিন্দি ফিল্মের মতো যে আপনাকে দুঃখের কাহিনী শোনাচ্ছিল। আপনি যার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলেন।’
-‘মানে?’ আঁতকে উঠি। যতো শুনছিলাম ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি হাঁ করে থাকি। আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। একটা ঢোক গিলে মৃদু স্বরে বললাম-‘কি দস্যি মহিলা, মিথ্যে কথা বলে আমার কাছ থেকে এতগুলো টাকা ও’ নিয়ে গেল! ওকে তো পুলিশে দেওয়া দরকার। সব জেনে শুনে আপনারা চুপ করে আছেন?’
গলাটা ঝেড়ে নিয়ে ভদ্রলোকটি বললেন,-‘আপনি এখনো ওকে চিনতে পারলেন না? ওতো নির্মলার যমজ বোন, উর্মিলা!’
স্ববিস্ময়ে বললাম,-‘এ্যাঁ, বলেন কি আপনি? ওর এই দশা কেন? কিন্তু আপনি এতো কিছু জানলেন কি করে?’
ভদ্রলোক নীরবে হাসলেন। বললেন,-‘ওতো আমাদের এলাকাতেই ঘোরাফেরা করে। দিনের বেলায় ষ্টেশনে পড়ে থাকে, আর সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলেই ফিরে যায় নিজের ঘরে। প্রায়শঃই আমার স্ত্রীর কাছে এটাসেটা চাইতে আসে। আর এলে কি করে জানেন? একেবারে গেঁঢ়ে বসে। ওঠার নামই করেনা। হাত-পা ছড়িয়ে আমাদের বারান্দাতেই বসে পড়ে। সারাক্ষণ বোনেদের গল্প করে। ওদের নারী নক্ষত্র আমাদের সব জানা!’
উৎসুক্য হয়ে বললাম,-‘তা’হলে ওর বোন নির্মলা এখন কোথায়? ওদের সম্বন্ধ্যে আপনি আর কি কি জানেন?’
কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়ে বললেন,-‘স্বামী-পুত্র নিয়ে আপনার নির্মলা খুব সুখেই আছে। ঐ যমজ ভাই সৌরভের ঘরেই। ঘটনার প্রথম দিকের সবটাই সত্য। শেষের দিকটা উর্মিলার ঈর্ষার রঙে বিকৃত। প্র্যাক্টিক্যাল নির্মলা এমন ভুল কেন করবে? স্বামী সৌরভকে নিয়ে সিমলায় বেশ সুখেই আছে। সুন্দরী ছোটবোনকে দত্তক নিলো মাসী-মেসো, মানুষ করলো, ভালো ঘরে বিয়ে দিলো। আর বাকি পাঁচবোনের কেউ গেল দোজবরে, কেউ অকাল বৈধব্যে অমানবিকভাবে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীর মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে করে বসে আত্মহত্যা। আরেকজন বন্ধানারীর কলঙ্ক মাথায় চেপে স্বামীর পরিতক্তা হয়ে একেবারে নিরুদ্দেশ। কোনো খোঁজ-খবর নেই। আর উর্মিলার তো বিয়েই হলো না। স্বল্প বিদ্যা-বুদ্ধির প্রভাবে কিভাবে ঐ অর্ফেনেজের সাথে জুড়ে গিয়ে বেশ কয়েকবছর সমাজ সেবিকার কাজে লিপ্ত ছিল। ওটাই ওর ঘর-সংসার ছিল, নিরাপদ বাসস্থান ছিল, নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল, কিন্তু নিজের স্বভাব চরিত্রের গুনে সেখানে বেশিদিন টিকতে পারেনি। বেচারি যাবেইবা কোথায়। জীবিকার তাগিদেই পয়সা কড়ি জোটাবার জন্যে নানান গল্প ফেঁদে মানুষকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে, লোক ভোলায়। কিন্তু আমারও তো মানুষ, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসার করি, সবই বুঝি, অনুভব করতে পারি। পুলিশে দেবার কথা ভাবতেই পারি না। জেনে শুনেও চুপ করে থাকি। কিন্তু ওর গল্পগুলি কিছুটা মিথ্যে হলেও অনাথ ছেলেমেয়েদের প্রতি ওর ভালোবাসা মিথ্যে নয়। তাদের চারবেলা ক্ষিদেটাও মিথ্যে নয়।’
ভদ্রলোক অস্ফূট ম্লান হেসে বললেন,-‘আপনাকেও বলতাম না। কিন্তু আপনার কান্না দেখে ভাবলাম, অন্ততঃ জেনে খুশী হবেন যে আপনার বন্ধু নির্মলা সুখেই আছে।’
তার পরক্ষণেই ডেকে বললেন,-‘ম্যাডাম্, উঠে এসে দেখুন!’
উঠে গিয়ে প্ল্যাটফর্র্মের রেলিংএর বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়াল থেকে দেখি, খোলা রাস্তার মাঝে এক ভদ্রলোকের হাত চেপে ধরে, রহস্যাবৃত হাসি ছড়িয়ে উর্মিলা বলছে,-‘চিনতে পারছেন না? আমি নিবেদিতা!’
সমাপ্ত