( তিন )

পলিটিক্যাল্ পার্টির বিশিষ্ট নেতা ধীরেন মুখুজ্জ্যের একমাত্র তনয়ার বিবাহ, চাট্টিখানি কথা! অসীম আনন্দ, উচ্ছাস নির্মলার। কোথায় যে ধারণ করে রাখবে, ভেবে কূল খুঁজে পায় না। দিশা হারিয়ে ফ্যালে।

বিয়ের দিন সকাল থেকেই আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই মেতে ওঠে আনন্দে। ইউরোপীয় ষ্টাইলে বাদ্য বাজজে, সানাই বাজজে। বড়দের ভাগ-দৌড়, জল্পনা-কল্পনা, ছোটদের হৈ-হুল্লোড়, হাসি-কলোতান, গুঞ্জরণ, ছোটাছুটি, হাঁকাহাঁকি। সারাবাড়ি গমগম করছে। দূপুর থেকেই গোধূলীর শুভক্ষণের অপেক্ষায় বাড়ির সবাই অস্থীর হয়ে ওঠে। সন্ধ্যে থেকে কনেপক্ষরাও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। আগুন্তুক অথিতি এবং শহরের গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গের আপ্যায়ন যথারীতি শুরু হয়ে যায়। অথচ এতো আনন্দ-উল্লাসের মাঝে এতোবড় একটা অহেতুক সংকট লুকিয়ে ছিল, যা বিয়ের পিঁড়িতে পাশাপাশি বর-কনের মুখদর্শণ করেও কারো নজরে পড়েনি। কিন্তু শুভদৃষ্টির শুভমুহূর্তে হৃদয়ের দুকূল প্লাবিত করে অব্যক্ত আনন্দের ঢেউ উতরে উঠতেই হঠাৎ অজানা আশঙ্খায় বুক ধুকধুক করে ওঠে নববধূ নির্মলার। উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো চোখের তারাদু’টি স্থির হয়ে যায়। কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা। অস্ফূট আর্তনাদ করে ওঠে,-‘এ কি, বিপ্লব মেয়েদের মতো মাথা নত করে আছে কেন? আশ্চর্য্য! সদা হাস্যৎজ্জ্বল, হ্যান্ডসাম মিশ্র ব্যক্তিত্ব তরুণ যুবক, এমন শান্ত, সৌম্য লাজুক হয় কি করে? সেদিন এতক্ষণ সাথে ছিল,আমাদের কথা হোলো, তখন একবারও তো মনে হয়নি! নাঃ, এ বিপ্লব নয়! হতে পারে না। তা’হলে কে ও’? এখানে এলো কি করে?

উদ্ভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে নির্মলা। উত্তেজনায় হৃদস্পন্দন ওর দ্রুতগতীতে চলতে শুরু করে। একটা শব্দও উচ্চারিত হয়না। আচমকা অনাকাক্সিক্ষত বিভীষিকায় সারা শরীর জমে হীম হয়ে আসে। এতো লোকজনের মাঝে একটা কেলেঙ্কারী না হয়ে যায়। কিছুতেই মেলাতে পারেনা। কোথাও এতটুকু তফাৎ নেই। একই চেহারা। সেই চোখ, নাক। সেই চিবুক, পশমাবৃত বলিষ্ঠ বাহু। কিন্তু একটা মানুষ দু’দিনে এতখানি পরিবর্তন হয় কি করে? এ কেমন করে সম্ভব? আবার পরক্ষণেই ভাবে, এ প্রজন্মের তরুণ যুবক, সাদা ধবধবে আর্দী কাপড়ের ধূতী, শীল্কের কূর্তা পরিধানে বর বেশে হয়তো লজ্জা পাচ্ছে বোধহয়। তবু মনের ভিতর কোনো আশক্সক্ষা কিংবা সন্দেহের বীজ তেমন ভাবে গজিয়ে না উঠলেও একরকম ঔদাসীন্যতা আর গহীন ভাবনার মধ্যে দিয়েই মিলনমন্ত্র উচ্চারণে সেদিন শুভপরিণয় সুসম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল নির্মলার। তারপর এলো বাসররাত। জীবনের পরম আকাক্সিক্ষত শুভ দিনের চরম আনন্দের শুভক্ষণ। এক নতুন অভিজ্ঞতা। মনের মতো জীবনসাথী পেয়ে আজ জীবন ধন্য নির্মলার। সার্থক ওর জনম। আসন্ন বাসররাতের গভীর নির্জনতায় ও নিঃভৃতে আকাক্সিক্ষত কামনা-বাসনাগুলি যখন বাস্তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে, উফ্, তখন কি যে হবে!

পুলকে একটা শিহরণ খেলে গেল ওর দেহে, মনে। শ্বাশত লজ্জায় রাঙাবৌ নির্মলার বিবাহবাসরের চিরাচরিত জৌলুস ও সানাইয়ের মনমাতানো অপূর্ব মূর্ছণায় ভিতরে ভিতরে মনকে আরো প্রভাবিত করে। বাসরঘরের ঝুলন্ত ঝাঁড়বাতিটার ঝিকিমিকি আলো আর রজনীগন্ধার মধুর সুরভীতে সৃষ্টি হয় এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। ওর স্বপ্নের সেই স্বর্গপুরি। যেখানে রাজা-রানী ওরা দুজনই হবে একমাত্র বাসিন্দা।

দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুলশয্যায় বসে আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠে নির্মলার। এ কি, নুতন চন্দন পালঙ্ক, বিছানাপত্র তোষক সবই নতুন। এর ভিতর থেকে টপ্ করে একটা কাগজের টুকরো পড়লো নীচে। কাগজটা এলো কোত্থেকে? কিসের কাগজ?

মনের ভিতর নানান প্রশ্নের ভীঁড় জমে উঠতেই খানিকটা আঁতঙ্কিত হয়ে কাগজটা হাতে তুলে নেয় নির্মলা। দ্যাখে ওটা একটা লম্বা চিঠি। খটকা লাগলো মনে। ওর সন্দেহ ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে। একরাশ বিস্ময় নিয়ে চিঠিটা খুলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওর হৃদয়পটভূমিতে লালিত ও পূঞ্জীভূত সমস্ত কামনা-বাসনা, ভক্তি-শ্রদ্ধা, ভালোবাসার ইচ্ছানুভূতিগুলি সব অনুতাপের আগুনে পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেল।

একেই বলে বরাত। আসন্ন বাসররাতের ক্ষণপূর্বের কাগজের ঐ টুকরোটাই নির্মলার জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। এ কেমন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! এ কেমন বিধাতা প্রদত্ত দু’টি মানব-মানবীর আত্মার মধুর মিলন! তাদের সংসার বেঁধে দেওয়ার মিথ্যে প্রয়াস! যেদিন মনের শক্তি, সাহস ও বুদ্ধি জোগাবার মতো কেউ ছিল না ওর পাশে।

চিঠিতে লেখা ছিল,-‘তোমায় কি বলে সম্বোধন করবো, জানি না। ক্ষমা করবে না জেনেও না লিখে পারলাম না। নইলে বড় অধর্ম হবে। চেয়েছিলাম, অন্ধগলির দুর্বিসহ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে ঘর বাঁধবো। একান্তে সুখে-শান্তিতে সংসার ধর্ম পালন করবো। তোমায় দেখার পর সেই ইচ্ছে আরো প্রবল হয়ে উঠলো। জানো, রাতে আমার ঘুম হতো না। শুধু ভাবতাম, নির্জন নিঃভৃতে নিবিড় করে, একান্ত আপন করে, কখন তোমায় কাছে পাবো, তোমায় বুকভরে ভালোবাসবো, আদর করবো। যে কথা আজ মূল্যহীন, অর্থহীন। জানি, এসব তোমার কাছেও অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে। তুমি বিশ্বাস করো, অনেক চেষ্টা করে ছিলাম, সাধারণ মানুষের মতো সভ্যসমাজে সসম্মানে মাথা উঁচু করে বাঁচবো, নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত করবো। কিন্তু পারলাম না। আজ আমি দুষ্টচক্রের শিকার। এমন সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছি, ক্ষুধার্ত হায়নার মতো ঐ শয়তানদের সঙ্গ বর্জন করা আজ আর সম্ভব নয়। আমি বংশের কলঙ্ক। আমার জন্মদাতা মাতা-পিতার উঁচু মাথা হেট করে দিয়েছি।

আমায় পূনরায় ফিরে যেতে হচ্ছে নরকের সেই আড্ডাখানায়। জীবনের রসাতলে। যেখান থেকে কোনদিনও আমার মুক্তি নেই। যদি পারো, আমায় ক্ষমা কোরো। এ তো মহান স্রষ্টার অসীম দয়া। একই চেহারা নিয়ে, একই মায়ের সন্তান হয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছি। যাকে বিবাহ করলে, ও’ আমারই যমজ ভ্রাতা সৌরভ। তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী নির্মলা। ভাই আমার হীরের টুকরো ছেলে। বাবা-মায়ের সুযোগ্য পুত্র। শুধু চেহারাই হুবহু মিল। এছাড়া আমরা দু’জন সম্পূর্ণ আলাদা, ভিন্ন জগতের মানুষ। ভিন্ন রুচী, ভিন্ন মনোবৃত্তি।

জানো, ভাই আমায় ঘেন্না করে, অশ্রদ্ধা করে। তাই তো অভিমান করে দেশান্তর হয়েছিল। আমাদের দুজনের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। সদ্য বিলেত ফেরত চ্যাটার একাউন্টটেন্ড্। ভাই বলে বলছি না, সৌরভ খুউবই অনেষ্ট, ইনোসেন্ট পার্সন, এ্যান্ড হ্যান্ডসাম্, গুড্ লুকিং। শুধু ব্যবহারেই নয়, অত্যন্ত ভদ্র, নম্র, চিন্তাশীল, রুচীশীল একজন মার্জিত পুরুষ। সেন্ট্রাল গর্ভনমেন্টের নতুন একটা চাকুরীতে জয়েন করেছে। ভাইকে সুখী করতে পারলে, জেনো আমিও খুশী হবো। আর্শীবাদ করি, ভাইকে নিয়ে সুখী হও। রাজরানী হও।

নিচে ছোট্ট করে লেখা,
হতভাগ্য বিপ্লব

চিঠিটা পড়ে হৃদয়পটভূমি তুমুল কম্পনে তোলপার হয়ে যায় নির্মলার।থরথর  করে গা-হাত-পা কাঁপে, ঠোঁট কাঁপে। রুদ্ধ হয়ে যায় কণ্ঠস্বর। ঘর্মসিক্ত হয়ে ওঠে সারাশরীর। এ কি ঘটলো ওর জীবনে! কিকরে এমন হোলো! স্বপ্নেও তো কল্পনা করেনি কখনো।
কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বণায় অনাকাক্সিক্ষত বিভ্রান্তিতে সদ্য পুলকে বিকশিত মনভোমরা মুমূর্ষ্যূ হয়ে পড়লেও সেদিন নিজের ভাগ্যকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি নির্মলা। পারেনি সদ্য বিবাহিত পুরুষ, উজ্জ্বল সুঠাম সুদর্শণ তরুণ যুবক সৌরভকে সর্বান্তকরণে স্বামীরূপে গ্রহণ করতে, ওকে স্বীকার করতে। পারেনি ওর হৃদয় নামক বিশাল সাম্রাজ্যের রাজ সিংহাসনে ঠাঁই দিতে। শুধুমাত্র স্বনামধন্য পিতার মান-সম্মান রর্ক্ষাথে সেদিন কোনো সীন ক্রয়িটে না করে নিঃশব্দে বেছে নেয় পলায়নের পথ।

অতঃপর, বেনারসী শাড়ি, দামী স্বর্ণালঙ্কার ও সুরভীত ফুলের গহনায় সুসজ্জিত বধূবেশে ধূর্ত স্বামীর প্রতিক্ষায় রাজরানীর মতো বসে থাকার প্রবৃত্তি হলো না। তিক্ত-বিষাক্ত হয়ে উঠলো ওর দেহ, মন-মানসিকতা। জীবনের চরম মুহূর্তে কি না এতবড় প্রতারণা! এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা!

সৌভাগ্যক্রমে বাসরঘরের সংলগ্নেই ছিল ব্যাল্কনির দরজা। পালাবার সুবর্ণ সুযোগ। এইভেবে বিছানা ছেড়ে দ্রুত নেমে আসে। গিয়ে দাঁড়ায় জানালার ধারে। গলা টেনে দ্যাখে, দরজাটা খুললেই একটি ছোট্ট ব্যাল্কনি। তার চারিদিকে কোমড় পর্যন্ত পাতলা নেট্ দিয়ে ঘেরা। মাটি থেকে উচ্চতাও খুব বেশী নয়। অনায়াসে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাওয়া যাবে। এইভেবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

ইতিমধ্যে দরজার আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে নির্মলা। চোখ পাকিয়ে দ্যাখে, খাদির পাঞ্জাবি পড়ে নব বিবাহিত স্বামী সৌরভ বাসরঘরে ঢুকে ছিটকিনি তুলে দরজা বন্ধ করছে। বেশ লাগছিল ওকে। আতরমাখা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতেই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানালার দিকে। মৃদুস্বরে বলল,-‘তুমি ওখানে কেন নিলু! আজ থেকে তোমায় নিলু বলেই ডাকবো। জানালার ধারে কি করছো!’

ততক্ষণে একটা সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করে সুপ্রসন্ন মেজাজে একটা টান দিয়ে বলল,-‘বাবা-মায়ের জন্যে মন কেমন করছে! জানি, প্রথম প্রথম সব মেয়েরই এমন হয়। লক্ষীটি,অন্তত আজকের দিনে মন খারাপ কোরো না, প্লীজ!’

কিছুক্ষণ থেমে বলল,-‘কি হলো নিলু, কথা বলছ না যে! এসো, আমার কাছে এসে বোসো! কিছু বলো!’

রজনীগন্ধায় সুসজ্জিত বিছানার পাশে রাখা টেবিল-ল্যাম্পটা তীব্র আলোয় জ্বলছিল। সামান্য আলো কমিয়ে নির্মলার সন্নিকটে এগিয়ে আসে। ও তখনও পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরে ভিতরে ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে ফেটে পড়ছে। চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। কোণা চোখে চেয়ে দ্যাখে, হুবহু একই চেহারা সৌরভের। একই হাইট। একই শরীরের গঠন। বোঝার উপায় নেই। ”াপা উত্তেজনায় হৃদয়ের দুকূল যেন ভেসে যাচ্ছে। স্বতঃফূর্তিতে মন-প্রাণ একেবারে টগবগ করছে। আবেগের প্রবণতায় চোখমুখ থেকে ঝরে পড়ছে উচ্ছাস।

মনে মনে ভাবে, আশ্চর্য্য, স্পর্ধার বলিহারি। এতবড় একটা ঘটনার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই! একটু ডর-ভয় নেই, সংকোচবোধ নেই! ভেবেছে দুনিয়ার মানুষকে ধোকা দিয়ে পার পেয়ে যাবে। কিন্ত নির্মলাকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয় বাছাধন! ধীরেন মুখুজ্জ্যের মেয়ে আমি, এতবড় অন্যায়, অবিচার, অধর্ম কখনো সইব না। এ বিয়ে আমি মানিনা। এ বেআইনি, বেইমানী, ফ্রড। তুমি কতখানি এগোতে পারো, আজ আমিও দেখে নেবো। শুধু সুযোগের অপেক্ষা।

বাসররাতে বসে বসে নব দাম্পত্য জীবনের যবনিকা ঘটাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল নির্মলা। হঠাৎ সৌরভের মৃদু কষ্ঠস্বরে কেঁপে ওঠে। -‘কই, দেখি তোমার হাতটা!’

বলে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ছোট্ট রেডবক্স বের করতেই নির্মলার বিষন্নময় কষ্ঠস্বরে থমকে দাঁড়ায়। -‘উফ্, মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে। একটা এ্যা¯িপ্রন হবে?’ বলতে বলতে জালানার কপাটে মাথা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় নির্মলা।

ক্ষণিকের যে অকপট সারল্য দেখা গিয়েছিল, তা মুহূর্তে মিলিয়ে গেল অপ্রস্তুত সৌরভের। মুখটাও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,-‘আই থিঙ্ক, তোমার শাড়ি গহনার ভরেই বোধহয়। দীজ্ আর টু হেভী। খুলে ফ্যালো সব। আমি এখনই এ্যাস্প্রিন এনে দিচ্ছি।’

বলে সৌরভ অবিলম্বে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ইত্যবসরে সুযোগের সদ্ ব্যবহার করতে সক্ষম হয় নির্মলা। সৌরভ আসার আগেই পড়নের বেনারসি শাড়ি, গহনা খুলে একটা কাপড়ে বেঁধে, ব্যালকনি থেকে লাফ দিয়ে চুপিচুপি রাতের অন্ধকারে শ্বশুড়বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় বান্ধবী সুদীপ্তার ফ্ল্যাটে। ততক্ষণে সারাপাড়ায় হৈ চৈ পড়ে যায়, বারুজ্জ্যে বাড়ির নববধূ নিখোঁজ, সমস্ত গহনা স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়েছে।

শুনে মাথায় হাত সবার। হতবাক হয়ে যায় বিস্ময়ে। এমন কী ঘটলো? হতভাগী, এতবড় একটা কান্ড করলি তুই! বাবা-মায়ের কথা একবারও ভাবলি নে!

কিন্তু শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা মনে মনে আসংখ্যা নিয়ে থাকলেও এহেন অপ্রীতিকর ঘটনা বাসররাতইে যে ঘটে যাবে, তা কেউই কল্পনা করতে পারেনি। ওদিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ মাতা-পিতার শোচনীয় অবস্থা। বজ্রাঘাত পড়ে মাথায়। উক্ত ঘটনার কারণ অনুসন্ধ্যানে দিশা হারিয়ে ফ্যালে। লজ্জায় অপমানে কপাল চাপড়াতে থাকে। কিছুতেই ভেবে কূল পায়না যে, নির্মলার আগ্রহেই এ বিবাহের আয়োজন। কোনদিকে ত্রুটি রাখেনি, এতটুকু কার্পণ্যতা করেনি। ওর সকল চাহিদা যথাযথ পরিপূর্ণ করেও মাতা-পিতার মুখে চূণকালি মেখে, তাদের উঁচু মাথা হেট করে দিয়ে নির্মলা কেন এমন করলো?

প্রমিলাদেবী আর্তনাদ করে ওঠে,-‘হতচ্ছাড়ি, কুলাঙ্গার, এ তুই কি করলি? এ কোন সর্বণাশ ডেকে আনলি? এইদিন দেখার জন্যই কি তোকে বুকে বেঁধে মানুষ করেছিলাম! পোড়ামুখি, জন্মলগ্নেই তো নিজের জনমধাত্রী মাকে খেয়েছিস। ধংস করে দিয়েছিস ওর সুখের সংসার। ছাড়খার করে দিয়েছিস মাতা-পিতার জীবন। সেদিন হাসপাতাল থেকে তোকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম কি এই জন্যেই? তোর এতটুকু রুচীতে বাঁধলো না? বিবেকে দংশণ করলো না? মায়ের অভাব কখনও তোরে বুঝতে দেই নাই। কখনো কষ্টে রাখি নাই।
আমাদের এতবড় শাস্তি দিলি তুই? আমাদের নাক কান সবই যে কাটা গেল রে! মান-ইজ্জত আর রাখলি নে আমাদের।’

অথচ বিপ্লবের লেখা চিঠিখানা হাতে না পড়লে এতক্ষণে গভীর ভালোবাসায় লিপ্ত হয়ে নিজেকে সৌরভের কাছেই সঁপে দিতো। আবেগে সোহাগে কেটে যেতো কত প্রহর। হারিয়ে যেতো দুজনার একান্ত আকাক্সিক্ষত চাওয়া-পাওয়ার অথৈ সাগরে। অঙ্গে অঙ্গে উষ্ণ পরশে দু’টি কোমল হৃদয়-মন-প্রাণ সারাশরীর মিশে লীন হয়ে একাকার হয়ে যেতো। অচিরেই দুজন দুজনার নিঃসৃত ভালোবাসার অবগাহনে নিমজ্জিত হয়ে কামনা বাসনার উত্তাল অগ্নিকান্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ে নারী-পুরুষের আদিম খেলার উন্মাদণায় দুজনেই মেতে উঠতো। কোনদিনও টের পেতো না। কিন্তু সৌরভের সাথে বিয়েটাও তো আর মিথ্যে নয়। সামাজিক ও পারিবারিক রীতি-নীতি ও ধর্মানুসারে অগ্নিসাক্ষী রেখে, ছত্রিশকোটি দেবী-দেবতা সাক্ষী রেখে স্বামী-স্ত্রী রূপে চিহ্নিত হয়েছে দুজনে। তার চে’ও বড় কথা, লগ্নভ্রষ্ঠার হাত থেকে সৌরভই ওকে বাঁচিয়েছে, রক্ষা করেছে। শুধু ওর নয়, সৌরভ নিজের মাতা-পিতার মান-সম্মান-ইজ্জত রক্ষা করেছে। ওর মতো এমন মহান এবং ক্ষমতাশীল ব্যক্তি ক’জন আছে সংসারে! হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন সমান নয়, তেমনি পৃথিবীর সব পুরুষমানুষ সমান নয়। তা’ছাড়া, সৌরভকে অপছন্দ হবার কোনো হেতুই নেই! গায়ের রঙ সামান্য চাপা হলেও মুখাকৃতিতে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুদর্শণ সুপুরুষই বটে! ওর পৌরুষে আভিজাত্যের প্রকাশ সর্বক্ষণ। তবু আপত্তিটা কিসের? কিন্তু বলাই সার, এতো বোঝানোর পরও বিরল সেন্টিমেন্টাল নির্মলার মন-মানসিকতার পরিবর্তন তো হোলই না, উল্টে মস্তিস্কটাই ওর বিগড়ে গেল।

কথায় বলে,-“ধর্মের ঢোল বাতাসে নড়ে। সত্য কখনোই গোপন থাকে না।”

সত্যিই তাই! পাড়াপর্শীর কানাঘুষোয় নিজের পরিচয় সম্বন্ধ্যে অবগত হতেই মাতৃসমতূল্য নিজের মাসিকে বুঝতে ভুল করে। বেঁকে বসে নির্মলা। সারাদিন পাগলের মত প্রলাপ বকতে লাগলো,-‘এটা তো বিয়ে নয়! নির্মলার শ্রাদ্ধ করেছো তোমরা, ওর অন্তিম ক্রিয়া সম্পন্ন করেছো। একটা ফুলের মতো নিস্পাপ মেয়ের জীবনকে তোমরা নষ্ট করে দিয়েছো। কে দিব্যি দিয়েছিল তোমাদের! মরে গেলে যেতাম, আমায় কেন নিয়ে এসেছিলে? চেয়েছিলে মহামানব হতে? পারবে না, কোনদিনও পারবে না। চাই না তোমাদের ভিক্ষের দয়া। এ বিয়ে আমি মানি না। আমায় জোর জবরদস্তী করলে তোমরা আমার মরা মুখ দেখবে। আমার মৃত্যুর জন্যে তোমরাই একমাত্র দায়ী থাকবে।’

হৃদয়াকাশের কোণে খুশীর ঝিলিক দিয়ে উঠতেই নির্মলার একান্ত ভালোবাসার প্রদীপ খানি নিভে গেল। নিভে গেল ওর আশার আলো। সংসারের প্রতি, নিজের জীবনের প্রতি, পালক মাতা-পিতার প্রতি নিরাসাক্ত নির্মলাকে বোঝার চেষ্টাই করলো না কেউ। ওর প্রতি স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা কিছুই রইলো না।
ধীরে ধীরে মায়ের সাথে কথাবার্তা, মুখ দেখাদেখি সব বন্ধ হয়ে গেল। রয়ে গেল পরগাছার মতো। ওদিকে শ্বশুড়বাড়ির কোন সাড়া শব্দ ছিল না প্রায় ছয়মাস।

একদিন হঠাৎ উকিলের নোটিশ আসে, নির্মলাকে জবানবন্দী দিতে হবে কোর্টে। যা কল্পনা করেনি। কিন্তু একরোখা মেয়ে নির্মলা গ্রাহ্যই করলো না। সমাজ স্বীকৃতি দিলেও অস্বীকার করলো সৌরভকে। আর সেই সঙ্গে পিতা ধীরেন মুখুজ্জ্যের দীর্ঘদিনের তপস্যা এবং ইলেকশানে এম.পি হবার স্বপ্নও ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়। যার দর্শণে শহরের মস্তানগোছের ছেলেরা কাবু হয়ে যেতো। কচ্ছপের মতো নিজেরা গুটিয়ে থাকতো। মুখ তুলে কথা বলার সাহস হোত না। এমন প্রভাশালী ব্যক্তির মান-মর্যাদা, আত্মসম্মান ধূলোয় মিশে যাবার ক্ষোভে, দুঃখে অপমানের যন্ত্রণায় একদিন মৃত্যু বরণ করেন নির্মলার পালক পিতা ধীরেন মুখার্জ্জী। আর সেই শোকে জীবনের কামনা-বাসনা, ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতির গলা টিপে, সংসারের মায়া-মোহ বর্জন করে নির্মলা আশ্রয় নেয় এক অনাথ আশ্রমে। যেখানে প্রস্ফূটিত ফুলের মতো একটি জীবনকে এতিম বাচ্চাদের সেবায় উৎসর্গ করে দেয়।

(চলবে)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন