পরিমলকে বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু হয়ে ভর সন্ধ্যায় সতীশ কাকার বাড়িতে ফিরতে দেখা গেল। গতকাল ভার্সিটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে হল ছাড়ার নির্দেশ দিলে পরিমল গত রাত থেকে এই সতীশ কাকার বাসাতেই উঠেছে। এই সতীশ কাকা নিকট আত্মীয় না হলেও পরিমলের বাবার খুব কাছের বন্ধু। বাবা ও সতীশ কাকা এক সাথে একসময়ে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে পড়া অবস্থায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। পরে, পরিমলের বাবা লেখাপড়া তেমন সুবিধা করতে না পেরে এবং সাতমাথার কাছে একটি রেস্টুরেন্ট খুলে ব্যাবসায় নেমে পরিবার-পরিজন নিয়ে পৈতৃক নিবাস রহমান নগরের বাড়িতেই থেকে গেলেন। আর বন্ধু সতীশ কমার্স নিয়ে পড়া শেষ করে সচিবালয় অফিসের একাউন্টেন্টের চাকরি নিয়ে ঢাকা শহরেই বসবাস করে আসছেন ।
শ্রাবনের বৃষ্টির তীব্রতা এবং স্থায়িত্ব কিছুটা বেশি থাকে। পরিমল যখন উত্তরা থেকে ফার্মগেটের লোকাল বাস ধরেছিলো তখন ঢাকার আকাশে কালো মেঘ ধেয়ে আসছে। তারপর বাসে উঠতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। কপাল ভালো পরিমলের। ফার্ম গেটে যখন বাস থেকে নামবে, তখন বৃষ্টি খানিকটা পাতলা হয়ে এসেছে। তবুও, বাস থেকে নেমে আজিমপুরের বাস ধরতে খামার বাড়ি পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতে পরিমল বেশ ভিজে গেল। এরপরে, সিটি কলেজের সামনে নেমে জিগাতলায় সতীশ কাকার বাসায় আসার জন্য একটি রিকশা ধরলো। বৃষ্টি ততক্ষনে আবার পরম উদ্দ্যমে শুরু হয়েছে। রিকশার পলিথিন থাকলেও বাতাসের দাপটে বৃষ্টির ঝাপটায় পরিমল একেবারে ভিজে যাচ্ছে। রিকশায় বসে বসে পরিমল ভাবছে আজ পরিমলের দিনটা যে এভাবে শেষ হবে, সে বুঝতেই পারেনি। মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে কত ভয়ংকর একটি ঘটনা তাঁর সামনে ঘটলো। পরিমল পলিথিনের আড়ালে আরও খানিকটা কুঁজো হয়ে বৃষ্টি ও বাতাসের ঝাপ্টার বিপরীতে কায়দা করে সিগারেট ধরালো। রাস্তায় পানি জমতে শুরু করেছে। বগুড়া হলে এতক্ষনে রাস্তার দুধারে জমানো পানিতে ব্যাঙের ডাক শোনা যেত। রাস্তার পাশের ডাস্টবিনের কাছে একটি কাক মাথা নিচু করে বৃষ্টিতে ভিজছে। আরেকটি কাক কয়েকবার ডানা ঝাপটিয়ে কা কা বলে অবিকল মানুষের মত পায়ে হেঁটে হেঁটে ভিজে থাকা সেই কাকটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
পরিমল মাথা থেকে সেই দুর্ঘটনার ছবি তাড়ানোর জন্যে সিগারেটে টান দিয়ে উৎসাহ নিয়ে সেই কাকদুইটির দিকে তাকিয়ে আছে। কোকিল, ঘুঘু প্রভৃতি পাখি ঢাকা শহর থেকে ক্রমশঃ হারিয়ে গেলেও এই কাক যেন ঢাকা শহরের মাটি আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। পরিমলকে হঠাৎ করে দর্শন তত্ত্বে পেয়ে বসলো। শহরের পচা ময়লা আবর্জনা খেয়ে যে পাখিটি মনুষ্য সমাজের এতো উপকার করে যাচ্ছে, সেই প্রাণীটিকে মনুষ্য সমাজ পাখি হিসেবে মনেই করে না। তবে কি তার খাদ্য প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সৃষ্টিকর্তা এদের পালকের রংকে কালো রং মাখিয়ে কদর্য করে রেখেছেন ? অথচ, সেই সৃষ্টিকর্তার কি অদ্ভুত খেয়াল! এই কাক পাখির মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন এক অনাবিল রোমান্টিসিজম। বৃষ্টিতে এঁরা জোড়ায় জোড়ায় অথবা ঝাঁক ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা নির্বিকারভাবে ভিজতে থাকে। পরিমল এসব দার্শনিক তত্ত্ব মনে করে কয়েক ঘন্টা আগের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটিকে যতই মন থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে ততই যেন মুখের সামনে তাঁর বন্ধুর মুখের ছবি ভেসে আসছে। আজ চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই মর্মান্তিক ঘটনাটি কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছে না। একেবারে চোখের পলকের মধ্যে ঘটনাটি ঘটলো। বন্ধুর কথাগুলো কেবলই পরিমলের কানে বাজছে , ‘পানি লাগবে কারো পানি …….’।
পরিমল তার যে বন্ধুর কথা ভাবছিলেন তার নাম ‘মুগ্ধ’। মুগ্ধ বয়সে পরিমলের চেয়ে কিছুটা বড়ো হলেও অনলাইন ফ্রিল্যান্সার কাজের মাধ্যমে পরিচয় এবং পরে বন্ধুত্ব। সদা হাস্যময় এই তরুণটির চমৎকার বন্ধুবাৎসল্য ক্ষমতায় অভিভূত হয়ে মাত্র ছয় মাসেই মুগ্ধর ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পরিমলকে আকৃষ্ট করেছে এবং সম্বোধন আপনি থেকে তুমিকে টপকে একেবারে ‘তুই’ তে নেমে এসেছে। মূলত, মুগ্ধের সাথে প্ল্যান করেই আজ দুপুরের দিকে পরিমল উত্তরার দিকে রওনা দিয়েছিলেন। পরিমলের সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল সাড়ে চারটা /পাঁচ টা বেজে গেল। মুগ্ধর সাথে দেখা হতেই পরিমল দেখতে পেলেন মুগ্ধর সদাসর্বদা হাসিমাখা মুখে বিষাদের ছায়া লেপ্টে আছে। আজ মুগ্ধ খয়েরি চকলেট কালারের প্যান্টের সাথে হালকা ধূসর রঙের গেঞ্জি পড়েছে। ওর হাতে আকাশি হালকা নীল রঙের প্লাস্টিক ব্যাগে কিছু বিস্কুট ও পানির বোতল। ও তখন কথা বলছিলো ওর দুই বন্ধুর সাথে। পরিমলের সাথে দেখা হতেই মুগ্ধ এগিয়ে এসে পরিমলের সাথে বন্ধুদের পরিচয় করে দিল। বিষাদমাখা মুখেও কিছুটা শুস্ক হাসিমুখে বললো, ‘দোস্ত এছেছিস, আয় আমার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করে দেই, এর নাম হচ্ছে জাকিরুল ইসলাম, আর ওর নাম হচ্ছে নাঈমুর রহমান আশিক। পরিমল সবার সাথেই কথা বললো, আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বললো। খানিক পরে পরিমলদের সাথে কথা বলে মুগ্ধ পানি আর বিস্কুটের ঝোলা নিয়ে আন্দোলনের সাথে মিশে যেয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো ‘পানি লাগবে কারো পানি !!
দুই একজন মুগ্ধর ডাকে সাড়া দিয়ে মুগ্ধর কাছ থেকে বিস্কুট নিল, পানির বোতল নিল। মুগ্ধ পরম উৎসাহে ব্যাগ থেকে আন্দোলনকারী ছেলেমেয়েদের পানি, বিস্কুট দিয়ে আবারো ছুঁটছে সামনের দিকে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে ‘পানি লাগবে কারো পানি’ !! এরই মধ্যে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। পরিমল দেখলো এক হাতে ঝোলা আর আরেক হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে মুগ্ধ খানিকটা এগিয়ে বন্ধু জাকির আর আশিকের সাথে রোড ডিভাইডারের উপর বসে পড়লো । পরিমল থেকে ওদের দূরত্ব কয়েক হাত মাত্র। হঠাৎ করে সবাই দেখলো আমির কমপ্লেক্স আর রাজউক কমার্শিয়ালের দিক থেকে কিছু লোকজন দৌড়ে আসছে। পরিমলদের এদিকটায় যারা ছিল তারাও দৌড় শুরু করলো। মুগ্ধর উরুতে হাতের মৃদু চাপ দিয়ে আশিক বললো, ‘চল দৌড় দেই’ । প্রথমে দৌড় দিল জাকির, তারপরে আশিক। পরিমল তখনও বসেই আছে। হঠাৎ আশিক দেখলো তার সামনে জাকির দৌড়াচ্ছে কিন্তু পাশে মুগ্ধ নেই। ছাত্র-জনতার স্লোগানের মাঝে হঠাৎ এক তীব্র ধাতব শব্দে আশিক ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল মুগ্ধ বসা অবস্থাতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে, কপাল থেকে রক্ত ঝরছে । এক হাতে তখনও বিস্কুট আর পানির বোতলের ঝোলা আঁকড়ে ধরে আছে। দুই চোখ বড়ো বড় করে তাকিয়ে আছে বন্ধুদের গমন পথের দিকে। আশিক চিৎকার করে জাকিরকে বললো, ‘জাকির, মুগ্ধ গুলি খাইছে’।
হ্যা, গুলি খেয়েছে আশিক। ততক্ষনে নরপিশাচ পুলিশের দল অস্ত্র হাতে প্রায় কাছে এসে পড়েছে। আশিক ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গেল মুগ্ধর কাছে। একা কিছুতেই টেনে তুলতে পারছিলো না আশিক। পাশ থেকে কে একজন এসে আশিকের কাছে এগিয়ে এলে দুজনে মুগ্ধকে টেনে তুললো। ভিড়ের মধ্যে আরো কয়েকজন এগিয়ে এলে সবাই মিলে ধরাধরি করে মুগ্ধকে একটি রিকশায় তোলা হলো। ঘটনার আকস্মিকতায় পরিমল হতবিহব্বল হয়ে খানিক্ষন দাঁড়িয়ে মুগ্ধদের সেই রিকশার পেছন পেছন দৌড়াতে শুরু করলো, পরে দ্রুত আরেকটি রিকশা নিয়ে মুগ্ধকে বহনকারী সেই রিকশার পেছনে ছুটলো। মুগ্ধদের সেই রিকশার সমান্তরালে আসতেই পরিমল দেখলো রিকশায় আশিক বন্ধুর কোলে শরীর এলিয়ে অসাড় হয়ে পড়ে আসছে মুগ্ধ। ভিড় কেটে রিকশা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের দিকে। এর পরের অংশটুকু নাঈমুর রহমান আশিকের মুখেই শোনা যাক :
“বন্ধু হয়ে কলিজার বন্ধুর মাথায় গুলি লাগা অবস্থায় কোলে নিয়ে অসহায়ের মতো লাগছিল জানিয়ে আশিক লিখেন, ‘আমার কাছে সবকিছু কেমন স্লো মোশন মনে হচ্ছিল! কিছুক্ষণ পর ঝাপসা চোখে দেখলাম মুগ্ধর আইডি কার্ড হাতে ডাক্তার আমাকে বলতেছে, আপনার কি হয়, বললাম আমার ভাই! বলল আপনার কোথায় লাগছে? পানি খান, বেডে শুয়ে পড়েন! বললাম আমার কিছুই হয় নাই! ওর কি হইছে, বাইচা আছে? আমাকে বলল পালস খুঁজে পাচ্ছি না আপনি একটু রিল্যাক্স হয়ে বাসায় ফোন দেন! তখনও ক্লিয়ারলি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না! আমি স্নিগ্ধকে কল করলাম সাথে সাথে! বললাম মুগ্ধ গুলি খাইসে তাড়াতাড়ি ক্রিসেন্টে আয় ভাই! স্নিগ্ধ আসল, দেখল! ডাক্তার জানাইলো পালস পায় না! স্নিগ্ধ আমাকে ধরে কানতেসে আর অসহায়ের মতো ডাক্তারকে বলতেসে ভাই প্লিজ, প্লিজ ভাই আরেকবার দেখেন না!”
না, ডাক্তার সাহেব মুগ্ধর পালস আর খুঁজে পেলেন না । ২০২৪ এর মহান বৈষম্যবিরোধী আন্দলোনের লম্বা মিছিলের খাতায় শহীদ হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হলো মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের নাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মীর মোস্তাফিজুর রহমান, এবং স্ত্রী শাহানা চৌধুরী তাঁদের যমজ এই দুই সন্তানের নাম রেখেছিলেন মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২৩ সালে গণিতে স্নাতক পাসের পর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)-এ এমবিএ করছিলেন মীর মুগ্ধ। আর স্নিগ্ধ আইন নিয়ে পড়ছিলেন। যমজ এই দুই ভাই মোটরসাইকেলে করে ইউরোপ ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন । ভ্রমণের জন্য অর্থ সঞ্চয় করতে দুই ভাই অনলাইন ফ্রিল্যান্সার হাব ফাইভারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং করতেন। মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে। যমজ দু ভাইয়ের একজন এখনও বেঁচে আছে, আরেকজন চলে গেছে অনন্ত অসীম পরম করুনাময়ের দরবারে।
আমি যে সময়ের কথা লিখছি তখন ২০২৪ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি চলছে। ছাত্রদের কোটাসংস্কার আন্দোলন ততক্ষনে আরও ঝাঁঝালো হয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হিসেবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। ছাত্রদের সাথে ক্রমশঃ সকল ধর্মের সকল মতের ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবকদের উপস্থিতির খবর আমরা প্রবাসে বসেও শুনতে পেয়েছি। তবে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ৫ ই আগষ্টের পরে কিছু দুর্বৃত্তদের কারণে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের হত্যা, অগ্নিসংযোগ, সম্পদ লুটপাটের ঘটনাগুলো আন্দোলনের সফলতাকে কিছুটা কালিমা লেপন করেছে। দেশের হিন্দু সমাজের কাছে আন্দোলনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। সেসব কথা পরে বিস্তারিত জানা যাবে।
২০২৪ এর কোটা সংস্কার তথা বৈষম্যবিরোধী আন্দলনে বেশ কিছু মৃত্যু দুনিয়া জুড়ে মানুষের বিবিকবোধকে নাড়া দিয়েছিলো। ছাত্রদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এগিয়ে এসেছিলেন দেশের স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের পাশাপাশি অভিভাবক এবং রিকশাওয়ালা, শ্রমিকসহ আপামর জনতা। জুলাই মাসের ১৬ তারিখে আবু সাঈদের মৃত্যুর ঠিক দুদিনের মাথায় ‘মুগ্ধ নামের এই তরুনের মৃত্যু সারাদুনিয়ার মানুষকে স্তব্ধ করে দিলেও সে সময়ের সরকারকে নিবৃত্ত করতে পারেনি তখন পর্যন্ত পাশবিক পথ পরিহার করে আপোষের পথ বেছে নিতে।
দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে প্রবাসে বসে আর সবার মতো আমিও সেই তরুণটির মৃত্যুর খবর শুনে গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে, নির্বাক হয়ে বসে থাকলাম। প্রবাসে বসেও আওয়ামী লীগ পার্টির মতাদর্শে বলীয়ান হয়ে আমার কিছু বন্ধুদের দেখলাম ওনারাও এক শোকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি বিস্ময়ের সাথে দেখলাম আমার সেই বন্ধুদের শোকের কারণ আবু সাঈদ বা মুগ্ধ নয়, সেই শোকের কারণ ও ধরন ভিন্ন। আমার সেই বন্ধুদের কাছে আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের সেই ট্রাজেডির আপেক্ষিক গুরুত্ব এতো বেশি যে এসব সাঈদ, মুগ্ধদের লাশের গন্ধ এঁদের নাক অবধি পৌঁছাতে ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে অথবা কে জানে সে বিষয়ে কোনো আগ্রহই হয়তো এনাদের নেই। একটি বিশেষ গোষ্ঠী ভুল মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আবু সাঈদ, মুগ্ধদের লাস আর ও আমার সেই বন্ধুদের হৃদয়ের মাঝামাঝিতে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পাহাড়ের মতো পাঁচিল তুলে ২০২৪ এর মহান আন্দোলনকে বিষাদগার করে তুলেছে !!!।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির মধ্যে জুলাইয়ের ১৮ তারিখে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ এর মৃত্যুর দিনে ঢাকা শহরে আরও দুটি উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা ঘটলো। এদিন বিকেলে রাজধানীর মিরপুরে মেট্রোরেলে এবং একই দিনে রামপুরায় বিটিভি ভবনে আন্দোলনকারীদের নাম দিয়ে কে বা কারা আগুন দিলেন। সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা চলাকালীন সময়ে মেট্রোর লাইনের নিচে মিরপুর-১০ গোলচত্বরে ফুটওভার ব্রিজে আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে কে বা কারা পুলিশ বক্সে আগুন দিতে দেখা গেল। এমনকি সেই আগুনের লেলিহান শিক্ষার মাঝেই একটি ট্রেনকে ছুঁটে যেতেও দেখা গেল। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ট্রেন চলাচল বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। পরদিন ১৯ জুলাই বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চললো । সেদিন রাতভর হামলাকারীরা স্টেশন দুটিতে ব্যাপক ভাঙচুর ও বিপুল সম্পদ লুটপাট করা হলো। একই দিনে প্রায় একই সময়ে রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনেও আন্দোলনচলাকালীন সময়ে আগুন দেওয়া হয়। বিটিভির পক্ষ থেকে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পথিমধ্যে আন্দলোনকারীদের বাধার মুখে সময়মতো পৌঁছুতে পারেননি। ততোক্ষণে বাগানের লেলিহানশিখা পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়েছে।
পরবর্তীতে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেন। অথচ প্রতিদিন যেভাবে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের গুলি করে মারা হচ্ছে সেসব লাস দেখে প্রধান মন্ত্রীকে কাঁদতে দেখা যায়নি। শুধু তাই না, আন্দোলন চলাকালীন মেট্রোরেল, বিটিভি ভবনসহ এসব ক্ষয়ক্ষতিতে শেখ হাসিনা’র সাথে আরো বহু মানুষ ও তথাকথিত সুশীল সমাজের শোকার্ত অনুভূতি আমরা ফেসবুকে দেখতে পেয়েছি। অথচ, আন্দোলন চলাকালীন সময়ে শান্তি শৃঙ্খলাবাহিনী ও সরকার সমর্থিত বাহিনীর হাতে নিহত প্রতিদিনের শত শত বাচ্চাদের লাস দেখে এসব সুশীল সমাজের এতো শোকের মাতম দেখা যায়নি। কত বিচিত্র এ সমাজ, কত বিচিত্র এ দেশ !!শত শত ছাত্রজনতার লাশের চেয়ে যেন মেট্রোরেলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অনেক অনেক বেশি !!!!
শ্যামলী ও অর্চণা দুজনেই বারান্দায় বসে গল্প করছিলো আর একটু পর পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অজানা আশংকায় ছটফট করছিলো। বৃষ্টির ছাট গায়ে এসে পড়ছে তবুও দুই বোনেরই ভ্রূক্ষেপ নেই। দেশের যে অবস্থা, আশংকা করাই স্বাভাবিক। এই দুবোনের আশংকার যায়গা একটিই। সেটি হচ্ছে মাত্র গত রাতে তাদের বাসায় থাকতে আসা পরিমল দাদা। রাত সাড়ে দশটা বাজে, তাদের পরিমল দা এখনও বাসায় ফেরেনি। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে শ্যামলী পরিমলকে ফোনে চেষ্টা করেও পাচ্ছে না। ইনস্ট্রাগ্রামে বার্তা দিয়েছে, সেখানেও খবর নেই। এদিকে অর্চনা টেবিলে বই পত্র সব গুছিয়ে রেখেছে। পরিমল তার সতীশ কাকার বাড়িতে যে স্রেফ গেস্ট না, অন্তত কয়েকদিন অর্চনার গৃহ শিক্ষক হিসেবে ক্ষণস্থায়ী নিয়োগ পেয়েছেন তার ফয়সালা গত রাতেই হয়ে গিয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে পরিমল সকালে অর্চনাকে ইংরেজি গ্রামাররের কিছু ব্যেসিক বিষয় নিয়ে বসেছিলেন। সেই শিক্ষাকে আরও বেগবান করার অভিপ্রায়ে অর্চনা পরিমল স্যারের দেয়া সব হোম ওয়ার্ক করে রেখেছে। কিন্তু স্যারের পাত্তা নেই।
ভিজে একাকার হয়ে পরিমলকে রিকশা থেকে নামতে দেখেই অর্চনা তার দিদির সাথে কথোপকথনের মাঝখানে মুখের কথা অসমাপ্ত রেখে বাচ্চা মেয়েদের মতো খুশিতে ঝলমল করে চিৎকার করে বললো, ‘এই যে দাদা ফিরেছে ।’ তড়িৎ বেগে অর্চনা শুখনো গামছা খোঁজে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। রিকশাওয়ালা ততক্ষনে সিট এর নিচে নিরাপদ জায়গায় ভাড়ার টাকা একটি পলিথিন দিয়ে মোড়ানো থলিতে রেখে ভিজে চুপসে যাওয়া শরীর নিয়ে নতুন কোনো প্যাসেঞ্জারের আসায় এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুত প্যাডেল মেরে রিকশা চালিয়ে রওনা হলো। সেই রিকশাওয়ালার প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকলেও শ্যামলী কিন্তু ভাবছে ভিন্ন কথা, পরিমল দা কে দেখে উৎফুল্ল অর্চনার ঝলমলে মুখ। শ্যামলী যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে বাইরের দরজা সরাসরি দেখা যায়। শ্যামলী দেখতে পেল অর্চনা দরজার পেছনে শুখনো গামছা হাতে অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে। অর্চণার এই আচরণ যে শুধু বড়ো দাদা অথবা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভক্তি ছাড়াও ভিন্ন কিছু, সেই ভিন্নতা ভাবতে যেয়ে শ্যামলীর বুক কেঁপে উঠলো।
আগের পর্বগুলি –
পর্ব ১-পর্ব ১
পর্ব ২-পর্ব ২
পর্ব ৩-পর্ব ৩
পর্ব ৪-পর্ব ৪
পর্ব ৫-পর্ব ৫