শ্যামলী খেয়াল করেছে আজ বেশ কয়েকদিন ধরে তাঁর ছোট বোন অর্চনা পড়াশুনা বিশেষ করছে না। পড়ার টেবিলে বইয়ের পাতা খুলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। কি নিয়ে যেন সারাক্ষন ভাবে। আজ সকালে নাস্তা খেয়ে পড়ার ঘরে যেয়ে শ্যামলী অর্চনাকে সরাসরি বললো, ‘আধা ঘন্টা ধরে দেখছি তুই বইয়ের পাতা খুলে বসে আছিস, একটি বইয়ের এক পাতা পড়তে আধা ঘন্টা লাগে ? অর্চণা বললো, ‘আপা পরিমল দাদা’র জন্য মন ভীষণ খারাপ। মানুষটা বলা নেই, কোয়া নেই হুট্ করে উধাও হয়ে যাবে, এটি কোনো কথা হলো ! কথাগুলো বলতে যেয়ে অর্চনা শ্যামলীকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললো। শ্যামলীর বুক ধক করে উঠলো। মেয়েটি কী তবে পরিমল দাদাকে ভালোবেসে ফেলেছে ! অল্প বয়সী বালিকারা অনেক ভুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে ভুলটি করে তা হচ্ছে চট করে অতি সহজেই প্রেমে পড়ে যায়। এই জটিল পৃথিবীর হিসাবনিকাশ এঁদের স্পর্শ করে না। এঁদের এই প্রেমের লিষ্টে মন্দলোক থাকলে এঁদের সরলতার সুযোগে এঁরা সর্বস্ব খুয়ে ক্যারিয়ারকে গুবলিয়ে ফেলে। পরিমল দাদা অবশ্য সেরকম না। পরিমল যে কত ভালো একটি ছেলে তা শ্যামলীর চেয়ে এই পৃথিবীতে কেউ বেশি জানে না।
শ্যামলী অবাক হয়ে খেয়াল করলো অর্চনাকে সান্তনা দিতে যেয়ে সে নিজেও কাঁদছে । শ্যামলী মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলো, সে কাঁদছে কেন? সে তো আর অল্প বয়সী অর্চণার মতো কিশোরী না। অর্চনারা ভুল করবে, প্রেম করবে, ভুল থেকে শিখবে। কিন্তু সে তো অর্চনা না, সে হচ্ছে ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া শ্যামলী। শ্যামলী যতই এসব বলুক এ কথা সত্যি সে আকারে ইঙ্গিতে মায়ের কাছ থেকে আভাস পেয়েছে, মা মনে মনে পরিমল দা’র সাথে তাঁর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। এসব কথা অর্চনার জানার কথা না। তবুও শ্যামলী নিজেকে প্রবোধ দিল। পরিমল দা যদি বেঁচে থাকে সেতাঁর এই ঠিক করা বিয়ের সবকিছু ভুলে অর্চনাকে পরিমল দাদার হাতে তুলে দিবে। এই জগৎ বড়োই রহস্যময়।
কাঁদতে কাঁদতে আদ্র গলায় শ্যামলী বললো, ‘আমি নিজেও বন্ধু বান্ধব দিয়ে পরিমল দা’র খোঁজ নিচ্ছি। আমার মনে হয়, দাদা কৌশলগত কারণে নিজের পরিচয় গোপন রেখে এই সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের যা অবস্থা, আমার মনে হয় না এই সরকার টিকতে পারবে। কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো দেশের একটা কিছু ভালো সংবাদ আমরা পেয়ে যাবো। তারপরে দেখবি, আমাদের পরিমল দা ভূস করে বেরিয়ে আসছে। কথাগুলো বলতে যেয়ে শ্যামলী আবারো কেঁদে ফেললো। দুই বোন জড়াজড়ি করে কাঁদছে। দেশে এমুহুর্তে বহু মানুষ কাঁদছে। সহস্রাধিক শহীদের বাবা মা কাঁদছে তাদের নিহিত সন্তানদের জন্যে। অনেকে আবার আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এঁদের মা-বাবাও কাঁদছে। শুধু যাঁকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন হচ্ছে, তিনি কাঁদছেন না। তিনি যেন মৃত্যুর হোলি খেলায় মেতে উঠেছেন।
তিন বাহিনীর প্রধান যতই বোঝাচ্ছেন, তিনি কিছুতেই বোঝার চেষ্টাই করছেন না। তিনি বরং পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এবং সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সাহেবকে আরও কঠোর হাতে সরকারবিরোধী এই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে বলছেন। সকাল সাড়ে দশটা থেকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে পুলিশের মহাপরিদর্শক আর তিনবাহিনীর প্রধানদের নিয়ে মিটিংএ যখন এসব নিয়ে বাদানুবাদ হচ্ছে, এমন সময় ওয়াকার সাবের ওয়ারলেসে বিশেষ খবর এলো, ‘স্যার, বয়েজ আর এটাকিং গণভবন উইদিন ফর্টি ফাইভ মিনিটস’ । ওয়াকার সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে শেষবারের মতো অনুরোধ করলেন, বললেন, ‘ম্যাডাম দলেদলে লোকজন গণভবনের দিকে ধেয়ে আসছে, কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না, হাতে একেবারেই সময় নেই, আপনি পদত্যাক করে সটকে পড়ুন, পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে। বল প্রয়োগ করে কিছুতেই এঁদের হটানো সম্ভব হবে না। এক পর্যায়ে অফিসারগণ হাল ছেড়ে দিয়ে শেখ রেহানার সাথে আলাপ করলেন এবং শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের ব্যাপারে বোঝাতে অনুরোধ করলেন।
শেখ হাসিনা বোনের সাথে কথা শেষে দেশের বাইরে ছেলে জয় এর সাথে কথা বললেন এবং কথা শেষে পদত্যাগ করতে রাজি হলেন। তবে শর্ত জুড়ে দিলেন, তাকে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ রেকর্ডের ব্যাবস্থা করাতে হবে। অফিসারগণ সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘ ম্যাডাম, সেই সময়ও নেই। হাতে মাত্র সময় আছে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ডাইনিং টেবিলে ততক্ষনে দুপুরের খাবার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই খাবার খাবার মানুষ নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে হেলিপ্যাডে গেলেন । সেখানে তাঁদের কয়েকটি লাগেজ ওঠানো হলো । তারপর তাঁরা বঙ্গভবনে গেলেন । সেখানে পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সামরিক হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ছোট বোনসহ ভারতের উদ্দেশে উড্ডয়ন করলেন । ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখের স্থানীয় সময় তখন প্রায় আড়াইটা বাজে। প্রচন্ড শব্দ করতে করতে বিশালাকার ফ্যান দিয়ে আশপাশের ধুলোর ঝড় তুলে হ্যালিকপ্টারটি উর্ধ আকাশমুখী হচ্ছে। হ্যালিকপ্টারের ছোট্ট জানালা দিয়ে শেখ হাসিনা শেষবারের মতো নিচে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর নিজের হাতে গোড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে উপহাস করছে।
শেষরাতের দিকে আবার আমার ঘুম ভেঙে গেলো। এবার আমি, বেড ছেড়ে উঠে বাথরুমে গেলাম। বাথরুম সেরে বাংলাদেশ বিষয়ে রাজ্যের উৎকণ্ঠা নিয়ে সেলফোনে ফেসবুকের আপডেট দেখছি। এই বুঝি দেখবো আরও কিছু লাশের ছবি। টরেন্টোর স্থানীয় সময় প্রায় ভোর সাড়ে চারটার মতো বাজে। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম সারা ফেসবুক জুড়ে প্রধানমন্ত্রীর পলায়নের খবর। আমি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চোখেমুখে পানির ঝাপ্টা দিয়ে আবারও ফোন হাতে নিলাম। না, এটি স্বপ্ন নয়। সত্যিই আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে ভারতে পলায়ন করেছেন। আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। মিতা তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমার চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে মিতা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘মিতা, আমরা দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন হলাম।’
বহু বছর ধরে কানাডাতে আগস্ট মাসের প্রথম সোমবারে সিভিক হলিডে হিসেবে ছুটি পালন করা হয়। যদিও এটি সরকারি বিধিবদ্ধ ছুটির দিন (statutory holiday ) হিসেবে বিবেচিত হয় না তবুও বহু প্রতিষ্ঠান এই দিনটিকে কর্ম-বিরতি ঘোষণা করে থাকে। অনেক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই দিনে ক্লাস বন্ধ থাকে। আজ সেই আগস্ট মাসের প্রথম সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০২৪ । আজ আমার অফিস বন্ধ, মিতারও কাজ বন্ধ। সূর্য ওঠার আগে আমি বাচ্চাদের নিয়ে, মিতাকে নিয়ে টরেন্ট শহরের বাঙালি পাড়া বলে খ্যাত ড্যানফোর্থের দিকে গাড়ি হাঁকালাম। দেশের মতো প্রবাসেও, বাংলাদেশিরা দেশের বড়ো বড়ো প্রাপ্তির দিনগুলোতে অথবা নানারকম দাবিদাওয়া নিয়ে শহীদমিনারে একত্রিত হয়ে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। টরেন্টোর শহীদমিনার ভিক্টরিয়াপার্ক / ডানফোর্থ এলাকায় ডেন্টোনিয়া পার্কের মাঠে। আমরা এই ভোরবেলায় সেখানে পৌঁছিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। কপালে লাল সবুজ জাতীয় পতাকা বেঁধে বেঁধে লোকজন উল্লাস করছে, বাংলাদেশ -বাংলাদেশ বলে স্লোগান দিচ্ছে। যেন একটুকরা বাংলাদেশ এখানে চলে এসেছে। আমরা এঁদের সাথে ভিড়ে মিশে গেলাম।
ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার বন্ধুর ছেলে লিটন চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে। ওর পাশেই ওর সাথে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিচ্ছে সেই শান্ত চেহারার লিটনের সেই সহপাঠী মেয়েটি, শম্পা। চোখেমুখে বিজয়ের আনন্দের দ্যুতি। এই ছেলেমেয়েরা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে দেশ ছেড়ে কানাডায় পড়তে এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা শেষ করে এদেশেই চাকরি-বাকরি করে সেটেল্ড হওয়ার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনে এদের ভাগ্যে কতখানি পরিবর্তন আনবে তা ভাবার বিষয়। অথচ, দেশের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে দেশের সহযাত্রী ছাত্রছাত্রীদের কোটাবিরোধী/ বৈষম্যবিরোধী তথা সরকারবিরোধী আন্দোলনের সাথে একমত পোষণ করে এঁরা এই কয়দিন এখানে প্রতিদিন বিশেষ করে উইকএন্ডের সন্ধ্যায় উত্তাল আন্দোলন করেছে। ‘জেগেছে জেগেছে, বাংলাদেশ জেগেছে’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করে প্রবাসে বাংলাদেশী কমিউনিটিকে মুখরিত রেখেছে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের আন্দোলনের আমেজ নিয়ে এসেছে। এদের তো আজ আনন্দই করার কথা !!
লিটন, শম্পা ও ওদের বয়সী আরকিছু ছেলেমেয়ে কোথেকে যেন অনেক লম্বা একটি লাল-সবুজের বাংলাদেশের জাতীয়পতাকা নিয়ে এসেছে। সেই পতাকাটিকে সামনে রেখে শহীদমিনারে পাশে সবাই দলবেঁধে গ্ৰুপ ছবি তুলছে। কেউ কেউ ফেসবুকে লাইভ এসে ভিডিও করছে । আমিও আমার পরিবার নিয়ে ওদের সাথে ছবি তুললাম। কাউকে কাউকে দেখলাম বক্সে মিষ্টি নিয়ে এসে মিষ্টি, ডোনাট ইত্যাদি বিতরণ করছে। পরিচিত-অপরিচিত সবাই সেই বক্স থেকে খাবার তুলে খাচ্ছে। এক চমৎকার উৎসবমুখর পরিবেশ।
অবশ্য এই উৎসব সার্বজনীন হতে দেখা যায়নি। দেশের কথা জানি না, তবে প্রবাসে আমি আমার বেশ কিছু বন্ধু -বান্ধব ও পরিচিত বেশ কিছু প্রবাসীদের বাসায় দেখেছি এদিন শোকের মাতম বসেছে। এনারা প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ায় শোকে মূর্ছিত হয়ে ঘরে ঝিম মেরে বসে আছেন। পোল্ট্রি জাতীয় প্রাণীদের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ রোগ হচ্ছে রানী ক্ষেত রোগ। এই রোগে আক্রান্ত পাখিদের ডানা আধাআধি মেলে ধরে ঝিম মেরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আগস্ট মাসের ৫ তারিখে আমি অনেক প্রবাসীদের মাঝে এরকম লক্ষণ দেখেছি। রাজনীতির এই এক খেলা। নেতা/নেত্রীগন দলের সমর্থকদের এমন বশীকরণ করে রাখেন যে এনারা কিছুতেই বক্স থেকে বের হয়ে মুক্ত মন নিয়ে তাদের নিজ নিজ পার্টির সমালোচনা করতে পারেন না। এনাদের হার্ড ডিস্কে রয়েছে নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস। যে কোনো অন্ধ বিশ্বাস মন্দ ছাড়া ভালো কিছু বয়ে আনে না।
ডেন্টোনিয়া শহীদমিনার চত্বরের ভিড়ের মধ্যে থেকে আমি আমার বন্ধুর ছেলে লিটন আর তার ক্লাসমেট শম্পা মেয়েটিকে এক পাশে ডেকে এনে বললাম, ‘ কেমন আছো তোমরা ? এতো সকালে চলে এসেছো ? লিটন রাজ্য জয়ের গর্বিত অভিব্যাক্তি মুখে প্রকাশ করে মৃদু হেসে আমাকে বললো,’ আংকেল এতো বিরাট সুখবর শুনে ঘরে বসে থাকা যায় ? তার মধ্যে, আজ ছুটির দিন, সিভিক হলিডে, কোনো ক্লাস নেই, তাই ছুঁটে চলে এসেছি।’ আমি বললাম, আমাদেরও তো ছুটি, বাসায় চলো, সারাদিন চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে। ওরা রাজি হওয়ায় বাসার দিকে রওনা হলাম। ঘড়ির কাটা তখন সকাল নয়টার কাছাকাছি। বাঙালি পাড়া বলে খ্যাত ড্যানফোর্থের রাস্তা দিয়ে ধূসর রঙের আমাদের নিশান রগ এস ইউ ভি গাড়িটি ছুঁটে চলেছে আমাদের বাসার দিকে। পেছনে পেছনে চলছ লিটনের টয়োটা। এতো সকালে এখনো দোকানপাট তেমন খোলেনি। রাস্তার দুইপাশদিয়ে ছোট ছোট দলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা জাতীয় পতাকা উঁচিয়ে মিছিল করে শহীদ মিনারের দিকে স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছে: ‘হই হই রই রই শেখ স্বৈরাচার গেলো কই……।’
বাসায় ফিরে লিটন-শম্পাদের সাথে অনেক গল্প হলো। সেই গল্পে আমার ছেলে অর্ণবও অংশগ্রহণ করলো। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করলাম। বললাম, ‘তোমাদের এক দফা এক দাবি তো মিটে গেল, এখন দেশ চালাবে কে ?’ তোমরা ছেলেপেলেরা, নাকি বিএনপি ? দেখলাম, ওদের কথা বেশ স্পষ্ট। লিটন বললো, ‘আংকেল, এই মুহূর্তে আমরা চাই না কোনো রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব ক্ষমতায় আসুক, আমাদের আন্দোলনের বেসিকটা ছিল বিগত পনেরো বছরে দেশের সর্বত্ত যে বৈষম্য তৈরী হয়েছে তা দূর করা।’ অর্ণব এর সাথে জোগ করে বললো, ‘এর জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে সংস্কারের প্রজেক্ট হাতে নিতে হবে।’ আমি ওদের থামিয়ে দিয়ে বললাম , হু উইল রিং দি বেল? সেই প্রজেক্টটি টি হাতে নিবে কে, আমি তো সেটাই বলছি।’ লিটন অনেক আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, ‘ আংকেল, আমি যতদুর শুনেছি আন্দোলনের প্রধান মাষ্টার মাইন্ডরা প্রফেসর ইউনুস সাহেবকে নিয়ে ভাবছে। যতদূর শুনেছি ওনাকে ইতিমধ্যে প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। দেখা যাক, উনি কি করেন, তবে আংকেল আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন আংকেল ঠিক এখনই কোনো রাজনৈতিক নেতাকে দেশ শাসনের ভার দেয়া হবে না, আমি নিশ্চিত। এই জি জেনদের আত্মবিশ্বাস আমাকে অভিভূত করলো। তাই তো, ওরাই ঠিক, বিগত বছরগুলোতে ওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো দল বিএনপি বলি, জাতীয়পার্টি বলি, বা জামাত বলি কেউই তো স্বৈরাচার সরকারকে উৎখাত করতে পারেনি, এই ছেলেমেয়েরা যা করতে পেরেছে। এখন, এঁদের সাথে একজন সৎ, বিজ্ঞ, নিরপেক্ষ গার্জেন থাকা উচিত। আর উনি যদি হন প্রফেসর ইউনূসের মতো আন্তর্জার্তিক ব্যাক্তিত্ব তাহলে তো চমৎকার হয় !
গল্প করতে করতে লিটনদের নিয়ে লাঞ্চ সারলাম। আমাদের বাসায় আমরা কেউই খুব একটা ভারী লাঞ্চ করি না। কাজের দিনে সবাই বাইরে থাকি। বাইরেই হালকা লাঞ্চ সেরে নেই। তবে আমাদের ডিনার হয় বেশ হ্যাভি। সন্ধ্যার আগেই সবাই সেই হ্যাভি ডিনার সেরে নেই। দুপুরে খেতে খেতে লিটন-শম্পাদের বললাম, তোমাদের যদি ব্যাস্ততা না থাকে তবে আমাদের সাথে ডিনার করে যাবে। দেশের এতো বড়ো খুশির খবর, তাঁর উপর আজ হলিডে। ওদের তেমন ব্যাস্ততা নেই শুধু লিটনের গ্যাস স্টেশনের কাজ আছে রাট সাড়ে আটটায়। ওদের সাথে সাথে গল্পের এক পর্যায়ে লিটন জানালো দেশে ওদের আরেক বন্ধু পরিমল আজ বেশ কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ। ওর কোন ট্রেসই পাওয়া যাচ্ছে না। পরিমলের বাবা নগেন আমাদের বাল্য বন্ধু। আমি সঙ্গে সঙ্গে হটসআপে নগেন বন্ধুকে ফোন দিলাম । ফোন মনে হলো বন্ধ। একেবারেই মেসেজে গেল। আমি আরেকবন্ধু সতীশকে ফোন দিলাম, কারণ সতীশের সাথে নগেনের যোগাযোগ ভাল। সতীশকে যত উচ্ছাস নিয়ে ফোন দিলাম ও ততটা উচ্ছাস দেখালো না। কথাবার্তা হু হা দিয়ে চালাচ্ছে। আমি বললাম, ‘ দোস্ত কেমন আছিস? অনেকদিন পর ফোন দিলাম, সব খবর ভাল ? সতীশ বললো, ‘হুম’। আমি বললাম, ‘দেশের তো হ্যাভি খবর দোস্ত, শেখ হাসিনা যে সত্যি এভাবে পালিয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। প্রসঙ্গতিতে রেমন একটা আগ্রহ না দেখিয়ে সতীশ নিরসভাবে বললো, ‘দেখি এবার কোন সরকার দেশের উন্নতির জোয়ার বয়ে দেয়’। আমি বললাম কেন আমি শুনছি ইউনুস সাহেব ফ্রান্স থেকে উড়ে আসছেন, উনি সরকার প্রধান হবেন। সতীশ ব্যাঙের গলায় বললো, ‘সুদের ব্যাবসা চালনা আর দেশ চালালো এক কথা না দোস্ত, তোরা তো দেশে থাকিস না, তোরা এসব বুঝবি না’। আমি বুঝলাম আমার বন্ধুর মতো যারা আওয়ামী লীগ পার্টির সমর্থক তাদের তো এই সুরেই কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। এবার আমি প্রসঙ্গ ঘুরে বললাম, ‘শুনলাম আমাদের নগেনের ছেলেকে কোটাও ঝুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ?’ এবার সতীশ কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো, ‘এসব ছেলেপেলেদের কথা! ও তো ইউনিভার্সিটি বন্ধের পরে আমার এখানে উঠেছিল, ভালোই ছিল। তারপর একদিন শুনলাম, ও নষ্টছেলেমেয়েদের পাল্লায় পরে সরকার পতনের আন্দোলনে নেমেছে, শুনে মাথা গরম হয়ে ওকে বাসা থেকে চলে জিতে বলেছিলাম, সেই থেকে তো ওর হদিশ নাই। আমি বললাম,; দোস্ত খারাপ কিছু হয়নিতো ? জানি না, ওর বাবা বগুড়া থেকে ঢাকায় আমার বটেই উচেছে, প্রতিদিন দেখি ছেলেকে এখানে সেখানে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমিও কিছুদিন নগেনের সাথে সাথে ঘুরে ওর ছেলেটিকে খোঁজার চেষ্টা করেছি। মিছিল থেকে যে পুলিশ অফিসার ওকে এরেস্ট করেছিল তাঁর সাথেও দেখা করেছি, কিন্তু কেউ কোন মুখ খোলে না। আমি বললাম, নগেন এখন কোথায় ? তোর বাসায় নেই ? সতীশ বললো, না, থাকলে তো ওকে ডেকে দিতাম, ও সেই সকালে বের হয়েছে এখনও ফেরেনি। পেতে হলগুধা লাগলে সুর সুর করে চলে আসবে। আমি চিন্তিত হয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, ছেলেটি বেঁচে আছেতো ? নাকি আবার মেরে গুম করে দিয়েছে ? সতীশের মধ্যে তেমন একটি উদ্বিগ্নতা দেখলাম না। সতীশ উদাসভাবে বললো, ওসব ছেলেপেলেদের কথা, নিজেরা নিজেদের মেরে গুম করে সরকারের দিকে দোষ চাপানোর চেষ্টা।’
সতীশের সাথে তেমন জুতসই কথা হলোনা দেখে এবার দেশে আরেক বন্ধু আফসার আলীকে মেসেঞ্জারে ভিডিও কল দিলাম। ওপ্রান্ত থেকে আফসার আলী কল রিসিভ করতেই আফসার আলীর হাসিখুশি মাখা মুখ দেখতে পেলাম। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আফার আলীর বেশ পরিবর্তন হয়েছে। মুখ ভর্তি সাদা সফেদ দাড়ি। ব্যাবসার পাশাপাশি ধরকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওর আর্থিক অবস্থায় বেশ ভাল। ধর্মচর্চার কারণেই হোক বা সততার সাথে কঠোর পরিশ্রমেই হোক, দিন দিন আফসারের ব্যাবসা বেশ উন্নতি হচ্ছে। ভাবলো আয়- রোজগারের জন্যে ছেলেকে কানাডায় পাঠিয়ে পড়াশুনা করাতে পারছে। ভিডিওকলে আফসারের দাঁত কেলিয়ে হাসি দেখে আমি হাল্কাচ্ছলে বললাম, ‘দোস্ত তোরা তো বেচারা শেখ হাসিনাকে একেবারে দেশ ছাড়া করলি।’ আফসার আলী বললো, ‘দেশ কি আর সহজেই ছাড়ে দোস্ত, লাস্ট মুহূর্তেও উনি চেয়েছিলেন ইন্ডিয়া এসে দেশ উদ্ধার করবে’। সতীশ বন্ধুর সাথে কথা বলে তেমন একটা ভাল লাগেনি। দেশে স্বৈরশাসনের অবসানেও তাঁর মধ্যে কোন বিকার লক্ষ্য করিনি বোরন দেখিছি শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির জন্যে বেশ বিষাদ ও হতাশাগ্রস্ত। অথচ, আরেক বন্ধুর সাথে কথা বলে বেশ ভাল লাগছে। রাজনৈতিক অন্ধ বিশ্বাসঃ থেকে বের হয়ে আমাদের মন্দলাগা ভাল লাগার মধ্যে যদি নিজস্ব এথিক্স থাকে, মূল্যবোধ থাকে, সাদা কে সাদা এবং কালো কে কালো বলার সৎসাহস থাকে তবেই আমাদের সম্পর্ক্যগুলো সহজ হয়, উপভোগ্য হয়।
আফসার বন্ধুর সাথে আরও কিছুক্ষন গল্প করলাম, ভিডিওতে ওর ছেলে, ছেলের বান্ধবীকে দেখালাম। আফসার আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওর ছেলে লিটনের সাথে গল্প করলো। ভিডিওকলে একসময়ে ওর বউ রাহেলাকে ডাকলো, ছোটছেলে টগরকে পরিকায় করে দিল। আমিও মিতা, অর্ণব, অধরাকে ওদের সাথে ভিডিওতে পরিচয় করে দিলাম। বেশ আনন্দঘন কিছু মুহূর্ত সবাই উপভোগ করলাম। বেলা গড়িয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশের দিকে ঝুলে পড়ছে। ফ্যামিলিরুমে অর্ণব, অধরা অতিথি লিটন, শম্পা সবাই ওদের মতো করে গল্পগুজব করছে। ফোন রেখে মিতাকে ডিনারের জন্যে হেল্প করার জন্যে কিচেনে ঢুঁ মারলাম। প্রবাসে দেশের মতো কাজের লোক নেই। সব কাজ নিজেরই করতে হয়। পরিবারে হাজব্যান্ড-ওয়াইফ মিলিয়ে ঝুলিয়ে সংসারের কাজ করে দিনাতিপাত করতে হয়। কিন্তু, দেশেই হোক বা বিদেশেই হোক আমাদের বিশেষ করে বাংলাদেশী কনিউটিতে বন্ধু সতীশ ধরণের অনেক ক্যারেক্টার দেখতে পাওয়া যায়। এঁরা রাজনীতিতে যেমন নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ ভক্ত , তেমনি পারিবারিক সম্পর্ক্যগুলোকেও এঁরা পরস্পর অসহযোগিতা, অবিশ্বাসঃ এর উপর ভিত্তি করে পারিবারিক বন্ধনগুলোকে এঁরা জটিল করে ফেলে।
আমাদের আজকের ডিনারের বিশাল আয়োজন। মিষ্টি লাউ দিয়ে গরুর মাংস রান্না করা হয়েছে যা আমাদের বগুড়া অঞ্চলের এটি বেশ জনপ্রিয় খাবার। কাটা ছাড়া ফিলেট মাছ কিছু দোপেঁয়াজা করে রান্না করা হয়েছে আর কিছু অল্প তেলে মচমচে করে ভাজা হয়েছে। মটরশুঁটি দিয়ে আর বেশি করে মসলা দিয়ে ডিমের ভুনা করা হয়েছে। বাচ্চাদের খাবারের কথা ভেবে চিংড়ি আর সবজি দিয়ে পাস্তা রান্না করা হয়েছে। এছাড়াও, চিকেন তন্দুরি দিয়ে খাবার জন্যে হালকা বাটার দিয়ে নানরুটি সেঁকে রাখা হয়েছে। আমাদের ডাইনিং টেবিলের কাছাকাছি দেয়ালে বড়ো স্ক্রিনের টেলিভিশন। আমরা খেতে খেতে ক্যাবলবক্স চালিয়ে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল দেখছি ।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের বিধিনিষেধ, কারফিউ সব উঠে যেয়ে খুশির বন্যা হচ্ছে। পুরো ঢাকা শহরের লোকজন রাস্তায় নেমে উল্লাস করছে। একেবারে খুশির বন্যায় থই থই করছে চারিদিকে। আমরা টেলিভিশনে দেখছি সেই খুশির বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ‘গণভবনে’। সেই দুপুরবেলা থেকেই প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার নামের আগে ‘প্রাক্তন’ শব্দটি গেড়ে বসার পর থেকেই আপামর জনতা গণভবনে হামলে পড়েছে। ক্রোধে ফেটে পড়া জনগণ ডাইনিং টেবিলে সাজানো খাবার, ফ্রিজে রাখা মাছ মাংস, ঘরবাড়ির আসবাবপত্র, হাঁসমুরগী ইত্যাদি সাবাড় করে জয়োধ্বনি দিচ্ছে । এইমুহূর্তে বাংলাদেশে কোন সরকার নেই।
সরকার শূন্য বাংলাদেশে সংখ্যালঘু শ্রেণীর মানুষেরা নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে আতংকিত হয়ে পড়লেন।
চলবে ….
পর্ব ২-পর্ব ২
পর্ব ৩-পর্ব ৩
পর্ব ৪-পর্ব ৪
পর্ব ৫-পর্ব ৫
পর্ব ৬-পর্ব ৬
পর্ব ৭-পর্ব ৭
পর্ব ৮-পর্ব ৮
পর্ব ১০-পর্ব ১০
পর্ব ১১-পর্ব ১১
পর্ব ১২-পর্ব ১২