জ্ঞান ফিরে এলে চারিপাশে খাকি পোশাকের মানুষজন দেখে পরিমল হকচকিয়ে গেল। জমাট অন্ধকার একটি ঘরে তক্তপোশে সে শুয়ে আছে। একবার মনে হলো সে বোধ হয় মরে টরে গেছে। মুসলমান ভেবে তাকে হয়তো লোকজন কবরে রেখে দিয়েছে। আবছাভাবে মনে পড়ছে। মব ফর জাস্টিস এর কর্মসূচিতে হাইকোর্ট এর মাজারের দিক থেকে একটি মিছিলে সে ছিল। তারপর পুলিশের লাঠিচার্জ শুরু হলো। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে মাটিতে পরে গেল। প্রচন্ড এক যন্ত্রণা নিয়ে কোথায় যেন সে অন্ধকার এক জগতে তলিয়ে গেল।
পরিমল টয়লেটের বোটকা একটি গন্ধ টের পাচ্ছে। ইউনিভার্সিটির হলে যখন টাপের পানি থাকতো না বাথরুমের আশেপাশে এরকম গন্ধ পেত। আরেকটু পরে পরিমল একজন মানুষের ভয়ার্ত চিৎকারের আওয়াজ পেল। জমাট অন্ধকার ঘরে এসব ভয়ার্ত চিৎকার, ফ্যানের ঘর ঘর শব্দ চারিদিকে আরও ভুতরে পরিবেশ বানিয়ে রেখেছে। এতক্ষণে পরিমলের মনে হল তাকে কোন বন্দীশালায় রাখা হয়েছে। হ্যাঁ, পরিমলের আন্দাজই ঠিক। তাকে যে ঘরে রাখা হয়েছে তার নাম আয়না ঘর। আগস্ট মাসের ৫ তারিখের পর থেকে বিগত সরকারের বেশকিছু গোপন তথ্য হুরমুর করে প্রকাশিত হচ্ছে তার মধ্য বেশ চাঞ্চল্যকর এই তথ্য, ‘আয়না ঘর’। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্রের নাম আয়নাঘর। ধারণা করা হয়, এখানে কমপক্ষে ১৬টি কক্ষ রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ৩০ বন্দি রাখার সক্ষমতা রয়েছে। আয়নাঘরটি বাংলাদেশের ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত বলে ধারণা করা হয়।
বন্ধু সতীশ এর ফোন পেয়ে নগেন বাবু কাল বিলম্ব না করে ছেলের খোঁজে ঢাকায় এসেছেন। সতীশের সাথে নগেনের এক পশলা ঝগড়াঝাঁটিও হয়ে গেছে। নগেন বলেছিলো, ‘ভার্সিটি বন্ধ, একটু আশ্রয়ের জন্যে আমার ছেলে তোর এখানে উঠল, আর তুই ওকে বাসা থেকে বের করে দিলি ? তোর নিজের ছেলে হলে এটা পারতিস ? সতীশ বন্ধুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে হুহু করে বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে ফেলল। ‘দোস্ত, বিশ্বাস কর, যখন শুনলাম তোর ছেলে রাজাকারের বাচ্চাদের সাথে হাত মিলিয়ে গলা মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তখন মাথায় আগুন ধরে গেল, রাগের মাথায় ওকে চলে যেতে বলেছিলাম।’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বললেন সতীশ বাবু। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও অনেক বাংলাদেশিদেরকে ব্যাক্তি পূজার রাজনীতিতে অন্ধ হয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, এমন কি পারিবারিক সম্পর্ককেও অগ্রাহ্য করতে দেখা যায়। এই অন্ধ বিশ্বাস মানুষের চেতন ও অচেতন বোধকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর তাই, আমাদের উপন্যাসের সতীশ বাবু যখন জেনে ফেলেছিলেন তার বন্ধুর ছেলে তার প্রিয় দলীয় শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তখন তিনি নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তিনি প্রিয় ব্যালবন্ধুর ছেলেকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা একেকটি নাগরিককে তথা জাতিকে বিপথগামী করে ফেলে।
সতীশ ও নগেন দুই বন্ধু মিলে ঢাকা শহরের সব হাসপাতাল, থানায় খোঁজ নিয়েছেন। পরিমলের কোনো সংবাদ পাননি। সতীশ ও নগেন দুই বন্ধুই অনেকদিন সরকারি দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। এই দুদিনে মন্ত্রিপাড়ায় ঘোরাফেরা করে কান্নাকাটি করছেন তবুও পরিমলের কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। তবে একটি ক্লু পাওয়া গেল। পরিমলের আরেক বন্ধু রাজন জানিয়েছে কানাডা থেকে তাদের বন্ধু লিটন নাকি তাকে জানিয়েছে পরিমলের সাথে লিটনের কথা হয়েছে ৩১ জুলাই বুধবার দুপুরে। সেই সূত্রধরে নগেন খবরের কাগজ ঘেঁটে বের করলো ঐদিন দুপুরে হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে ‘ মব ফর জাস্টিস’ প্রোগ্রাম চলছিল। এক প্রতিমন্ত্রীকে ধরে ঢাকা মহানগরের পুলিশের আইজিপি কে ধরে নগেন ও সতীশ ঐদিন পুলিশের যে টিম ডিউটিতে ছিল সেই টিমের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন পরিমলকে কচুক্ষেত এলাকায় একটি বিশেষ জায়গায় আটকে রাখা হয়েছে। হাইকমান্ডের হুকুম ছাড়া সেখানে যাওয়ার সাধ্য কারও নেই।
বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের বেডে ঘুমন্ত আফতাবের পাশে একটি কিশোর ছেলে একটি পোটলা হাতে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরটির নাম বাবলু। বাবলুকে দিয়ে তার বড়ো বোন তিথি খাবারের টোপলা পাঠিয়েছে। বাবুল উপর নির্দেশনা হচ্ছে, সে যদি দেখে আফতাব ভাই ঘুমিয়ে আছে তাকে ডাকা যাবে না। যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি নিজের ইচ্ছায় ঘুম থেকে না উঠবেন তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বাবলুর শার্টের পকেটে তিথি ভাতের আঠা দিয়ে লাগানো খামে একটি চিঠি রেখেছে। বাবলু যদি আজকের এই খাবার ও চিঠির প্রজেক্ট সুষ্ঠভাবে শেষ করতে পারে তবে বাবলুর জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে, বাবলু স্কুলে বিজ্ঞান বই যে হারিয়ে এসেছে সেটি বাবা কে বলা হবে না। তিথি নিজের পয়সা দিয়ে বিজ্ঞান বই কিনে মলাট করে বাবলুর হাতে তুলে দিবে, বাবা অথবা মা কেউই ঘুনাক্ষরেও টের পাবে না। আজ বাসায় যেহেতু বাবা সারাদিন বাসায় ছিল তাই তিথি নিযে না এসে ছোট ভাইকে ঘুষ দিয়ে আফতাবের খাবার পাঠিয়েছে।
বাবলু প্রায় পনেরো মিনিট ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। বাবলু অনায়াসে আরো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো, কিন্তু নাদুস নুদুস চেহারার কয়েকটি পেট মোটা মশা বাবলুর গালে,পায়ে একটু পর পর বসে বাবলুকে জ্বালিয়ে মারছে। পাছে শব্দে আফতাব ভাইয়ের ঘুম ভেঙে যায়, তাই বাবলু অতি সাবধানে মশাগুলোকে হাতের আঙুলে ঠেসে ধরে মারার চেষ্টা করছে। মশাগুলিও বেশ ধূর্ত টাইপের । বাবলু যখনি হাতের আঙ্গুল মশার একেবারে কাছে আনছে ঠিক তখনি মশাটি গান গাইতে গাইতে পালিয়ে যাচ্ছে। তবে দুই একটি বোকা টাইপের খাদক মশা রক্তের নেশায় হাপুসহুপুস করে খেতে যেয়ে বাবলুর হাতের আঙুলে চেপ্টা হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে। বাবলুর মুখ তখন জয়ের আনন্দে ঝলমল করে উঠছে। বাবলু সেই মৃত মশাকে হাসপাতালের মেঝেতে ফেলে দিতেই সার বেঁধে লাল পিঁপড়ে মশার শব দেহকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই আজব পৃথিবীর ফুড চেইনের নিয়মে বাধা যাবতীয় প্রাণিকুল। একেকটি প্রাণী বেঁচে থাকার জন্যে, টিকে থাকার জন্যে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতি ও কম শক্তিশালী জীবকে শিকার করে, গ্রাস করে। ক্ষমতা লিপ্সু লোভী প্রাণীদের ক্ষেত্রেও কি একই নিয়ম খাটে না ? উপজেলা, জেলা , বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ের একেকটি ক্ষমতাবান নেতানেত্রীবৃন্দ ফুডচেইনের মতো করে ক্ষমতার চেইন বিস্তার করে ক্ষমতায় টিকে থাকেন। সেই চেইনের তলানিতে থাকে নিরীহ জনগণ।
ঘুম ভেঙে আফতাব বাবলুকে দেখতে পেয়ে বলে উঠলো, ‘আরে বাবলু সাহেব, কখন এলে ? বাবলুকে এই আফতাব ভাই ছাড়া আর কেউ কখনো সাহেব সম্বোধন করে না। মা তাকে আদর করে বাবলু সোনা বলে ডাকে, বাবলুর বেশ লজ্জা লাগে। বাবা তাকে ডাকে বাবলু মিয়া বলে। বাবলুর এটি মোটামুটি লাগে, তবে আফতাব যখন বাবলু সাহেব বলে নিজেকে তখন বেশ বড়োসড়ো লাগে। শুধু সম্বোধনেই না আরো একটি কারণে আফতাব ভাইয়ের উপর বাবলুর বেশ শ্রদ্ধা ভক্তি। মাঝে মাঝে আফতাব ভাই তাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে হাওয়া খেতে মালতি নগরের চানমারির ঘাটে নিয়ে যায়, ঝালমুড়ি কিনে দেয় ইত্যাদি।
বাবলু নির্দেশ মতো পোটলা খুলে খিচুড়ির বাটিতে আরেকটি ছোট বাটি থেকে হাঁসের মাংস, আরেকটি বাটি থেকে আলুভাজি ও ডিমের ওমলেট রেখে আফতাবের মুখের সামনে তুলে ধরলো। আফতাব বললো, ‘বাবলু সাহেব, এ যে একেবারে বেহেশতী খাবার? বাসায় আজ কি কোনো উৎসব ছিল বাবলু সাহেব ? বাবলু কাচুমাচু মুখে বললো, ‘বাড়িত বুবু, বড়ো দুলাভাই আচ্চে তো সেই জন্য আব্বা বক্সী বাজার থেকে হাঁস লিয়া আচ্চিলো।’ আফতাব চেটেপুটে খেয়ে এক গ্লাস পানি খেল। বাবলু এবার জামার পকেট থেকে আপার দেয়া চিঠির খামটি আফতাব ভাইয়ের হাতে তুলে দিল। আর আরেক হাতে প্যান্টের পকেট থেকে এক টুকরা কাগজ ও একটি বলপেন এগিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘ আপা কোয়া দিছে চিঠি পড়ে আপনে এই কাগজত উত্তর লেখে হামার হাতত দিবেন।’
আফতাব ধীরে সুস্থে সাদা কাগজ আর বলপেন বিছানায় রেখে পরম যত্নে তিথির দেয়া খামের প্রান্ত ছিঁড়ে দ্রুত চিঠি পড়া শুরু করলো।
একেকটি লাইন পড়ছে আর আফতাবের মুখচ্ছবি পাল্টে যাচ্ছে । চিঠির মাঝামাঝি আসতেই হাঁসের মাংস আর খিচুড়ি খেয়ে আফতাব যে তৃপ্তি পেয়েছিলো সেই তৃপ্তি কর্পূরের মতো দ্রুত উবে গেল। পড়া শেষে চিঠিটি হাতে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে আফতাব আধো শোয়া হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে তাকিয়ে আছে। মাথার মধ্যে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে একটি বিশাল মরুভূমিতে সে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে মরুভূমির তপ্ত বালি আর লু হাওয়া। তৃষ্নায় ছটফট করছে। দূরে তপ্ত মরুভূমির মাঝে পানির আভাস দেখে দৌড়ে কাছে যাচ্ছে, কিন্তু সেই পানির দেখা মিলছে না। দেখার কথাও না, সে তো মরীচিকা। তার ক্ষেত্রে ভালোবাসা কী শুধুই মরীচিকা!!
বাবলুর কথায় আফতাব বাস্তব জগতে ফিরে এলো। বাবলু বললো, ‘ভাই, একন আপনে চিঠির উত্তর লেখে দেন। হামি বাড়িতে যায়া আপার হাতত দিমু।’ আফতাব অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবলুর দেয়া সেই কাগজটিতে অনেক সময় নিয়ে চিঠির উত্তর লিখে ভাঁজ করে সেই ছেঁড়া খামের মধ্যে ঢুকিয়ে এঁটো খাবারের থেকে দু একটি ভাতের দানা দিয়ে খামটি বন্ধ করে বাবলুর হাতে দিতে দিতে বললো ‘বাবলু সাহেব, তোমার আপাকে বলবে খাবার খুব মজা হয়েছে।’ বাবলু সেই কথার উত্তর না দিয়ে এঁটো খাবারের বাটিগুলো পোটলায় ভরে আফতাবের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি দিয়ে চলে গেল। পাঠক, আসুন দেখি, কি এমন লেখা ছিল সেই চিঠিতে যে আফতাব এতখানি মূর্ছিত হয়ে পড়লো এবং আফতাব এতো সময় নিয়ে কিই বা উত্তর লিখল:
প্রিয় আতু (তিথির দেয়া আফতাবের সংক্ষিপ্ত নাম)
বাড়িতে মেহমান ভর্তি, একেবারে গিজগিজ করছে। আমি যা সন্দেহ করেছিলাম, তাই হলো। বড়ো দুলা ভাই আমার বিয়ের এক সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। ছেলে ময়মনসিংহ থেকে পাশ করা গাবতলী উপজেলার ভেটেরিনারি সার্জেন, তার মানে গরুর ডাক্তার। আম্মা, আব্বা সবাই এই বিয়ে তে রাজি। গতকাল ছেলের বাবা, মামা এসে আমাকে দেখে বিয়ের দিন-তারিখ পাকা করেছে। ছেলের মায়ের কথা, দেশের অবস্থা যেহেতু ভালো না, তাই কোনো অনুষ্ঠান না করে বিয়ে পড়িয়ে মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে। জান পাখি, আমার মনের অবস্থা একটু বোঝার চেষ্টা করো, আমি যে তোমার হাত ধরে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবো সেই পথ নাই, তুমি হাসপাতালে গুলি খাওয়া পায়ের যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছ। আমাকে বাইরেও যেতে দিচ্ছে না। জান-মনি, এই অবস্থায় আমি কি করবো, কাগজে লিখে বাবলুর হাতে দিবে। বাবলু কাউকে এই চিঠি দেখাবে না।
ইতি
তিথি
তিথির এই চিঠির উত্তরে আফতাব অনেক সময় নিয়ে যা লিখেছিলো তাতে কাগজে অনেক কাটাকুটির পরে শুধুমাত্র একটি লাইন লেখা ‘ভালো থেকো তিথি’।
তিথি কতখানি ভালো আছে সেটি জানতে হলে পাঠকদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, ততক্ষনে বগুড়া শহরের তরফদার মার্কেটে বইয়ের দোকানের কর্মচারী দেলোয়ারের বাসার দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দেলোয়ারের বাসায় ঘরোয়া পরিবেশে উৎসব হচ্ছে। দেলোয়ারের স্ত্রী রাবেয়া বেগম এক চুলায় গরুর গোস্ত তুলে দিয়েছেন, আরেক চুলায় চিকন চালের ভাত রান্না হচ্ছে। আলু সিদ্ধের পাতিল ইতিমধ্যে নামিয়ে রাখা হয়েছে। দেলোয়ারের ছোট বোন স্নিগ্ধা, পলিন মায়ের সাথে হাত লাগিয়ে সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়ছে। খোসা ছাড়ানো হয়ে গেলে আলুগুলিকে পেস্ট করে পিয়াজ রসুনের কুঁচি তেলে ভেজে বাগার দিয়ে ছোট ছোট পিস করে রান্না করা গরুর গোস্তের সাথে মিশে বগুড়ার বিখ্যাত আলু-ঘাঁটি রান্না করা হবে। এই উৎসবের উপলক্ষ, আজ এই বাড়ির মেঝো ছেলে রাজনকে বগুড়া সদর থানা থেকে বিশেষ মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে রাজনকে থানায় ঘরে নিয়ে যেয়ে টর্চার করা হয়েছিল। বসার ঘরে দেলোয়ার তার বাল্যবন্ধু রহমান নগরে অবস্থিত ফুড অফিসের হেড ক্লার্ক ময়েজ উদ্দিন আরেক বাল্যবন্ধু ব্যাবসায়ী আফসার আলীর সাথে চা পান করতে করতে খোশ গল্পে মেতে উঠেছে। আজ কারফিউ কিছুটা শিথিল হওয়ায় বন্ধুরা দেলোয়ারের বাসায় আড্ডা দিচ্ছে। দুপুরের খাবার খেয়ে আসরের আগেই যে যার পথে চলে যাবে।
আমি দেশ থেকে হাজার হাজার মেইল দূরে কানাডার টরেন্ট শহরে দেশের জন্যে রাজ্যের উৎকণ্ঠা নিয়ে ইন্টারনেট এর উপর চোখ রেখে দেশের খবরের আপডেট দেখি, ক্যাবেল বক্সের সাহায্যে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখি। সব চ্যেনেলে সঠিক খবর পাওয়া যায় না। দু একটি চ্যানেল যেমন যমুনা টিভি, চ্যানেল আই প্রভৃতি চ্যানেলের উপর কিছুটা ভরসা করা যায়। গুজব সৃষ্টি না করার জন্যে সেই ১৭ জুলাই (বুধবার) রাত থেকে দেশে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। নির্দেশ দিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। আমি দেশের বন্ধুদের সাথে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কয়েকদিন ধরে কথা বলতে পারছি না। প্রচন্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে যন্ত্রের মতো অফিস করছি। অবশেষে মঙ্গলবার জুলাই ২৩ তারিখে বিকেলে বিটিআরসি ভবনে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক সাহেবের দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী পরের দিন বুধবার থেকে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে।
ইতিমধ্যে শুনেছি দেশের মোবাইল ফোনে আড়ি পেতে কথা রেকর্ড করা হয়। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি দেশে কথা বললেও পারতো পক্ষে দেশের রাজনীতি নিয়ে কোনো কথাই বলি না। বাল্যবন্ধু আফসার আলীর ছেলে লিটন টরেন্টোতে পড়াশুনা করার সুবাদে দেশে আফসার আলী বন্ধুর সাথে টুকটাক কথা হতো তাও, অনেকদিন করা হয় না। আজ গভীর রাতেও কিছুতেই ঘুম আসছে না দেখে বন্ধু আফসার আলীকে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিলাম, ‘ বন্ধু কেমন আছিস? আফসার আলী গল্পের মাঝে কথা থামিয়ে বন্ধুদের বললো, ‘ কানাডা থেকে জাকারিয়া ফোন করছে’। আফসার আলী ফোনে স্পিকারে দিয়ে আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বললেন , ‘দোস্ত, আমরা মানে আমি, ময়েজ, দেলোয়ারের বাসায় আড্ডা দিচ্ছি। আজ ওর ছেলে রাজনকে….. বলতেই কি মনে করে কথা ঘুরিয়ে বললো, তোদের ওখানে এখন কয়টা বাজে দোস্ত? আমি দেলোয়ারের ছেলে রাজনের প্রসঙ্গে আর উৎসাহ না দেখিয়ে বললাম, ‘আমাদের এখানে এখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে বন্ধু, তোদের কথা খুব মনে হচ্ছিলো, তাই ফোন দিলাম। তোর ছেলে লিটন মাঝে মাঝে আসে আমাদের বাসায়, আজ ফোন করেছিল কালকে সন্ধ্যায় আবার আসবে। ওর এক ক্লাসমেটের বাসা নিয়ে কি এক ঝামেলা হচ্ছে । আমাকে বলছিলো সেই মেয়েটির জন্য বাসা ভাড়ার ব্যাপারে হেল্প করার জন্যে, আমি ওদের কালকে এখানে আমার এক বন্ধুর বেজমেন্ট দেখতে নিয়ে যাবো’। আফসার আলীর সাথে আরো কিছুক্ষন কথা বলে খানিক্ষন বন্ধু দেলোয়ারের সাথে, খানিক্ষন বন্ধু ময়েজের সাথে ফোনে কথা বলে ফোন রেখে দিলাম।
নিজেকে কেমন জানি সুবিধাবাদীরা মতো মনে হচ্ছে। একটি উন্নত দেশে পরিবারপরিজন নিয়ে দুধেভাতে শান্তিতে আছি। তবে সুখে কী আছি ? ? প্রিয় জন্মভূমি দেশের এই পরিস্থিতিতে সুখে কী থাকা যায়? দেশে আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবরা কি এক অরাজকতার মধ্যে অশান্তিতে আছে। দেশের এক সময়ের কালজয়ী নেতার কন্যা কচ্ছপের মতো মরণ কামড় বসিয়ে ক্ষমতার চেয়ার আগলে ধরে আছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন বাড়ি বাড়ি যেয়ে স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছাত্রজনতা।
৩ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র-জনতা সমবেত হয়ে সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম সরকার পতনের এক দফা একদফা দাবি ঘোষণা করলেন। আমি আমার ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার আগেই লাল করে রেখেছি। এবার সেই লাল বৃত্তের মাঝে বাংলায় এক সংখ্যা লিখে আন্দোলনকারীদের সাথে এককত্বতা ঘোষণা করে নানান পোষ্ট দিয়ে দিয়ে আন্দলোনকারীদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। অনেকদিন পরে, দেশে বন্ধুদের সাথে কথা বলে আরও খানিক্ষন ইন্টারনেটে থেকে গভীর রাতে ঘুমুতে গেলাম। ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমের মধ্যে ভোর রাতে জেগে উঠেছি। স্বপ্নে দেখলাম হাই ওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছি। আমার গাড়ি থেকে পেছনের একটি চাকা খুলে গড়িয়ে যাচ্ছে। আমি গাড়ি থামানের চেষ্টা করছি কিন্তু থামাতে পারছি না। তিন চাকা নিয়েই আমার গাড়ি বিকট শব্দ করতে করতে সমানে এগিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে আমার গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
পর্ব ২-পর্ব ২
পর্ব ৩-পর্ব ৩
পর্ব ৪-পর্ব ৪
পর্ব ৫-পর্ব ৫
পর্ব ৬-পর্ব ৬
পর্ব ৭-পর্ব ৭
পর্ব ৮-পর্ব ৮