আফতাব হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে শুয়ে লম্বা অবসরে নানান কথা ভাবার সুযোগ পেয়েছে। আফতাব তার সমস্ত ভাবনাগুলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ লিস্ট করে চারটি ভাগে ভাগ করেছে। যেমন, রাজনীতি, ধর্মনীতি, নিজের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার, এবং পারিবারিক এফেয়ার্স। এই প্রধান ভাগগুলোকে আফতাব আবার কতগুলো উপভাগে বিভক্ত করেছে। যেমন রাজনীতির ক্যাটাগরিতে লিখেছে বাংলাদেশে কমিউনিস্টদের ভবিষ্যৎ, বিএনপি ও জামাতের মিল -অমিল, আওয়ামী লীগের ভারত তোষণ-নীতি, বর্তমানের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশে জামাতে ইসলামের রাজনীতির প্রভাব, ইত্যাদি। সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করার জন্যে আফতাব সেই ভাবনাগুলোকে একটি ছকে নিয়ে এসেছে। যেমন ভোরে ঘুম ভেঙে নাস্তা খাবার আগ পর্যন্ত একটি ভাবনা, নাস্তা খাবার পর থেকে দুপুরের খাবারের মধ্যবর্তি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অন্য এক ধরণের ভাবনা, দুপুরের খাবারের পরে ঘুমের আগ পর্যন্ত, আবার বিকেলে ঘুম থেকে উঠে রাতের খাবার পর্যন্ত এবং ফাইনালি রাতের খাবার খেয়ে রাতের  ঘুম পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ভাবনা। এই ভাবনাগুলোর কার্যক্রম রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলে। শুক্রবারের ছুটির দিনের হিসেব আলাদা।

আজ শুক্রবার দুপুর বেলা। একে তো ছুটির দিন, তারপরে আবার দুপুর বেলা । হাসপাতালের নার্স, বয়-বাবুর্চি সবার মধ্যে ঢিলে ঢিলে ভাব। স্বয়ং ডিউটি ডাক্তার মেহরাব হোসেন সকাল সাড়ে আটটার ডিউটি করতে এলেন পৌনে দশটার সময়। ওনার মেঝো মেয়ে ইতালি থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। সকালে মেয়ে জামাইয়ের সাথে নাস্তা পর্ব ও ইতালি বিষয়ে গল্পগুজব শেষ করে আসতে কিছুটা দেরি করে ফেলেছেন। দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে ডাক্তার মেহরাব কে তেমন একটি বিচলিত হতে দেখা গেল না।

একমাত্র হেড বাবুর্চি ইমতিয়াজ হোসেনকে দেখা যাচ্ছে বিপুল উৎসাহ নিয়ে দেশী মুরগির ঝোল রান্না করছেন। দেশে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার ও স্টাফরা রুগীদের তেমন একটা মান্য করতে দেখা যায় না। ইমতিয়াজ এরকম করে ভাবেন না। অনেক কষ্টের বিনিময়ে এই বাবুর্চির চাকরি পেয়েছেন বলে তিনি এই হাসপাতালের সকল রুগী , স্টাফ সবাইকে সমীহ  করে চলেন। শুধু সহকারী বাবুর্চি রহিমা বেগম ছাড়া। রহিমা বেগম একজন ধূর্ত চোর টাইপের স্টাফ।

হাসপাতালের রান্নায় বেশি মশলাপাতি দেয়ার নিয়ম নেই। তবুও ইমতিয়াজ হোসেনের আজ ইচ্ছে হয়েছে মুরগির ঝোল রান্নার শেষের দিকে চুলা থেকে নামানোর  আগদিয়ে ভাজা জিরের গুড়া ছিঁটিয়ে  দিবেন। এতে টেস্ট ভাল হয়। কিন্তু সমস্যা হয়েছে জিরার কৌটায় জিরা একেবারে জিরো হয়ে আছে, পুরোটাই খালি। সম্ভবত রহিমা বেগম সরিয়ে ফেলেছে। এই বদ মহিলাকে চাকরি থেকে সরানো দরকার। ইমতিয়াজ হোসেনের ধারণা আমাদের দেশে পুরুষদের চাকরি যত সহজে খাওয়া যায়, মহিলাদের ক্ষেত্রে তত সহজে খাওয়া যায় না। মহিলারা ছলাকলা করে চাকরি টিকে রাখে। যেমন এই রহিমা বেগম।

বছর দুয়েক আগে সমস্ত হাসপাতাল যখন কোভিড ভাইরাসে আক্রান্ত রুগিদের সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে সেই সময়ে ষ্টোর রুম থেকে দুই ব্যাগ কালিজিরা চাল সাফাই করতে যেয়ে রহিমা বেগম রেজিস্ট্রার সাহেবের পিয়ন আশরাফের এর কছে হাতেনাতে ধরা পড়লেন। পরে আশরাফের হাতেপায়ে ধরে মরাকান্না করে বিলাপ করে রহিমা বেগম বলতে থাকলেন ‘ ঘরোত হামার আধামরা স্বশুর পোলাও খাবার চাছে, তাই হামি এই চাল বাড়িত লিয়া যাচ্চি।’ বাহ্, কি চমৎকার যুক্তি! আশরাফের মন নরম হতেই চতুর রহিমা বেগম আশরাফের হাতে একটা চালের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে নিজের ব্যাগটা নিয়ে ধুম করে রিকশায় উঠে বসলেন। আশরাফ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চালের ব্যাগ হাতে নিয়ে  দাঁড়িয়ে  দাঁড়িয়ে দেখলেন রহিমা বেগমের রিক্সা দ্রুত হাওয়া হয়ে গেল। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন রহিমা বেগম।

ইমতিয়াজ হোসেন রহিমাকে বললেন ক্যাশিয়ার বাবুর কাছ থেকে পেটি ক্যাশ নিয়ে চট করে দোকান থেকে জিরা কিনে আনতে। ইমতিয়াজ হোসেন আজ বিশেষ আগ্রহ নিয়ে ভালো খাবার রান্না করার রহস্য হচ্ছে এই হাসপাতালের দোতলায় কোনার দিকের ওয়ার্ডের পুবপাশের বেডে যে যুবক পেশেন্টকে রাখা হয়েছে তিনি ইমতিয়াজ হোসেনের বিশেষ পরিচিত। যুবকটির নাম আফতাব । এই আফতাবের বাবা ময়েজ উদ্দিনের সুপারিশেই ইমতিয়াজের  এই হাসপাতালের চাকরিটি হয়েছিল। গতরাতে ডিউটি শেষ করে বাসার দিকে যেতেই ইমতিয়াজ হোসেন ময়েজ উদ্দিন সাহেবকে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতে দেখে সবার সামনে টুপ করে পা ছুয়ে ছালাম করে বললেন, ‘ স্যার, আপনে এটি, হঠাৎ কি মনে কর‍্যা?  কোন রুগি আছে? ময়েজ উদ্দিন  বললেন,

‘আমার ছেলে দুদিন ধরে এখানে আছে। আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলি ওর বাম উরুতে লাগে। পা টা মনে হয় কেটেই ফেলতে হবে।’

চট করে এই মানুষটিকে কিভাবে শান্তনা দেয়া যায় ইমতিয়াজের মাথায় আসছে না। হেড বাবুর্চি ইমতিয়াজ তার স্যারের ছেলের পায়ে গুলি লাগার বিষয়টিকে পাশকাটিয়ে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন , ‘স্যার আপনার ছোলের খাবার লিয়া চিন্তা করবেন না, হামি দেখভাল করমু।’ সেই থেকে ইমতিয়াজ হোসেনের রান্নার বিশেষ তোড়জোড়। বিপুল উৎসাহ নিয়ে ভাল ভাল খাবার রান্না করে নিজ হাতে আফতাবের কাছে এসে সেসব খাবার দিয়ে যাচ্ছে।  যে মানুষটির জন্যে তার এই বাবুর্চির  চাকরি হয়েছে সেই মানুষটির ছেলের প্রতি তারতো একটি বাড়তি  কর্তব্য থাকতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। কৃতজ্ঞতা বোধ সমাজের তথাকথিত উপরের স্তরের মানুষদের মধ্যে তেমন একটা দেখা না গেলেও নিচের দিকের মানুষদের মধ্যে প্রবলভাবে দেখা যায়।

আফতাব বেডে শুয়ে দুপুরে খাবারের অপেক্ষা করছে। যদিও ছুটির দিন, আজ তার লিষ্টের নির্দিষ্ট কোনো ভাবনা নিয়ে চিন্তা করার দিন না। তবুও সে আজ অভ্যাসমতো তার ছকে লেখা পারিবারিক এফেয়ার্স বিষয়ে ভাবছে। ঠিক কাকতালীয়ভাবে সেই সময়ে ফুলের তোড়া হাতে অসম্ভব রূপবতী একটি মেয়েকে আফতাবের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আফতাব বিস্ময় ও মুগ্ধতা নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটিও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আফতাবের দিকে। একে অন্যের দিকে এই দৃষ্টির বিনিময়ের মেয়াদ আরো দীর্ঘ হতে পারতো, কিন্তু বেরসিক ইমতিয়াজ হোসেনের ডাকে দুজনেরই চমক ভাঙলো । ইমতিয়াজ বললেন, ‘ ছোট স্যার, গরম গরম খাবার, খায়া ল্যান, আপনার জন্যে একেবারে চুলাত থ্যাকা লিয়া আচ্চি।’

আফতাবের কাছে ফুলের তোড়া নিয়ে যে মেয়েটি আফতাবের দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে, তাঁর নাম তিথি। তিথি বগুড়া আযিযুল হক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। অতি সম্প্রতি তিথি, আফতাবের এক মামাতো বোনের প্ররোচনায় ও সহযোগিতায় আফতাবের প্রেমে পড়েছে। দু একবার ছুটির দিনে দুজনে প্রেমের দুর্নিবার আকর্ষণে শহর থেকে দূরে মহাস্থানে বেড়াতে গিয়েছে, গল্প গুজব করেছে। ওদের প্রেমের ফুল ফুটতে না ফুটতেই দেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হলো । গত ৪/৫ দিন আগেও এক সাথে কলেজ চত্বরে গল্প করেছে। পরশুদিন বান্ধবীর মাধ্যমে তিথি শুনেছে আফতাব ভাইয়ের পায়ে গুলি লেগেছে। খবরটি শোনার পর থেকে তিথি কেঁদে কেটে দুচোখ ফুলে তুলেছে। এক দিন রোজা রেখেছে। মসজিদে একশো টাকা দান করার নিয়ত করেছে। তিথির মনে ক্ষীণ আশা অপারেশনের পরে আফতাব ভাইয়ের পা ঠিক হয়ে যাবে। আশা আকাঙ্খা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রেম-ভালোবাসাকে জিইয়ে রাখে, সজীব রাখে।

তিথি আফতাবের মাথার কাছে বেডের উপরে ধপ করে বসে পড়লো। আফতাব শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে একটু কাত হয়ে তিথির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই তিথি  আফতাবের হাতটি কোলের কাছে এনে  কান্নায় ভেঙে পড়লো। আশেপাশের বেডে থেকে  রুগীরা ওদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তাতে কি! সেদিকে এঁদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। প্রেম যুবক-যুবতীদের বেপরোয়া করে তোলে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিথি বললো, ‘ডাক্তার সাহেব কি বলেছে ? অপারেশনের পরে পা ঠিক হবে, না কি কেটে ফেলে দিবে ? তিথিকে শান্তনা দিয়ে আফতাব মৃদু হেসে বললো, ‘আরে না, দেখবে ইন্শাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে গেছে। আর ঠিক না হলেই বা কি, আরেক পা তো আছেই।   ক্র্যাচে ভর দিয়ে এক পায়ে হাঁটতে হাঁটতে গান গাইবো , ‘এক পায়ে জুতা, আর অন্য পা খালি ….. এক পাশে সাগর, এক পাশে বালি, তোমার ছোট তরী, বলো, নেবে কি? তিথি কপট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘এসব নিয়ে রসিকতা করা একদম ঠিক না, খবরদার আর এসব কথা মুখে আনবে না।’

জুলাই মাসের ২৪ তারিখ শুক্রবারে দুপুর বিকেলের সন্দিক্ষনে যখন বগুড়া শহরের মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের বেডে শুয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে গুলি খাওয়া আফতাব যখন তাঁর নব্য প্রেমিকা তিথির সাথে আনন্দ ও বেদনার কথোপকথন করছে,খুনসুটি করছে অনেকটা একই সময়ে নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকায় একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার অবতারণা হতে দেখা গেল। মাত্র সাড়ে ছয় বছরের একটি শিশু ছাদে খেলা করতে যেয়ে আন্দোলন ঠেকাতে সরকার কর্তৃক লেলিয়ে দেয়া বাহিনীর গুলি খেয়ে বাবার কোলে নেতিয়ে পড়লো।

শিশু মেয়েটির নাম রিয়া গোপ। দীপক কুমার গোপ ও বিউটি ঘোষ দম্পতির একমাত্র সন্তান। ১৯ জুলাই, দুপুরের খাবারের পর রিয়া ছাদে খেলতে গিয়েছিল। বাইরে তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঝড় বইছে। ছাত্র-জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভয় পেয়ে বাচ্চা মেয়ে রিয়াকে ছাদ থেকে নিরাপদে আনার জন্য পিতা দীপক কুমার গোপ প্রায় দৌড়ে ছাদে উঠে এলেন । অপলকে চেয়ে দেখলেন একমনে বাচ্চাটি খেলে চলেছে। হাত বাড়িয়ে রিয়াকে কোলে তুলে নিতেই পুলিশের গুলি রিয়ার মাথার পেছনে ছোবল মারলো। ‘বাবা বলে আর্তনাদ করে উঠলো বাচ্চা শিশুটির মাথা থেকে গল গল করে রক্ত বের হওয়া দীপকের জামাকাপড়, সমস্ত শরীর মেখে গেল । রক্তে রঞ্জিত হলো বাংলাদেশের মানচিত্র। খানিক্ষন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দীপক ছুটলেন স্থানীয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের দিকে।

পরে শিশু রিয়ার অবস্থা অবনতি ঘটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলো। অস্ত্রোপচার করা হলো। ডাক্তারগণ ইনটেনসিভ কেয়ারে ((ICU) রেখে পরিচর্যা করলেন। তিন দিনের দিনে রিয়াকে একটু নড়াচড়া করতে দেখে সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। মহাবিশ্বের এ এক অদ্ভুত নিয়ম। জগতের সকল কিছু শেষ হওয়ার আগে সবকিছু দপ করে করে জ্বলে উঠেতে দেখা যায় । ২৪ জুলাই দেশবাসীকে কাঁদিয়ে চিরদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে গেল শিশু রিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা রিয়ার ফাইলে মৃত্যুর কারণ হিসেবে লিখে রাখলেন “গানশট ইনজুরি”। পরের দিনের দেশের প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলো শিশু রিয়াকে নিয়ে বড়ো বড়ো হরফে হেডিং করে খবর পরিবেশন করল। প্রথম আলো পত্রিকা শিশু রিয়ার জন্মদিনের একটি ছবি দিয়ে খবর ছাপালো ‘বাসার ছাদে বাবার কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট মেয়েটি’। (প্রথম আলো আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০০: ৪৪)

রিয়া গোপের মৃত্যুর ঠিক আগের দিনে আরো একটি মর্মান্তিক মৃত্য সংবাদ আমাদের সবার মনকে নাড়া দিয়েছিল। আসুন, সেই সংবাদটির দিকে একটু দৃষ্টি ফেরাই। প্রথম আলো পত্রিকা যে হেডিং দিয়ে খবর ছেপেছিল সেটি হচ্ছে : একটি গুলিতে সব স্বপ্ন শেষ’। এই খবরের সূত্র ধরে পাওয়া যায় হৃদয় চন্দ্র পটুয়াখালীর বাসা মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঘটকের আন্দুয়া গ্রামে। ওনার বাবার নাম রতন চন্দ্র তরুয়া ও মায়ের নাম অর্চনা রানী। দুই ভাই–বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। পড়তেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষে। হৃদয়ের বাবা-মা পরিবার নিয়ে পটুয়াখালী শহরের মুন্সেফপাড়া এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। ১৮ জুলাই চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে কোটা এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের সময়ে  হৃদয় চন্দ্র  গুলিবিদ্ধ হন।  পরবর্তীতে, ঢাকা মেডিকেলের হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঁচ দিন লড়াই করে ২৩ জুলাই (মঙ্গলবার) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। পেশায় কাঠমিস্ত্রি বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া পত্রিকার সাংবাদিকদের কাঁদতে কাঁদতে বলেন: ‘অনেক কষ্ট করে হৃদয় লেখাপড়া করছিল। অনেক স্বপ্ন দেখেছি তাকে নিয়ে। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করে দরিদ্র বাবার সংসারের হাল ধরবে—কত স্বপ্ন ছিল। একটি গুলিতে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।’ (প্রথম আলো আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০৩: ৫৯ )

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে শত শত শহীদের তালিকায় বেশ কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশিদের নাম ইতিহাস ঘেটে পাওয়া যায়। শুধুমাত্র ১৪ ই ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসেই  কেবল মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অনেক মুসলিম শিক্ষদের সাথে অন্তত চারজন হিন্দু শিক্ষক যেমন ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ডঃ জি. সি. দেব, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য – এনাদেরকে পাকবাহিনীরা নির্মমভাবে মেরে ফেলে।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহিত মুসলিমের পাশাপাশি  হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী শহীদগণের কথা মাথায় রেখেই হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ স্থান পেয়েছিল । সেই ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ আবারও জেগে উঠেছে ২০২৪ সালে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সহস্রাধিক শহীদের কাতারে অন্তত নয়জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী শহীদের নাম পাওয়া যায়। এনারা হলেন: রিয়া গোপ, দীপ্ত দে, হৃদয় চন্দ্র তারোয়া, রিপন চন্দ্র , রথীন বিশ্বাস, রুদ্র সেন, শুভ শীল, তনয় চন্দ্র দাস, সৈকত চন্দ্র দে। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার তথা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাষ্টরমাইনদের নির্দেশে ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে যে লাল রঙের ব্যাবহার দেখা যায় সেই লাল রঙের সাথে মিশে আছে অনেক হিন্দু-মুসলিমের রক্ত।

২০২৪ সালের প্রতিটি শহীদের মৃত্যু একেকটি মর্মান্তিক ইতিহাস। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে ইন্টারনেট ঘেটে আমি এই ইতিহাসের সংবাদগুলো খুঁটে খুঁটে মন দিয়ে পড়ি। সেই ইতিহাসের কিছু চরিত্রের সাথে আরও কিছু কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করে রং তুলি মেখে আমার গল্পে নিয়ে আসি। আমি যখন আমার ধারাবাহিকের আজকের পর্বটি লিখতে বসেছি একটি বিশেষ মহলের নীল নকশায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশী কমিউনিটিগুলোতে হিন্দু-মুসলিম বিভক্ততা দেখিয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে মাসমিডিয়াগুলোতে আক্রমণাত্মক পোষ্ট দিচ্ছেন। তাই ভাবলাম, আমার লেখায় এই প্রসঙ্গটি টেনে আনি। প্রবাসে বসে আমি জেগে জেগে সংখ্যাগুরু-লঘুহীন এক অসাম্প্রদায়িক অখন্ডিত নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। শুভ বিজয় দিবস !!!

আগের পর্বগুলি –
পর্ব ১-পর্ব ১
পর্ব ২-পর্ব ২
পর্ব ৩-পর্ব ৩
পর্ব ৪-পর্ব ৪
পর্ব ৫-পর্ব ৫
পর্ব ৬-পর্ব ৬
পর্ব ৭-পর্ব ৭

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালচাল : ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন
পরবর্তী নিবন্ধনজরুল ইসলাম 
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন