কেরামত আলী মিয়ার পরিকল্পনা রমিজের বাড়ি উঠিয়ে দিয়ে সুন্দর করে দৈর্য/প্রস্থ সমান করে  বাড়ি ও ফুলের বাগান করবে। সে  বলে, আমার পরিকল্পনা আছে,বাড়ির সামনে যে পুকুর আছে, তার চারি পাড়ে ফুল ও ফলের গাছ লাগানো হবে এবং সুন্দর করে সান বাঁধানো ঘাট করা হবে যেখানে আমার ছেলে মেয়ে,পুত্র বধূ এবং নাতি নাতনিরা বসে বিকালে গল্প করবে।  পুকুরের পাড়ে পাক্কা বেঞ্চ বসানো হবে । পুকুরের  পানিতে মাছ মারার ঔষুধ দিয়ে সব ছোট মাছ মেরে শুধু নিদৃষ্ট রুহি, কাতল,মৃগেল মাছের চাষ করবো ।  খালের সঙ্গে পুকুরের যে নালা আছে তা বন্ধ করে দেব যাতে করে  বাহির থেকে ছোট নানান ধরণের মাছ আসতে  না পারে ।
দিলারা বলে আব্বু ওপারে রমিজ ও তার স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে।  তাদের কি করা হবে,তারা ও  তো   পুকুরের  অংশীদার ?
সে বলে ওকে এখান  থেকে উঠিয়ে দেয়া হবে।
দিলারা বলে ,ওকে তুমি কি করে উঠাবে ওদের পূর্ব পুরুষ এখানে থেকেছে?
কেরামত বলে তুই যা জানোস না তা নিয়ে আমার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করা একদম পছন্দ করি না। যা বলি মনোযোগ দিয়ে শোন ,রমিজকে এখান থেকে উঠিয়ে দিয়ে বাড়িটা সুন্দর করতে হবে।  স্ত্রী রাবেয়া বেগম বলে, আপনি এ সব বলেন  সে জন্য  ঝর্ণা আমাদের বাড়িতে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কেরামত বলে, ঝর্ণা আমার বাসায় কাজ করলে দু’মুঠো খাওয়া পেতো,কাল দেখছি সে জমি থেকে পাট পাতা ও ছেলেকে দিয়ে মাঠ থেকে শালুক ও শাপলা তুলে নিতেছে। নিত্য কম খেতে খেতে ছেলে মেয়ের শরীর শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়েছে। রফিকুল্লা বলে দাদা সেদিন কি হয়েছে শুনেন, সোহেল পানিতে নেমে শাপলা উঠানোর সময় জোঁকে  ধরেছে । জোঁক এমন ভাবে  কামড়ে ধরেছে এবং পা থেকে কিছুতেই  সরাতে পারছে না। পা থেকে রক্ত পড়তেছে এবং কান্না শুরু করেছে। আমি ওই দিক দিয়ে আসতেছিলাম ,দেখে তার পা থেকে জোঁক টেনে ফেলে দিয়েছি। পা থেকে রক্ত বের হতে ছিল , আমি বললাম বাড়ি গিয়ে পায়ে কিছু দাও তাতে রক্ত পড়া বন্ধ হবে।  সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি গিয়েছে, দেখে আমার খুব মায়া লেগেছে। শুনে কেরামত আলী মিয়া দাঁত বের করে হাসলো ।কেরামত আলী মিয়া বলে ,দেখবে এই ছেলে মেয়েরা নিত্য না খেয়ে থাকতে থাকতে একদিন বিদ্রোপ করবে এবং রমিজ ও ঝর্নাকে ফেলে চলে যাবে।   দিলারা বলে ওর ছেলে মেয়েরা পড়াশুনায় খুব ভালো।  দুষ্টামি করে না ,সারাক্ষন বাড়িতেই থাকে এবং পড়া শুনা করে।
কেরামত আলী মিয়া রাগ করে বলে তুই এত খবর কি করে জানিস?
দিলারা বলে, আব্বু আমি স্কুলে যাই এবং দেখি ওরা খুব মনোযোগী ছেলে মেয়ে।  রাবেয়া বলে, রমিজ সব সময় কিছু না কিছু কাজ করে । কাজ না করলে  কি খাবে ? কেরামত বলে তোমাদের মা মায়ের তো দেখি ওদের জন্য অনেক দরদ । ওদেরকে বরং আমার বাড়িতে এনে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়া দাও । দিলারা বাবার সামনে থেকে  নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।  কেরামত আলী মিয়া  তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো । মনে হলো ,যতক্ষণ কেরামত আলী মিয়া ঘরে থাকবে, দিলারা আর বের হবে না । রাবেয়া বলে, ঝর্ণা ঘর খালি রেখে কোথায় ও গেলে হাঁস,মুরগি চুরি হয়, সে জন্য সে কাজ করতে চায় না ।  কেরামত আলী মিয়া বলে, এই গ্রামে নষ্টের মূল কিছু সংখক লোক যারা দুই মুখী ,আমার সামনে বলে এটা আপনার বাড়ি, আবার রমিজের সামনে বলে এটা তোমার বাবার জমি এবং তুমি ছেড়ে দেবে কেন?  রফিকুল্লা বলে দাদা আমি সেদিন শুনেছি দোকানে কিছু সংখ্যক লোক আপনার বিরুদ্ধে বলা বলি করে, আমাকে দেখে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। সে বলে গ্রামে দুই ধরণের লোক আছে, এরা এক দিকে  রমিজকে পরামর্শ  দেয়, আবার আপনার পক্ষ নিয়ে দোকানে চা খেয়ে উঠে যায় এবং পিছে পিছে  বলে কেরামত আলী মিয়ার অনেক পয়সা আছে এবং আমরা না খাইলে ওর টাকা পয়সা  কুমিরে খাইবে।   দিলারা পুনঃরায়  ঘর থেকে বের হয়ে বলে ,আব্বু স্কুলের স্যারেরা পয্যন্ত তোমার সমালোচনা  করে এবং বলে তুমি গরিবের সম্পত্তি কেড়ে নিচ্ছো।
কে তোর স্যার আমাকে বল।
দিলারা বলে, হু ! আমি তোমাকে বলি আর তুমি গিয়ে  ঝগড়া শুরু করো।
তুই চুপ কর।  তুই দেশ গ্রামের কি বুঝোস ? শুধু শুধু আমার সঙ্গে তর্ক করছ? ভালো করে শুনে রাখ ,এই বাড়ি তোর দাদা  নেয়ামত মিয়া কিনেছে।  রমিজ জোর করে এই বাড়িতে  থাকে।  আমার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করবি না।  আমি সামনে একটা বড়ো করে দীঘি ও মাছের চাষ করবো, সান বাঁধানো ঘাট থাকবে।  ছেলে বৌ নাতি নাতনিরা এসে আনন্দ করবে।
স্ত্রী রাবেয়া বেগম বলে,আপনি গরিব মানুষ রমিজ ও ঝর্নাকে উঠিয়ে দিয়ে বস্তুহারা করে  সুন্দর করে বাড়ি করবেন ?
কেরামত ধমক দিয়ে বলে ,আমার সামনে থেকে যাও ।  তুমি আমার প্ল্যান বুঝবে না।
দিলারা বলে বাবা, তুমি রহমতকে ও দেখতে পারতে  না।
কেরামত বলে রহমতকে আমি ঘর বাড়ি ছাড়া করি নি।  ওটা তাকে আল্লাহ করেছে।  নদী ভেঙে তাকে ঘর বাড়ি ছাড়া করেছে।বাবা   আমাদের তো অনেক গুলি খালি ঘর পড়ে আছে ,ভাই ও ভাবী কেউ বাড়িতে থাকে না।  ওরা একটা ঘরে থাকলে  আমাদের একটু না একটু উপকার হতো। কেরামত বলে আমার মুখে মুখে কথা বলা একদম পছন্দ করি না।  দিলারা বলে বাবা থাকগে আমি আর তোমাকে  কিছু বলবো না।  দিলারা রাগ করে তার নিজের ঘরে গিয়ে বিড় বিড় করে বলে ,” আমি স্কুলে গেলে লোকে বলে তোমার  বাবা এই গ্রামের একজন জুলুমবাজ  লোক। সে লোকজনের জমি জমা জোর করে দখল করে এবং ভয়ে কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না।“  আমার শুনতে কষ্ট লাগে।  রাবেয়া বেগম বলে তুই চুপ কর এখন তোর বাবা চিল্লা চিল্লি করবে।  দিলারা বলে ,বাবা তো সারা জীবন চিল্লাচিল্লি করেই দাপট দেখায়।

কেরামত বলে তার বাবা নিয়ামত রমিজের বাবাকে কিছু টাকা ধার দিয়েছে।  সে মৃত্যুর সময় বলে গেছে রমিজের বাড়ি তার বিনিময়ে দেয়া হয়েছে।  কয়েক বৎসর থেকে কেরামত  রমিজকে বলে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার জন্য।  সে ভূমি অফিসে দরখাস্ত করে ঘুষ দিয়ে শেষ পয্যন্ত কেস পেয়েছে।  কেরামত রমিজের নিকট হেরে যাবে এটা চিন্তা করে নি। মাস্টার তাকে সাহায্য না করলে রমিজ কেস পেতো না।
আমি দেখে ছাড়বো রমিজ কি ভাবে এই গ্রামে থাকে ?
কেস না পেয়ে সে   আজিম ও রফিকুল্লাকে  তার পিছনে লাগিয়েছে।  তারা গরু ছাগল ছেড়ে দিয়ে বাড়ির সবজি নষ্ট করে।  ঝর্নাকে সিস্ দিয়ে উত্তক্ত করে।  ঝর্ণা তার স্বামীকে বলে না।  রমিজ ওদের সঙ্গে মারামারি করবে এবং ওদের লোক বল আছে যার সঙ্গে সে পারবে না।  ঝর্ণা রমিজের সঙ্গে বলে রহমত ভাইকে এখানে ঘর উঠানের একটু জায়গা দাও, এতে আমাদের শক্তি বাড়বে।  রমিজ বলে তুমি ঠিক বলেছো।  রহমত,হাসি ও ছেলে মেয়েরা বেড়াতে আসলে এ নিয়ে আলাপ করবো।   তাছাড়া রহমতের থাকার মতো কোনো ভূমি নাই, তার বাড়িঘর নদী ভেঙে নিয়েছে।  তবে  শুনো ঝর্ণা, রহমতকে আমি ঘর উঠানোর জায়গা দিতে পারি।  সে এবং তার ছেলে মেয়েরা গ্রামে আর আসবে না।  তারা গ্রামে কি খাবে এবং ছেলে মেয়েরা শহরে পড়াশুনা করে এ সব ছেড়ে গ্রামে আসবে না।

সকালে রমিজ কাজে চলে যায় ,ছেলে মেয়েরা স্কুলে যায়।  ঝর্ণা আতংকে সময় কাটায় যে সময় টুকু সে ঘরে থাকে , সব সময় তার ইজ্জতের ভয়। সে সব সময় নিজের কাছে কিছু একটা  রাখে নিজের আত্মরক্ষার জন্য।  ঝর্ণা কারো বাড়িতে কাজ করতে গেলে বাড়ি খালি থাকে এবং কয়েকবার দেখেছে তার ঘর থেকে কিছু না কিছু চুরি হয়েছে।  সে ভয়ে রমিজকে কিছুই বলতে চায় না।  ঝর্ণা জানে এসবের মুলে কেরামত আলী মিয়ার লোকজন   রয়েছে। কেরামত আলী মিয়া তার লোকজন দিয়ে  ভয় দেখাচ্ছে।  সে মনে করে ভয় দেখালে রমিজ ও তার স্ত্রী ছেলে মেয়ে এখান থেকে চলে যাবে।

থানা ভূমি অফিসার যে রায় দিয়েছে তা কেরামত আলী মিয়া  মেনে নেয়  নি । সে জেলা কোর্টে এর বিরুদ্ধে কেস করেছে এবং কোর্ট থেকে রমিজ নোটিশ পেয়েছে এবং তাকে কোর্টের তারিখ অনুসারে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে । কেরামত আলী মিয়া  বাজারে চায়ের দোকানে বসে বলে আমি কেসে হেরে যাই নি , রমিজকে কোর্টে নিয়ে উচিৎ শিক্ষা দেব । রমিজ ভোরে কাজে  রওয়ানা হয়েছে ,পথে কেরামত আলী মিয়া  দেখে সালাম দিয়ে পাস্ কাটিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয় । কেরামত আলী মিয়া  বলে শুনো রমিজ, আমি কোর্টে তোমার বিরুদ্ধে কেস দিয়েছি ।
রমিজ বলে চাচা কি জন্য কেস দিয়েছেন ? জমি সংঙ্ক্রান্ত ব্যাপারে তো মীমাংসা হয়েছে ।
কেরামত বলে আমি তা মেনে নেইনি । এ বাড়ি তুমি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে ,অন্যথা আমি তোমাকে কেসে লটকিয়ে রাখবো । তোমাকে আমি ভালো ভাবে বলতেছি চলে যাওয়ার জন্য  অথবা আমার সঙ্গে বসো   একটা মীমাংসায় আসি । রমিজ বলে আমি কাজে যাইতেছি ,এই ব্যাপারে পরে দেখা যাবে ।  গ্রামের কিছু সংখ্যক লোক  বলেছে,  আপনি এত বড়ো লোক , এই গরিব লোকের বিরুদ্ধে না যাওয়া ভালো । সে বলে আমার বাবা এই বাড়ি তার বাবার কাছ থেকে কিনেছে,  কে কি বললো আমার কিছুই যায় আসে না।  আমি এর  দাবি ছেড়ে দেব না ।

রমিজ আজকাল কারো সঙ্গে কথা বলে না কারণ কিছু বলতে গেলে উল্টু রি-অ্যাকশন হয় । রহমত বলেছে যা কিছু চিঠি আসে ঢাকা নিয়ে স্কুল  হেডমাস্টারকে দেখাতে।  সে থানা ভূমি অফিসারের কাগজ  নিয়ে পুনরায় ঢাকা যাওয়ার চিন্তা করতেছে । সে ঝর্নাকে বলে,” আমি কাল ঢাকা যাবো।“
ঝর্ণা বলে কবে ফেরত আসবে ?
রমজান বলে ভোরে এক লঞ্চে যাবো এর এক লঞ্চে বিকেলে  ফিরে আসবো।  হেডমাস্টকে চিঠি দেখিয়ে তাঁর মতামত নিয়ে আসবো।   সে একদিন ভোরে কাগজ নিয়ে ঢাকা গিয়ে রহমতের সঙ্গে দেখা করে এবং  কেঁদে কেঁদে তার দুঃখের কথা বলে। রহমত বলে তুমি চিন্তা করবে না । চলো, আমি তোমাকে নিয়ে হারুর স্কুল  যাবো এবং দুইজন গিয়ে হেডমাস্টারকে কাগজ দেখাবো ।  হেডমাস্টার কাগজ দেখে বলে, তোমার কোনো অসুবিধা নাই, সে যেখানে খুশি যাক । যেহেতু জমি তোমার বাবা বিক্রি করে নাই , তা ছাড়া ভূমি অফিস তোমার পক্ষে রায় দিয়েছে , তোমার কোনো চিন্তা নাই। তুমি চুপ করে থাকো এবং কোর্টের দিন গিয়ে হাজির হবে এবং বলবে এই জমি আমার বাবা বিক্রি করে নাই । দুপুরে  রহমতের বাসায় খাবার পর দুইজনে সদরঘাট গিয়ে  রমিজকে   লঞ্চে উঠিয়ে দিয়ে রহমত বিদায় নিয়ে ঘরে আসে।  হাসি বলে রমিজ ভাই অতি সরল মানুষ।  তাঁর বিপদে আমরা ব্যাতিত কে দেখার আছে?  রহমত বলে ওর কোর্ট কেস মীমাংসা হলে ঢাকা চলে আসলে ওকে কাজে লাগিয়ে দেব।

স্কুল দুই সপ্তাহের ছুটি, রহমত হাসিকে বলে,”তুমি হারু ও রেনুকে নিয়ে এক সপ্তাহ গ্রাম থেকে ঘুরে আসো।“  হারু ও রেনু শুনে আনন্দে হৈ  চৈ শুরু করে, ” আমরা রমিজ কাকুর বাড়ি,নানু বাড়ি, দাদু বাড়ি যাবো !”  আব্বু তুমি ও আমাদের সঙ্গে চলো । রহমত বলে ,আমি তো যেতে পারবো না, সব লোক একত্রে যাওয়ার দরকার নাই।  মুছার মতি গতি ঠিক নাই।  আমরা বাসা খালি রেখে যাবো ,সে আবার কাউকে বেশি টাকায় ঘরে ঢুকিয়ে দেবে।  কাজেই তোমরা যাও,আমি এখানে থাকবো।  তোমরা ঘুরে বেরিয়ে আসার সময় হলে আমি গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে তোমাদের নিয়ে আসবো ।  ছেলে মেয়েরা অনেক দিন পর গ্রামের বাড়ি যাবে , তাই রহমত তাদের কিছু টুকি টাকি জিনিস কিনে দিয়ে পাঠায়।  ভোরে রহমত ও আফজাল রিক্সা জমা দেয়ার পূর্বে ওদের সদরঘাট পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে রিক্সা জমা দেয় । রেনু হাউ মাউ করে   আব্বুকে জড়িয়ে ধরে করে বলে, আমরা তোমাকে ছেড়ে যাইতে ভালো লাগে না । রহমত বলে মা ,আমি আসবো এবং তোমাদের নিয়ে গ্রামে ঘুরা ঘুরি করে সময় কাটাবো ।  রেনু শুনে খুশি এবং বলে ঠিক আছে ।ওরা লঞ্চে  উঠে নিচে ডেকে গিয়ে জায়গা নিয়ে আব্বুর দিকে চেয়ে থাকে ।  হাসি বাসা থেকে চা বানিয়ে এনেছে এবং বসে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে চা খেয়ে নদীর দুই দিকে চেয়ে থেকে বলে, মানুষে বোঝাই লঞ্চ ঢাকা আসতেছে এবং ঢাকা থেকে যাইতেছে । লঞ্চের টিকেট চেকার এসে সমস্ত প্যাসেঞ্জারের টিকেট চেক করা শুরু করে । হাসি সবার টিকেট দেখিয়ে আপন মনে বসে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেছে । লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে এবং কিছু লোক এখন ও সিট পায়  নি । ফেরিওয়ালা এসে চিনা বাদাম ও চা নিন বলে আপন মনে চিৎকার করতেছে । হাসি ছেলে মেয়েদের কিছু চিনা বাদাম কিনে দিলো । ওরা খুশিতে বাদাম খাচ্ছে  আর বাহিরের দৃশ্য দেখে মায়ের সঙ্গে গল্প করে সময় পার করছে । হাসির মনে পড়ে সেই দিনের স্মৃতি, ছেলে মেয়েদের নিয়ে অজানা শহরে এসে রাস্তায় ঘুরা ঘুরি করা ,” কোথায় যাবো , কে একটু আশ্রয় দেবে । “ আজ মনে আনন্দ, ঢাকা থাকার একটু জায়গা আছে।  হারু ও রেনু  মায়ের সঙ্গে  গল্প করতে করতে সময় অতি দ্রুত পার করে ।  দিনের ১২টা বাজে লঞ্চ ঘাটে  ভিড়লে ওরা আস্তে আস্তে হেটে গ্রামে গিয়ে পৌঁছে।  আসে পাশের চেনা পরিচিত লোকজন  এসে রমজানের ছোট্ট উঠান ভর্তি হয়  ? ছেলে মেয়েরা দৌড়ে এসে বলে তোমাদের আমরা অনেক মিস করি। ঝর্ণা ও তার ছেলে মেয়েরা তাদের দেখে আনন্দে আত্মহারা । খবর পেয়ে এ বাড়ির ,সে বাড়ির লোকজন রমিজের ঘরের সামনে এসে জমা হয়েছে এবং বলে তোমাদের অনেক দিন দেখিনি । সবাই খোঁজ খবর নেয়ার জন্য জড়ো হয়েছে ।
সবার মুখে এক কথা , তোমরা কেমন আছো ?
হাসি বলে, আমরা ছেলে মেয়ে নিয়ে অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি।
ঝর্ণা গিয়ে রান্না চড়িয়ে দিয়ে হাসিকে ডেকে বলে,” ভাবি তুমি এখানে এসো গল্প করি ।” হাসির সঙ্গে অনেক দিনের জমানো গল্প করে ও ছেলে মেয়েদের মুড়ি, নারিকেল, গুড় সহ খেতে দিয়ে বলে তোমরা খাও ও গল্প করো , ততক্ষনে আমাদের রান্না হয়ে যাবে । রমিজ পাশের বাড়িতে কাজ করতেছিলো এবং খবর পেয়ে দৌড়ে এসে হাসতে হাসতে বলে তোমরা আসবে আমি জানতাম এবং আজ সকালে ঝর্নাকে বলেছিলাম।  রমিজ   বলে আমি কাজ  শেষ করে আসবো ততক্ষনে ছেলে মেয়েরা খেয়েদেয়ে খেলাদুলা করুক ।  কেরামত  আলী মিয়া বাড়ির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় অনেক লোক নজরে পড়ায়  বিস্বিত হয় ।   কিছু না বলে কেরামত  আলী মিয়া  বাড়ি গিয়ে কাজের ছেলেকে বলে ওই বাড়িতে কি হয়েছে এত লোক কেন ? রফিকুল্লা  বলে দাদা, রহমতের স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা বেড়াতে এসেছে।
কেরামত আলী মিয়া  বলে রহমত ও কি এসেছে ?
কে কে এসেছে বলতে পারি না । আপনি বললে গিয়ে খবর নিয়ে আসতে  পারি । কেরামত আলী মিয়া  বলে ,না দরকার নাই ।

বাজার থেকে আসতে  দেখলাম রমিজ মাঠে কাজ করে। আমাকে দেখে  আজকাল একটা সালাম ও দেয় না।    রফিকুল্লা  বলে দাদা, ওর ঘাড়টা একটু বেশি মোটা হয়েছে।  তাই সে আপনাকে দেমাগ দেখায়।  আপনি চাইলে আমি ঘাড়টা  ভেঙে দিতে পারি।  কি বলেন ? এই মুহূর্তে কিছু করিস না।  কোর্টে কেস হয়েছে।  কেসের ফলাফল দেখতে হবে।  পরে যা করার করিস এই বলে কেরামত আলী মিয়া  ঘরের ভিতর গিয়ে  কাপড় ছেড়ে পুকুরে গোছল করতে যায়।  এই পুকুরের পূর্ব পাড়ে রমিজদের বসত।  কিন্তু কেরামত আলী মিয়া  বা তার লোক রমিজকে পুকুর থেকে একটা মাছ ও ধরতে দেয়  না ।  কি মনে করে কেরামত  আলী মিয়া  বলে, রফিকুল্লা জালটা নিয়ে আসতো ।  পুকুরে জাল ফেলে দুইটা  মৃগেল , কিছু পুটি , কই ও  কেচকি  মাছ ধরেছে , রফিকুল্লা  ধাপা ধাপি  করে মৃগেল মাছ নিয়ে। মাছ নিয়ে ঘরে গেলে  দিলারা বলে আব্বু , আমরা তো অনেক খাই ,একটা মাছ ঝর্ণাদের দিয়ে আসি।  ওদের ঘরে রহমতের স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা এসেছে।  ওদের খাবার তো কিছু নাই এবং ওদের আমি দেখে আসি।  কেরামত আলী মিয়া বলে ,ওদের সম্পর্কে আমাকে কোনো কিছু বলবে না।  দিলারা রেগে বলে,আব্বু তুমি এই মাছ একা একা খাবে।  আমরা ছুঁয়ে ও দেখবো না।  কেরামত আলী মিয়া মেয়েকে তেড়ে এসে বলে তোর এত বড়ো সাহস আমার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করিস ? কেরামতের স্ত্রী কাছে এসে বলে দিলারা তুমি চুপ করে থাকো।  তুমি তোমার  বাবাকে বোঝাতে পারবে না। কেরামত রাগে বিড় বিড় করতে করতে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে ।  রাবেয়া এসে গরম ভাত, ছোট মাছের দোপেয়াজা ও ডাল দিয়ে সামনে বসে থাকে । কেরামত কিছু না বলে খেয়ে উঠে সাদা পাঞ্জাবি পড়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে বাজারে গিয়ে দোকানদারকে বলে এক কাপ চা দাও । পাশে এক ছেলে বসে আছে ,কেরামত বলে ওকে ও এক কাপ চা দাও । চা খাইতে খাইতে ছেলেটি বলে দাদা রমিজের বাড়িতে অনেক লোক দেখলাম । দোকানদার বলে ঢাকা থেকে রহমতের স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা বেড়াইতে এসেছে । পাশের ছেলেটি বলে ছেলে মেয়েদের স্কুল ছুটি সে জন্য বেড়াতে এসেছে । কেরামত জিজ্ঞাসা করে ,রহমত কি করে ঢাকা ? দোকানদার বলে কি আর করবে  হয়তো রিক্সা চালায়?

দিলারা বলে,” মা আমি কি হাসি ভাবি ও তার ছেলে মেয়েকে একটু দেখে আসবো ?” ওদের জন্য আমার মনটা খুব খারাফ লাগে। রাবেয়া বলে,  বেশিক্ষন থাকবে   না, তোমার বাবা আসবে আর এই নাও ২৫টা  টাকা ছেলে মেয়েদের হাতে দিও বলবে আমরা খুশি হয়ে দিয়েছি।  দিলারা ঘর থেকে বের হতেই দেখে রফিকুল্লা বাহিরে কাজ করে।  সে জিজ্ঞাস করে কোথায় যাবেন?  দিলারা বলে , রফিকুল্লা, তুমি বাবাকে বলবে না আমি ওদের ছেলে মেয়েদের একটু দেখে আসবো।  সে বলে যান আমি দাদাকে বলবো না।  দিলারা ওই বাড়িতে গিয়ে দেখে ওরা খেতে বসেছে।   ও আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে দেখে ওরা ডিম্ ভাজি ও ডাল দিয়ে ভাত খাইতেছে।
দিলারাকে দেখে সবাই হেসে বলে কেমন আছেন ?
দিলারা বলে  ভালো।
তোমাদের অনেক দিন দেখি নি ,তাই একটু দেখতে আসলাম ।হাসি ও ঝর্ণা বলে আপা বসেন এই বলে ওকে একটা বসার মোড়া এনে দেয়।  দিলারা বলে আমি বসবো না এই বলে হাসির হাতে টাকাটা দিয়ে বলে মা আপনাকে দিয়েছে এবং বলেছে হারু ও রেনুকে কিছু কিনে দিতে। এই বলে সে চলে আসে ।  ওরা ওর চলে যাওয়ার পিছনে তাকিয়ে থাকে ।  ঘরে এসে দিলারা বলে মা ওরা ডিম্ আর ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছে অথচ আমাদের কত কি খাওয়া।  মা, বাবা বুঝে না এই বলে দীর্ঘ নিঃশাস ফেলে। আব্বুকে বললাম একটা মাছ ওদের দাও ,দিলোনা বরং কত কি বলে রাগ করে ঘর থেকে চলে গেলো । তাদের ও তো এই পুকুরের অংশ আছে । রাবেয়া  বলে তোমার বাবা পুনরায় কেস করেছে এবং কি জানি কি হয় ? মা এটা কি ঠিক ? আব্বু গরিব মানুষের সঙ্গে কেস করে এবং কি জন্য কেস করে আমি বুঝি না ? দিলারা তোমার বুঝার দরকার নাই । মা হাসি আন্টির মেয়ে রেনু কি সুন্দর হয়েছে, তুমি যদি একটু দেখো! তুমি  চোখ ফিরাতে  পারবে না । হারু ও অনেক বড়ো ও খুব সুন্দর হয়েছে । রাবেয়া বলে ওরা শহরে থাকে সে জন্য সুন্দর থাকে । রমিজ বাসায় আসে নি ওদের খবর শুনে? মা আমি ওকে দেখিনি, হয়তো জানে এবং কাজ শেষ করে বাসায় আসবে । শুনো তোমার আব্বু আসতেছে ,এখন কিছু বলবে না । মা ওই বাড়িতে যাওয়ার সময় রফিকুল্লা আমাকে দেখেছে । আমি ওকে বলেছি যেন আব্বু না জানে । রাফিকুল্লা বলবে না কিছুই । তোমার আব্বু কোথাও গেলে আমি না হয় একবার গিয়ে হাসি ও তার ছেলে মেয়েকে দেখে আসবো । গ্রামে বাড়ি ঘর নাই , গরিব মানুষ ,বেঁচে থাকার জন্য মানুষ কত কি সংগ্রাম করে !

বিকেলে রমিজ কাজ থেকে ঘরে এসে ভাত খেয়ে বলে আমি ঘোঘরার বিলে যাবো জাল নিয়ে যদি কিছু মাছ ধরতে পারি । হারু ,রেনু ,সোহেল ও লতা বলে আমরা ও তোমার সঙ্গে মাছ মারতে যাবো । ছেলে মেয়েরা আনন্দে চিৎকার শুরু করে এবং বলে চলো মাছ ধরতে যাই । হারু ও রেনু খুশিতে আত্মহারা , কাকু চলো মাছ ধরতে যাব এই বলে ওরা রমিজের পিছু পিছু ছুটে ।  ঘর থেকে তাদের এক কিলোমিটার হাটতে হলো এবং ওরা ঘর থেকে হারিকেন নিয়ে এসেছে যদি রাত হয় ।  ছেলে মেয়েরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে খালে নেমে আনন্দ করে মাছ ধরবে । কিন্তু , রমিজ ওদের বলে তোমরা পানিতে নামতে পারবে না । কেন নামতে পারবো না ? রমিজ বলে পানিতে জোঁক   আছে এবং তোমাদের ধরবে । আমি মাছ ধরবো তোমরা শুধু ঝুড়িতে রাখবে । খেয়াল রাখবে মাছ যেন লাফালাফি  করে পানিতে পড়ে না যায় ।  হারু বলে কাকু আমি পানিতে নামবো তোমার সঙ্গে । রমিজ বলে না ,তোমরা পানিতে নামতে পারবে না ,এখানে জোঁক আছে এবং তোমাদের পায়ে ধরবে । ওরা ভয় পেয়ে  বলে না কাকু আমরা জোঁকে ভয় পাই । সবাই রমিজের সঙ্গে গিয়ে প্রায় দুই ঘন্টা খালে এবং বিলের নালাতে একটা সোল্ ,কয়েকটি কই,খলিসা ও কিছু পুটি মাছ ধরে নিয়ে আসে । উঠানে জ্যান্ত মাছ  লাফালাফি শুরু করে । ছেলেমেয়েরা দারুন ভাবে আনন্দ উপভোগ করতে থাকে । রাতে ঝর্ণা ও হাসি মাছ দোপিঁয়াজা করে সবাইকে ভাত খেতে দেয় । খাওয়া দাওয়ার পর সবাই মিলে বসে কত কি নানা ধরণের গল্প করে । ছেলে মেয়েরা ঢাকা থেকে লুডু নিয়ে এসেছে ।রেনু ও লতা এবং সোহেল ও হারু বসে লুডু খেলা শুরু করে । রাত অনেক হয়েছে কিন্তু কেউ ঘুমাতে যাবে না । সন্ধ্যা থেকে আকাশ মেঘলা এবং ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে । তাই ওরা উঠে ঘরে গিয়ে সবাই গল্প করে রাত দুটার দিকে ঘুমাতে যায় ।

চারিদিক অন্ধকার, ঘরে ইঁদুরের কিচির মিচির কারো ঘুম আসে না।  ইঁদুর বিছানার উপর দিয়ে দৌড়া দৌড়ি করে। ঝর্ণা আলো জ্বালিয়ে দেখে, ইঁদুর ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে উচ্ছিষ্ট খাবার তুলে খাচ্ছে।  এমন ভাবে ইঁদুর তাকিয়ে আছে যেন ওদের ও এখানে সব কিছুতে অংশীদারিত্ব আছে।   এ দিকে সারা রাত বৃষ্টি এবং সকালে রমিজ ঘুম থেকে উঠে বলে আমি আজ কাজে যাবো না ,  ওদের অনেক দিন পর পেয়েছি এবং ওদের সঙ্গ দেব ও গল্প করে সময় কাটাবো। সে সকাল সকাল বাজারে গিয়ে সেমাই, গুড় , চিকন চাল ও এটা সেটা কিনে এনেছে।   বাড়ির আঙিনায় কদম ফুলের গাছ ,ছেলে মেয়েরা গাছ থেকে ফুল এনে ঘরের চারিদিক সাজিয়েছে । সারাদিন ওরা এটা সেটা নিয়ে খেলা করে এবং গ্রামের কিছু ছেলেমেয়ে যারা ওদের সঙ্গে গ্রামের স্কুলে  যেত তারা ও এসে যোগ দিয়েছে । আজ ওদের খেলার সাথির অভাব নাই এবং এক সময় কেরামতের স্ত্রী ও মেয়ে দিলারা  ওদের খোঁজ নিতে আসে এবং বলে হাসি তুমি কেমন আছো ? সে বলে আন্টি ভালো আছি , ওরা খানিক বসে কেরামত আসার পূর্বে চলে যায়  এবং বলে তোমরা ভালো থেকো ।

হাসির মাবাবা খবর পেয়েছে যে হাসি ছেলে মেয়েদের নিয়ে রমিজের বাড়ি এসেছে । ওরা কিছু পিঠা , পোলার চাল, দু/তিনটা মুরগি, নিয়ে  দেখা করতে এসেছে । হাসি মা বাবাকে দেখে জড়িয়ে কান্না শুরু করে এবং বলে তোমাদের কতদিন দেখি নি । তোমরা বেঁচে আছো এটাই আমি ভুলে গিয়েছি । হারু ও রেনু নানা নানীর কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করে  বলে নানু তোমরা কেমন আছো ? ওরা বলে আমরা ভালো আছি । হাসির মাবাবা সারাদিন ওদের সঙ্গে থেকে বলে তোমাদের আমরা বাড়ি নিয়ে যাবো ।আমরা তোমাদেরকে ফেলে যাবো না । নাতি নাতনি কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে।  হাসি বলে এখন না ,রহমত আসুক ওকে সহ যাবো ।
রমিজের ছোট্ট ঘর এত লোক কোথায় থাকবে?
ওরা চলে যাবার পূর্বে দীর্ঘ নিঃশাস ফেলে, কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং বলে তোমাদের ছেড়ে যাইতে ইচ্ছা করে না ।   মাবাবা হাসি ও নাতি/নাতনিকে বলে তোমরা আমাদের সঙ্গে দেখা না করে ঢাকা যাবে না । হাসি বলে রহমত আসুক ,আলাপ করে যাবো ।

ঝর্ণা হাসিকে বলে ভাবি,আমি এখানে এই দলাদলি আর অভাবের মধ্যে সোহেল ও লতাকে পড়াশুনা করাইতে  পারবো না । রমজান যে কাজ করে তা দিয়ে চার জনের সংসারে দু’বেলা খাওয়া ঘরে আসে না । আমি হাঁস/মুরগির ডিম্,গাছের নারিকেল, তরকারি বিক্রি করি, তা ছাড়া এ বাড়ি সে বাড়ি মাঝে মধ্যে কাজ করি । ছেলে মেয়েদের কাগজ কলম এটা সেটা সব সময় লাগে । আমি বলি ঢাকা চলে যাইতে এবং ছেলে মেয়েদের পড়া শুনা ভালো হবে । কিন্তু রমিজ বলে কেরামত আলীর সঙ্গে যে মামলা রয়েছে ,তার একটা কিছু না হওয়া পয্যন্ত কি ভাবে যাবো?   কেরামত আলী মিয়া অত্যন্ত লুভী মানুষ এবং শুধু আমাদের সঙ্গে নয়, গ্রামে  আরো অনেকের সঙ্গে জমি জমা নিয়ে গন্ডগোল করে । রমিজ বলে আমি এখানে থেকে না খেয়ে ছেলে মেয়েদের মারবো । তার চেয়ে বাড়ি ঘর রেখে ঢাকা গিয়ে চেষ্টা করে দেখবো । হাসি বলে তুমি রহমতের সঙ্গে বরং এ নিয়ে কথা বলো । সে এ ব্যাপারে ভালো বুঝবে ।
রহমত এক সপ্তাহ কাজ করে ওদের নেবার জন্য গ্রামে আসে। রহমত গ্রামে আসার পর রমিজ এ নিয়ে কথা বলে ।
রহমত রমিজকে নিয়ে বিকেলে বাজারে চায়ের দোকানে গেলে লোকজন বলে তুমি কি  পরিবার পরিজন নিয়ে থাকার জন্য  এসেছো?
সে বলে আমার  বাড়িঘর নাই, কি ভাবে  থাকতে পারি বলে মনে করো ? ঢাকাতে কোনো রকমে দুমোঠো খেয়ে চালিয়ে যাচ্ছি । দোকানদার বলে তোমাকে অনেক দিন দেখি না ,তুমি কেমন আছো ? সে বলে কেমন আর থাকতে পারি তুমি মনে করো ? বাড়ি নাই ,ঘর নাই দিন আনি দিন খাই । কোনো রকমে চলে যাচ্ছি । কেরামত খবর পেয়ে তার কাজের লোক রফিকুল্লাকে পাঠায় কোনো কথা বের করতে পারে কিনা । রফিকুল্লাহ বলে শুনেছি তুমি রমিজকে বুদ্ধি পরামর্শ দাও কি ভাবে কেস করতে হয় ? রহমত বলে, আমি ওকে কি পরামর্শ দেব,আমার নিজের কোনো পড়াশুনা নাই । আমি নিজে কাগজ বুঝি না । পরিস্থিতি উত্তপ্ত   হতে পারে ভেবে ওরা দুই জন দোকানের চায়ের পয়সা দিয়ে উঠে যায় । সবাই কেরামতের লোক এবং ওদের কথা বার্তা শুনে মনে হয় রমিজ এবং রহমত এই গ্রামের লোক নয় । ওরা বাড়িতে চলে আসে এবং রাত্রে ঘরের বের হয়  নি । ওদের ধারণা হয়েছিল লোকজন যেভাবে কথা বার্তা বলে ,এই গ্রাম কেরামতের নিয়ন্ত্রণে এবং যে কোনো সময় মারা মারি হতে পারে । রহমত বাড়ি ঘর হারা এবং কারো তার প্রতি সহানুভূতি নাই । রমিজকে বাড়ি ছাড়া করতে পারলে সবাই খুশি হবে । রমিজ বলে রহমত ভাই তুমি দেখো কি ভেবে এই গ্রামে আমি থাকি । একেতো আমার কোন কাজ নাই ,ওপর দিকে সারা গ্রাম কেরামত আমার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে । আমি ঝর্ণাকে একা ঘরে রেখে কাজে যাইতে ভয় পাই । যে কোনো সময় যে কোনো ধরণের অঘটন ঘটতে  পারে ।   আমি কাজ করি আর দুপুরে খাবার সময় ঘরে ফিরে  আসি । ঝর্ণা কাজে গেলে বাড়িতে চুরি হয় এবং কয়েকবার এসে  দেখেছে ঘরের দরজা ভাঙা এবং জিনিস পত্র লন্ড ভন্ড অবস্থায় । আজকাল একটু কম হয় কারণ কেরামত আলী মিয়ার স্ত্রীকে এ ব্যাপারে অনুরোধ  করা হয়েছে এবং সে বোধ হয় তার কাজের লোকদের কিছু বলেছে । তাই গত দুই মাস ধরে কিছু দেখি না ।  রহমত বলে কেস কোর্ট থেকে মিমাংসা না হওয়া পয্যন্ত একটু দেখে শুনে চলতে হবে । কেস কেরামত পাবে না কারণ তার কোনো প্রমাণাদি নাই । কেস মীমাংসা হলে তুমি  ঢাকা চলে আসলে রিক্সার কাজে লাগানো যাবে ।  রহমত বলে তুমি এখানে রিক্সা চালাও এবং দেখো কেমন করো । রহমত স্থানীয় বাজারে গিয়ে রমিজকে  এক মালিকের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয় এবং বলে  তুমি রিক্সা চালান শিখ এবং পরে ঢাকা আসলে অসুবিধা হবে না ।

পরদিন রহমত  ওদের নিয়ে নিজের বাড়ি চলে আসে এবং মাবাবার সঙ্গে একদিন থাকার পর হাসির বাবার বাড়িতে পাঠায় । সে নিজে আর ও দুই দিন বাড়িতে থেকে মাবাবার সঙ্গে সময় দেয় । রহমতের মাবাবা বলে তুমি আমাদের কোনো টাকা পয়সা দাও না।
সে বলে বাবা আমি কোত্থেকে টাকা দেব ?

আমরা চার জন,আমি রিক্সা চালাই,হাসি দুই বাসায় ছুটা কাজ  করে । বস্তিতে ১০০ টাকা মাসে ভাড়া দিয়ে থাকি। তাও ছেড়ে দিলো এটা ও পাওয়া যাবে না । মাবাবা বলে আমাদের দেয়ার প্রয়োজন নাই । তুমি ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাঁচো।  হাসি ও ছেলে মেয়েরা ফিরে আসলে ওদের নিয়ে রমিজের বাড়ি এক রাত থেকে   ঢাকা চলে আসে । রমিজের ছেলে মেয়েরা এই কয়েক দিন হারু ও রেনুকে কাছে পেয়ে অনেক আনন্দ করে । ওরা লঞ্চ ঘাট পয্যন্ত গিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করে এবং বলে তোমরা আবার আসবে ।  রহমত ও হাসি বলে অবশ্যই  আমরা আবার এসে  দেখে যাবো । লঞ্চ ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে ,রমিজ,ঝর্ণা এবং তার ছেলে মেয়েরা অনেক সময় ঘাটে দাঁড়িয়ে লঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সোহেল ও লতা বলে ,”মা ওরা কি আবার আসবে ?”
ক্রমশ:

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনের খেরোখাতাঃ এলোমেলো পংক্তিমালা – পর্ব ২৪
পরবর্তী নিবন্ধফিরে দেখা-২০২০
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন