টরন্টো থেকে শুচিতার অনেক বন্ধু তার ছেলে দ্রুবকে দেখতে চায় । তার চাকুরীর ব্যস্ততা, বিবাহ এবং সুমিতের অসুস্থতার কারণে অনেকদিন থেকে ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারে নি । দাদু রাবেয়া টেলিফোন করলেই বলে তোমার ছেলেকে একবার দেখিয়ে গেলে না? তোমার এমন কি সমস্যা যে দুইদিনের জন্য ও আসতে পারোনা?
দাদু, আমি ব্যস্ত সে জন্য আসতে দেরি হচ্ছে ; তবে আসবো একটু সময় নিয়ে। এ দিকে সুমিতের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না, ও দুবার স্ট্রোক করেছে, ওপেন হার্ট সার্জারি হলেও অসুস্থ এবং শরীরে পানি নেমেছে, হাঁটা চলাফেরা ও খুব একটা করতে পারে না; এ নিয়ে সে অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকে। প্রতিদিনই কাজ সেরে হাসপাতালে গিয়ে কিছু সময় সুমিতের নিকট বসে অতিবাহিত করে। তাছাড়া শশুর পক্ষের লোকজন তাকে পছন্দ করে না।
কমল ও আরতি বলে স্ত্রীর ভাগ্যে স্বামীর সংসারে সুখ আনে। সুমিত যেদিন শুচিতাকে বিয়ে করেছে, তার পরদিন থেকেই এ সংসারে নানাহ অশান্তি দেখা দিয়েছে। কমল আরো বলে শুচিতাকে ঘরে রাখলে সুমিতের কোনোদিন ও শারীরিক, মানসিক পরিবর্তন আসবে না। সুমিত গত দুই মাস হাসপাতালে ভর্তি, ওর আজ এই সমস্যা, কাল সেই সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আছে , তার নিজের মাবাবা,ভাইবোন এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। সে কারো সাহায্য ছাড়া হাঁটা চলা করতে পারে না। হাসপাতাল গেলে দেখা যায় ও ওয়াকার ঠেলে ঠেলে করিডোর দিয়ে কখন ও হাঁটে; তবে বেশিরভাগ সময় বেডে থাকে।
প্রীতম ও আভা ইন্ডিয়া থেকে এ যাবৎ ফিরে আসে নি। শুচিতা অফিসের কাজ সেরে হাসপাতাল গিয়ে সুমিতের সঙ্গে আলাপ করে , মাবাবা ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়েছ; আমি অনেকদিন টরন্টো যাইনি, আগামী লং উইকেন্ডে দ্রুবকে নিয়ে ঘুরে আসতে চাই। সুমিত বলে যেতে পারো, আমার দেখাশুনার জন্য লোকজন আছে: তাছাড়া হাসপাতালে নার্স, ডাক্তার সবই আছে আমার দেখার জন্য।
শুচিতা প্রদীপের সঙ্গে আলাপ করে, আমি টরন্টো যেতে চাই , তুমি যদি যেতে রাজি হও তাহলে একটা গাড়ি রেন্ট নিয়ে আমরা আগামী লং উইকেন্ডে যেতে পারি। আমাদের কিছু বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন আছে যারা সব সময় যেতে বলে। আমার দাদা ও দাদু গত তিন বৎসর থেকে বলে আসছে যাওয়ার জন্য। প্রদীপ বলে তুমি কি এ নিয়ে সুমিতের সঙ্গে আলাপ করেছো?
হ্যা। আমি আলাপ করেছি , সে বলেছে কোনো আপত্তি নেই; কারণ ওকে দেখাশুনার লোকজন রয়েছে এবং মোবাইল ফোনে আলাপ করে খোঁজখবর নেয়া যাবে। সুমিতের সঙ্গে আলাপ করে থাকলে ভালো করেছো। আমার গাড়িও নিতে পারো, তবে পুরানো গাড়ি। শুচিতা বলে দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে যাবো, ভালো গাড়ি না হলে নিরাপদ মনে করি না। আমরা বরং ভালো দেখে একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে যাব। ঠিক আছে।
শুচিতা প্রোগ্রাম ঠিক করে গাড়ির ব্যবস্থা করেছে। শনিবার ওরা ভোর ৮টায় বাসা থেকে সকালের নাস্তা করে, কোম্পানি থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে অটোয়া থেকে রওয়ানা দেয়। অটোয়া থেকে টরন্টো ৪ ঘন্টার জার্নি, ওদের কোনো তাড়া নেই, আসতে ধীরে গল্প করে ওরা দুইজনেই শেয়ার করে গাড়ি চালাচ্ছে।
দ্রুবর পছন্দের রাইম ” টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল ষ্টার, হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর …” সিডি বাজাচ্ছে এবং দ্রুব তার সঙ্গে গলা মিলাচ্ছে। ওর আনন্দ দেখে প্রদীপ ও শুচিতা ওর সঙ্গে গেয়ে আনন্দ দিচ্ছে। দ্রুব কিছুক্ষন পর বলে মাম্মি আমি ম্যাকডোনাল্ডে যাবো, কাজেই ওকে নিয়ে ম্যাকডোনাল্ডে ওয়াশরুম সেরে দুইজনে কফি ও ওর জন্য চকলেট মিল্ক কিনে খেয়ে পুনরায় জার্নি শুরু করে। ওরা আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে পথে কিংস্টন থেমে দুটার দিকে রেস্টুরেন্টে খেয়ে দেয়ে ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার দিকে দাদা মজিদের পার্কিং লটে এসে কল দিয়ে বলে দাদু আমরা তোমাদের পার্কিং লটে। মজিদ ও রাবেয়া নিচে নেমে এসে বলে এস উপরে। তাদের পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রাম, দাদার বাসায় রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে তার এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে ঘুমাবে। সে আগে থেকে টেলিফোন করে জানিয়েছে যে দাদু আমি এবং ভাই প্রদীপ ও দ্রুব তোমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য টরন্টো আসব এবং রাতে খাবো ।রেবেকা বলে তোমরা এখানে রাতে খাওয়া দাওয়া করবে, কোনো অসুবিধা নাই; তাছাড়া আমরা সব সময় বাসায় থাকি: তবে আমরা এক বেডরুম বাসায় থাকি,কাউকে থাকতে দিতে পারি না।
শুচিতা মজিদ ও রেবেকার জন্য এটা সেটা কেনাকাটা করে এনেছে । মজিদ ও রেবেকা বলে তুমি আমাদের মনে রেখেছো, এটাই যথেষ্ট; তাছাড়া তোমার ছেলে দ্রুবকে দেখিয়েছো, আমরা এতে অনেক আনন্দিত। খাবার টেবিলে অনেক ধরণের খাওয়া দেখে শুচিতা বলে, দাদু তোমার রান্নার স্বাদ আলাদা। তুমি এত এত রান্না করেছো, আমরা কটা খাবো। রেবেকা বলে কি আর করলাম ?
তোমরা খাবে সে জন্য টুকটাক একটু না করে পারি না। তোমার ছেলে এবং প্রদীপ কিছুই খাচ্ছে না। তোমার বাবামাকে নিয়ে একবার এসে দেখা করে যেয়ো। নানাহ কাপড় এবং এটাসেটা দেখে বলে এত এত জিনিস কেন আমাদের জন্য এনেছো?
শুচিতা বলে আমার মন চাইলো, তাই আনলাম। তুমি আমাদের কথা মনে করে তোমার ছেলেকে নিয়ে এসেছো , তার চেয়ে আনন্দের আর কি থাকতে পারে!
শুচিতা বলে দাদু আমরা কাল তোমাদের নিয়ে ব্লু মাউন্টেন যাব। মজিদ বলে আমার না গেলে হয় না ?
না , তোমাদের নিয়ে যাব। তোমরা দুই জন তৈরী থেকো। মজিদ বলে দেখি যদি শরীর ভালো থাকে যাবো; নতুবা তোমার দাদু যাবে। না দাদা, তোমাকেও যেতে হবে, তুমি ভালো থাকবে কালকের জন্য।
দাদুর বাসা থেকে ফোন দিয়ে বান্ধবী রিতাকে বলে আমরা দাদুর বাসা থেকে খেয়েদেয়ে তোমার বাসায় আসতেছি। রিতা বলে তোমার জন্য আমি বিকেল থেকেই রান্না করে বসে আছি। শুচিতা তার বাসায় পৌঁছতে রাত সাড়ে দশটা বাজে। রিতা ওদের দেখে বলে তোমরা এখানে এসে খাওয়া দাওয়া করবে সে জন্য জন্য রান্না করেছি। সে বলে আমরা দাদুর বাসায় খেয়ে এসেছি এবং তোমার রান্না কাল সকালে খেয়ে বের হবো। অনেক রাত পর্যন্ত ওরা গল্প করে বিছানায় যায় । ওদের সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয় । ঘুম থেকে উঠেই দেখে টেবিলে ভর্তি খাওয়া । তোমরা কাল রাত খাও নি, এখন খেয়ে যাও এবং রাত এসেও খাবে আমার বাসায়। শুচিতা বলে তুমি ও তোমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলো। না, আমরা সব সময় যাই , আজ তোমরা যাও ঘুরে এস। মনে রেখো রাতে আমাদের এখানে খাবে এবং কাল সকালে নাস্তা করে বিদায় নেবে। সে দেখা যাবে। শুচিতা দাদুর বাসায় টেলিফোন করে বলে দাদু তোমরা কি তৈরি হয়েছো? রেবেকা বলে আমরা সেই সকাল থেকে উঠে নাস্তা করে বসে আছি। দাদু আমরা কাল রাত দেরি করে ঘুমিয়েছি; সে জন্য উঠতে দেরি হলো। ঠিক আছে তাড়া কিসের ? তোমরা নাস্তা করবে না ? না , দাদু আমরা এখানে নাস্তা করতেছি।
ঠিক আছে, আস্তে আস্তে আসো, নিচে এসে কল দিলে আমরা নেমে যাবো। আমরা আসতেছি আধঘন্টার মধ্যে। ঠিক আছে ।
মজিদ ও রেবেকাকে সিনিয়র হোম থেকে উঠিয়ে নিয়ে হাইওয়তে না গিয়ে ছোট রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে এবং মাঝে মধ্যে টিম হর্টন দেখলে দ্রুব চিৎকার করে বলে মাম্মি এখানে রাখো আমি আইস ক্রিম খাব। শুচিতা বলে টিম হর্টনে ভালো আইস ক্রিম পাওয়া যায় না। ওরা কপি এবং মাফিন, চকলেট মিল্ক কিনে খেয়ে ওয়াশরুম সেরে আস্তে আস্তে দুই দিক দেখে এগোচ্ছে। দুই দিকে বিরাট বিরাট কৃষি ফার্ম, গম , আলু চাষ দেখে এগুচ্ছে । তাছাড়া বিরাট বিরাট বাড়ি চারিদিকে প্রসস্থ মাঠ এবং অনেক ফার্মে গরু আর ঘোড়া। বিকেল দুইটার দিকে ওরা ব্লু মাউন্টেন পৌঁছে । টরন্টো থেকে ব্লু মাউন্টেন প্রায় ২০০ কিলোমিটার।ওরা ক্লান্ত হয়ে রেস্টুরেন্টে ও ডেইরি কুইনে সবাই মিলে দুপুরের খাওয়া ও আইস ক্রিম খেয়ে রাইডিং এ যায়। ব্লু মাউন্টেন অতি চমৎকার পাহাড়ি এলাকা এবং সুন্দর করে বিভিন্ন গেম দিয়ে সাজানো। পাশেই চার্লেস্টোন লেক অতি চমৎকার এবং চারিদিকের মনোরম দৃশ্য দেখলে মন ভরে যায়।
ব্লু মাউন্টেন ট্যুরিস্টদের থাকার জন্য হোটেল, মোটেল ও ভাড়া বাসা, সিঙ্গল, ডাবল বেড রুমের ব্যবস্থা রয়েছে। যে কেউ গ্রীষ্মের উইকেন্ড বা ছুটি নিয়ে থাকতে পারে। ওরা বিভিন্ন রাইডিং এ ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার দিকে ফিরতি যাত্রা শুরু করে রাত ১০টার দিকে টরন্টো পৌঁছে। রেবেকা বিকেলের জন্য রান্না করে রেখে গিয়েছে এবং বলে তোমরা উপরে এস খেয়ে যাও । শুচিতা বলে দাদু খাবার মতো ইচ্ছা নাই; রিতা ও আমাদের জন্য রান্না করেছে। মজিদ বলে উপরে উঠো এবং খাওয়া শেষ করে তবে যাও। শুচিতা এবং প্রদীপ দ্রুবকে নিয়ে ওদের এপার্টমেন্টে গিয়ে খেয়ে বলে দাদু আমরা কাল সকালে অটোয়া চলে যাবো। আমাদের জন্য আশীর্বাদ করো। রেবেকা বলে কাল সকালে যাওয়ার পূর্বে একবার কয়েক মিনিটের জন্য আসবে।
মজিদ ও রেবেকা আগেই দ্রুব এবং শুচিতার জন্য এটা সেটা কিনে রেখেছে। সকালে রিতার বাসায় নাস্তা করে, এ বাসায় আসলে, হালকা খাবার পর রেবেকা বলে এগুলি তোমাদের জন্য। শুচিতা খুশিতে আপ্লুত হয়ে বলে দাদু তোমরা আমাদের অনেক আপন জন, কিছু না দিলেও আমরা খুশি থাকি। মা বাবা আসলে তোমাদের একবার অটোয়া নিয়ে যাবো। রেবেকা বলে সে দেখা যাবে। ওদের পার্কিং পৰ্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বিদায় দেয়।
শুচিতা প্রদীপকে বলে টরোন্টোর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। এখানে আমার বহু বন্ধু যাদের সঙ্গে রয়েছে শিশু, কিশোর ও যৌবনের নানা কাহিনী ও স্মৃতি । টরন্টো থেকে বিদায় নেয়ার পূর্বে সে CN টাওয়ার, পার্লামেন্ট এরিয়া, টরন্টো ইউনিভার্সিটি গাড়ি নিয়ে ঘুরে দ্রুব ও প্রদীপ কে দেখিয়ে বিকেলের দিকে অটোয়া রওয়ানা দেয়। যাওয়ার পূর্বে জার্রার্ড স্ট্রিট নেমে কিছু কেনা কাটা করে। শুচিতা বলে বাবামা মাসে দুএকবার এই স্থানে আমাকে নিয়ে আসত। এখানে রেস্টুরেন্টে বসে কিছু না কিছু খেয়ে ঘোরাঘুরি করতাম।
যাওয়ার পথে ওরা থেমে থেমে রেস্টুরেন্টে বসে খেয়েদেয়ে আস্তে আস্তে রাতের দিকে অটোয়া পৌঁছে । প্রদীপ শুচিতা ও দ্রুবকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে কোম্পানিতে জমা দিয়ে নিজের গাড়ি গ্যারেজ থেকে নিয়ে বাসায় গেলে মারিয়া বাসার দরজা খুলে বলে লম্বা জার্নি করে এসেছ। প্রদীপ হেসে বলে মারিয়া তুমি ঠিকই বলেছ। সকাল ৯টা বাজে গাড়ি চালান শুরু করেছি, এখন রাত ৯টা বাজে ঘরে ঢুকেছি। মারিয়া বলে টরন্টো থেকে অটোয়া ৪ঘন্টার জার্নি, তোমাদের ১২ঘন্টা লাগার কারণ কি?
প্রদীপ বলে আমরা বিভিন্ন স্থানে রেস্ট নিয়ে আস্তে আস্তে নানাহ দৃশ্য দেখতে দেখতে এসেছি। মারিয়া বলে তুমি কি রাতের খাওয়া খেয়েছো ? প্রদীপ বলে আমরা পথে অনেক কিছু খেয়েছি। আমি পাস্তা, মিটবল ও ভেজেটাবল তৈরী করেছি, তুমি কাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। সকালে তোমার কাজ আছে ,লম্বা জার্নির পর রেস্টের দরকার আছে। প্রদীপ বলে মারিয়া তুমি ঠিক- ই বলেছো। আমি ক্লান্ত, রাতে ভালো ঘুমের দরকার।
রাতে শুচিতা কল দিয়ে বলে প্রদীপ তুমি কি গাড়ি জমা দিয়েছো?
প্রদীপ বলে হ্যাঁ ! কোনো অসুবিধা হয় নি তো ?
না, কোনো সমস্যা হয় নি।
কিছু কি খেয়েছো?
হ্যাঁ ! মারিয়া খাওয়া দিয়েছে , আমি খেয়ে শুয়ে পড়েছি। ঠিক আছে কাল কথা হবে।
পরদিন শুচিতা অফিসের কাজ থেকে বের হয়ে হাসপাতালে সুমিতকে দেখতে যায়। সুমিত বলে তোমার জার্নি কেমন হয়েছে?
শুচিতা বলে খারাপ না, মোটামোটি উপভোগ করেছি; তবে তোমাকে মিস করেছি। তুমি সুস্থ হলে একবার নিয়ে যাবো। সুমিত কিছু না বলে চেয়ে থাকে।
আরতি বলে তুমি আমার ছেলেকে এই অবস্থায় রেখে কি ভাবে প্রদীপকে নিয়ে টরন্টো বেড়াতে গেলে?
শুচিতা বলে মা, এখানে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি; তাছাড়া প্রদীপ আমার কাজিন , ও আমার সঙ্গে গাড়ি ড্রাইভ করে গিয়েছে। এ নিয়ে তুমি রং ছড়াছড়ি করবে না অনুগ্রহ পূর্বক। আমি সুমিতকে ভালোবাসি ,সে আমার স্বামী এবং আমি আশাকরি সে ভালোহয়ে উঠুক এবং আমরা ঘর সংসার শুরু করি। আরতি বলে তুমি ডাবল এক্টিং করো , প্রদীপকে তুমি ভালো না বাসলে ওকে নিয়ে উঠাবসা করবে কেন ?
মা আমি তোমার সঙ্গে এ সব কথার জবাব দিতে চাই না; এই বলে সে হন হন করে হাসপাতালের রুম থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে দ্রুবকে ডে কেয়ার থেকে নিতে যায়। নাহিদ ওকে বলে তোমার টরন্টো জার্নি কেমন হয়েছে?
ভালো হয়েছে, আমরা টরন্টো এবং ব্লু মাউন্টেন গিয়েছিলাম। দুই দিনে আমি দ্রুবকে নিয়ে অনেক উপভোগ করেছি। আমি একা লম্বা ড্রাইভ করতে পারি না সে জন্য আমার কাজিন প্রদীপকে নিয়ে গিয়েছি। অধিকাংশ সময় সে ড্রাইভ করেছে আমি দ্রুবকে সামলিয়েছি। কিন্তু এ নিয়ে আমার শাশুড়ি আরতি আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছে, আমি সুমিতকে একা হাসপাতালে রেখে প্রদীপকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করি। আমি রাগ করে হাসপাতাল থেকে চলে এসেছি। নাহিদ বলে এ সব বাদ দিয়ে তুমি তোমার কর্তব্য কর। কে কি বললো এতে তোমার কিচ্ছু যায় আসে না। তুমি ভালো হলে একদিন তোমাকে কেউ না কেউ ভালো বলবে।টরন্টো এবং ব্লু মাউন্টেন তোমার কেমন কেটেছে ?
অপূর্ব ! লোকজন অনেকদিন পর দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরেছে ; তাছাড়া দ্রুবকে দেখে সবাই খুশি। দ্রুব চটপটে সবার সঙ্গে কথা বলে এবং কোনো জড়তা নেই , সবার কাছে যায়।
রাতে শুচিতা মা আভাকে টেলিফোন করেছে। আভা টেলিফোন উঠিয়ে বলে শুচিতা তুমি কেমন আছো?
মা আমি দ্রুব ও প্রদীপকে নিয়ে টরন্টো এবং ব্লু মাউন্টেন ঘরে এসেছি। দাদু রাবেয়া,মজিদ এবং বন্ধুরা আমাদের দেখে অনেক খুশি হয়েছে।ওরা দ্রুবকে খেলনা,প্যান্ট শার্ট এবং আমাকে অনেক কাপড় চোপড় দিয়েছে। দাদুদের নিয়ে আমরা ব্লু মাউন্টেন অনেক মজা করেছি। তাছাড়া প্রদীপ নুতন মানুষ, দেখে খুব খুশি হয়েছে। আমরা দুইদিন ঘোরাঘুরি করে অটোয়া এসেছি ; তবে আমার শাশুড়ি আমার উপর অনেক রাগ হয়েছে এবং বলে সুমিত এত অসুস্থ , তুমি টরন্টো বেড়াতে গিয়েছো। আমাকে অনেক খারাপ বলেছে আমি কেন প্রদীপকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করি।
আভা বলে আরতির কথা তুমি শুনবে না । সুমিত কি কিছু বলেছে? না, ও কিছুই বলেনি; তাছাড়া সে অনেক অসুস্থ।
তুমি কি সারাদিন রোগীর কাছে বসে থাকবে?
এদের কথা মত সারাদিন সুমিতের কাছে বসে থাকতে হবে এবং তার মাবাবার কথা শুনতে হবে; আর চোখের পানি ফেলতে হবে। আমি এখানে বসে থাকলে আমার কাজ কে করবে এবং দ্রুবকে কে দেখবে ?
আরতি আর কমল আমাকে দেখলেই বলে আমি ওর ছেলেকে অসুস্থ্য করেছি। আমার উপর দোষ চাপাতে পারলেই খুশি। ওদের খুশি হতে দাও।
মা তোমরা এখন কোথায় আছো?
আমরা এখন দিল্লী প্রদীপদের বাবামায়ের বাসায় আছি , এখান থেকে এক সপ্তাহ থেকে আমরা বোম্বে তোমার এক আংকেলের বাসায় যাবো এবং কয়েকদিন থেকে কলিকাতা ফিরে যাবো।দিল্লিতে কিকি দেখলে?
এখানে মোঘল আমলের অনেক স্মৃতি ও আগ্রার তাজমহল দেখেছি। এত এত স্মৃতি, দেখে শেষ করা যায় না।
তুমি কি প্রদীপের বাবার সঙ্গে কথা বলবে?
দাও। হেলো শুচিতা তুমি কেমন আছো ?
ভালো। আংকেল আপনারা কেমন আছেন?
আমরা ভালো আছি, প্রদীপ কেমন আছে?
ভালো আছে, আমরা তোমাকে সেই ছোট বয়সে দেখেছি। অনেকদিন তুমি ইন্ডিয়া আসো নি। তুমি একবার তোমার ছেলে দ্রুবকে নিয়ে এসে দেখা করে যাবে। ঠিক আছে আংকেল; আমার জন্য আশীর্বাদ করবেন। তোমার আন্টির সঙ্গে কথা বলবে কি ?
দাও।
হায় শুচিতা ! তোমাকে সেই ছোট বয়সে দেখেছি , আর দেখি নি।
প্রদীপ কেমন আছে ?
ভালো আছে।তুমি দ্রুবকে নিয়ে বেড়াতে আসবে । ঠিক আছে ভালো থেকো।
শুচিতা টেলিফোন রেখে দিয়ে দ্রুবকে বলে তুমি টেবিলে এসে খাওয়া শেষ করে তোমার ড্রয়িং নিয়ে বস।
মাম্মি আমি এখন ড্রয়িং করবো না। আমি একটু টেলিভশন দেখবো, আচ্ছা খেয়ে টেলিভশন দেখে ঘুমাতে যাবে। মাম্মি আংকেল কি আজ আসবে না ?
কেন ?
না , আংকেল আসলে টিম হর্টন থেকে একটা কিছু আনতে পারতো আমার জন্য। তুমি কি সব সময় আংকেলের খাবার আসা করে বসে থাকো ?
দ্রুব কিছু না বলে হাসি দিয়ে থাকে। শুচিতা জড়িয়ে ধরে বলে তুমি আমার লক্ষি সোনা।
প্রীতম ও আভা দিল্লি এবং বোম্বে ঘুরে কলিকাতা গিয়ে কয়েকদিন রেস্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফরিদপুর ওদের আদি বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রীতম বলে বাংলাদেশে ফরিদপুর একটু না গেলে ওখানকার লোকজন অসন্তুষ্ট হবে ।
ছুটির মাত্র আর দুই সপ্তাহ আছে। প্রদীপ বলে, চলো কাল বাংলাদেশের ভিসার জন্য গিয়ে দাড়াই; যদি ভিসা পেয়ে যাই, শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে বেনাপোল বর্ডার গিয়ে যশোহর হয়ে ফরিদপুর তিন চার দিন থেকে চলে আসি। আর কোনোদিন যেতে পারবো কিনা বলতে পারি না।
ওরা সকালে বাংলাদেশ দূতাবাস, কলিকাতা গিয়ে ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়ায় । ভিসা নিয়ে বের হতে দিনের তিনটা বাজে।
পরদিনই সকালে নাস্তা করে প্রীতম ও আভা শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে ট্রেনে পেট্রাপোল স্টেশন এ নেমে বেবিট্যাক্সি করে বেনাপোল বর্ডার ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশ চেকপোস্ট শেষ করে বাসে যেশোর শহরে চলে যায় এবং ওখানে রেস্ট ও খায়াদাওয়া সেরে পুনরায় বাস ও বেবিটেক্সি করে ফরিদপুর নিজেদের আদি ভিটাবাড়ি গিয়ে উঠলে সবাই এসে প্রীতম ও আভাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে মেতে উঠে। ওরা এ বাড়ি / সে বাড়ি ঘোরাঘুরি করে প্রীতমের পুরানো স্মৃতি,তার দাদা ও দাদির সমাধির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গাছ থেকে সদ্য প্রস্ফুটিত জবা ফুল সমাধিতে দিয়ে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে পুরানো দিনের পূজার ঘর সেরে পুকুরে শানবাঁধানো ঘাটে বসে পুরানো স্মৃতি স্বরণ করে। প্রীতম বলে এই পুকুর থেকেই আমাদের পুরানো লোকজন সে যুগে স্নান সেরে পানি নিয়ে রান্না করতো এবং একদিকে পুরুষ এবং ওপর দিকে মেয়েরা পুকুরে আসতো, কাপড় ধোয়া,স্নান সেরে রান্না ও খাবার পানি নিয়ে মহিলারা ঘরে যেত। পুকুরে মহিলাদের আলাদা ঘাটে কোনো পুরুষ যেত না। পুরুষদের দেখলে মহিলারা মাথার কাপড় টেনে নিজেকে আড়াল করতো, সে সব স্মৃতি আজ মনে জাগে ।
প্রীতম ও আভা একদিন রেস্ট নেয়ার পর সারা গ্রাম ঘোরে বেড়ায়। ওরা নিজেদের আত্মীয়স্বজন খুঁজে খুঁজে বের করে দেখা করে। তাদের পরিচিত অনেকেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছে, তাদের স্মৃতি ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপ করে খোঁজখবর নেয়।
সবাই বলে তোমরা আরও কয়েকদিন থাকো এবং আমাদের সঙ্গে একটু বসে কানাডার জীবন কি ভাবে কাটছে জানাও । প্রীতম বলে আমরা অবসর জীবন নিয়ে দুইজনে একমাত্র দ্রুবকে নিয়ে আনন্দ করি।
ওরা গাড়ি ঠিক করে ঢাকা শহর ঘোরাতে নিয়ে যায়। ঢাকা ওয়ারী প্রীতমের দাদা একটা বাড়ি করেছিল এবং সে বাড়ি দেখার জন্য গেলে ওখানে তাদের আত্মীয়রা বলে তোমরা এখানে কয়েকদিন থেকে যাও। আভা বলে আমাদের এক সপ্তাহ মাত্র আছে এর মধ্যে কানাডা চলে যেতে হবে। আভার লোকজনের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে কলিকাতা চলে গিয়ে স্থায়ী ভাবে বসতি স্থাপন করেছে। তারা তিনদিনের জন্য গেলেও লোকজনের অনুরোধে দুইদিন বেশি থেকে ঢাকা থেকে বাস নিয়ে কলিকাতা চলে আসে।
কলিকাতা এসে ৪-৫ দিন থেকে লাগেজ গুছিয়ে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স এ লন্ডন এসে ৮ ঘন্টা ট্রানসিট নিয়ে অটোয়া এসে নিজের বাসায় উঠে। প্রদীপ , শুচিতা এবং দ্রুব এয়ারপোর্টে গিয়ে ওদের পেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে তোমাদের অনেকদিন মিস করছি ।
ক্রমশ :