দীর্ঘ কবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
অনিরুদ্ধ আলম
পর্ব ০৩।।
বৃক্ষদের আত্মার সানুতলে ঘুমিয়ে-থাকা আসন্ন বৃষ্টির পদাঙ্ক কর্পূরের মতো উড়ে যেতে দিও না। উড়াল মেলেছে ডাকাবুকো হুঁকোতে জমানো বাষ্পীভূত দীর্ঘশ্বাস। ঝিনুকের করোটিতে কে জমিয়ে রাখে ধূলিস্মাৎ বেলার ছেলেখেলা? কানামাছি আর বউছি খেলেখেলে সেই যে ছেলেবেলা হারাল আর ফিরে এল না। হারিয়ে-যাওয়ার কী এক-অদম্য তাড়না নিয়ে মুহূর্তগুলো আসে! প্রচ্ছন্নে রেখে যায় ঢেউ-ঢেউ চোরাটান।
কাদার খোলে শিংমাগুরের মতন নবীন ঢেউরা প্রাণান্ত হলে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে মৌসুমি হাওয়া এসে ওদের বলে যায়, ‘আসছে দিনগুলো তোমাদেরই হবে।’
অবিসংবাদিত নবান্নের দিন এল কি? খয়েরি পক্ষীসকল আরো খয়েরি হল। কুঁকড়ে-থাকা জলগুলো দিঘির গ্রীবা পর্যন্ত চওড়া হবে – ভাবছে। ঘাটে জল নিতে এসে রাঙা বউটা বলল, ‘কলস, তোমার অতল তলে কে-বা ডুবে মরে?’
মগ্নতা কি সাঁতার জেনেও ডুবে মরার কৌশল?
ভরসার মতো নিতল স্বপ্ন মানুষের মগ্নতা নিয়ে খেলা করে।
স্বপ্নরা পুষ্ট শস্যের নান্দনিকতায় বর্ণাঢ্য ও স্বনির্ভর হলে, যোজিত হয় জন থেকে জনে। উঠোন থেকে উঠোনে। গ্রামান্তরে। গাঁয়ে ফেরিওলা আসে। ঢেউ-তোলা টিনের চকচকে সামর্থ তার ঘাম-ভেজা কপালের বিশিষ্ট ভাঁজেভাঁজে ফুটে ওঠে। রুক্ষ-কঙ্কালসার ডালিতে হরেক মাটির খেলনা ভ’রে নিয়ে বাড়িতে-বাড়িতে ফেরি করে। ঘরে-জমানো হলুদ ঘিয়ের বেকার রঙ ধানের বুকে আঠালো হয়ে জমে উঠেছে। মুঠিতে চেপে ধরে শুঁকেছি তার ঝঙ্কৃত ঘ্রাণ বারবার! দীর্ঘদিন আগুনের জন্যে হাহাকার-করা উনুনের পতিত বুকে ফুটবে কি সূর্যের জ্বলন্ত ফুল একটানা সারাবেলা? বাইস্কোপের জানালা গ’লে মুগ্ধতার ঘূর্ণিপাক আতশবাজির আদলে উছলে পড়ে। কোথা থেকে যেন একটা তাজমহলের ছবি জোগাড় করে এনেছিলে। টাঙিয়ে দিলে ঘরের দেয়ালে। চাঁদিনী রাতে উড়ে-বেড়ানো ডানাঅলা সুন্দর রমণীমুখী একটি ঘোড়ার ছবি ঘরের কোণায় পড়ে ছিল। সেটাও খুব যত্নে স্থান পেল তাজমহলের বিমুগ্ধ পাশটায়। কানে ভেসে এল– দূরত্ব-চিহ্নিত শেষসীমানাতে জলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে একটি ঝরনা।
আশ্চর্য একটি জগৎ রাজপ্রাসাদের মতো সুসজ্জিত হয়ে এখানে-ওখানে ছড়িয়েছিটিয়ে বিরাজ করতে লাগল।
রাজপ্রাসাদজুড়ে সাঁজোয়া রঙের আতর ছুটছে। ঘোড়াশালে ঘোড়া। হাতিশালে হাতি। মণিমাণিক্যের ছড়াছড়ি উর্বর রাজভাণ্ডারে। কিসের অভাব রাজার! রাজার মুখে হাসি নেই। রাজকর্মে নেই মনোযোগ। সবাই তাকে আঁটকুড়ে রাজা বলে। কবে আসবে তার ঘর আলো করে এক-ফুটফুটে রাজকুমার? আশার অক্ষরে অস্তাচল লেখা চলে না। আর প্রতিটি প্রার্থনাই সূর্যের পুনর্জন্মের কথা বলে। সোনালি সীমান্ত ঘিরে জোছনাস্নাত সভ্যতার সার্থক উত্তরাধিকারীর কথা বলে।
নির্লিপ্ত খড়কুটোর মহিমাতে যে-স্বর্ণমুদ্রা ডহর সিন্দুকের অন্দরে চিরায়ু হয়, সে কী করে বুঝবে জোছনা আর অমাবস্যার পার্থক্য? কখনো কি শুনেছ– ম্রিয়মাণ মেঘের আত্মিক মেধারা পুরোহিতবেশে আসন্ন রোদের আগমন-জপে ব্যস্ত? কিংবা প্রতিটি আগমনই যেন জ্বরে-পুড়ে-যাওয়া প্রতীক্ষার শৃঙ্গারে চূড়ান্ত পরিণতি অনুসন্ধান করে!
প্রতীক্ষাকে চণ্ডিদাস আর কালের মায়াকে রজকিনী বলে যেই ভাবা, অমনি মনে হল– বহুদিন দুপুরতান্ত্রিকভাবে দেখি নি জোড়াশালিক। পাশে পড়ে থাকল পৃথিবীর মুখ। পুনর্ভবার পহর, পহরের পুনর্ভবা হৃদপিণ্ডে লুটোপুটি খেতে থাকে। ঝিঙেমাচাটার কোলঘেঁষে শালিকদের পায়চারি। কাছে যেতেই দেখি ওদের হলুদ ঠ্যাঙ আরো বেশি লাবণ্যে হয়েছে সুচারু। নদীতে জল-আনতে-যাওয়া নবব্ধুটার কাচা হলুদ রঙের শাড়িটার স্নিগ্ধতাকেও হার মানায় যেন সে-লাবণ্য।
গোলাপি ফুলের মতো লাবণ্যময় বেলারা শ্বাস নেয় অনাত্মীয় হাওয়ার হাঁপরে। দ্বিধান্বিত দূরে কোথাও ঘণ্টাধ্বনি বাজছে। ছায়ানটবাসী ঘাসদের জানা আছে– এমন সময় কীভাবে গুচ্ছগুচ্ছ শ্যামল তীব্রতাকে নজরদারি করতে হয়। কচ্ছপরা এর মধ্যে নির্ভরযোগ্য সঙ্কেত পেয়ে গেছে। জলধির তীরঘেঁষে ডিম পেড়ে যায় ঝাঁকেঝাঁকে।
মুকুটহীন উচ্ছ্বাসে ভর ক’রে সাম্পানগুলো ভিড়েছে তীরে। বিভিন্ন নকশি পসরা ছড়িয়ে দেয় হাটেবন্দরে। মানুষের কৌতূহল আসলে বটের ঝুড়ির মতোই জমাটি। পাহাড়ি মেয়ে আসে রঙিন চুড়ি কিনতে। লাল-জাফরানি ফিতেতে তার ফুলেল খোঁপা বাঁধা চাই। জংলা ফুলের বাগানে উড়ে-উড়ে ঘোরে নতুন এক অনিন্দ্য ফুল আনমনে।
মনেমনে শিরি আপুকে অনেক খুঁজেছি। কোনো এক-অসমাপ্ত জোছনার নিখুঁত লাবণ্য আমাকে তাড়া করে ফিরত। আমি যখন ক্লাশ এইটে তখন শিরি আপুরা আমদের গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া প্রায় শেষ করেছি। এমন সময় শিরি আপুদের খোঁজ পেলাম। গাঁয়ে তাদের দূরসম্পর্কের এক-আত্মীয় ছিলেন। তিনিই ঠিকানাটা দিলেন। ঠিকানা নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় সোজা গিয়ে হাজির হলাম শিরি আপুদের ধানমণ্ডির বাসায়। ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে-থাকতে আরণ্যক হয়ে পড়ি। আমার মনে হল আমি কৈশোরে ফিরে গেছি। একগুছ কাশফুল হাতের মুঠোতে ধরে একটি জংলা মাঠের মধ্য দিয়ে কোথাও যেন দৌড়ে যাচ্ছি। পেছন-পেছন শিরি আপু ছুটে আসছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। প্রাণান্ত গলায় চিৎকার করে আমাকে বলছে, ‘ওদিকে যাস নে ঋজু! ফিরে আয়!’
যখনি পেছন ফিরব, আমার হাতের ফর্সা কাশফুলগুলো সুলতানি পায়রা হয়ে কোথাও দিল উড়াল। রেলগাড়ির মতো গটগট করে সারিবদ্ধ পাতিহাঁসগুলো নদীতে নেমে গেল। জেলেরা মাছ ধরতে এসে সবচেয়ে বড় শিলাটাতে লিখে রেখেছে তাদের নাম। ঝিরঝিরে বাতাসে জলের ঝিমুনি দেখে মাছরাঙা ঘুমিয়ে পড়েছিল গাছের ডালে। ছাতিম গাছটাও আকাশে প্রতিদিনের মতো দীপান্বিতা নামের মেঘটাকে দেখতে না-পেয়ে হেমন্তকে ফিরে যেতে বলে নি। হাটে যাবে বলে কোনো হাঁটুরে এ-পথে ভুল করে এলে, সনির্বন্ধ ধুলোরা আরো বেশি বিনয়ী হয়। নারকেলপাতার চশমা বুনতে-বুনতে হয়ত চলে আসবে বকেয়া বসন্ত। পাঁজরে ছিন্নভিন্ন বহুবিধ দাগ নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে-থাকা সর্বংসহা কুঁড়েঘরটা এখন দৃঢ়তা বলতে বোঝে সন্ন্যাসীর একাকীত্ব-যাপন।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শিরি আপু আমাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে চমকে উঠবে। ড্রয়িংরুমে শিরি আপু খুব ধীরপায়ে হেঁটে এল। মুখে গম্ভীর ভাব। আরে এ তো আমার অসম্পূর্ণ কৈশোরজুড়ে-চেনা শিরি আপু নয়! সাক্ষাৎ স্বর্গ থেকে সবচেয়ে সুন্দর ছিপছিপে পরিটা ভুল করে মর্ত্যে নেমে এসেছে। সোনার কুঠার উপহার দেয়ার জন্যে প্রথম বারের মতো জলপরি যে-অনুসন্ধিৎসু অথচ উন্নাসিক দৃষ্টি নিয়ে প্রকৃত কাঠুরেকে বনে খোঁজ করছিল, সেরকম এক অভিব্যক্তিতে আমার দিকে তাকাল শিরিআপু।
শিরি আপু ঠিক আমার সোফার উলটো দিকে মুখোমুখি বসল। আমি আমার পরিচয় দিলাম। তারপর কী যেন ভাবল। ‘আচ্ছা, তুমি সেই দুষ্ট ঋজু?’ বলেই উঠে গেল। যাওয়ার সময় বলল, ‘আমি একটা নতুন কলেজে জয়েন করেছি তো। সকালে ক্লাশ নিতে হবে। একটু তাড়াতাড়ি না-ঘুমুলে সকালে উঠতে দেরি হয়ে যাবে।’
ঘুম থেকে দেরি-করে-ওঠা পানকৌড়িটা শুনতে পায় নি জলে-ভেসে-যাওয়া পাতাদের ছোঁয়াচে খুসসুটি। গোয়ালের দাসত্ব থেকে ছাড়া পেয়েই লাল বাছুর নদীর তীরে এসে অদ্ভুত অভ্যাসে নিজের মুখশ্রী দেখে নিল। আয়নার দেশে ঘুরতে যায় নি সীমাবদ্ধ বাতাসের নিরলস শিস। তবুও রঙান্ধ কাচের কুচির মতো ভেঙে পড়ে সহানুভূতিশীল প্রচ্ছায়াদের ঘরবাড়ি। ধেড়ে আঙুলের রাজত্বে বিনীত তরবারির কাছে দীক্ষা নিল প্রজারা– কীভাবে রাজাধিরাজের গুণমুগ্ধ থাকতে হয়। কেউ জানে না– কেন পুতুল-নাচ দেখানোর পেশাটা তাদের কাছে বড়ো প্রিয় হয়ে উঠেছে। মাংসল উৎকণ্ঠার চামড়াতে বাঁদরনাচের ডুগডগি বানানো যায় না। এ তাদের অজানা ছিল না। তাই মাটির কাঁকড়াবিছে বানিয়ে ভুল করে রেখে আসত থুত্থুড়ে কোনো পর্বতগুহার সাজানো তাকে। এই প্রতিবাদের দায়ে কোনো অন্ধের কক্ষনো হয় নি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কে না চায় অমর হতে? সন্ধ্যা ঘনালেই দরবার শেষে রাজা সপরিবারে বের হয় রাক্ষস-নিধনে। (চলবে…)
জলে-ভেসে-যাওয়া পাতাদের ছোঁয়াচে খুসসুটি। দীর্ঘ কবিতা
“জাদুঘর থেকে বলছি” পর্ব ০৩ খুব মন সংযোগ করে পড়লাম। বেশ ভালো চলছে। আরও কটা পর্ব আছে? সত্যি খুব ভালো লাগছে। তোমার সব লেখাই তারিফ করার মতো। সব পাঠক পাঠিকার ভালো লাগবে এতে কোন সন্দেহ নেই। মনের আনন্দে লিখতে থেকো। ভালো থেকো। সুস্থ থেকো।