ধারাবাহিক দীর্ঘকবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
পর্ব ১৮।।
পাগলপারা-জোছনাময় আলতার অলিখিত রঙে তোমার রাঙা পা ডুবে গেলে, রুক্মিণী, বুঝবে আমি চলে এসেছি।
জলাটে অঞ্চলে অপার্থিব মক্তব্যের নামী শিক্ষক গনিমিয়া তার ছাত্রদের ধারাপাত পড়াতে-পড়াতে ভাবেন, ‘অভিমানী পৃথিবীর সকল থমথমে ভগ্নাংশ একপ্রকার শুভঙ্করের ফাঁকি।‘ ব্ল্যাকবোর্ডে সমর্পিত মহেঞ্জাদারোর ইতিহাস ডাসটার আত্মস্থ করে কী এমন সবল আন্তরিকতায়?
‘ধবল বকের উড়াল হব’– এমন সাধ নিয়ে মন্দাক্রান্তা ছন্দের জাতক নিগূঢ় চকের গুঁড়োরা ক্লাশরুমের কোলাহলে বিলীন হয়েছিল। অভিভাবকহীন কথকতার সূত্র ধ’রে নারঙ্গি-ঝোপের ডানা-কাটা হলুদ প্রভা বাগদাদি রজনীর ঝলক দেখে ঈর্ষান্বিত নাও হতে পারে। হরিণাকুল পৃথিবীর তাবৎ উঠোন একটি করে নদী পুষে রাখুক। অস্তিত্বের খাতিরে গাঙচিলের কাছে প্রাণবন্ত ঘুড়িটা শিখুক ওড়ার মেঘবাচক কৌশল। কোনো কি মৎস্যকুমারী তার নৈরামণি জানালায় সচিত্র প্রার্থনাতে গুছিয়ে রাখে হারিয়ে-যাওয়া জোনাকিদের সাহসী সন্তরণ?
আধফোটা জলহাওয়ারা অমন মৈথিলী প্রজন্মের মতো কাঙাল হয়ে আলোর খিলানে এলিয়ে দিল পাখিমূলক উৎকণ্ঠার রথগুলোকে!
আলবত মাটির বিপরীতে বৃহন্নলা মৃগতৃষারা যাজকীয় অভিলাষের নিভৃতচারী পরমাত্মীয় হতে পারে না। ক্লান্তিহীন জোকারের অধ্যবসায়ে ভর কোরে এক-চাকার সৌভাগ্য গড়িয়ে-গড়িয়ে যায় খাদের কিনারে। পাথরকুচি ছুঁইয়ে দিয়ে আমি এগোই গগনবেড়ের বাড়ন্ত দিকচক্রবালের দিকে। কেউ হয়ত ভেবে থাকবে– একটি আয়নায় শূন্যের দশানন কীভাবে মুখ দেখে? রাজকন্যা ও রাজত্ব আসলে কখনোই একসঙ্গে মেলে না। একটিকে পেতে গেলে অন্যটি সাদরে অনিবার্য রাক্ষসের পৌর-দক্ষিণা বলে পরিগণিত হয়। মুক্তোর মুকুট পরা মানেই মাংসাশী কোনো সুখের স্বার্থপর ক্রীতদাসে পরিণত হওয়া।
অতঃপর নিতল আঁখিতে আমার দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ো না। পাখি হয়ে যাবে।
বৈকাল হ্রদের পাকাপাকি পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে সর্বাত্মক কাঠঠোকরাদের বিকল্পকাতর ব্যস্ততাকে কখনো দানা বাঁধতে দেখে নি নিরন্ন মাছরাঙা। এলোকেশী আশালতাদের রোদ্দুরে পড়ে আছে ডিমের কুসুমের মতো নির্ঘুম যত উম।
নিজ্ঝুম দহের কিনারা ঘেঁষে হার্মাদরা বাণিজ্যিক বসতি গড়তে ভালবাসে। মগের মুল্লুকে পরম সভ্যতার মানে মুন্ডুহীন সমাজসংস্কারকদের প্রাত্যহিক বনভোজন! অকথ্য রক্তে গঙ্গা ভেসে গেলে, গুহাচিত্রে-আঁকা আদিম মানবরা অতিকষ্টে পাথর হয়ে যায়। ভাবে ‘এ কেমন তাড়নাজাত উত্তরাধিকারী আমরা রেখে এলাম!’
তামাম ছায়ার দ্রবণে একটুকরো আলোর লিটমাস জারিত হলে, দখিনাত্মক দাওয়া নিমেষে বুঝে নেয় সারাটা বেলা বাড়িটার দিন কেমন কাটবে।
গুনিন সাঁঝের স্বাধীন শার্সিতে খই-সম্প্রদায়ের শুকতারা আজো তার রাবীন্দ্রিক অস্তিত্ব জানান দিল।
অথই ডাহুকের জলজ ডাকবাংলো থেকে অতলান্তের ডাক অবিভক্ত নিস্তব্ধতার পর্দা চিরেচিরে উবে যায়। কালোত্তীর্ণ কাকের ডানায় উষ্ণতাবোধক উদাসীনতার প্রতিপক্ষ হয়ে রইল নারিকেল-ফুলদের ডাকনাম।
ধানের সবাক চিটা হয়ে জন্মসূত্রে কোনো দুঃসংবাদ পুষ্ট হল কি? প্রাক্তন করুণারা ঠোঁট উলটিয়ে গৌরি রূপ দেখায়। নিরুদ্দিষ্ট দিনের-সমান কিছু ভালোলাগা ছিল। এখন অশুচি বোধ হয়! নদীর জ্ঞানশূন্য বাঁধে প্রতিষ্ঠিত হেমলকের বিষ শুশুক আর ঝিনুকদের কতখানি সুরক্ষা দেবে?
শীতলক্ষ্যার তীরে গড়ে-ওঠা জনপদে দিন-দিন চর্যাপদের পাঠক বাড়ছে। এমন জরিপ-ফলাফলে সংখ্যায়ন যুগের কবিদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। চারদিকে তোড়জোড়! ক্ষুরধার তোড়জোড়! সাহিত্য-সম্মেলনে শবর পা-কে পরাবাস্তব কবিতার প্রধান পথিকৃৎ হিসেবে চিহ্নিত করা হল। জানাল হল, প্রকৃত প্রস্তাবে গোলাপ আর পাথরের মধ্যে নিগূঢ়তম মিল ওই একটাই। তারা কেউই মেঘবশত চিত্রকল্পের উপবর্গভুক্ত নয়।
অভুক্ত শুকুন মরুময় শশ্মানের আমিষজাতীয় সন্দেহ মেলে রাখে। টাইটানিক-সমান আতঙ্কের হয়ে ওঠে আত্মিক অধীনস্থ। আপন মনে কল্পলতা ছড়াতে থাকে ভাবান্তরে, ‘লতাগুল্মের সামরিক পাহাড় এগিয়ে আসছে। শ্যামল হবে চিরভিখারি মরীচিকাদের লতা। তাহলে কি উপবাসই দীর্ঘপথযাত্রার একমাত্র মাপকাঠি? দুপুরের রিপুতে ভস্ম হোক তবে কাঁঠালচাপার ঘ্রাণ। অগোচরীভূত তরল সিসাতে গলে যাক বৃক্ষের বাকল।’
অমল শিশুর তিক্ত ওজনহীনতার মতো দুঃস্বপ্ন জাতিকে যেন আর তাড়া না করে। তার চে’ ভালো–হিংস্র ষাঁড়কে রক্তিম ইশারায় সৎকার কোরে তার সঙ্গে মৃত্যুপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া।
সন্তর্পণ দুই হাতে দুই দিগন্ত রাখি। দেবদারুসুলভ ও-সকল দিগন্তে তোমাকে খুঁজে বেড়াই পোশাকী বেলায়। দুখাহত একটি সুখসুখ ক্ষত হৃদয়ে প্রিয়ংবদা কলিংবেলের স্বভাবে একটানা বেজে চলে। একশত গ্রামের সমান বিস্ময় নিয়ে মনসামঙ্গলে খুঁজতে থাকি সরীসৃপ পাথরের খোলস ছাড়ার আকুতি। চায়ে পরোটা ভিজিয়ে খেতে-খেতে শেষ করে-ফেলা মিসির আলীর রহস্যগল্প অশথ বৃক্ষের কাণ্ডজ্ঞান? এসএম সুলতানের ধ্রুপদে ভর ক’রে প্রমোদভ্রমণে বের হল একটি মুখচোরা বিকেল।
দময়ন্তী, অনিকেত বিকেল চলে শ্বেতপাথরের বিকেলের দিকে। আর আমি ভুলে-যাওয়া ধনুর্বিদ্যার দক্ষতাতে রঙ্গিনি একেকটি সাঁঝবেলাকে অন্ধরাতের বন্দনাহীন কূপের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখেছি। আমার পড়ে-থাকা হামাগুড়িগুলোর দৃষ্টিপাতে শূন্য কলস ভরে ওঠে জলে।
অপেক্ষার জলছাপ সারেংবাড়ি শঙ্খধ্বনি শুনলেই নোঙর-ফেলা জাহাজের ভেঁপু বলে ভুল করে। হাড়ের ভেতরে গেঁথে নেয় আসন্ন শুভদিনের নিত্যানন্দ প্রতিচ্ছবি।
নাগরিক চাঁদের বরেণ্য শরীরে হাসপাতালের সন্দিগ্ধ ডেটল গন্ধ। একটি বকুলগাছ বড়ো দরকার। জন্মাক পারমাণবিক গবেষণাগারের উঠোনে। নুহের প্লাবনের প্রবলতায় সোনালি গন্ধে মুছে যাক শহুরে জোছনার অবসন্নতা। চালকুমড়ার জাংলাতে ভরে উঠুক মোসাহেব বরফকলের পরিসর। ক্যালকুলাসের পরিসেবায় বেড়ে-ওঠা সমাজসেবকের গাণিতিক সৃজনশীলতা উঁইপোকার তাগিদ নিয়ে কনক্রিটের ঢিপি গড়তে ব্যস্ত। দুঃশ্চিন্তা প্লাস্টিক বোতলের আবর্জনা রূপে অক্টোপাসের করাল গ্রাস মেলে রাখে। (চলবে…)