ধারাবাহিক দীর্ঘকবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
পর্ব ১৭।।
দৃশ্যবিহীন বন্যতায়-শাসিত করমচার শাখাগুচ্ছ একচেটিয়া লাবণ্যের স্বতন্ত্র প্রস্রবণ হয়ে দুলছে। কথা দিয়ে কথা-রাখা বেনেবউয়ের মুখের দিকে কত দিন হয় নি তাকানো! সবুজের পরিবর্তে অসংযত হলুদকে নিয়ে পেশাদারিত্ব বেড়ে গেলে, গাঙ্গেয় বনাঞ্চল ছেড়ে শহরে গিয়ে অনুমেয় টিয়েরা ভাগ্যগণনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এমন আশঙ্কায়, তিনটি কৃপণ বুড়ির গাঁয়ে ভাঙা-হাঁড়িপাতিলের জাঁকজমকপূর্ণ মেলাতে অপ্রাপ্তবয়স্ক পাঁচটি পুরোহিত এবার প্রতিশ্রুত পুতুলনাচের আয়োজন করেছে।
নিরঞ্জন উটের সাময়িক উঠোনে বসে সুপেয় জলের বণিক জীবনের লাভক্ষতি নিয়ে হিসেব কষে যায়। দু’ আনার দোর্দণ্ড প্রতাপে বিন্ধ্য পর্বতের মালিকানা দাবি করে বসে দোদুল্যমান ধূলিরা অনায়াসে।
আশপাশে পাড়ার ছেলেছোকরাদের মতো চঞ্চল ঝরাপাতারা তখন দুপুরের চিলেকোঠায় বসে ঝিমধরা ভজনে মত্ত।
বঙ্কিম বৃষ্টি কি অরুন্ধতী তানপুরার উদ্ভিন্ন প্রতিধ্বনি? টাপুরটুপুর চিৎকারে সম্প্রতি লাউডগাগুলো মাচান ছেড়ে জাজ্বল্যমান জমিনে নেমে এলে, ঘাস বলে, ‘ওপরে ওঠো। সবিস্তারে ওপরে উঠতে হবে। ওপরে ওঠো পরমার্থে।’ পাশাপাশি পাটিগণিতের ব্যস্ততা বাগিয়ে সমসাময়িক তকমাতে প্রোজ্জ্বল বেলারা আরো পরিপাটি, বৈষয়িক ও সময়কাতুরে।
ঘুরেফিরে ব্যস্ততা কি শতভুজ দৈত্য? দৈত্য তার ডাকাতিয়া ঝুলিতে হনন করে নিয়ে যায় আমার ভালোলাগার দিঘি, স্মৃতির হরিণ, স্মরণের বাস্তুভিটা, সুখের ডাহুক, ভাবনার প্রজাপতি, বোধের বৃক্ষ, নিমগ্নতার সিংহাসন, অত্মীয়তার সাঁকো।
তুমি থাকো মধুমতির ওপারে। একজীবনে আর কত অবাস্তব নৌকা কুড়াব? কবে পাড়ি জমাব পশ্চিম থেকে পুবে? মনন কি অজন্তা? ভালোলাগার তালপাতাতে অঙ্কিত চিত্রকলাগুলো সাঁটিয়ে দেব উত্তর থেকে দখিনের মেঘলা পাঁচিলে। পরিণয়-ঘটিত এমন মোরগফুলের অপচয় এখনো অন্তকরণে লালন করি।
আমি আহামরি তেমন কিছু স্মরণে রাখতে পারি না। একদিন জেনেছিলাম– আমার হারিয়ে যাওয়া সদর ঘরের নিথর চাবিগুচ্ছ ঝাউগাছের মতো তোমাদের সৈকতে ঝিলমিল করেছিল। অলৌকিক জড়ুলচিহ্নের দোসর জেল্লাকে গেঁথে নিয়ে কার্তিকের আলো দূরে, আরো দূরে, সরে গেল।
সাঙ্কেতিক বোদলেয়ারের সমালোচনা অগ্রাহ্য করে আবলুস হাতির পিঠে-সওয়ারী রাত্রি নামে। পদচ্যুত তাঁবুর আভায় উঠানজুড়ে জড়ো করতে থাকি শালবনের প্রচ্ছন্নতা, প্রচ্ছন্নতার আড়ালে সমুজ্জ্বল আধেক-লীন জোছনার ভ্রূকুটি।
নিজের অজান্তে ঘটে-যাওয়া কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি দাঁড়কাকের বেশে সাতসকালেই চালাঘরের পেছনে আমগাছটিতে বসে ‘কা-কা-কা’ ডাকতে থাকে। পামির-সমান বিস্তৃতিতে বিব্রত হই সারাবেলা নিবিড় দংশনে।
অনেক দিন তুমি না এলে আমার অবিরল অলিন্দে ক্ষণে-ক্ষণে মেঘ করে। কখনো অপেক্ষার ঘনঘোর সে-মেঘ ফুঁড়ে অনমনে উড়ে-উড়ে কোথাও দূরে চলে যাই। কোথায় যাই? খুঁজি তোমাকে। কষ্টের বেঢপ কাঁটাতারে আপ্লুত আকাশে-আকাশে ঘুরি। রক্তাক্ত হয়ে প্রমথ সাঁঝে ফিরে আসি এ-আমি আমার মধ্যে।
লোকমুখে-প্রচারিত গদ্যে নিদ্রাহীনতা কি শুধুই পাঠোদ্ধার-বঞ্চিত বিদীর্ণতা? জানি– ধানের গোলা ভরতে না-ভরতেই পানের বরজে মড়ক লাগবে না তথাগত কোনো তিথিতে। পুবদিগন্তে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লার মতো বাতিঘর-ধরনের একটি রূপশালী মেঘ অতন্দ্র প্রহরী হয়ে অন্তত আমাকে দেখে রাখে দাঁতাল রাতের চাতালে।
আথালপাথাল বজ্রের ঝলকানি নিয়ে ভাষাহীন পূর্ণিমা পাশে এসে দাঁড়াল। যশোর রোড ধ’রে জোছনার কাজল-টানা উৎসবে, যদ্দূর চোখ যায়, তদ্দূর শস্যের খামার হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী। আতশী নৈঃশব্দ্য আমার ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়লে, আমি প্রার্থনারত পাহাড় হতে চেয়েছিলাম। চোখ থেকে খসে-পড়া কালো চশমাটা স্নেহের আড়াআড়ি আর্দ্রতায় মুছে নিই। রোদে পুড়ে কাঠ-হওয়া বাঘিনীর থাবাও ঝরনার হাঁটুজলে ডুবে যেতে-যেতে আপনমনে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, ‘অমলতাসের পৃথিবীতে প্রেম বলে কোনো ঋণ নেই?’
সেই-প্রকারে কিশোর-কাশের ঔদ্ধত্য নিয়ে তুলোট জীবাণুদের ঘোরসংসারী জীবন নির্ঘাত তীর্থাতুর।
আঁতুড়-পৃথিবীতে প্রথম নারী যখন একটি নদী বিছিয়ে দিয়ে ওখানে ছড়িয়ে দিল কৈবর্তের হাঁস, তখনো কি গৃহত্যাগী কোনো যুবক শেখে নি জলে নাও ভাসানোর কৌশল? মনে-মনে জপে নি কি ঘুণেপোকাতে ঈষৎ-দষ্ট অমোঘ মন্ত্রখানা, ‘রমণী, সাঁতার মানে তোমার দিকে যাই।’
আহা যে যায়, সে সর্বান্তকরণে সকল কিছু অবিন্যস্ত করে যায়। যে যায়, কেবলি অপূর্ণাঙ্গ বিকেলেই চলে যায়। তবুও ফুটুক তুলসিতলায় প্রীতির কোহিনুর সংক্রমণজনিত প্রশ্রয়ে। স্মৃতির পরাগায়নে ডানা মেলুক বুক-ভরা দিঘির লক্ষ্মীট্যারা পদ্ম।
ক্ষীণ ক্ষণের সদ্য বিবর্ণতাজুড়ে আমার চারদিকে বেড়ে-ওঠা নিরাসক্ত প্রবালপ্রাচীর আরো ব্যক্তিগত হল। আমি জলান্তরে বিশুদ্ধ বীজের মন্দির এঁকে দিই। ক্ষণান্তরে ইবনে সিনার দোয়াতে কালি ফুরাতে না-ফুরাতে, নিজের ধরনে কোনো উভচর নক্ষত্র আমার পিছু নেয়। লুকিয়ে-পড়া বেলাগুলোর নাজুক দেহাবশেষ উত্তরমুখী হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই নাও তোমার স্বনির্বাচিত সর্বস্ব!’
প্রসারিত দক্ষিণ হাতে নিজস্ব বিলপাড়ে পুঞ্জিভূত পাকুর গাছের কোমর জড়িয়ে জানালে, ‘সাগরে ঘুরতে যাওয়ার প্রাসঙ্গিক যোগফল কিন্তু সবিশেষ কাউকে ভুলে যাওয়া নয়।’ কয়েকটি নিকট-কাকাতুয়া একসঙ্গে প্রবীর কণ্ঠে গেয়ে উঠল, ‘সন্ধ্যামালতির আলোড়নে গিয়েছে তো ভেসে কিংবদন্তির শুকতারা।‘ (চলবে…)