দীর্ঘ কবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
অনিরুদ্ধ আলম
পর্ব ০৯।।
গানের ওস্তাদের কাছে হারমনিয়াম বাজানো শিখতে গিয়ে বুঝলাম– পাখির ছানা হয়ে খুঁদ খুঁটে বেড়ানো অনেক আনন্দের। জলের চশমা পরে বিলের অঘোষিত মাছদের সশরীর উড়াল গুণে রাখি। তুষারপাতের ক্রুদ্ধ প্রশান্তি দেখি নি কখনো। তবুও রাতদিন পরে থাকি অমর হাতমোজা। আদিগন্ত জিভের তলায় অনেকদিন রসালো লজেন্স রেখে রাতে ঘুমোতে যাওয়া হয় নি। কেবলি ভেবেছি– পৃথিবীর সকল নিলুয়া সুপুরিবন কি স্বর্গের বাগানের চেয়েও নিরিবিলি? নিপাট?
পূর্বজন্মে পুণ্যবান খরগোশ কায়মনে নিপাট প্রার্থনা করেছিল– যেন এ জন্মে সে চিতা হয়ে জন্মায়। হলেও তাই! কিন্তু ইদানিঙ তার তুলতুলে মাংসের স্বাদে ভক্তি বেড়েই চলেছে। দ্রুতগতির ঊরুদ্বয় শানিত হলে তা পালাবার অবলম্বন নয়, শিকার ধরার ধূর্ত অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।
বহুলব্যবহৃত বাতাসে উবু হয়ে সমান্তরাল নৈঃশব্দের পৌষালি দাগগুলো কেমন প্রোজ্জ্বল! ইলেকট্রিক তারের রেখা মনে ক’রে টুকটাক মেঘের তুলোট কিছু পাখি কখনোসখনো ওতে ঝুলে থাকে। সাদাসিধে মইয়ের থাকথাক সিঁড়ির মাঝখানটা বিনা নোটিশে ছিঁড়ে গেলে তা সারাবার মতো ক্ষণজন্মা লোকজন দিনদিন কমে যাচ্ছে। তাতে ইতস্তত সাপের আপত্তি থাকার কথা না। কেউ-কেউ হয়ত পুষে থাকবে নিরহঙ্কার বেজি। যার থুতুর গিলোটিনে নির্বিষ হবে হাড়-হিম-করা করোগেট সম্পর্কের ফণা! ওপরে ওঠার জন্যে শীতল গতি কতখানি সৌজন্যবান্ধব?
কুলিদের মাথার ঘামে কিনে-নেয়া পেশীবহুল ভদ্রতা কারা সাজিয়ে রাখে সৌখিন টিলার ওপরে বাংলো বাড়িতে?
সারাটা বেলা ধরে, তুমি তোমার যত-না কাছে তার চেয়েও আমি তোমার বেশি কাছে। তোমার বিশ্বাসকে জিজ্ঞেস করো। সে তোমাকে একই উত্তর দেবে।
জমিদারবাড়ির উত্তর-বাগানে সব ফুলই গোলাপ নয়। তুমি আশ্বস্ত করেছিলে পৃথিবীর সকল হলুদ ফুলের নাম আমাকে শেখাবে। সেভাবে জেনে যাব– সূর্যমুখী কোনো অভিনন্দনের শিরোনাম। প্রতিটি ভোরে পাখিরা মেঘের প্রত্যাবর্তন বুঝে নেয় ঝরনার অভ্যাসে। তখন শমিদের ঘরে হারমনিয়াম বাজলেই, তবলবাদক না-হতে পারার দুঃখবোধটা গীতল হতে থাকে।
শেখ সাদির নিতল পদাবলি কে আমাকে পাঠাল সবুজ নদীর মোড়কে ভরদুপুরে? ভুলে গেছি– কীভাবে কলাপাতার করতলে বিছিয়ে রাখতে হয় নদী। কতটা পুঁথিতে গড়া একটি পরমাত্মীয় মালা শঙ্খমালার কন্ঠ থেকে শুকতারার মতো প্রচ্ছন্ন হয় না? পর্যটনপ্রিয় এই আমি তো একদিন তোমার অঙ্গুরির মতো তোমার মাঝে নিত্য লীন হতে চেয়েছিলাম।
নদীমাত্রিক জমিনে মৃত দৈত্যদের দ্বিত্ব আত্মা মাপতে গিয়ে আনুবিস কখনো ভুল করে বসে না তো?
বালির চাকচিক্যে বোনা নদীর নির্ভুল করিডোরে বেগুনি আভা কচুরি ফুল হয়ে ফোটে। হৃদয় কর্তৃক শোণিতে উচ্চারিত ইশতিহারের একান্ত শব্দগুলো হায়ারোগ্লফিক্স হতে পারে না। যেমন ধানফুলের প্রফুল্লতা নিয়ে অচেনা আতরের সুগন্ধে মুখরিত মহুয়ার বন।
হাতের তালুতে পুরে রেখে সুবাসিত জর্দা, মত্ত বাতাসে-বাতাসে কত্ত হয়েছি গন্ধবণিক। চিরকাল নিরন্ন কঙ্কালদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে গড়ে ওঠে ইমারত। জোছনা কখনো সিদ্ধান্তহীন রূপটানে ছদ্মবেশ নেয় না। ঊর্ধ্বশির কোনো সিঁড়ির ব্যতিক্রমে নতশির হওয়ার সুযোগ থাকে না। শীত কি আজন্ম খিল-আটা দুয়ারের দমবন্ধ অনুগামী? আঁধারে-সংক্ৰমিত একটি বিষণ্ণ জানালা জোছনাতে আরোগ্য লাভ করতে-করতে ভোর হয়ে আসে। হিরন্ময় পেয়ালাতে পুরে পান করি ডহর শ্বাস। সামাদ জাদুকরের মতো আমি কি চাইতে পারি না কোনো সূর্যগোলক আমারো অধীনত হোক?
ঈর্ষা কি দুই-দুয়ারি? আমি আমাকে হিংসে করি আর জিজ্ঞেস করি, কেন তোমাকে এত ভালবাসি? ভাবতেই পারি না– ইদিপাস শীর্ষক দুর্ভাগ্য আমাকে সৌভাগ্যের মুকুট পরাবে। চাই– আমিই শুধু তোমাকে ধারণ করব। অন্য কেউ নয়। এমন কি তুমিও নও। দীর্ঘসূত্রতা সে এক বিষলক্ষা ছুরির অভিশাপ! তোমার জন্যে হলেও তুমি আমার হয়ে যাও। জলে-ভরা পিতলের ঘড়া দিঘিতে রেখে আসে নিঃসঙ্গ বুদবুদ কিসের অভিমানে? এসো, দ্বিপাক্ষিক শপথে হই অম্লান। যে পথ বিভাজিত হয়ে দু’ দিকে চলে গেছে তাকে বলব, তুমি আমাদের মতো চমৎকার জুটিদের খুঁজে বের করে তাদেরকে হাতে হাত রেখে একত্রে কোনো গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যে অনুপ্রাণিত করো।
নেহাত শীতকালেই রাজকন্যার প্রস্তরীভূত অশ্রুতে ডাইনীবুড়ি আচমন সারে। হারিয়ে যাওয়া সবিশেষ কিছুর নির্ঘন্ট কখনো ঘণ্টাধ্বনির স্পন্দনে পলাতক স্মৃতিকে তালাস করেছে? মোহের মলাটে তবুও কাঠ-চেরাইয়ের দশানন কোনো শব্দ কর্ণকুহুরে স্থায়ী আবাস গড়ে অকুণ্ঠ চিত্তে। কলমিপাতার সমান কাঁপন মেলে দিয়ে একটি ধানটুনি উড়ে গেল উন্নাসিকতায়।
ঝিঁঝিঁপোকাদের মঙ্গলার্থে কোনো এক বিনীত সন্ধ্যায়, শতরঞ্জি থেকে উঠে আসা শান্ত প্রার্থনাসঙ্গীত আমি নির্ঘাৎ শিখে নেব। ফুসমন্তর আচ্ছন্নতা কি শাক্ত-পরিসরে কুরুবক ফুলের মতোই নিষ্পলক? আহা আমি আপন করে নিতে থাকি সময়হীন স্রোত, স্রোতহীন সময়।
আমরা কি সেই গহীন জাতি যারা প্রতিটি দিন ঘাড়ে ব্যাথা নিয়ে ঘুমুতে যাই; আর, ঘুম থেকে উঠে পোষা রুমালটা দিয়ে পাখি বানিয়ে গাছের মগডালে সাজিয়ে রেখে আসি? বিশ্বাসী শ্বেতপাথরের দেবতারাও নিরামিষভোজী হয় না। ঝড়ে বাগান বিধ্বস্ত। ঢেঁকিশাকের ফুলেই চলল বর্ষা দেবীর পুজো-অর্চনা এই দীর্ঘায়ু জ্যৈষ্ঠের কাপালিক ক্ষণে।
অষ্টাদশী কুমড়োফুলের উপমার যথার্থতা নিয়ে ভাবতে-ভাবতে কখন যে তোমাদের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি টেরই পায় নি। সাতসকালে ঠোঁটে শস্যের সুবাস মেখে পায়রারা ওড়ে আকাশ-বাতাসের সন্ধিস্থলে। সর্বাগ্রে পাতার গুমটি ঘর থেকে বেরিয়ে শিশিরের সৈকতে শালিকগুলো প্রাতঃভ্রমণে ব্যস্ত। অর্বাচীন সাইকেলে চেপে নতুন ডাকঘরের দরজায় চক দিয়ে লিখে এলাম আমার বাড়ির ঠিকানা। বিশেষ দ্রষ্টব্যে উল্লেখ করলাম– কেউ তো লিখুক চিঠি!
পড়ন্ত বেলায় মেসোপটেমীয় উচ্ছ্বাসে কোনো মৃন্ময়ী এসে বলল না, ‘আমাকে নিয়েও কবিতা লিখতে পারেন!’ ডুব-সাঁতারে অভ্যস্ত সাঁতারু কখনো কি ভুলে যায় ভেসে থাকার কৌশল?
সাগরে ডুবে-যাওয়া জাহাজের কেবিনে লবণদানি দেখে বিস্ময়ে-সন্তপ্ত একটি তারামাছ ভেবেছিল– মানুষ বড়ো রহস্যময় প্রাণী। কে তার নোনতা পাপকে জনপ্রিয় স্বাদুজলে ধুয়েধুয়ে বেলা করে দিল পার? জুতোর গোঁড়ালিতে ক্ষয়রোগ দেখা দিলে মুচিবাড়ির দূরত্ব কমে আসে। শিরদাঁড়া জেনে যায় পায়ের আঙুলের গুরুত্ব কতখানি। হাটের জমকালো দোকানে সাজানো আলতা-শিশিটার বড়ো সাধ হয়– একদিন ঘুরতে যাবে কোনো রাঙাবধূর বাড়ি। নদীর ওপাড় থেকে ভেসে-আসা ভাসানের গান কেড়ে নিল বৈঠার বিশ্বস্ত ঘুম। নির্ঘুম তাঁবুদের পৃথিবীতে সকলে সৈনিক। যুদ্ধ ওদের জাতীয় খেলা।
দু’ দণ্ড দাঁড়িয়ে একটি অতীন্দ্রিয় কাঠবেড়ালি যাবতীয় ঘাসের সম্ভ্রান্ত সুনামিতে হারিয়ে গেল। দেখি– সুপুরিবনে লেগে আছে সবুজ শ্রাবণ। নিষ্ঠার মজ্জাতে কুমোর গড়ে আবেগের টেরাকোটা। দক্ষ হাতে রাজরানীর প্রতিমাতে পরিয়ে দেয় লাবণ্যের ত্রিকোণ ঝলক। তবু অনন্য তার স্বপ্নগুলো শাদা বক হয়ে চক্রাবর্তের সলীলে উড়ে যাবে দূর অজানায়। (চলবে…)