একটা সত্যিকার সাংঘাতিক গল্প।
মানুষটির বয়স যখন ছয় কী সাত; তখন তাকে ছাদের একটি ঘরে আঁটকে রাখা হয়। কিছু বই দিয়ে বলা হল, তুমি এখন বন্দী। বই পড়। হাইস্কুলে যেদিন উঠবে সেদিন এই ঘরের চাবি খুলে দেয়া হবে।
ছেলেটি পড়া শুরু করল। খাটের উপরে বসে পড়তে শুরু করল স্বর বর্ণ – ব্যঞ্জন বর্ণ… হাইস্কুলে উঠলেই ছাদের দরজা খুলে যাবে। দরজা খোলা জরুরী। বড়দের মত যখন ইচ্ছে একা একা সাহাব স্টোরে যাবার জন্য হলেও জরুরী।
হাইস্কুলে উঠার পর সত্যি সত্যি ছাদের দরজা খুলে দিল। সিলিং ছাদের বদলে নীল নীল এগুলো কী? আকাশ! কী সর্বনাশ! আকাশের বুকে আবার নীল নীল বাতি কেন! ডিম লাইট নাকি? নক্ষত্র!
ছেলেটি ছাদ থেকে নিচে তাকিয়ে দেখে কত মানুষ রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছে! পৃথিবীতে এত মানুষ! এদের সবার বাবা মা আছে! পরিবার আছে! প্রত্যেকের একটি করে ঠিকানা আছে! কী চমৎকার নকশা!
ছাদ থেকে নামতে গিয়ে দেখে সিঁড়ী ঘরে একটি কলাপ্সিবল গেট লাগানো। গেট ধরে ঝাকি দিতেই একজন এসে কিছু বই দিয়ে গেল!
‘ গেট খুলে দিন। আমি রাস্তায় যাব’
‘যেতে চাইলেই তো যাওয়া যায় না। তোমার আরো কিছু দায়িত্ব আছে। এই বই গুলো পড়। অংক আছে। জ্যামিতি আছে। ম্যাট্রিক পাশ করতে হবে। কলেজে উঠে গেলেই একেবারে স্বাধীন তুমি; এই গেট খুলে যাবে’।
চার পা ওয়ালা টেবিলের উপর বসে পড়া শুরু করল- চৌবাচ্চর পাটিগণিত। কলেজে উঠা মানেই চিকন চিকন নতুন গোঁফের রেখা। একেবারে বড়দের মত যখন ইচ্ছে আনামস প্লাজায় চলে যাওয়া। ভাবতেই গা শিওরে উঠে… কবে বড় হবে সে! বড় হওয়া জরুরী; ছোট হওয়া থেকে মুক্তির জন্য হলেও জরুরী।
সদ্য গজানো গোঁফের রেখা নিয়ে নতুন নতুন প্রেমে পড়ার জগত! কী আশ্চর্য অনুভূতি! কাউকে পেয়ে অথবা না পেয়ে এত আনন্দ হয় কেন!
ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে রেকর্ড প্লেয়ারে অঞ্জনদা ছেড়ে দিলেই মরে যেতে ইচ্ছে করে! কি আশ্চর্য! মরে যেতে এত ভাল লাগে কেন!
কলাপ্সিবল গেট খুলে দেয়া হল। সিঁড়ি দিয়ে চাইলেই নেমে আসা যায়। সন্ধার সাথে সাথে বাসায় ফিরতে হবে বলে তাড়া থাকে না। বড়দের মত দু একবার সিগারেট খাবার পরেও তাকা বুঝিয়ে দেয়া হল তুমি এখনো বড় হও নি।
‘ কেন?’
‘ তোমাকে আরেকটু পড়ালেখা করতে হবে। এটাই শেষ। এর পর তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন’
‘ তখন আমি যা ইচ্ছে করতে পারব?’
‘ হুম পারবে’
‘দূরে গিয়ে নিজের মত করে স্বপ্ন বানাতে পারব?’
‘ পারবে…’
চার পা ওয়ালা টেবিলের উপর বসে পড়া শুরু করল- বিশ্ববিদ্যালয়ের বই। প্রতি বছর বছর ক্যালেন্ডারে কত কিছু হারিয়ে যায় … বেটম্যানের স্টিকার , আলিফ লায়লা, এক টাকার দশটা মার্বেল … কাঠপেন্সিল ছেড়ে গেল; বলপয়েন্ট এল।
আর কিছুদিন পরেই দেশের সর্বচ্চ ডিগ্রীর সার্টিফিকেট ফ্রেমে করে দেয়ালে বাঁধানো যাবে। এরপর পুরোপুরি স্বাধীন।
রাত করে বাড়ি ফিরলেও কেউ কিছু বলবে না। কাউকে পছন্দ হলে তাকে বিয়ে করার ব্যাপারটা মাথায় রাখা যাবে; এই বয়সে চাইলেই বিয়ে করা যায়!
ইচ্ছে করলেই কলেজ লাইফের রুনাকে নিজের কাছে নিয়ে আসা যাবে। সে একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাবে! এঘরে ওঘরে হেঁটে বেড়াবে! কি আশ্চর্য !
বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করার পর সে সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেলল। শোবার ঘরে দুটি ছবি ফ্রেমে করা বাঁধানো। একটি তার বিবাহের অন্যটি সর্বচ্চ ডিগ্রী ওয়ালা ছবি।
সেই বন্ধ ছাদ ঘর। বন্ধ কলাপ্সিবল গেট… সব খুলে গেল। আজ সে বের হবে। সে আজ মুক্ত! সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার পর বাসার মেইন গেটের কাছে এসে দেখে তালা ঝুলছে !!!
আর তো পড়ালেখার কিছু নেই! নিশ্চয়ই কারো কোথাও ভুল হচ্ছে…
তাকে বোঝানো হল; তুমি এখনো পুরোপুরি স্বাধীন না। তোমার কিছু দায়িত্ব আছে তো ব্যাটা… বিয়ে করেছো… সন্তান হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই সময়টা তোমার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর না। এটা সেটেল হবার সময়।
মানুষটি দশ বছর ধরে নিজেকে অনেক প্রতিষ্ঠিত করার পর গেট খুলে দেয়া হল। কি পেল জীবনে!!! কোলকাতার জোছনা ! ট্রেনের কেবিনের গল্প! মাছ ধরা সুনামগঞ্জের পুকুর! আহাআ… রাস্তায় কত মানুষ হাঁটছে! এরা কেউ সুখী না! এদের সবার একটি করে ভুল ঠিকানা আছে।
গলির রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় যাবার পরেই তাকে আঁটকে দেয়া হল…
আমাকে আটকালে কেন! চল্লিশ বছর ধরে তোমাদের কথা শুনেছি। এখন অন্তত আমাকে মুক্তি দাও!
আপনে এখন আর শুধু আপনার না। আপনার সন্তান আছে। তারা বড় হয়েছে… তাদের ভবিষ্যৎ আছে।
একটি বাড়ি বানিয়ে যান… কিছু টাকা ব্যাংকে জমা থাকুক তাদের জন্য… তারা সুখ পাবে।
মানুষটি সারা জীবন নিজের মত করে একটু সময় কাটাতে চেয়েছিল! মরে যাবার দশ মিনিট আগেও সেই সুযোগ তিনি পান নি।
এই গল্পটি শুধু মাত্র একজন মানুষের না; এই গ্রহের সব মানুষের গল্প এটি…………….
নীলিকা নীলাচল
সময়:—– ভোর :—–৫:৩০