বেশ কিছুক্ষন ধরে ফোনটা বেজে চলছে একনাগারে। কিন্তু অফিসে কাজের ব্যস্ততা এত বেশী মিশা সময় করে উঠতে পারেনি কলটা রিসিভ করার । যখন হাতের কাজগুলো সেরে মোবাইলটার দিকে চোখ পড়লো সে দেখলো একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে বেশ কয়েকবার কলটি এসেছে। তাই সে কল ব্যাক না করেই আবার কাজে ডুবে গেল। মিশা কাজ করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ।
একটা ডিপার্টমেন্টের জিএম হিসাবে। ডিপার্টমেন্টের হেড হিসাবে অফিসের হয়ে বিদেশী বায়ারদের সাথে যোগাযোগটা তারই করতে হয়। অথবা বায়াররা যখন আসে তাদের থাকা থেকে কনফারেন্সের ব্যবস্থা করাও তার দায়িত্ত্বের মধ্যেই পড়ে। আর মাঝে মাঝেই যেতে হয় দেশের বাইরে কোম্পানীর প্রতিনিধি হিসাবে সেমিনার বা ট্রেনিংএর জন্য। আর এত পরিশ্রমের বিনিময়ে সে পাচ্ছে মোটা অঙ্কের বেতনসহ নতুন মডেলের সার্বক্ষণিক গাড়ী, প্রতি তিন মাস অন্তর বিনা খরচে বিদেশ ভ্রমনের সুযোগ। নিজের যোগ্যতা দিয়ে আদায় করে নিয়েছে কোম্পানীর মালিকসহ সকলের শ্রদ্ধা । মিশার এই সাফল্যমন্ডিত কর্মজীবনের জন্য তাকে নিজেকে তৈরী করতে হয়েছে একটু একটু করে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর যখন সে ক্লান্ত দেহে নিজ গৃহের কড়া নাড়ে দরজা খোলার পরেই দেখতে পায় উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষারত মায়ের মুখ। সে মাকে খুশি করার জন্য প্রতিদিনই বাসায় কিছু না কিছু নিয়ে আসে। কিন্তু মায়ের তাকে নিয়ে উৎকণ্ঠা কিছুতেই কমাতে পারে না। মা ভাবেন তিনি গত হলে কে ওকে দেখে রাখবে! মেয়েকে তিনি সুখী দেখতে চান। দেখতে চান তার মেয়ের স্বামী সন্তান নিয়ে ছোট একটা সংসার। মিশাও দেখেছিল তার মায়ের মত এমন স্বপ্ন। কিন্তু সবার স্বপ্ন তো বাস্তবে রূপ পায় না।
বিশ বছর আগে মিশা ইউনিভার্সিটির শেষ ধাপটি পার করে চাকুরী শুরু করেছিল একটি বিদেশী কোম্পানীতে । কাজের সুবাদে পরিচয় হয় হাসি নামের এক মেয়ের সঙ্গে। মিশা সব সময়ই ছিল খুব উচ্ছ্বল আর প্রানবন্ত । হাসি খুব কাছ থেকে ওকে দেখতে থাকে। হাসির খুব পছন্দ হয় ওকে । সে মিশাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয় তার ভাইয়ের জন্য। হাসির ভাই রবিন আমেরিকা থেকে পিএইচডি করছে ফিজিক্সে। দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য। হাতে একদমই সময় নেই। হাসি তাই চাচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখাশুনার কাজটা শেষ করে বিয়েটা দিয়ে দিতে। মিশা ওর পরিবারের সবাইকে বিষয়টা জানায়। সবাই ভাবে এত ভাল পাত্র হাত ছাড়া করাটা ঠিক হবে না। তাই এক সপ্তাহের মধ্যেই দুপক্ষের দেখাদেখি শেষ করে বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। গায়ে হলুদ আর বিয়ের দিনেই চোখে পড়ে মিশার পরিবারের সবাই কেমন যেন তটস্থ আছে বরের পক্ষের মন রক্ষায়। তাদের আগে থেকেই ধারনা দেয়া হয়েছে, বরের পরিবারের লোকজন কোনটা পছন্দ করে আর কোনটা পছন্দ করে না। মিশার পরিবারের সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে ভালভাবে মেয়েকে তুলে দিতে । রবিনের বাবা মা পুরান ঢাকায় থাকে তার অন্যান্য ভাই বোনের সাথে। মিশা তার চাকুরী ছেড়ে দেয় পরিবারের সবার কল্যাণের স্বার্থে। তার প্রথম দুই মাস কাটে স্বপ্নের মধ্যে। রবিন দুমাসের ছুটি শেষে আবার পাড়ি জমায় আমেরিকা। মিশার কাধে পড়ে তার বিশাল সংসারের দায়িত্ব। তার বৃদ্ধ বাবা মায়ের দেখাশুনা। এক হাতে সংসার সামলাতে গিয়ে সে হিমশিম খায়। রবিন ফোন করে ঠিকই কিন্তু মিশার সুজোগ হয়ে উঠে না নিরিবিলি দুটো কথা বলার। রবিন যখন পরিবারের অন্যদের সঙ্গে কথা বলে তখন তারা বৌএর দোষগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ধরে তার কাছে। প্রথম প্রথম রবিন সেগুলো বিশ্বাস করেনি। কিন্তু কান কথা একদিন, দুইদিন, তারপর? তারপর আস্তে আস্তে রবিনের মধ্যে গেথে যেতে থাকে তা। সে বিশ্বাস করতে থাকে স্ত্রীর বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে বলা কথা গুলো। নিজের পরিবারের সদস্যদের কথায় তার মন ভারি হয়ে আসে। কঠিন হতে থাকে তার মন।
এভাবে ধীরে ধীরে মিশার সাথে রবিনের তৈরি হতে থাকে দু্রত্ব। একটা পর্যায়ে ঐ বাড়ির প্রতিটি সদস্য তার সাথে প্রচন্ড দুঃব্যবহার শুরু করে। আর রবিনও ধীরে ধীরে মিশার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। মিশা এমন মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে চলে আসে উত্তরা বাবার বাড়িতে। তার কিছুদিন পরেই সে রবিনের কাছ থেকে পায় ডিভোর্স লেটার। সে মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়ে ।
সময় যেতে থাকে সে মনকে শক্ত করে । সে আবার শুরু করে কাজ। অফিসে কাজের মধ্যেই ডুবে থাকতে পছন্দ করে। সে কাজ করে একাগ্রতা আর সততা দিয়ে। কোম্পনীর এমডি ওর উপর যে কোন কাজ দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে করেন নিজেকে। তাই তো তার অবর্তমানে মিশা যেকোন সিদ্ধান্ত দিতে পারে নিজের মত।
বিকেলে অফিস থেকে বের হতে যাবে এমন সময় মিশা দেখে একটা লোক তার দিকেই এগিয়ে আসছে । সে থমকে দাঁড়ায়। লোকটা এগিয়ে এসে হেসে বলে “ ভাল আছো মিশা?”
মিশা হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ে।
সে বলে “আপনি?”
লোকটা বলে, তুমি আমাকে আপনি বলছো কেন? তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না?
আমি রবিন । সেই দুপুর থেকে গেটের বাইরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। তোমাকে এতবার ফোন দিলাম তুমি ফোনটাও ধরলে না। তুমি কি আমাকে আধা ঘন্টা সময় দেবে?”
মিশা বলে, চিনতে পারছি। কিন্তু এখুনি যে আমাকে বাসায় যেতে হবে।
রবিন বলে “আমি কি তোমার সাথে তোমার বাসায় আসতে পারি? তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। আমি তোমার সঙ্গে ভীষণ অন্যায় করেছি। আমি বুঝতে পারছি না আমি এর প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে করবো? তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে? আমাকে কি আর একবার সুজোগ দিবে মিশা?”
মিশা হাসি মুখে বলল , “ না আপনাকে আর সুযোগ আমি দিতে পারি না। আমার জীবনের বিশটা বছর কি আপনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন? মুখোশের আড়ালের যে মানুষদের আমি দেখেছি তাদের চেহারা কি আমি ভুলতে পারবো? না তা আর কখনোই সম্ভব নয় । – বলে মিশা বের হয়ে আসে রুম থেকে। রবিনও বের হয়ে আসে ।
মিশা তড়িঘড়ি করে উঠে যায় গাড়িতে।