রাতটা খুব অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে প্রিয়ন্তির। রাতটা যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিলো। তার ঘুম আসছিলো না বলে সে তার রুমের সাথে লাগানো ছোট্ট বারান্দাটায় বসে ছিল চুপচাপ। দেখছিল অন্ধকার রাতের সৌন্দর্য। পাশের বিল্ডিং থেকে ভেসে আসছে ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজানো রবীন্দ্রসঙ্গীত “ বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিলো সেকি আমারই পানে ভুলে পড়িবে না…” । গানের সুর আর কথায় সে যেন হারিয়ে গিয়েছিল দূরে বহু দূরে।
বড় ভাই ভাবী আর ছোট্ট শায়নকে নিয়ে প্রিয়ন্তির পরিবার । ভাই ভাবী দুজনই সরকারী অফিসে কর্মরত। প্রিয়ন্তির সাথে তার ভাবীর সম্পর্ক বন্ধুর মত। প্রিয়ন্তি সদ্য মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে বাসায় আছে। বিভিন্ন জায়গায় চাকুরীর আবেদন করছে । ইন্টারভিও দিচ্ছে। একটা কোচিং সেন্টারে পারটাইম ক্লাশ নিচ্ছে । সবকিছু মিলিয়ে কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। যদিও বড় ভাই আর ভাবী তাকে চাকুরী নিয়ে এত ব্যস্ত হতে নিষেধ করছেন।
তার সম্বিৎ ফিরে এল এক মায়াময় কন্ঠস্বরে। “ প্রিয়ন্তি ঘুম আসছে না? কি করছো একা বসে?” সে পিছনে তাকিয়ে দেখে তার ভাবী দুটো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রিয়ন্তি কিছু বলার আগেই ভাবী চায়ের কাপটা হাতে দিয়ে বলল “ আস চা খেতে খেতে গল্প করি।” প্রিয়ন্তি বলল “ তুমি উঠেছ কেন?” ভাবী বলল শায়নকে খাওয়াতে উঠেছিলাম । দেখলাম তুমি বসে আছো । তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি। তোমার কি খুব মন খারাপ?” না তুমি কিছু নিয়ে চিন্তা করছো? কোন সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পার। “ না না আমার কোন মন খারাপ না। আমি ভাল আছি । কাল আমার কোচিং সেন্টারে একটা প্রোগ্রাম আছে। ওটা নিয়েই চিন্তা করছিলাম।” ওদের গল্পের মাঝখানে শায়ন কেঁদে উঠায় ভাবী তড়িঘড়ি করে ভিতরে চলে গেলন। আর প্রিয়ন্তি আরো কিছুক্ষন বসে থেকে রুমে এসে শুয়ে পড়লো। তারপর সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি।
সকালে যখন তার ঘুম ভাঙ্গল তখন প্রায় নয়টা বাজে। প্রিয়ন্তি তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে যখন ড্রয়িং রুমে আসলো । ভাবী বলল বাহ সবুজ শাড়ীতে তো তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। দাঁড়াও দাঁড়াও একটা কাল টিপ দিয়ে দেই। সত্যি সত্যি ভাবী তাকে একটা কাল টিপ পরিয়ে দিল।
প্রিয়ন্তি বাসার নিচে থেকেই একটা রিক্সায় উঠে বসলো । সে এলিফ্যান্ট রোড কোচিং সেন্টারে না গিয়ে রিক্সাওয়ালাকে শাহবাগ মোড়ে যেতে বলল। পথের জ্যাম আর বাড়ে বাড়ে রিক্সার চেইন পড়ে যাওয়াটা অসহ্য লাগছিল তার। তার অস্থিরতা দেখে রিক্সাওয়ালা বলল “ আফা আফনে অস্থির হইলেও যেই সময় লাগবো । চুপচাপ মাথা ঠান্ডা রাখলেও সেই সময়ই লাগবো।” সে রিক্সাওয়ালার কথায় হেসে ফেললো। বলল আপনের কথাই ঠিক চাচা। আর অস্থিরতা করতেছি না। আপনি চালান আপনার মত।” রাস্তার ধকল পার করে যখন শাহবাগ পৌছলো তখন ১১টা ছুঁই ছুই করছে। সে রিক্সা থেকে নামতেই দেখল সজল দাঁড়িয়ে আছে এক তোড়া রংবেরঙের ফুল হাতে করে। ফুলের তোড়াটি এগিয়ে দিতে দিতে বলল “ শুভ জন্মদিন প্রিয়। আজ তোমাকে পরীর মত লাগছে। আর একটু দেরী করলে তো আমি মনের দুঃখে বনে চলে যেতাম। আমি ভাবছিলাম তুমি হয়ত আসবেই না।” প্রিয়ন্তি এত মিষ্টি করে হাসছিল যেন সজলের সব কথার উত্তরই ওর ঐ হাসিতে লুকিয়ে আছে। সজল প্রিয়ন্তিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল “ আজ তোমার একটা বিশেষ দিন আমি সেটা তোমার জন্য রাঙিয়ে তুলবো। তুমি কিছু বলবে না।”
প্রিয়ন্তি হেসে বলল “ ঠিক আছে জনাব। মানলাম আপনার কথা । আমার কিন্তু তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। এটুকু খেয়াল রাখলেই চলবে। “
সজল ছুটাছুটি করে একটা অটোরিক্সা ঠিক করে ফেললো উত্তরার উদ্দেশে । সিএনজি চলছে তপ্ত ঢাকার মধ্য দিয়ে। হাজার হাজার মানুষের কর্মব্যস্ততা, যানজট, হকারের ডাকাডাকিকে পিছনে ফেলে। আজ যেন ওদের কোন তাড়া নেই। পৃথিবীর কারো দিকে তাকাবার প্রয়োজন নেই। দুইজন সুখী মানুষ যেন শুনতে চায় দুজনের না বলা কথা গুলো। দুজনই তাকিয়ে থাকে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে। দুজনই বাস্তবতায় ফিরে আসে সিএনজি চালকের ডাকে। “ স্যার এই রেস্টুরেন্টের কথা কইছেন? “
সজল বলে হ্যাঁ ঠিক আছে। এখানেই থামান। সজল ভাড়া দিয়ে হাত ধরে প্রিয়ন্তির। প্রিয়ন্তির খুব লজ্জা লাগে। সে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। সে এগিয়ে যায় সজলের হাত ধরে। রেস্টুরেন্টের পরিবেশটা এত সুন্দর প্রিয়ন্তির মনে হয় তার জমানো সব কথা সে তার প্রিয় মানুষটিকে ইচ্ছে করলেই বলতে পারে। কিন্তু সে কিছুই বলে না । শুধু দেখে যায় তার পছন্দের মানুষটির উচ্ছাস , আনন্দ আর মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকা। ওয়েটার যখন মেনু বুক এগিয়ে দেয় সজল প্রিয়ন্তির উপর ছেড়ে দেয় মেনু পছন্দের দায়িত্ব। সে দুজনের পছন্দ মিলিয়েই খাবারের অর্ডার দেয়। সজল তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এঁকে ফেলে খাবার টেবিলে বসেই। সে বিশাল জায়গার উপর বাড়ি বানাবে। সেখানে থাকবে একটা পদ্মপুকুর। সেই পদ্মপুকুরে থাকবে শান বাধানো ঘাট। মাঝে মাঝে পূর্ণিমার রাতে তারা এসে বসবে সেই ঘাটে। গল্পে গানে পার করবে রাত। তাদের গল্পের তরে সময় যে কখন পার হয়ে যাচ্ছে দুজনের কেই সেটা খেয়াল করেনি।
এভাবে খাওয়ার পর্ব শেষ করে যখন প্রিয়ন্তি বাসায় যাওয়ার কথা বলে সজলের মনে হয় এতদুর এসে আব্দুল্লাহপুর গিয়ে একটু নৌভ্রমন না করলে কেমন হয়। সে খুব অনুরোধের সুরে বলে “ প্রিয়ন্তি আমার এই ইচ্ছাটা একটু পুরন করতে দাও। প্রিয়ন্তি সজলকে না করতে পারে না। ওরা রিক্সায় করে অলিগলি ধরে যায় খেয়াঘাটে। ওরা উঠে নৌকায়। খোলা আকাশের নীচে অথই পানিতে ভাসছে নৌকা। চারিদিকে সূর্যের তেজ কমে এসেছে। বাতাসে প্রিয়ন্তির চুল মুখে এসে পড়েছে । সে নৌকা থেকে পানিতে হাত রাখছে। সজলের কাছে মনে হচ্ছে এটা যেন তার চোখে দেখা শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। দূর আকাশে উড়ে সাদা বক আর পানিতে জলকেলি করছে হাঁসের দল।
সজলের চোখ ভিজে আসছে ভাল লাগায়। সূর্য যেন কিছুটা ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। প্রিয়ন্তি ভয় জড়ানো চোখে তাকায় সজলের দিকে। সজল বলে কি হয়েছে প্রিয়? প্রিয়ন্তি মন খারাপ করে বলে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সবাই তো চিন্তা করবে। আমি কি বলব? সজল তাকে অভয় দিয়ে বলে “একদিন একটু দেরিতে বাসায় গেলে কিছু হবে না। তুমি চিন্তা কর না।” সজল প্রিয়ন্তিকে পৌছে দেয় বাসার নীচ পর্যন্ত। প্রিয়ন্তি তটস্থ পায়ে সিড়ি বেয়ে উঠে উপরে।
সে যখন দরজা নক করে হাতে ফুল নিয়ে, ভাবী দরজা খুলে জানায় তার বড় ভাই তার কোচিং সেন্টারে গিয়েছে খোঁজ নিতে। খোঁজ নিতে যাওয়ার আগে তাকে অনেক প্রশ্ন করেছে। সে কোন উত্তর দিতে পারেনি। প্রিয়ন্তির যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সে বুঝতে পারে না তার জন্য কি কঠিন মুহূর্ত অপেক্ষা করছে !!!