বগুড়া সদর থানার এস আই রফিকুল ইসলাম আয়েস করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় সিগারেট টানছেন। বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। যারা সিগারেট খোর, বৃষ্টির পটভূমিকায় চায়ের সাথে তাঁদের সিগারেটের নেশা বেশ জমে ওঠে। রফিকুল ইসলামেরও হয়তো তাই হয়েছে। তিনি সিগারেটে জোরে টান দিয়ে এবার সামনের চেয়ারে বসে থাকা রাজনের দিকে মরা মাছের মতো ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। রফিকুল ইসলাম বললেন, ‘তোকে দুমিনিট সময় দিচ্ছি, এই সময়ের মধ্যে ভালোই ভালোই যদি না বলিস তোদের আন্দোলনের টাকাপয়সার যোগান দিচ্ছে কে, তবে একটি একটি করে তোর হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলা হবে। বল, শালার বাচ্চা তোদের বাপ কে? জামাতে ইসলাম নাকি ইসলামী কোনো জঙ্গি সংগঠন?

এই কিছুক্ষন আগেও রফিকুল ইসলাম রাজনের সাথে আপনি করে কথা বলেছিলেন। এখন কথাবার্তায় এস আই রফিকুল ইসলাম ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ কে ডিঙিয়ে একেবারে ‘তুই’ তে নেমে এসেছেন। থানার অফিসারদের ক্ষেত্রে এটি একটি সাবধানী বার্তা। রাজন চোঁয়াল শক্ত করে জবাব দিল, ‘আমি কোনো রাজনীতির সংগঠন করি না। আমরা আন্দোলন করছি আমাদের দাবি নিয়ে, কোটা সংস্কারের জন্য। আমরা মেধা থাকা সত্ত্বেও সরকারি চাকরি পাবো না তা হতে দেয়া যাবে না, আমরা বলছি না, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়স্বজনদের কোটা একেবারে বাতিল হোক, আমরা চাচ্ছি সেই কোটার সংখ্যা আরো কমিয়ে আনা হোক। এবার রফিকুল ইসলাম উত্তেজিত হয়ে খপ করে রাজনের হাত চেপে ধরে সেই জ্বলন্ত সিগারেট ঠেসে ধরে বললেন, ‘শালা রাজাকারের বাচ্চা, বল, তোদের সাথে আর কে কে আছে?

যে কারণে রাজনকে থানায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছে সেটি শোনা যাক। রাজন ও আফতাব একটি মিছিল নিয়ে পোষ্ট অফিসের দিক থেকে সাত মাথার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করে ওদের মিছিলে পুলিশ চার্জ করে বসে। আফতাব রাজনের গায়ের সাথে ঘেঁষে হাঁটছিলো। কানে প্রায় তালা লাগানোর মতো গুলির শব্দে রাজন দেখলো আফতাব মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আফতাবের কোমরের নিচ থেকে ফিনকি দিয়ে গল গল রক্ত পড়ছে। রাজন ঝুঁকে আফতাবকে টেনে তুলতেই এক পুলিশ রাজনের হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে পুলিশ ভ্যানে তুললো। রাজন পুলিশের গাড়িতে ওঠার আগমুহূর্তে পেছনে তাকিয়ে দেখলো তাঁর প্রাণের বন্ধু আফতাবকেও আরেকটি গাড়িতে তোলা হচ্ছে। আফতাব কি বেঁচে আছে ? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আফতাবকে ? রাজন শুনেছে এই কয়েকদিনে অনেক লাশ গুম করে দেয়া হয়েছে। তবে কি আফতাবকেও …!! আর ভাবতে পারছে না রাজন, সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।

রফিকুল ইসলামের সিগারেটের ছেঁকায় রাজনের ডান হাতের কনুইয়ের কাছাকাছি মুহূর্তেই লালচে দগদগে হয়ে উঠলো। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো রাজন তবে চিৎকার করলো না। এদের কাছে চিৎকার করে কোনো লাভ নেই। দাঁতে দাঁত চেপে রাজন চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে এদেশে পথে ঘাটে তাবু খাঁটিয়ে পাকসেনারা ক্যাম্প বসাতো। সে সমস্ত ক্যাম্পে যুবকদের ঘর থেকে ধরে আনা হতো । মুক্তিযোদ্ধাদের উর্দু ভাষায় মুখ খারাপ করে গালি দিয়ে বীভৎস কায়দায় যখন টর্চার করা হতো, তীব্র যন্ত্রনায় কাতর মুক্তি যোদ্ধাদের আর্ত চিৎকার অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যেত । মাঝে মাঝে সেসব চিৎকারের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পেত। শান্তিপন্থী কিছু টুপিওয়ালা শ্রেণী মানুষরূপী জানোয়ারেরা পাকসেনাদের সাথে আপোষ করে পণ্য সরবরাহের মতো করে রমণী সরবাহ করতে দেখা যেত। রাতের আঁধারে শিকারী পেয়ে খাঁকি পোশাকের জন্তুরা যেন উম্মাদ হয়ে উঠতো। সেই জন্তুদের পৈশাচিক বুনো উল্লাসের মাঝে ক্যাম্প থেকে ভেসে আসতো বাংলা মায়েদের করুন আর্ত চিৎকার। কেঁপে কেঁপে উঠতো বাংলার আকাশ বাতাস। মাঘ মাসের পূর্ণিমাও যেন ম্লান দেখাতো। অপমানিত চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢেকে থাকতো। এসব হচ্ছে ইতিহাস। এই জি -জেন যুবকেরা এসব ইতিহাস দেখেনি তবে অসংখ্যবার শুনেছে এক ব্যক্তি ও তাঁর দল এই দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। এই বয়ান শুনিয়ে শুনিয়ে পর্দার আড়ালে থেকে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে মন্ত্রী, আমলারা এবং সেই সরকারপন্থী পার্টির নেতা নেত্রীগণ রক্ত চোষা বাদুড়ের মতো দেশের সম্পদ চুষে নিয়েছে। মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস কে পুঁজি করে,মুক্ত যুদ্ধের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে টাকার পাহাড় বানিয়েছে।

লেবুকে কচলিয়ে কচলিয়ে যেমন তিতা করা হয়, এই ইতিহাসের কথা কচলিয়ে কচলিয়ে তিতা হয়ে উঠেছে জি-জেন যুবকদের কাছে। এক ইতিহাস থেকে জন্ম নেয় আরেক ইতিহাস। সেখান থেকে আরও। এভাবে ফিবোনাক্কি রাশিমালার মতো ধাপে ধাপে বেড়ে ওঠা নতুন নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে হয় হতবাঘা এই নির্বাক নিথর ধরণীকে। বগুড়া শহরের অদূরে করতোয়ার কোলে দাঁড়িয়ে থাকা বেজোড়া ঘাটের সেই প্রবীণ অশ্বত্থ গাছকে এরকম কালের সাক্ষী হয়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে দেখা যায়। আমরা মানুষেরা সুখ-দুঃখের কথা অন্যের সাথে শেয়ার করি। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করি। গাছেদের সেরকম নিয়ম আছে কি না জানা নেই। হয়তো আছে যা আমরা মানুষেরা বুঝতে পারিনা। স্কুলের ছেলেমেয়েরা সুর করে গায় কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে ……….। এক সময়ের বিশালতা থেকে ক্রমশ সরু হয়ে আসা করতোয়ার ছোট্ট ছোট্ট ডেউয়ের উপরে সেই বট গাছের আকৃতির তুলনায় ক্ষুদ্রাকার পাতাগুলো ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যায় শহরের দিকে অথবা শহর থেকে আরও অনেক অনেক দূরে।

ময়েজ উদ্দিন সাহেব বগুড়া শহরের রহমান নগরে অবস্থিত ফুড অফিসের হেড ক্লার্ক। তিনি আজ কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না। বড়ো স্যার একটি ফাইল দেখে দুপরের মধ্যে জমা দিতে বলেছিলেন। বেলা সাড়ে বারোটা বাজে, সেই ফাইলের অর্ধেকও দেখা হয়নি। পিয়ন ফয়েজ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো স্যার, ভাবি নিচে কাঁদতে কাঁদতে আপনার জন্যে অপেক্ষা করেছে। মনে হয় কোনো খারাপ খবর। মাঝ বয়সী ময়েজ উদ্দিন উদ্ভ্রান্ত হয়ে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে দোতালার সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলেন। স্বামীকে দেখে নাবিলা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন তাদের ছেলে আফতাবের পায়ে গুলি লেগেছে, ও এখন মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আছে। আফতাবের মতো সারা দেশের হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে শত শত আফতাব দেশরক্ষাবাহিনীর গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। শত শত আবু সাঈদেরা প্রতিদিন পাখির মতো গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছে। পরাধীন দেশের ৭১ স্বাধীন দেশে বিশ্বাসঘাতক কিছু শকুনের বাহনে ভিন্ন পরিচয়ে যেন আবারও ফিরে এসেছে।

স্বদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে দেশের এই মহা সংকটকালে তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে এক একটি সকালে ইন্টারনেটে চোখ বড়ো বড়ো করে ফেসবুকের পোষ্ট দেখি, দেশের খবর দেখি । এই বুঝি আরও খারাপ খবর এলো। এই বুঝি আরও নিরীহ ছাত্রদের মেরে ফেললো স্বৈরাচার সরকারের পেটোয়া বাহিনী। স্বাধীনতার পরে বিডিআর এর সেই নিশৃংস হত্যাকাণ্ডের পরে এত মানুষের এভাবে মৃত্য বাংলাদেশের জনগণ আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। দেশের সরকার প্রধান দেশের সবচেয়ে গুর্রুত্ব ও দায়িত্বপূর্ণ চাকুরী। অথচ দেশে দেশে ক্ষমতার শীর্ষস্থানীয় মহাগুরুত্বপূর্ণ এই পজিশনের চাকুরীরত মানুষকে ক্ষমতা এতটাই লোভাতুর ও হিংস্র করে ফেলে যে এঁরা ক্ষমতায় আঁকড়ে ধরার জন্য দেশের শত শত মানুষকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু মানুষের আবাসস্থল এই পৃথিবীকে যিনি পরিচালনা করনে, এই মহাবিশ্বকে যিনি পরিচালনা করেন সেই সৃষ্টিকর্তার কিছু বিশেষ হিসেবনিকেশ থাকে। থাকে কিছু বোঝাপড়া। এই পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম অনেক বোঝাপড়ার ইতিহাস আছে। জগৎ জুড়ে রাজনীতিবিদগণদের তাই বারবার ভুল করতে দেখলেও সৃষ্টিকর্তার সেই বোঝাপড়ার ইতিহাস থেকে এনাদেরকে শিক্ষা নিতে কখনো দেখা যায় না।

গভীর রাতে কিছু বগুড়াবাসী শুনতে পেলেন সদর থানার বিশেষে কক্ষ থেকে রাজনসহ আরও অনেক মেধাবী তরুণদের গোঙানির ভয়ার্ত শব্দ ভেসে আসছে । থানা থেকে আরও আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণে মোহাম্মদ আলী সদর হাসপাতালের চত্বরে ময়েজ উদ্দিন আর নাবিলার কান্নার আহাজারি শোনা যাচ্ছে। এই মাত্র সার্জন জানালেন তাদের একমাত্র সন্তান আফতাবের জ্ঞান ফিরলেও তার বাম পা সম্পূর্ণ কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। চিরদিনের জন্যে ছেলের অঙ্গহানির জন্য বাবামায়ের আহাজারিতে আশেপাশে কিছু মানুষ জটলা পাকিয়ে ওনাদের ঘিরে ধরেছে। গত কয়েকদিনে স্বাধীন বাংলাদেশে একেকদিন এরকম অনেক অনেক বাবা-মায়ের আহাজারিতে বাংলাদেশের বর্ষা কালের আকাশ বিষাদের কালো মেঘে ক্রমশঃ ছেয়ে যাচ্ছে।

দেশের ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও আমি যে দেশে থাকি সে দেশের ইন্টারনেট তো আর বন্ধ নেই। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আমার শৈশবের বগুড়ার আপডেট খবর জানার জন্যে ইন্টারনেটের উপর ভরসা রাখতে হয়। অনলাইনে ২০ জুলাইয়ের দৈনিক করতোয়া পত্রিকা খুলেই দেখলাম প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম কলামে বড়ো বড়ো হরফে হেড লাইনে লেখা আছে:
“ফের রণক্ষেত্র বগুড়া: গুলিতে একজন নিহত: গুলিবিদ্ধ ৪
আমি এক নিঃশ্বাসে পুরো খবরটি পড়ে ফেললাম। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সাথে সংঘর্ষের সময় শহরের সেউজগাড়ী এলাকায় সিয়াম ওরফে শুভ নামের ২০ বছরের এক যুবক পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হলে বগুড়া নার্সিং হোম নিয়ে গেলে চিকৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

১৯ জুলাই থেকে নিখোঁজ থাকার পর ২৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কদের অবশেষে খোঁজ জানা গেল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম, মো. সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, মো. আবু বাকের মজুমদার, আসিফ মাহমুদ ও নুসরাত তাবাসসুমদের নিরাপত্তা দেওয়ার নামে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আটকে রেখেছেন পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ ওরফে ডিবি হারুন। সারা দেশে ছাত্রজনতা আরও ক্ষিপ্র থেকে ক্ষিপ্রতর হয়ে উঠলো। আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনুপস্থিতিতেও সারা দেশের দেয়ালগুলোতে গ্রাফিটি ও দেয়াল লিখনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হতে থাকল। এরই মাঝে পুরোনো কায়দায় চাটুকর ধূর্ত ডিবি হারুন তাঁর ভাতের হোটেল থেরাপি আবারো শুরু করলেন । ডিবির কার্যালয়ে বসিয়ে ডিবি হারুন আটককৃত প্রধান প্রধান সমন্বয়কদের ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে ভাত খাইয়ে আপ্যায়ণ করলেন । একই কায়দায় আপ্যায়ণ করলেন তাদের আত্মীয়স্বজনদের। সে সব দৃশ্যের ভিডিও মিডিয়াতে ছেড়ে দেয়া হলো । ডিবি হারুনদের চাপের মুখে আত্মীয়জনরা বললেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা ডিবির কার্যালয়ে ভালো আছে, নিরাপদে আছে। এমনকি চতুর ডিবি হারুন চাপ প্রয়োগ করে আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় সমন্বয়কদের দিয়ে আন্দোলন অব্যহতির ঘোষণা দেওয়ালেন। শুধুমাত্র ছাত্র-জনতাই এসব ছেলে ভুলানো ছলচাতুরি ধরে ফেললেন না । দেশের আদালত পর্যন্ত এসব তামাশা বন্ধের নির্দেশ দিলেন। আর এই নির্দেশে দেশের আন্দোলনের পালে বাতাস লেগে আন্দোলন আরোও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগলো।

ইতোমধ্যে ২১ জুলাই, রোববার জনগণ জানতে পেরেছেন সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় দিয়েছে । রায়ে বলা হয়েছে , ‘কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো। তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদগুলো সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অনতিবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।’

সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ে অনেকেই মনে করলেন, এবার বুঝি সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। ছাত্ররা বুঝি এখন পড়ার টেবিলে ফিরে যাবে। সরকারীবাহিনীদের হত্যাযজ্ঞ এবার বুঝি শেষ হবে। কিন্তু, মেধাবী তরুণেরা, সরকারের ফাঁদে পা না দিয়ে, ডিবি হারুনদের সেই ভাতের হোটেলের থেরাপি উপেক্ষা করে , সুকৌশলে কোটা আন্দোলনকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত করে ‘বাংলা ব্লকেড’ এর ডাক দিলেন। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের লক্ষ্যে নতুন উদ্দমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । রাজধানী ঢাকা শহরকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হলো। সারা দেশে কারফিউ দিয়ে তৃতীয় বাহিনীর দেয়া লিস্ট ধরে ধরে পুলিশবাহিনী ঘরে ঘরে ছাত্রদেরকে এরেষ্ট করে থানায় নিয়ে আটক করতে লাগলেন। দেশ জুড়ে যে সমস্ত পরিবারে কিশোর-কিশোরী, যুবক -যুবতী রয়েছে, তাঁদের বাবা-মায়েরা ভয়ে-আতংকে দিন কাটাতে লাগলেন।

২০১৩ সালে যে আন্দলন ছাত্ররা শুরু করেছিলেন সরকারি চাকুরীতে কোটার বিরুদ্ধে, সেই কোটাবিরোধী আন্দোলন আবারো জেগে উঠলো ২০১৮ সালে। এখনকার এই জি-জেন ছেলে-মেয়েরা তখন ২০/২১ বছরের টগবগে তারুণ্যে উদ্ভাসিত। এরাই এবার ২০২৪ সালে আরও প্রসারিত অবয়বে, জনতাকে সাথে নিয়ে কোটা সংস্কারের দাবি আদায়ে আরও সাহসী হয়ে উঠলেন। নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী সকল কাজের একটি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া থাকে। ছাত্রজনতার সেই মহতী আন্দোলনের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো সরকারের দিক থেকে। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী ছাত্র-জনতার চাওয়া-পাওয়াকে আমলে না এনে যেন আরো মারমূখী হয়ে উঠলেন। আন্দোলন ঠেকাতে লেলিয়ে দেওয়া হলো স্বাধীন দেশের শৃঙ্খলা বাহিনীকে এবং সরকার সমর্থিত বাহিনীকে। সারা দেশে লাশের মিছিলের দৈর্ঘ্য ক্রমশঃ বাড়তে থাকল। কোটা সংস্কার আন্দোলন সহসাই বৈষম্যবিরোধী ও সরকার খেদানো আন্দোলনে রূপান্তরিত হলো।

(চলবে)

আগের পর্বগুলি –
পর্ব ১-পর্ব ১
পর্ব ২-পর্ব ২
পর্ব ৩-পর্ব ৩

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধ“জেন-জি”: এ জার্নি ফ্রম এক্স টু জেড- পর্ব ৩
পরবর্তী নিবন্ধ“জেন-জি”: এ জার্নি ফ্রম এক্স টু জেড- পর্ব ৫
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন