ডিসির বইমেলায় একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন কবি মাহবুব হাসান সালেহ। কবি ছাড়াও তার অন্য একটি বড় পরিচয় রয়েছে কিন্তু তা আমি ইচ্ছা করেই উহ্য রাখছি। কবি কবিই, তার চেয়ে বড় পরিচয় আর কিচ্ছু নয়।
আলোচনার মঞ্চ ছিল আষাঢ়ের নদীর মত।সেখানে ছোট্ট পানার মত আমিও ছিলাম। প্রত্যেকের পরিচয় দিতে দিতেই আলোচনার জন্য নির্ধারিত সময়ের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রম হয়ে যায়। মূল আলোচনার শুরু হয় একটি প্রশ্ন দিয়ে, “আমরা কেন লিখি?”
বক্তা অনেক, প্রত্যেকেই দীর্ঘ সময় নিয়ে বলছেন। মঞ্চে বসার অভ্যাস কম বলে ধারণা ছিল না যে, মঞ্চের স্বৈরিনি মাদকতা আছে।কথা আসে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির মত। প্রত্যেকেই বলছেন, আমি ভাবছি।
ইওরোপ বা আমেরিকার একদীর্ঘ শীতকাল যেন অতিক্রম হয়ে গেছে। যে বৃক্ষশাখা মৃত ছিল, সেখানে মুকুল গজিয়েছে, তারপরে পাতা, তারপরে পাপড়ি মেলেছে কত কত ফুল, তারপরে মৌমাছি ও দ্রুতির ডানার ক্যালিব্রি ( humming bird) উড়ে এসেছে ফুলের জগতে।
ফ্রান্সে একজন কবি মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, কিন্তু একটি কবিতাও লিখেন নি যুদ্ধ নিয়ে, প্রেম নিয়ে লিখেছেন।
“যুদ্ধ সাময়িক, প্রেম চিরায়ত, যা সাময়িক তা নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হয় না, তাই প্রেম নিয়ে লিখি” প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন।
“আমাকে কেউ বুঝতে পারে না, সম্ভবত আমি খুব দীর্ঘদিন অরণ্যে বাস করেছি।” নিৎসে বলিয়েছেন জরাথুস্ত্রর মুখ দিয়ে। বুঝতে না পারার ব্যাপারটি কি ভুল বলেছেন? আসলেই কি মানুষকে বুঝতে পারে ?
এবং দীর্ঘদিন বনে থাকার কারণ দিয়ে এ কি চোখে ধূলো দেয়ার চেষ্টা নয়? মানুষ যদি মানুষকে নাই বোঝে তবে কেন লেখা?
একটা দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ, সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হচ্ছে তার মানুষ।মাটি নয়, বন নয়, নদী নয়, মানুষ। কিন্তু কোথায় সেই দেশ যেখানে মানুষকে ঐশ্বর্য, অর্থবিত্ত, মোহর ও গয়নার মত যত্ন করে রক্ষা করা হয়?
রুশ কবি আলেক্সেই গানিন ভালোবাসতেন জিনাইদা রাইখকে। তিনি অনেকগুলো প্রেমের কবিতা লিখেছিলেন তাকে নিয়ে, সুন্দর কবিতা! আমার, আপনার, তার এবং সবার হৃদয়ে ভালোবাসার যে রক্তক্ষরণ হয় এ হল সেই আদিগন্ত প্রবাহের ইওফেরাত।কিন্তু তাকে সাক্ষী হতে হয়েছিল জিনাইদা রাইখ এবং তার প্রিয় বন্ধু সের্গেই ইয়েনিনিনের বিয়েতে।
সে বিয়ে খুবই স্বল্পস্থায়ী ছিল।রাশিয়ার ‘চেরেওমুখা’ ফুল ফুটে ঝরে যাবার মতই অতি সংক্ষিপ্ত।
গানিন শুধুই প্রেমিক নন, তিনি তার দেশকেও ভালোবাসতেন, তাই অক্টোবর বিপ্লবকে সমর্থন করে লাল ঝাণ্ডা হাতে ছুটেছিলেন স্বপ্ন-জোনাকির পিছনে। দেশ নিয়ে ভাবতেন, সবাই যেমন ভাবে, কিন্তু তিনি অন্ধ হতে পারেন নি, ভোলগার বুভুক্ষু মানুষের ভাগ্য ও পার্টির মানবতা বিবর্জিত সরল রেখার সমাজ পরিবর্তনের প্রতি প্রতিবাদ করেছিলেন। কবিই প্রতিবাদ করে, আরজিনা, কেঁচো, কুচে বা উরজ তক্ষক কোনদিন প্রতিবাদ করেনি।
গানিন ও তাঁর চৌদ্দজন বন্ধুকে , যাদের সিংহভাগই ছিল কবি, ফায়ারিং স্কোয়াডে যেতে হয়েছিল ১৯২৫ সালের মার্চ মাসে।
তাদের ধরপাকর শুরু হবার মাত্র কদিন আগে শুভাকাংখি কোন পার্টি-নেতার হুশিয়ারি শুনে সের্গেই ইয়েসিনিন ১৪টি মামলা কাঁধে নিয়ে মস্কো থেকে বাকু পালিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও মাত্র মাস ছয়েকের অতিরিক্ত জীবন পেয়েছিলেন, কিন্তু তাই ছিল তাঁর অমর গীতিকবিতাগুচ্ছ “পারস্যের মোটিভ সমূহ” লেখার মৃত্যুঞ্জয়ী বোনাস। বিপ্লবের বৎসরা
ঠিকই তাঁর গর্দান পর্যন্ত পৌঁছেছিল, জমাট রক্তের কালশিটে দাগ সৃষ্টি করে, ডিসেম্বর মাসের (১৯২৫ সাল) শেষ দিকে।
পার্টি ও রাষ্ট্রের ভাষ্য ছিল ইয়েসিনিন আত্মহত্যা করেছেন। মৃত্যুর একদিন আগে অথবা আত্মহত্যার দিন সকালে তাঁর বন্ধু “এরলিখ” এসেছিল হোটেলে দেখা করতে এবং ইয়েসিনিন তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর সর্বশেষ কবিতা, “বিদায় বন্ধু বিদায়।”
বিখ্যাত কবিতা, রাশিয়ার প্রায় সবাই কবিতাটি পড়েছে। কবিতাটি নাকি তিনি কলম খুঁজে না পেয়ে হাতের কব্জি কেটে রক্ত দিয়ে লিখেছিলেন।
রক্ত যখন লেখনীর কালি হয় মিথ্যাকে ঋৃজু গ্রীবার রাজহাঁসের মত লাগে।কিন্তু বাস্তবে ওটা তাঁর শেষ কবিতা ছিল না, হাতের কব্জি কেটে রক্তদিয়েও লেখা নয়। এবং ওটা এরলিখকে উদ্দেশ্য করেও লেখা হয় নি।ওই কবিতা ইয়েসিনিন লিখেছিলেন বন্ধু গানিনকে উদ্দেশ্য করে, মার্চ মাসে
তাঁর হত্যার পরে। মিথ্যাকে সত্য হিসাবে পরিবেশন করা হয়েছে লাল মোড়কে। এই ঘটনা প্রথম নয়, ইতিহাসে এমন কম হয় নি। মোড়কের রং লাল না হয়ে রামধনুর যে কোন রঙের হলেও ইতর বিশেষ হতো না।
এরলিখ ছিল গুপ্ত সংস্থার লোক এবং সে ইয়েসিনিনের বন্ধু ছিল চাকরির অংশ হিসাবে। প্রতিবাদী, মদ্যপ ও ডানপিটে কবিকে চোখে চোখে রাখা ছিল তার দায়িত্ব।
এইসব কথা সত্য? কে জানে?
মিথ্যা ? কি করে বলি?
এরলিখ ও এরলিখ-প্রভুরা জগৎ সংসার চালায়, তাদের হাতে ইতিহাস লেখার কলম, তাদের মুখ কদর্য নয়, বরং সুন্দর।
শুনেছি সত্যের মুখ কদর্য, আমি সেই মুখ দেখেছি ভাবি, সত্যই দেখেছি কি?
এমন কি হতে পারে যে, আমি যা ভাবছি, তা শুধুই একটি বোধ, সত্য নয়?
এই যে আমরা কাউকে বন্ধু, কাউকে শত্রু, কাউকে দেশপ্রেমিক, কাউকে দেশ-শত্রু ভাবি, সে ও তো বোধই।
“কেন লিখি?” সেই প্রশ্নের সাথে অবশ্যম্ভাবী আসে, “কী হয় লিখে?”
হয় হয়তো কিছু, তা নইলে মানুষ লেখে কেন হাজার হাজার বছর ধরে?
কিন্তু আসলেই কী হয়? মানুষের নিপীড়িত হবার প্রান্তর-সমান ভাগ্যের
কোন হেরফের হয় কি? মানুষ স্বাধীন হয়, পতাকা পায়, নতুন নতুন রাজ্য ও রাষ্ট্র সীমানা অর্জন করে, তারপরে রং বেরংয়ের বিপ্লব হয়, একজন নিপীড়ককে বিতাড়িত করে ‘মুক্তিদাতা’ অন্য নিপীড়কের অভিষেক করে।
কবি বা লেখক চিরকাল প্রতিবাদ করেছে, চিরকাল মানবতার কথা বলেছে, সাম্যের কথা, দায়বদ্ধতার কথা, ভালোবাসার কথা, প্রকৃতির কথা বলেছে।
আরও কিছু বলার আছে কি?
“নূর হোসেনের ত্যাগ বৃথা যায় নাই”
কে বলে? নূর হোসেন ? তার মা ? তার বাপ বা তার সন্তান?
নাকি তিমির সড়িয়ে আসা লালচোখের সুদর্শন অন্য তিমির?
আমি লিখি কেন?
আমার মাথার ভিতরে এক ছাদহীন, তলাহীন, অন্তহীন আকাশ আছে, সেখানে মেঘের মত কত চিন্তা উড়ে আসে, কত চিন্তা উড়ে-উবে যায়, প্রেম, দ্রোহ, দায়িত্ববোধ, প্রতিশ্রুতি, প্রত্যয় …..কত কত কোটি চিন্তাকণা….
আমি তাদেরই সামান্য কিছুকে শব্দ ও বর্ণের খাঁচায় বেঁধে রেখে যেতে চাই।
শুধুই তাই, আর কিচ্ছু নয়।
২৩ জুন,২০১৯
ডিসি বইমেলা থেকে ফেরার পথে প্লেনে