কে কাকে কতোদিন মনে রাখে? পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার ৩০০ বছর পরও মানুষ তাকে শুধু মনেই রাখেনি; তার কাজ আর সৌন্দর্যবোধ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে গবেষণা ।আমরা যারা মহান কবি কিটসকে চিনি; তারা মোটামোটি জানি যে, কিটস ও সৌন্দর্য অনেকটাই সমার্থক। সৌন্দর্যের কথা বললেই আমাদের মনে সবার আগে আসে তার নাম। সৌন্দর্য বিমূর্ত, তার অর্থ মায়া হরিণ। যাকে দূর থেকে দেখা যায়, ছোঁয়া যায় না। তবে কিটসের ক্ষেত্রে এটি অসত্য। তিনি সব জায়গায় সুন্দরকে কেবল দেখতেই পেতেন না, কবিতার সোনার কাঠিতে তাকে স্পর্শও করতেন।
প্রত্যেক রোমান্টিক কবিই কোনো না কো্নো কিছুর প্রতি অনুরাগী ছিলেন। ওয়ার্ডওয়ার্থ প্রকৃতির প্রতি, কোলরিজ অতিপ্রাকৃতির প্রতি, শেলি আদর্শের প্রতি এবং বায়রন মুক্তির প্রতি। তবে কিটসের যে সৌন্দর্যের প্রতি অদম্য অনুরাগ ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। নিজের লেখা চিঠিতেও সৌন্দর্যের প্রতি তারআসক্তি ব্যক্ত করেছেন। বন্ধু জর্জ এবং টমকে লেখা এক চিঠিতে কিটস লিখেন, ‘বড়কবিদের ক্ষেত্রে সৌন্দর্যবোধ কেবল অন্যান্য বিষয়কে পেছনেই ফেলে না, নিশ্চিহ্নও করে দেয়। ’
কিটস প্রতিটি জায়গায় প্রতিটি বস্তুতে সৌন্দর্যকে দেখতে পেতেন। ফুল, মেঘ, পবর্ত, পাখির গান, নারীর মুখ, বিশালাকৃতি বই কিংবা পুরানে ইত্যাদি সকলক্ষেত্রে সৌন্দর্য তার কাছে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন রূপে ধরা দিত। তাইতো এন্ডিমিয়ন কবিতায় তিনি লিখেছেন,
‘সৌন্দর্যের যে কোন জিনিস সব সময়ই আনন্দের:
এর রমণীয়তা বাড়তেই থাকে;
এটি কখনোই শূন্যতায় হারিয়ে যায় না।’
কবিতায় নীতি শিক্ষা দেওয়াকে ঘৃণা করতেন কিটস। কারণ কবিতাই তার কাছে সৌন্দর্য। তাইতো ‘ওড টু এ নাইটিঙ্গেল’ এ কবিতায় ডানায় ভর দিয়েই তিনি নাইটিঙ্গেল পাখির সুন্দর পৃথিবীতে পাড়ি জমাতে চেয়েছেন। নাইটিঙ্গেলকেউদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছেন,
`দূরে, আরো দূরে
তোমার কাছে আমি যাব উড়ে,
বাক্কাসের রথে চড়ে নয়
কিংবা তার উড়ন্ত চিতার পিঠে
কবিতার অদৃশ্য ডানায় ভর করে
আমি যাব সরে।‘
কিটসের কাছে কবিতা সামাজিক বিদ্রোহ কিংবা দার্শনিক মতবাদ প্রকাশের কোনো হাতিয়ার না, বরং সৌন্দর্য বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম। ‘সৌন্দর্যের খাতিরেই সৌন্দর্য’- এই ধারণা তিনি কবিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। মানুষ যেসব জিনিসকে খালি চোখে সুন্দর বলে, কিটস সেগুলোকে সেইভাবে সুন্দর বলায় পক্ষপাতী ছিলেন না । সৌন্দর্য দেখার জন্য তিনি সেসববিষয়ের গভীরে অন্তর্দৃষ্টি দিতে পছন্দ করতেন, যেগুলো অনেক সময় সাধারণমানুষের কাছে কুৎসিতও মনে হতে পারে। তিনি বলতেন, ‘আমি সব জিনিসের ভেতর সৌন্দর্যের নীতিকে ভালবাসি।’
রোমান্টিক যুগের সূচনার মাত্র তিন বছর আগে ১৭৯৫ সালের ৩১ অক্টোবরলন্ডনের মুরগেটে জন্মগ্রহণ করে জন কিটস। তৎকালীন দুরারোগ্য ব্যাধি যক্ষারকাছে হার মেনে মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চলে যান নাফেরার দেশে। তবে সাহিত্য জগতে তার আয়ুকাল ছিল মাত্র চার বছর। ২৫ বছরে মারাগেলেও শেষ দুই বছর অসুস্থতার কারণে তেমন কিছুই লিখে যেতে পারেননি কিটস।
কুকুরের মতো শত বছরের জীবনের চেয়ে বাঘের মতো একদিন বাঁচাও ভালো। সেক্ষেত্রে বলা যায়, জন কিটস জীবদ্দশায় সাহিত্য জগতে বাঘের মতো বেঁচে ছিলেন চার বছর। আর তার সৃষ্টিকর্ম দিয়ে আজও বেঁচে আছেন কোটি সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের হৃদয়ে; কবিতাপ্রেমী পাঠকের অন্তরে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে কিটস যা লিখে গেছেন, পৃথিবীর বহু কবি বয়সে তিন/চার গুণ বেশি বেঁচেও তার ধারে-কাছে যেতে পারেননি।
মূলত পঞ্চইন্দ্রীয়কে জাগিয়ে তুলতে পারে শব্দের মাধ্যমে এমন সংবেদনশীল চিত্র মনে ফুটিয়ে তোলার পারদর্শিতার জন্য কিটস সবচেয়ে বেশি পরিচিত। আর এ কারুকার্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার হলো কিটসের ওডস। এ ছাড়াও কিটসের অন্যান্য কবিতা ও চিঠি নিয়েও যে পরিমাণ গবেষণা হয়েছে, তার সিকিভাগ আলোচনাও অন্য কোনো রোমান্টিক কবিকে নিয়ে হয়নি।
হীরাকে কেউ মাটি দলা মনে করে ছুঁড়ে ফেললে তাতে হীরার উজ্জ্বলতা কিংবা মূল্য কোনটাই খর্ব হয়ে যায় না। বরং যারা হীরাকে প্রত্যাখ্যান করেন তারাই লোকসমাজে হাসির পাত্রে পরিণত হন। জীবদ্দশায় জন কিটসের কবিতার হীরক মূল্যায়ন করতে পারেননি অনেক সাহিত্যিক সমালোচক। তবে সেই উপেক্ষিত কিটসই উনিশ শতকের শেষে সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজ কবি হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন। কিটসের মৃত্যুর পর এ যাবৎ বহু লেখক ও সাহিত্যিক তাকে অনুসরণ করেছেন। জর্জ লুইবোর্জেজ তো বলেই ফেলেন, কিটসের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ তার সাহিত্য জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছিল। মৃত্যুর প্রায় ৩০০ বছর পর আজো কিটস পৃথিবীতে একজন অন্যতম পাঠকপ্রিয়, বিশুদ্ধ কবির নাম। আর নিঃসন্দেহে বলা যায়, কিটসকে এ অমরত্ব এনে দিয়েছে সৌন্দর্যের প্রতি তার অকাট্য ভালবাসা।
থু আরনল্ড যথার্থই বলেছেন, ‘He is; he is with Shakespeare.’
লেখক – গবেষক সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ।