একটি বাস ড্যানফরথ্-ভিক্টোরিয়া ইন্টারসেকশনে এসে থামল। বাস থেকে কেউ নামল না। বাসে কেউ উঠল না। ট্র্যাফিক সিগনাল সবুজ হতেই বাসটি ভিক্টোরিয়া পার্ক পাতালরেল স্টেশনের দিকে ছুটল। নিশ্চয় ওখানে শতশত না-হলেও বেশ কিছু লোক এ বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে।
আজ সোমবার। চারদিক গ্রীষ্মের ঝলমলে আলোতে কেমন পুলকিত হয়ে আছে। এই সময়টার জন্যে টরেন্টোবাসী প্রায় সাত-আট মাস ধরে অপেক্ষা করে। প্রায় বাসার সামনে টিউলিপসহ রঙবেরঙের বিভিন্ন ফুল ফুটে আছে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। ড্রাইভার আলিম এসব দেখে একটু বিস্মিতই হল। করোনায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকার কারণে সে সেলফ-আইসোলেশনে ছিল। তখনো শীত কাটে নি। কিন্তু যখন ডাক্তার ঘোষণা করল, সে পুরোপুরি সুস্থ, তখন প্রায় সামার চলে এসেছে। এবার যেন সামারটা একটু তাড়াতাড়িই চলে এল। মনে হল – লাফ দিয়ে নেমে এসেছে টরেন্টোর বুকে। এখন তো চারদিক লোকজনে ভরপুর থাকার কথা। কিন্তু কী আশ্চর্য! লোকগুলো কি কোথাও জাদুবলে হাওয়ায় উবে গেল? এসব ভাবতে-ভাবতে ড্রাইভার ভিক্টোরিয়া পার্ক পাতালরেলের স্টেশনে চলে এল। এখানেও একই অবস্থা। লোক নেই। জন নেই। মনে হচ্ছে আজকে মানুষ হঠাৎ করে দূরে কোথাও স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে গেছে। একটু খেয়াল করতেই চোখে পড়ল, একজন মোটামতো গম্ভীরপ্রকৃতির লোক তার বাসের দিকে এগিয়ে আসছে। বাসের কাছে আসতেই ড্রাইভার আলিম বুঝতে পারল, এ যে তাদের সুপারভাইজার জেমস! কিন্তু জেমস তো সবসময় হাসিখুশি থাকে। তাকে এত রাশভারি অথবা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে কেন? জেমসকে কাছে পেয়েই আলিম বলল, ‘বস, কী হয়েছে বলো? কোথাও কোনো লোক নেই কেন?’
জেমসের মুখে যেন থোকাথোকা কালো মেঘ জমে আছে। বলল, ‘আলি, তুমি তো দীর্ঘ দিন কাজে আসো নি। বাইরেও বের হও নি। গত পনেরো দিনে পুরো টরেন্টোর অবস্থা চেঞ্জ হয়ে গেছে। যাক ওসব কথা। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো।’
জেমস কখনোই আলিমকে আলিম বলে ডাকে না। সবসময় আলি বলেই ডাকে। এটা একটা রহস্যপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু এ নিয়ে আলিমের কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই। এটা ভালোভাবেই বোঝে জেমস তাকে খুব স্নেহ করে। জেমস বলল, ‘আলি, একটা কাজ করো। আমি তোমার রুটে একটু পরিবর্তন আনছি। তুমি সোজা ড্যানফরথ ধরে ইয়ঙ আর ব্লোরে যাও। ওখানে নিশ্চয় অনেক যাত্রী অপেক্ষা করছে। আজকে আচমকাই অধিকাংশ বাস-ড্রাইভার ছুটিতে আছে। করোনা-আক্রান্ত হয়ে তারা বাসায় না-হয় হসপিটালে অবস্থান করছে। তোমার মতো যারা দু’-একজন সুস্থ হয়ে ফিরেছে তারাই আজ বাস চালাচ্ছে।’
‘ঠিক আছে বস। হ্যাভ অ্যা গুড ডে!‘, বলেই আলিম তার বাস নিয়ে রওনা হল।
রাস্তার দু’ পাশে বাড়িঘরগুলো কেমন চুপচাপ। দু’ একজন লোক বেশ নির্লিপ্তভাবে হাঁটাচলা করছে। কিছুকিছু রেস্টুরেন্ট খোলা। কিন্তু সেখানে কোনো লোকের আনাগোনা নেই। আহ্ কী সুন্দর এই প্রকৃতি। সৃষ্টিকর্তা যেন নিজ হাতে টরেন্টোর প্রতিটি পরতে-পরতে লাবণ্য সাজিয়ে রেখেছে। আলিমের বাবা-মা’রা বাংলাদেশ থেকে এসেছে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে টরেন্টোতে। তার জন্ম এখানেই। এই টরেন্টোতেই। এমন সুন্দর ও স্নিগ্ধ একটি শহরে তার জন্ম হওয়াতে সে সৃষ্টিকর্তাকে আবারো ধন্যবাদ দিল। বাস ড্রাইভ করতে-করতে ভাবতে লাগল, ‘বেহেশতের নিসর্গ কি এই টরেন্টোর প্রকৃতির চেয়েও সুন্দর? নাহ্, মনে হয় না!’ – এসব এলেবেলে ভাবনা মাথায় নিয়ে আলিম ইয়ঙ-ব্লোর পাতাল-রেলস্টেশনে এসে পড়ল। কিন্তু একী? এখানেও কেউ অপেক্ষা করে নেই বাসের জন্যে। একটা দশ কী এগারো বছরের ছেলে – উস্কুখুস্কু তার চেহারা – বাসে উঠে আলিমকে বলল, ‘আমি এয়ারপোর্ট যাব।’
আলিম বিনয়ের সঙ্গে জানাল, সে এখন ভিক্টোরিয়া পার্কের দিকে যাবে। এটাই তার রুট।
ছেলেটি বলল, ‘আমি দুই ঘণ্টা যাবত অপেক্ষা করছি। কোনো বাস আসছে না। ওদিকে আমার চাচাচাচি ইতিমধ্যে এয়ারপোর্টে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। ওরা ক্যালগেরি থেকে আসছেন।’
ছেলেটির কথায় আলিম একটু কৌতূহল বোধ করল। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বাবামা কোথায়?’
‘ওরা দু’ জনেই মারাত্মক অসুস্থ। ভীষণ জ্বর। ওদের ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। তারা আমাকেই বললেন এয়ারপোর্টে গিয়ে চাচাচাচিকে রিসিভ করতে। ওরা তো এই শহরে নতুন!‘- কথাগুলো বলতেবলতে ছেলেটার চোখমুখ কেমন যেন কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল।
এর মধ্যে আলিম শুনতে পেল, কে যেন তাকে নাম ধরে ডাকছে। আরে! ওই তো এই এরিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারভাইজার রবিন।
‘আলিম, তুমি ছেলেটিকে নিয়ে এয়ারপোর্টে যাও। ও অনেক ক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।’ বলেই রবিন তার কাজে চলে গেল।
রবিনের কথামতো রওনা হল আলিম।
এয়ারপোর্টে এসে আলিমের যার-পর-নাই অবাক হওয়ার পালা। টরেন্টো পিয়ারসন এয়ারপোর্ট পৃথিবীর ব্যস্ততম এয়ারপোর্টগুলোর মধ্যে একটি। যে-স্থান চব্বিশ ঘণ্টা লোকে-লোকারণ্য থাকে, সেখানে সবে মিলে বিশ-পঁচিশজনকে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে দেখল। নিজের চোখে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কীভাবে সম্ভব? আলটপকা আলিমের মনে হল তার কিছু ক্যাশ টাকা দরকার। পকেট একদম ফাঁকা। এটা ঠিক না। তাই বাসটা পার্ক করে নিকটস্থ এটিএম বুথের দিকে গেল। মাস্টার কার্ড ইন্সার্ট করল। মেসেজ এল বুথে টাকা নেই। একটু যেন নারভাস ফিল করল আলিম। এমন তো হওয়ার কথা না! এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এটিএম বুথে টাকা নেই – এটা কিছুতেই ভাবা যায় না।
আলিম আবার বাসে ফিরে এল। নির্দেশনা এল ওয়াটার ফ্রন্টের দিকে যাবার জন্যে। এই সময় প্রতি বছর অসংখ্য লোকে গিজগিজ করে ওয়াটার ফ্রন্টের ব্যাপক এরিয়াজুড়ে। তৎক্ষণাৎ ছুটল আলিম তার বাস নিয়ে। অত্যাধুনিক ঝকঝকে ইলেকট্রিক বাসটি নিয়ে হেলেদুলে ওয়াটার ফ্রন্ট এরিয়া সংশ্লিষ্ট ইন্টারসেকশনগুলো পাড়ি দিতে লাগল আলিম। গা শিরশির-করা কী অদ্ভুত এক নীরবতা চারদিক দখল করে আছে! নিস্তব্ধ। নিথর পরিবেশ! অধিকাংশ বার-রেস্টুরেন্টগুলো সুনসান। কালেভদ্রে একজন-দু’জন করে লোক চোখে পড়ছে।
হঠাৎ আলিমের মনে হল এবারের প্রকৃতিটা অন্যবারের চেয়ে একটু ভিন্ন। একটু বেশি সুন্দর। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হল এমন সুন্দর প্রকৃতির সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হওয়ার জন্যে। তার মানবজন্ম সার্থক! দূরে চোখ মেলতেই দেখল লেকের পানি কেমন অবিরল উজ্জ্বল! শান্ত! মৃদু ঢেউ খেলছে আপন মনে। রোদের চঞ্চলতায় অতিষ্ট হয়ে আছে আলসে বাতাসগুলো। সিগালগুলো উষ্ণ আলোতে উড়াল এঁকে দিচ্ছে বারবার। একসময় আলিম কবিতা লিখত। আজ অনেক দিন পর তার কবিতা লিখতে ইচ্ছে করল। কিন্তু আলিমের মনে খটকা কিছুতেই যাচ্ছে না। প্রকৃতির এত রূপ, এত যৌবন, এসব থেকে কী হবে যদি কোনো মানুষ না-থাকে এসব উপভোগ করার জন্যে!
নৈঃশব্দ্যের মধ্যে সারা শহর দাপিয়ে বেড়িয়ে বিকেলে বাসায় ফিরে এল আলিম। পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতার সকল পর্ব সেরে প্রার্থনা করতে বসল। সৃষ্টিকর্তার কাছে হাত তুলে আকুতি জানাল, ‘হে সৃষ্টিকর্তা, আবারো তুমি সারা পৃথিবীকে মানুষের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে দাও!’
উন্নতবিশ্বের শহরের একটি বাস্তবিক গল্প। মহামারির সময় জীবন যখন থমকে দাঁড়ায় তখন একজন সাধারন মানুষের চোখ দিয়ে দেখা চিরচেনা শহরের অন্যরকম রূপ। লেখক খুব সুন্দরকরে তুলে ধরেছেন।
যদিও গল্পটিতে একটি মনোটোন রয়েছে, বিশেষ কোনও ঘটনা ঘটে নি তবু মনে হল, এটি গল্প না হয়ে অনায়াসে একটি রিপোর্ট হতে পারত।
তবে পড়তে ভাল লেগেছে।