সিস্টেমের স্বচ্ছতার অভাব থাকলে মানুষ আবেগের প্রধান্য বেশি দিবে, যেটি একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের বিরাট বাধা হতে পারে।
একজন ডাক্তারকে মৃত রুগীর আত্মীয়রা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। এই রকম ঘটনা শুনে যদি কারো স্বাভাবিক লাগে তাহলে বুঝতে হবে তারা কোন জাতীয় দেশে বসবাস করছেন! নিম্নের খবরটির আদি অন্ত খুঁটিনাটি বিস্তারিত বিষয় আমি জানি না, শুধু মাত্র পত্রিকা বা খবরের বর্ণনা ছাড়া। তবে খুঁটিনাটি বিষয় যাই হোক না কেন, এই জাতীয় ঘটনা ঘটতে দেওয়া আপনার আমার সবার পরিবারের জন্য অত্যান্ত ভয়কংর। ডাক্তার কবিরাজের বা থানা পুলিশের হাতে অবহেলা বা তাচ্ছিল্লের কারণে যেমন কোনো রুগীর মৃত্যু কারোরই কাম্য নয়, তেমনি একজন ডাক্তার বা অন্য প্রফেশনের লোকের আবেগী জনতার হাতে মৃত্যু হওয়া একটি রাষ্ট্রের জন্য অতীব লজ্জার বিষয়। আর এই ভাবে আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে একজন মানুষকে হত্যা করলে তাতে যেখানে নড়াচড়া হওয়া দরকার সেখানে কিছুই হবে না।
আমি যদিও আদি অন্ত জানি না, তারপরেও ধরে নিচ্ছি যে এই ডাক্তারের হয়তো কিছুটা দোষ ছিল, কিন্তু এর থেকেওতো দেশে অনেক অনেক বড়ো দোষী এবং বড়ো বড়ো খুনি রয়ে গেছে, কই সেগুলির বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের আবেগ কোথায় যায়। ১৬ থেকে ১৮ কোটি মানুষের দেশে আপনি মাত্র ৮৫ হাজার ডাক্তার দিয়ে কাজ চালাবেন, তার পরে আবার তাদের কাজ পরিচালনার যথাযত সরঞ্জাম দিবেন না, এবং যা দিবেন তা গ্রহণ করতে তাদের আবার আমলাতন্ত্রের শত বেড়াজাল পার হতে হবে। এর মধ্যে যে এখনো মানুষ এই পেশাকে বেছে নিচ্ছে, ভাগ্যিস !
অসৎ, কাজে অবহেলা করা, মেরে খাওয়া কিছু লোক শুধু যে ডাক্তারি পেশায় আছে তা নয়। সব জায়গাতেই আছে, কিন্তু তাই বলে কি বাদ বাকি যে লোকগুলি অতি অল্প resource দিয়ে দেশের মানুষের অক্লান্ত সেবা করে যাচ্ছেন তাদেরকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে ? আজকে যদি পরিবহন শ্রমিকের মতো দেশের সেই সমস্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করা চিকিৎসকরা একযোগে ধর্মঘট করে বসেন তাহলে কি হবে। বিদেশ থেকে ডাক্তার এনে কাজ চালাবেন, না কি নিজে গিয়ে কাজ করবেন, না সেটি সম্ভব নয় এটি তেমন পেশা নয়। এই জাতীয় ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রায় এরকম ঘটনা ঘটে। আবেগী হয়ে চিকিৎসকের উপর চড়াও, অরে বাবা আসল জায়গায় হাত দেওয়া কেন।
এই কানাডাতেই শুধু মাত্র ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে রুগীর সার্জারি করার পরে ভুলে রুগীর দেহের মধ্যে অপারেশনের যন্ত্রপাতি রয়ে গেছে এরকম ঘটনা ৫৫০টি। এবং বিগত বছের তুলনায় এটির বেড়ে যাওয়ার হার ১৪% যেটি কিনা ১২টির মতো রিপোর্ট করার দেশের থেকে দ্বিগুন। রিপোর্ট করা দেশগুলির মধ্যে নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ড ইত্যাদি দেশ আছে। এই নিয়ে এরা কাজ করে যাচ্ছেন যাতে করে এই সমস্যা কমানো যায়, কিন্তু তাই বলে যে সমস্ত রুগী এই সমস্যার ভুক্তভোগী তারা ডাক্তার বা সার্জনকে মেরে ফেলছে, তা না। তারা প্রথাগত পদ্ধতিতে আগাচ্ছেন জিনিষটির সমাধানের জন্য। আবেগে পড়ে ধাম করে একজনকে মেরে ফেললাম, এটি কোনো ক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমার নিজের কাছের লোককেও যদি কেউ হত্যা করে, আমি চাইবো দেশের আইন তার বিচার করুক, আমি নোই। এরকম ঘটনা ঘটলে একটি খুবই কমন বাক্য সমস্ত মিডিয়াতে শোনা যায়। “দোষীদের কে ধরে শ্রীঘ্রই বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক ” এর পর কতৃপক্ষের উত্তর হলো। “ঘটনার তদন্ত করে দোষীদেরকে ধরে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হবে “. এই বাক্যগুলি শুনতে শুনতে এখন শুধু ফাও প্যাচাল মনে হয়। (এই জাতীয় কমেন্টের জন্য দুঃখিত).
আমি আবারো বলছি Bad Apple সব জায়গাতেই আছে। সেগুলিকে খুঁজে যথাযত শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। আবার যারা সীমিত আয়ে সীমিত সামর্থ দিয়ে দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদেরকেও মূল্যায়ণ করতে হবে, তা না হলে এক সময় তাদের কাজের স্পৃহাও কমে যাবে। আমি গত বারের আগের বারে দেশে গিয়ে আমার বোনের বাড়ি রাজশাহীতে বেড়াতে যাই। ধুলাবালি খেয়ে আমার প্রচন্ড ঠান্ডা কাশি হয়, কিন্তু আসে পাশে ডাক্তার বলতে কিছু ক্লিনিক ছিল এবং উনারা বললেন ডাক্তার আসবেন বিকালে। যাহোক আমি আমার ছোট ভাগ্নে ভাগ্নি সহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজের outpatient এ গেলাম, যদিও আমার বড়ো ভাগ্নে আমাকে বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে ক্লিনিকে যেতে বলেছিলো।
যা হোক ওখানে গিয়ে ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া সম্পাদন করে তারপর ডাক্তার দেখলাম। আছেন শুধুমাত্র কিছুসংখ্যক ডাক্তার, কিন্তু রুগীর পরিমাণ অগণিত, হাজারে হাজারে। আমি প্রিয়া ২ শত লোকের লাইন পার হয়ে ডাক্তারের দেখা পেলাম। শুধু ওই দৃশ্য দেখেই আমার অসুখ অর্ধেক ভালো হয়ে গেছে, কারণ আমি তো শুধু দেখেছি, কিন্ত ঐখানে বসা ব্যাক্তি কিভাবে তার মাথা ঠিক রাখছেন। তারপরে আবার এক একজন লোকের এক এক রকম ব্যবহার। ২/৩ বছর আগে ব্রিটেনে একটি জরিপে দেখা গেছিলো যে ডাক্তারের রুগী দেখার সময়ের স্বল্পতার কারণে তাদের diagnosis কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। এই প্রমান আমরা কানাডাতেও দেখি, কোনো ডাক্তার ঝটপট করে আমাদেরকে দেখলে ভালো লাগে না। এমনকি সেলুনে গেলেও ঝটপট চুল কাটালে ভালো লাগে না। এখন চিন্তা করুন আপনাকে যদি মিনিটে মিনিটে একটা করে রুগী দেখতে হয় তাহলে আপনি সঠিকভাবে চিকিৎসা করবেন কি ভাবে। আমি ডাক্তারের কপালের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে নিজের পরিচয় দিয়ে তাকে একটি বড়ো ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, “এখন বুজছি কানাডাতে ডাক্তারদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া অত্যান্ত কঠিন জেনেও কেন শত শত ডাক্তার ওখানে পাড়ি জমায় “. যেসব লোক এটাকে ব্রেন ড্রেন বলে বেশি কথা বলেন, তাদেরকে ওখানে নিয়ে দুদিন বসিয়ে দেওয়া দরকার।
ওই ভাবে যারা নিরলস দেশের মানুষের জন্য করে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ সালাম। সত্যি বলতে কি, আমি উনাদের মতো পারি নি, তাই ভেগে এসেছি।
আসুন আমরা সবাই আবেগের বসবতী হয়ে এমন কিছুর দৃষ্টান্ত না তৈরী করি যাতে সমাজের ক্ষতি হয়। বরং আমাদের সীমিত সামর্থ দিয়ে যতটুকু পারা যায় জায়গামতো কিছু করি।
সমাজের চলমান পুরাতনের চিরাচরিত প্রথা ভেঙে আজকের নতুন যুবক যুবতীরা একদিন জেগে উঠে হাল ধরবে এবং মুছে যাবে চাটুকর আর চোর চোট্টার প্রভাব, প্রিতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন, এই কামনা করে শেষ করছি।
মুকুল
টরন্টো
শ্রদ্ধেয় মুকুল ভাই, তথ্য নির্ভর আপনার চমৎকার লেখাটি মন দিয়ে পড়লাম। আমি আপনার সাথে একেবারেই একমত। আমি যেকোনো বিচার বহির্ভুত হত্যাকে সমর্থন করি না। আশাকরি, আপনার লেখাটি পড়ে আমাদের দেশের কিছু অমানুষরা তাদের নিজের কর্মকান্ডে পরিবর্তন আনবে।
———-জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
Thanks for weigh in bhai. Mukul