সকাল এগারোটা। ধানমন্ডি থেকে একটা ক্ষ্যাপ নিয়ে তেরো মুল্লুক ঘুরে কার্জন হলের গেটে যখন সোয়ারী নামায় রিকশাচালক কাছেম আলী, তখন দুপুর। জ্যামের শহর ঢাকা আজ এক্কেবারে নট নড়নচড়ন!! বিত্তান্ত যা শুনতে পেলো, তা হলো হুজুরে হুজুরে লড়াই। এয়ারপোর্ট রোড বন্দ। কেউ একজন আসছে প্লেনে উড়ে, কেউ নামতে দেবে, কেউ দেবেনা। অস্পষ্ট একটা খিস্তি করে কোমরের গামছা খুলে মুখ মোছে কাছেম আলী। এসব গা সওয়া হয়ে গেছে, ঐ খিস্তি পর্যন্তই। আজ এটা কাল ওটা, নির্গমন, আগমন, পাওয়ার খুশি, না পাওয়ার রাগ। সব এই রাজপথেই। ঠিক আছে বুঝলাম এটাই নিয়ম, তবুও তো সময় বলে কথা, এই ঢাকা কি সেই ঢাকা আছে? আর এই মিছিল কি, সেই মিছিল? তেইশ জন মানুষ পুরো রাস্তা জুড়ে বিরাট মিছিল!! পেছনে মূহুর্তেই পাঁচ মাইল লম্বা জ্যাম।
প্রেস ক্লাবের সামনে কতগুলো ভাড়ায় খাটা মানুষ ব্যানার নিয়ে হররোজ রাস্তা বন্দ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঢাকায় এসে দেশি বন্ধুর সাথে সেও দাঁড়িয়েছিলো বেশ ক’দিন। একবেলা দু’শো টাকা।
খুব খিদে পেয়েছে। প্যাডেল মারলেই খিদা পায়, গরীবের খিদা, রাক্ষুসে খিদা। দুনিয়াডারেও খাইতে চায়। ভার্সিটি সুইমিংপুলের দেয়াল ঘেসে ভাসমান ভাতের দোকান। এক প্লেট ডিম ভাত নিয়ে গোগ্রাসে খেতে শুরু করে কাছেম আলী। বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছিলো সে, হঠাৎ চোখে পড়লো, দেয়াল ঘেষা মাটিতে পিঁপড়ার সারি। এক লাইনে সার বেঁধে চলেছে, কোন হুড়োহুড়ি নেই পাড়াপাড়ি নেই।
গরীবের ঘরে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলো কাছেম আলী, ঐ শেষ। পিঁপড়ার সারির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মনে পড়ছে বাংলা স্যার বলেছিলেন, মানুষ আর পিঁপড়ার নিজের, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অনেক মিল। ওদেরও রাণীর আদেশে চলতে হয়, ঘরবাড়ি বানানো, খাদ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিবাদ, শালিস, সাঁজা সবই, এবং তা শৃঙ্খলার সাথে।
কপালে ভাঁজ পড়ে কাছেম আলীর, স্যারের কথাই যদি ঠিক হয়, তাহলে সামান্য পিঁপড়ারা যা পারে, আমরা মানুষ হয়ে তা পারছি না কেন?
সব বাদ দিলাম, রিকশা গাড়ি গুলো যদি শৃঙ্খলায় চলতো, রাজনৈতিক আর ধর্মভিত্তিক দলগুলো যদি তাদের আন্দোলনের মিছিল, খুশির মিছিল, রাগের মিছিল রাস্তার একপাশ দিয়ে একসারি বদ্ধ হয়ে প্লাকার্ড হাতে হেঁটে যেতো, যেমন পিঁপড়ারা যায়। তাহলে কেমন হতো?
ভাতের বিল মিটিয়ে আবারো রাস্তায় নামে। দোয়েল চত্ত্বরের জ্যামে আটকা কাছেম আলীর মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে, ” পিঁপড়ারা যা পারে, আমরা মানুষ হয়ে কেন তা পারিনা”?