আমাদের আরু কাকা গতকাল শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন। আরু কাকা আমার বাবার আপন ভাই না, বরং তিনি আমার বাবার বংশীয় ভাই। তবে বেশ বড়ো না হওয়া পর্যন্ত সেটা বুঝতে পারিনি। উনি স্বল্পভাষী, ঝামেলাহীন এবং নীরব প্রকৃতির একজন লোক ছিলেন। উনার সাথে আমার দেখা হতো ছোট বেলায় হয়তো বছরে ২/১ বার শহর থেকে যখন গ্রামের বাড়ি ছুটিতে যেতাম। আমার ধারণা, উনার হয়তো কিছুটা ADHD ছিলো, যেটি অবশ্য ডায়াগ্নোস্ট করা ছিল না। তবে বিয়ে সাদি করে সংসার করে বেশ functionaly জীবন অতিবাহিত করেছেন। বাংলাদেশে, এবং পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ থাকে নিভৃতে নীরবে জীবন চালিয়ে যায় এবং নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে সেবা দিয়ে যায় এবং এই ধরনের কিছু মানুষের জন্য পৃথিবীটা এখনো সুন্দর।
উনি আমাদের অনেক কাজ করেছেন, তবে কখনো কিছু চান নি, আমার মা-বাবা যা দিতেন তাই নিয়েই খুশি থাকতেন। উনার মৃত্যুতে খারাপ লাগার পাশাপাশি উনার সাথের স্বল্প সময়ের বেশ কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে। আপনাদের অনেকের হয়তো আমাদের দেশের গ্রামের মাটির রাস্তায়, কাঁদার মধ্যে হাঁটা, হারিকেন জ্বালিয়ে পড়া বা নদীতে সেই আমলের লঞ্চ বা স্টিমারে চড়ার অভিজ্ঞতা নেই। আমার ছোট বেলার কিছুটা সময় সেই অভিজ্ঞতা পেয়াছি। যশোর/কুষ্টিয়া এলাকা থেকে থেকে ট্রেন করে তারপর ততকালীন লঞ্চে করে আমাদের গ্রামের বাড়ি যেতে হতো। লঞ্চ থেকে নেমে ২/৪/৮ কিঃমিঃ পর্যন্ত হেটে তারপর আমাদের বাড়ি। নির্ভর করতো কোন লঞ্চে যাচ্ছি বা কোন ঘাটে নামছি। আমাদের আগমন বার্তা আরু কাকা ঠিকই পেয়ে যেতেন। আগের থেকে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমাদেরকে receive করার জন্য। মৃদু হাঁসি দিয়ে কখনো আমাকে বা আমার ছোট বোনকে ঘরে নিয়ে অথবা লাগেজ নিয়ে শুরু করতেন হাঁটা। তেমনি ঠিক ফেরার সময়ও আসতেন এবং আমাদের লঞ্চ ছাড়ার পরেও দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত ঘাঁটে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া লঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
বর্ষাকালে রাস্তাঘাট প্রায়ই কর্দমাক্ত থাকতো; তাই হাঁটার সময় পা পিছলে পড়ার সম্ভাবনা থাকতো। কিন্তু আরু কাকার ঘাঁড়ে যখন আমরা অথবা কোনো লাগেজ থাকতো তখন উনি এতটাই সতর্ক থাকতেন যে উনি নিজে পড়ে পড়ুক, আমরা অথবা লাগেজ যেন না পড়ে। লোক সাদা-সিধা বা নীরব প্রকৃতির হলে কি হবে, তার কর্মের integrety বা সততা ছিল উদাহরণমূলক (examplery) . উনি নিজে না পড়াশুনা করলেও উনি কিন্তু আমাদেরকে এই work ethic বা integrety (কর্মের সততা) শিখিয়ে গেছেন। উনি আমার বাবাকে অসম্ভব পরিমান সম্মান করতেন। আর উনি আমার মায়ের খুব স্নেহের পাত্র ছিলেন। আমার মনে আছে, ছোট বেলায় বর্ষাকালে আমাদের মামার বাড়িতে নৌকা করে যেতে হতো। আমার মার হটাৎ করে বাপের বাড়ি যেতে মন চাইলে আমার বাবা অথবা দাদা আরু কাকাকে ডাকা মাত্রই বান্দা হাজির। আমাদের নানু বাড়ির লোকও উনাকে খুব পছন্দ করতো।
আমার সাথে উনার দেখা গত ২০১৭ সালে যখন বাংলাদেশে যাই। আমার ছোট বোন তার চাকরির পাশাপাশি অবসরে তার বচ্চা ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাড়িরই পাশে আঙিনা কৃষি টাইপ সবজি চাষ করে। প্রতি মৌসুমেই পাড়াপ্রতিবেশীকে দেওয়ার পরেও মাঝে মাঝে কিছু বিক্রিও করতে পারে। আর ওই আরু কাকাই ওই শব্জিগুলি বাজারে নিয়ে যেতেন। ঠিক তেমনি একদিন এসেছিলেন আমার বোনকে সাহায্য করতে। তখন দেখা, এবং সেই শেষ দেখা। এই ধরণের মানুষেরা যত দূরেই থাকুক না কেন বা যোগাযোগ যত সীমিত হোক না কেন তারা আত্মার অনেক কাছে থাকেন। তাই আরু কাকাদের মতো নিঃশব্দ হিরোরা আমাদের জীবনের উৎসাহ এবং উদ্দীপনা হয়ে আমাদের অন্তরে বেঁচে থাকেন আজীবন। তার মৃত্যুর খবরে তাই তার সমন্ধে কিছুটা স্মির্তিচারণ এবং কিছু কথা লেখা উনি অবশই deserve করেন। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন এই দোয়াই করি। Be rest in peace dear Aru কাকা। বি. মুকুল টরন্টো। কানাডা।