কয়েক বছর আগে ‘বাবা থেকে পাপ্পা’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম, তখন পর্যন্ত আমি নিজেও এই ‘জেন-জি’ শব্দটি বিষয়ে কিছুই জানতাম না। অতি সম্প্রতি দেশের ‘কোটা সংস্কার ও বৈষম্যহীন আন্দোলনের পর থেকে এই শব্দটি বেশ আলোচনায় এসেছে বলে আমি নিজেও কিছুটা কৌতূহল বশতঃ ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে কিছু তথ্য পেলাম। আগস্ট মাসের নয় তারিখে লেখক অনন্যা গোস্বামীর একটি লেখা যার শিরোনাম ছিল ‘জেন-জি কারা’ লেখাটি আমাকে বিশেষ আকর্ষণ করেছে। সেই লেখা এবং আরো কিছু তথ্যের আলোকে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করলাম।
জেন (Gen ) শব্দটি নেয়া হয়েছে জেনারেশন শব্দ থেকে আর জি হচ্ছে zoomers ইংরেজি শব্দটির প্রথম অক্ষর। যারা এক বা একাধিক ব্যাক্তির সাথে বা গ্ৰুপের সাথে আলাপ/আলোচনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে কম্পিউটারে বা স্মার্ট ফোনে জুম সফ্টওয়ার ব্যবহার করে থাকে তাদেরকেই zoomers বলা হলেও মূলত জেন -জি এর ক্ষেত্রে zoomers বলতে এই সম্পূর্ণ জেনারেশনকেই বুঝানো হচ্ছে। এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের জন্মকাল late 1990s বিশেষকরে ১৯৯৭ থেকে early 2010s বা আরো নির্দিষ্ট করে বললে ২০১২ সালের মধ্যে। এঁদের বয়স ১২-২৭ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ঠিক এই জেনারেশনের আগের জেনারেশনকে বলা হচ্ছে ওয়ায়-জি বা সহস্রাব্দ প্রজন্ম, ইংরেজিতে বলা হচ্ছে millennials generation ( জন্মকাল ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত) এবং তার আগের জেনারেশনকে বলে হয়ে থাকে এক্স -জি ( জন্মকাল ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০)। আবার এই জেন -জি এর ঠিক পরের জেনারেশনকেই বলা হচ্ছে আলফা-জি ( জন্মকাল ২০১২ থেকে ২০২৪) ।
সেই অর্থে আমি হচ্ছি আমি এক্স জেনারেশনের এবং আমার ছেলে অর্ণব হচ্ছে জেন -জি এর মেম্বার। আজকের এই লেখাটির শিরোনামঃ জেন-জি: এ জার্নি ফ্রম এক্স টু জেড রেখেছি কারণ আমি আমার ব্যক্তিগত ও সমাজকর্মী হিসেবে কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান থেকে গ্রাডুয়েশনলব্ধ সীমিত জ্ঞানের লেন্স দিয়ে দেখে এই জেন-জি বিষয়ে আজ লিখতে বসেছি।
জেন-জি এবং জেন-এক্স এর তুলনামূলক আলোচনাঃ
১. তথ্যপ্রযুক্তিঃ
আমাদের এই এক্স জেনারেশনের ঠিক আগে ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম কম্পিউটার স্থাপিত হয় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে (আগে নাম ছিল পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন)। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরে দেশে কম্পিউটারের ব্যাবহার ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭৯ সালে দেশে একটি কম্পিউটার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয় । এটিই পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এর অধীনে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে নামকরণ করা হয়। এই কেন্দ্রটি শুরু থেকেই বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের দেশে কম্পিউটারের প্রবর্তন ঘটে ১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে। এর পরে, ১৯৮৫ সালে, বেশ কয়েকটি সফল স্বতন্ত্র উদ্যোগে কম্পিউটারে প্রথম বাংলা লিপি উদ্ভাবিত হয়, যার ফলশ্রুতিতে আরও তীব্রভাবে দেশে কম্পিউটার ব্যবহারের পথ প্রশস্ত হয়। আমাদের দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয় মূলতঃ ১৯৯৫সালের দিকে এবং প্রায় তখন থেকেই স্থানীয়ভাবে সফটওয়্যার তৈরী করে রফতানি শুরু হয়। এই হচ্ছে আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবিকাশের ইতিহাস।
এবার আসা যাক জেন-জি এর কথা। এঁদের ছেলেবেলায় কেটেছে স্মার্ট ফোন হাতে নিয়ে। ঘুম ভেঙেই এঁরা অন্তত একবার TikTok, Twitter , Instagram ইত্যাদিতে ঢুঁ মারবেই। ফোনে প্রচুর সময় ব্যয় করার কারণে আমরা এঁদের উপর কিছুটা বিরক্ত প্রকাশ করলেও এঁদের তেমন কিছুই যায় আসে না। এঁরা চলে ওদের বুঝ নিয়ে, ওদের মতো করে। এঁরা কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে আমাদের জেনারেশনের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে রেখেছে । এর প্রমান আমরা অতি সম্প্রতি দেখলাম কীভাবে অল্প সময়ে এঁরা সঙ্গবদ্ধ হয়ে একসাথে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
২. ফেসবুকঃ
সমস্ত পৃথিবীতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের চার তারিখে ফেসবুকের প্রথম প্রবর্তন শুরু হয়। এর পরে অন্যন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও জেন-এক্স এবং জেন-জি উভয় জেনারেশনের মধ্যে বিনোদন ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অতি সম্প্রতি আমাদের দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তীতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে এই ফেসবুকের জনপ্রিয়তা এতো বেশি ভূমিকা রাখে যে শেখ হাসিনা সরকার সেই আন্দোলনের সময়ে সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলেও আন্দোলনের তীব্রতাকে ঠেকিয়ে রাখতে ব্যার্থ হন।
৩. চারিত্রিক বৈশিষ্ট:
প্রতিটি মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট আলাদা। ঢালাও ভাবে জেনারেশনের কথা বলতে যেয়ে উভয় জেনারেশনের সবাইকে পৃথকভাবে দুটি প্রধান ক্যাটেগরিতে ফেলে বিশ্লেষণ করা কঠিন হলেও কিছুটা গড়পড়তা ভাবে আমি বলার চেষ্টা করবো। আমার ব্যাক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে দেখেছি আমাদের জেনারেশন অর্থাৎ জি -এক্স এর এই আমরা আগের জেনারেশনগুলো থেকে দর্শন, ব্যাক্তিত্ব, বেশ লিবারেল। আমরা খুব বেশি ধর্মান্ধ না, কথাবার্তায় যুক্তি-তর্কের আশ্রয় নিয়ে থাকি। খেলাধুলার প্রতি বেশ আগ্রহী। রাজনীতি বিষয়ে আমাদের ভিন্নতা থাকলেও আমরা সামগ্রিকভাবে সাদা কে সাদা, কালো কে কালো বলার সৎসাহস খুব একটা দেখাতে পারেনি।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, সময়ের পরিবর্তনে এই জি -এক্স থেকে জি -জেন পর্যায়ে আমরা দেখলাম আমরা যা পারিনা, এঁরা অবলীলায় তা করতে পারছে। এঁরা রেখেঢেকে তেমন কথা বলে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এঁরা অন্যায় কিছু দেখলে মুখের উপর কটকট করে কথা বলে। আমাদের মধ্যে অনেকেই তথাকথিত মুরুব্বিরা অনেকসময় এঁদের এই আচরণকে উদ্ধত বা ‘বেয়াদপ’ বলার চেষ্টা করে। কিন্তু, এঁরা এসব তোয়াক্কা করে না। এঁরা যদি মুখ দিয়ে একবার বলে ডাক্তারি পড়বো না, আপনি আমি জোর করেও ওদেরকে ডাক্তারি পড়াতে পারবো না। এই একরোখা , জেদী মানসিকতাকে পজিটিভলি ভাবে দেখলে ‘straight forward personality ‘ বলা যেতে পারে যা এই ‘জি-জেন’ দের একটি বেশ কমন বৈশিষ্ট । এই বৈশিষ্টের কারণেই ওদেরকে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলায় ওঁরা ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে উঠেছিল, বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলো।
আমাদের করণীয় কী হতে পারে:
১. strength perspective এবং সৎ নেতৃত্ব নির্বাচন
নেগেটিভ সমালোচনা না করে, তরুণদের সাম্প্রতিক এই সফলতাকে উৎসাহ দিয়ে ওদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। আমি দীর্ঘ বছর মেন্টালহেল্থ সেক্টরে ‘recovery model ‘ নিয়ে কাজ করে শিখেছি strength perspective অনুসরণ করে মানুষের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব। আমি বিদেশে থেকে যা শিখেছি, লেখাপড়া করে যা শিখেছি, কাজ করে যা শিখেছি আমাদের দেশের তরুণরা কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ইতিমধ্যেই এসব জানে, বোঝে এবং সেটা তাদের কাজ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। আর তাই তাঁরা মেধা থাকা সত্ত্বেও সীমিত চাকুরী থেকে বঞ্চিত হয়ে নেশার সামগ্রী হাতে না তুলে ওঁরা সম্মিলিতভাবে রাস্তায় নেমে কোটার সংস্কার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, দেশের সংস্কার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, জনগণের সমর্থন আদায় করতে সামর্থ হয়েছে। আমরা এই তরুণদের অভিনন্দন জানাই !!! এখন যা করতে হবে , আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। ওদের কাছ থেকে সাদা কে সাদা বলা, কালো কে কালো বলা শিখতে হবে। অন্ধের মতো কোনো দলকে সমর্থন না দিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক নেতৃত্ব বেছে নিয়ে সৎ সরকার নির্বাচন করতে হবে।
২. প্যারেন্টিং এর পরিবর্তন:
এই তরুনদের পরের প্রজন্ম অর্থাৎ জেনারেশন আলফা যাদের বয়স ০ -১২ বছর এদেরকে আরো সুশিক্ষিত করতে হলে আমাদের প্যারেন্টিং এ পরিবর্তন আনতে হবে। গতানুগতিক Authoritarian parenting পরিবর্তন করে আমাদের Authoritative parenting এর আশ্রয় নিতে হবে। আমি আমার অনেক লেখায় এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার চেষ্টা করেছি। যারা নতুন এই টার্ম দুটি শুনছেন তাদের জন্য অতি সংক্ষিপ্তভাবে বলছি। Authoritarian parenting হচ্ছে সদা সর্বদা ছেলেমেয়েদেরকে আমাদের প্রস্তাবকৃত নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে রেখে সারাক্ষন আদেশ, উপদেশ দেওয়া, পান থেকে চুন খসলেই শাস্তি দেওয়া ইত্যাদি। অপরদিকে Authoritative parenting এও নিয়মশৃঙ্খলার কথা থাকে তবে সেখানে mutual respect থাকে। উভয় উভয়কেই সম্মান করে কথা বলে, লজিক নিয়ে কথা বলে, যে কোনো কাজের consequences অথবা cause and effect নিয়ে কথা বলে এবং নিঃসন্দেহে ভালো ফলাফল বয়ে আনে।
৩. পুলিশ বাহিনী :
পুলিশ বাহিনী আমাদেরই কারো বাবা, কারো ভাই, কারো সন্তান। সরকারি চাকুরী করতে যেয়ে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়, যেমনটি ওনারা করেছেন। আমি ঢালাও ভাবে সকল পুলিশবাহিনীকে দোষারোপ না করে, শুধুমাত্র হত্যা ও অত্যাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট পুলিশদের বিচারের আওতায় এনে অন্যান্য পুলিশবাহিনীকে কাজে যোগদানের জন্য অনুরোধ করবো।
সেই সাথে সাম্প্রতিক আন্দোলনে যে সকল পরিবারের কেউ শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবার থেকে অন্তত একজনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের ব্যাবস্থা নেয়ার জন্য আমি এই অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করবো।
উপসংহারঃ
আমি দৃঢ়তার সাথে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আমাদের তরুণেরা যারা তাদের প্রাপ্য অধিকার ছিনিয়ে এনেছে এঁরা কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে না, এঁরা সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যারা বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছে, সতীর্থদের পানির বোতল সরবারহ করতে যেয়ে জীবন দিয়েছে এঁরা কখনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাসায় আগুন দিতে পারে না। আমরা দেশের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই, ধ্বংসাত্মককাজের সঠিক তদন্ত চাই।
আসুন দল, মত, ধর্ম, বর্ণ সব ভুলে, রাজনৈতিক শত্রু-মিত্র সবাই একসাথে এই নব্য শক্তি তরুণদের সাথে থেকে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সাহায্য করি, একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ি।