অতিসম্প্রতি, দেশের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদী মোহাম্মদের আত্মহত্যা-র খবরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালি কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আমরা গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে অনেকেই আমাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছি। সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি, শিল্পীর পরিবারের এক সদস্য জানিয়েছেন, গত বছরে জুলাই মাসে ওনার মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ (৯৬) বার্ধক্যজনিত রোগে মারা যাওয়ার পর থেকে মায়ের শোক কাটতে না পেরে শিল্পী অনেটাই ট্রমাতে চলে যান । আমি অনেক আগে একবার টেলিভিশনের কোনো এক চ্যানেলে এই রুচিশীল শিল্পীর সাক্ষাৎকারে জেনে ছিলাম, কিভাবে ওনাদের বাবাকে মুক্তিযুদ্ধের সময় কেটে টুকরো টুকরো করা হয় সেই ট্রাজিক ঘটনার কথা। ওনার মৃত্যুর সঠিক কারণ মান/অভিমান, নাকি ডিপ্রেশন নাকি পিটিএসডি তা আমার জানা নেই তবে আসুন এসব বিষয়গুলোর বেসিক ব্যাপারগুলি জেনে নেই। আমরা কোনো মৃত্যুকেই ফিরিয়ে আনতে পারবো না, কিন্তু কমিউনিটির প্রতি মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আপনার আমার সহযোগিতায় মৃত্যুর মিছিলের লম্বা লাইনকে খাটো করতে পারবো বলে আমি একজন মেন্টাল হেলথ কর্মী হিসাবে আশাবাদী।
আগুন জ্বলেরে নিভানের মানুষ নাই
কাইজ্যার বেলা আছে মানুষ
মিলের বেলা নাই মনের আগুন জ্বলে রে
আমাদের এই বিচিত্র সমাজে মানুষেরা আরেকজন মানুষের ব্যাক্তিগত সুখদুখের সাথি হওয়ার চেয়ে কান ভারি করে অথবা পেছন থেকে কথা লাগিয়ে বিদ্যমান বিবাদকে উস্কে দিয়ে সেই মানুষের মনের অশান্তিকে বাড়িয়ে দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। আর সেই অশান্ত মনকে হাল্কা করার জন্যে উপযুক্ত শুভাকাংখীর সাথে দুটো মনের কথা না বলতে পেরে মানুষের মনের ভিতরে তোলপাড় করতে থাকে। তুষের আগুনের মত ভিতরে ভিতরে জ্বলতে থাকে মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা কষ্ট । এক পর্যায়ে সেই মানুষটির মনে ভর করে মরন ব্যাধি ডিপ্রেসন (depression)। পরিবারের, আত্মীয়জনদের এবং বন্ধুবান্ধবদের অসহযোগিতায়, অবহেলায় এবং বিনাচিকিৎসায় সেই হতবাঘা মানুষটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
ডিপ্রেশন রোগের সিম্পটম হচ্ছে : দীর্ঘ্য সময় ব্যাপী স্থায়ী দুঃখবোধ (Persistent Sadness ), নিজের সম্পর্কে অযোগ্য/ঘৃণা সূচক অনুভূতি (Self-Loathing), সবকাজেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, লোকজনকে এভোয়েড করে নিজেকে আড়ালে রাখার প্রবণতা (Isolation ), ব্যাক্তিগত অমীমাংসিত ইস্যুগুলি নিয়ে উদ্বিগ্ন (anxiety) থেকে পরিশেষে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়া, অস্বাভাবিক ঘুমের প্যাটার্ন, ক্ষুধা বৃদ্ধি বা কমে শরীরের ওজন বাড়িয়ে বা কমিয়ে যাওয়া, হতাশা কমাতে ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে বেপরোয়া ব্যবহার ( Reckless Behavior ) এবং সর্বোপরি আত্মহত্যার চিন্তা বা প্রচেষ্টা।
ডিপ্রেশন ছাড়াও আরো কিছু মানসিক রোগ আছে যেমন পিটিএসডি (Post Traumatic Disorder) এর উল্লেখ করাযেতে পারে। এসব যেসব রোগাক্রান্ত মানুষদের শৈশবে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ কোনো অভিজ্ঞতার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতেও তাদেরকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখা যায়।
ডিপ্রেশন বলি বা পিটিএসডি বলি, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই কমবেশি হয়তো ঘাটাঘাটি করলে পাওয়া যেতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের মনের ভিতরে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত সহ্য ক্ষমতা থাকে যাকে আমরা tolerance window বলে থাকি। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিজ নিজ coping strategy -র ব্যবহার ঘটিয়ে আমাদের ছোটোখাটো ইস্যুগুলোকে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারি , যেমন, নিজ নিজ ধর্মের সাথে সম্পৃক্ততা থেকে, খেলাধুলা, গানশোনা, বাইরে ঘুরে বেড়ানো প্রভৃতির মাধ্যমে নিজেদের tolerance window কে আরও প্রসারিত করতে পারি। কিন্তু যেসব ব্যক্তিরা মানসিক রোগাগ্রন্ত ওনাদেরকে অবশ্যই সময়মতো বিশেষজ্ঞগণের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসার আশ্রয় নিতে হবে । বেশি দেরি হয়ে গেলে আমাদেরকে অনেক অনেক খেসারত দিতে হবে। হাহুতাশ করতে করতে হবে।
আপনারা যারা নিজেদেরকে মানসিকভাবে তথাকথিত সুস্থ বা স্বভাবিক বলে দাবি করেন একজন মেন্টালহেল্থ কর্মী হিসাবে আপনাদের কাছে আমার সবিনয় অনুরোধ, আপনাদের আশেপাশে মানসিক ভারসাম্যহীন কোনো ব্যক্তি থাকলে ভালোবাসা, স্নেহ দিয়ে তাদেরকে সম্বোধন করুন, তাদের পরিবারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। আর তা যদি না পারেন এদের প্রতি কটূক্তি করে অন্তত কথা বলা থেকে দয়া করে করে বিরত থাকুন। আপনার একেকটি কটূক্তি হয়তো আত্মহত্যার তালিকাকে আরও বড়ো করতে সহায়তা করতে পারে। এই লেখাটি পড়ে কোনো লাইক বা মুখরোচক কমেন্টের চেয়েও কমিউনিটির অন্তত একটি মানুষের মাঝেও যদি মানসিকতার কোনো পরিবর্তন আসে তবেই এই লেখার সার্থকতা।
—————-
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
মেন্টালহেল্থ কর্মী
রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার , টরেন্ট