‘গৌরীকুঞ্জ’ ঘাটশীলা ভ্রমণের একটি অন্যতম জনপ্রিয় স্থান। গৌরীকুঞ্জ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাটী। তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রীর নামে এই বাড়ির নাম রেখেছিলেন এমন।
আমরা ঘাটশীলায় এসে উঠেছিলাম রামকৃষ্ণ মঠে।আমরা মানে আমি আর আমার বাবা মা। সময়টা দু’হাজার তেইশ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে। এই রামকৃষ্ণ মঠ যেখানে অবস্থিত সেই জায়গার নাম হলো ‘দাহিগোরা’। ঘাটশীলা স্টেশন থেকে রামকৃষ্ণ মঠ প্রায় এক কিমি দূরে। রামকৃষ্ণ মঠ থেকে হেঁটে দুই মিনিট গেলেই গৌরীকুঞ্জে পৌঁছে যাওয়া যায়। রামকৃষ্ণ মঠের সামনেই রেললাইন।সারা দিনেরাতে মিলিয়ে ষাট থেকে সত্তরটি ট্রেন প্রতিদিন যাতায়ত করে। সংখ্যাটি তার থেকেও বেশি হতে পারে।একদিকে খড়গপুরের লাইন আর অপরদিকে টাটানগরের লাইন।তাই খুবই ব্যস্ত থাকে এই লাইন। বেশিরভাগই মালগাড়ি, দূরপাল্লার ট্রেন, কয়েকটা লোকাল ট্রেনও চলে।
বড়ো রাস্তার পাশ থেকে গৌরীকুঞ্জে যাওয়ার রাস্তা আছে। এই রাস্তার নাম ‘অপুর পথ’। সেই রাস্তা দিয়ে যেতে হলে পাশে এক বড়ো মাঠ পড়বে।এই মাঠের একদিকে বাজার বসে আর একদিকে সার্কাস, যাত্রা, খেলাধুলা প্রভৃতি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বলা যায় এটিই হলো ঘাটশীলার সবথেকে জাঁকজমকপূর্ণ জায়গা। পথে হাঁটতে হাঁটতে দূরেই দেখা যাবে পাহাড়ের রেখা। খুব ভালো লাগে হাঁটতে। এমন পরিবেশ কা’র না ভালো লাগে? আর একটু এগিয়ে গেলে দেখা যাবে পাশে অনেক হোটেল লজ আছে থাকার জন্য। তারমধ্যে একটির নাম মনে পড়ছে ‘আনন্দিতা প্যালেস’।আর একটু এগিয়ে গেলে পাশে ঘাটশীলার পাবলিক স্কুল পড়বে। ছোটোখাটো স্কুল।এছাড়াও স্থানীয় মানুষদের থাকার বাড়ী এদিকে ওদিকে।
যাইহোক এইসব পেড়িয়ে গৌরীকুঞ্জে পৌঁছে যাওয়া যাবে।
এবার গৌরীকুঞ্জের বর্ণনায় আসি। বিভূতিভূষণের সেই পুরোনো গৌরীকুঞ্জের বাড়ি কিন্তু এখন আর নেই। এখন ঝাড়খন্ড সরকার নতুন আদলে বাড়িটি তৈরি করেছে। বাড়িটির চারধার সবুজ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এবং ঢোকার সামনেই লোহার বড়ো গেট।তার উপরে লেখা ‘গৌরীকুঞ্জ’ বলে।
গৌরীকুঞ্জের ভিতরে বেশ বড়ো জায়গা রয়েছে। বাঁদিকে রয়েছে বিভূতিভূষণের একটি আবক্ষ মূর্তি।আর তার নিচে বিভূতিভূষণের জন্ম মৃত্যুর তারিখ আর তাঁর সম্বন্ধে দু চারটি কথা লেখা আছে। এটির পিছনেই ছোটো ছোটো কিছু ঘর আছে। প্রথমে ঢুকে একটি ছোটো বারান্দ দেখা যাবে।বাইরে জুতো খুলে ঘরে ঢুকতে হয়।এই বারান্দার ঠিক মেঝের কাছে আছে বিভূতিভূষণের সেই আদিবাড়ীর ছবি। ওটা দেখে ভাবছিলাম কী বাড়ি ছিল আর এখন কী বাড়ি হয়েছে। তবে সংস্কার তো করতেই হবে নাহলে কোনোকিছুই ভালো থাকবে না। এবার মূল ঘরের ভিতর ঢুকলাম। সেখানে বিভূতিভূষণের একটি বড়ো ছবি আছে।আর চারধারের দেয়ালগুলিতে তাঁর লেখা বিভিন্ন বইয়ের নাম ছবি, আছে।তাঁর ব্যবহার করা জামা কাপড় দেখলাম টাঙানো আছে তবে সবই কাঁচ দিয়ে ঘেরা। তাঁর বিভিন্ন বয়সের ছবি রয়েছে। ছবিগুলো খুবই দুর্লভ। ভিতরের ঘরের ছবি তোলা যাবে। খুব ভালো লাগবে।একদম শান্ত পরিবেশ।
এরপরে গেলাম পাশের ঘরে। সেখানে দেখলাম একজন মানুষ রয়েছেন একটি রেজিস্ট্রি খাতা নিয়ে। যারা যারা আসে ঘুরতে তাদের নাম ঠিকানা লিখতে হয় ইত্যাদি। তাঁর মুখ থেকে এই বাড়ীর অনেক কথা শুনলাম।
তিনি বললেন এই বাড়ীতেই বিভূতিভূষণের মৃত্যু ঘটে। সেই ছবিও দেখলাম রয়েছে। বিভূতিভূষণের হাতের লেখা দেখতে পেলাম। এত ভালো লাগছিল যে কী বলব।উনি কিছু দক্ষিণা চাইছিলেন।কারণ ওনারা একটি ছোট স্কুল চালায়।তাই যাদের যেমন ক্ষমতা সেই অনুযায়ী সাহায্য করে। আমরাও দিলাম কিছু আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী।
এরপর সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। এবার চারপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। আগেই বলেছি সামনে বেশ বড়ো জায়গা রয়েছে।তার সামনে রয়েছে ‘তারাদাস মঞ্চ’। এটি বিভূতিভূষণের ছেলের নাম অনুযায়ী করা হয়েছে। এখানেই বাংলা শিক্ষা দেওয়া হয় ছোটো ছোটো শিশুদের। আর চারদিকের দেওয়ালে অসংখ্য ছবি আঁকা। বিভূতিভূষণের জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের বিভিন্ন কাজকর্মের অজানা সব ছবি ভর্তি। আঁকা ছবিগুলো খুবই সুন্দর। আর সেই সাথে লেখাও রয়েছে। আমরা একে একে সব পড়ছিলাম। অনেক কিছু জানলাম। বিভূতিভূষণ এখান থেকে কোথায় কোথায় যেতেন, কোন পাহাড়ে কোন ঝর্ণার পাশে বসে গল্প উপন্যাস লিখতেন ইত্যাদি বিষয়ে লেখা আছে। তিনি তাঁর ছেলেকে ট্রেন দেখাচ্ছেন এমন ছবিও আঁকা আছে। তাঁর প্রথম স্ত্রী দ্বিতীয় স্ত্রীর ছবিও আঁকা আছে। তিনি বিবাহ করছেন এমন ছবি আঁকা আছে। পাহাড়ে ঘন গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন ইত্যাদি নানান ছবিতে ভরা দেয়াল।
আর একটি দেখলাম আমগাছ রয়েছে। চারপাশে লাল সিমেন্টের বেদী করানো। তার নিচে লেখা “দাদা বিভূতিভূষণের আম খাওয়ার ইচ্ছাতে ভাই নুট বিহারী বন্দ্যোপাধ্যায় এই গাছটি বসিয়েছিলেন”। দেখলাম অল্প বয়সে পিতার মৃত্যুর পরে তিনি টিউশনি শুরু করেছিলেন এমনই ছবিও আঁকা আছে। সবকিছু দেখে নিয়ে এবার বেরিয়ে পরলাম।
গৌরীকুঞ্জ থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটা পথ ধরলাম সুবর্ণরেখা নদীর দিকে। আগেই বলেছি এখানে আসার পথে দূর থেকে দেখা যায় পাহাড়। তো সেই পাহাড় দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। আমরা গিয়েছিলাম বিকেলের দিকে। সামান্য একটু হেঁটেই চলে গেলাম সুবর্ণরেখা নদীর পারে। হাঁটার সময় বারবার মনে পড়ছিল এই পথ দিয়েই বিভূতিভূষণ হেঁটে গেছিলেন।কত গল্প উপন্যাস লিখেছিলেন ঐসব পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে।
সুবর্ণরেখা নদীর পারে যখন এসে দাঁড়ালাম তখন বিকেল শেষের পথে। পড়ন্ত লাল সূর্য ডুবছে দূরের পাহাড়ের মাথায়। উফ সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! যারা না সামনাসামনি দেখেছে তারা ছাড়া এই অনুভূতি কেউ বুঝতে পারবে না।আকাশ লাল কমলা ইত্যাদি রঙে ভরে গেছে আর সুবর্ণরেখার জলে সেই আলো পড়ছে। একসময় দেখলাম সূর্য পাহাড়ের মাথায় ডুবে গেল। সামনাসামনি এমন সূর্য ডোবার দৃশ্য আমরা আগে খুবই কম দেখেছি। মনে মনে ভাবছিলাম হয়ত আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি ঠিক এই জায়গায় বসেই বিভূতিবাবু এমন বিকেলে সন্ধ্যার মুখে দূরের পাহাড় জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে কত গল্প উপন্যাসের প্লট ভেবেছেন।ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়।
এরপর ফিরে চললাম রামকৃষ্ণ মঠের দিকে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। দেখলাম পিছনে কিছু স্থানীয় ছেলে কয়েকটি মোষ নিয়ে ফিরছে। এটাই তো গোধূলি। আবার গৌরীকুঞ্জের পাশ দিয়েই ফিরে চললাম। অপুর পথ পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় উঠলাম।এই রাস্তার ঠিক পাশেই রেললাইন। সবসময় ট্রেনের আওয়াজে জায়গা গমগম করে। ভাবছিলাম এইসব ট্রেনের আওয়াজ বিভূতিবাবুও শুনেছিলেন আজ আমরাও শুনছি। ঘন্টায় তাও পনেরোটা মতন ট্রেন যায় কী তারও হয়ত বেশি হবে। চারিদিকে আলো জ্বলে গেছে। বড়ো ছোট গাড়ি যাচ্ছে। দেখলাম একটা এক্সপ্রেস ট্রেন ছুটে গেল। যারা ট্রেন ভালোবাসে, পাহাড় ভালোবাসে, নদী ভালোবাসে তাদের জন্য এমন একটা পরিবেশ আদর্শ।
হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম রামকৃষ্ণ মঠে।
— অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী
৪/১২/২০২৩