এবার কানাডায় আমার বাসায় ৩১শে ডিসেম্বর ২০২৪ সন্ধ্যা থেকে আমার দুই ছেলেকে নিয়ে টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসে বিভিন্ন দেশের নব বর্ষের আতশবাজি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আর পুরানো স্মৃতি ও রোমন্থন করছি। এই দুই ছেলে ও মেয়ে ছাত্র জীবনে এই বিশেষ রাতে টরন্টো শহরের ইয়ং-ডানডাস স্কয়ার (Young -Dundas square ) আতশবাজি দেখে ভোর রাতে ঘরে ফিরতো। আমি এবং আমার স্ত্রী দুইজনে চিৎকার করে যতই বলি এত রাতে বাহিরে যেতে হয় না,কোনো কাজে দেয় না ,ওরা চলে যায় এবং রাতে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত আমাদের ঘুম হয় না, বিশেষ করে আমার স্ত্রী জেগে টেলিভশন দেখে আর কিছুক্ষন পর পর মোবাইলে জিজ্ঞেস করে ” কখন ঘরে ফিরবি ?” যেই ঘরে ফিরে আসলো, মনে শান্তি ফিরে আসে এবং নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাওয়া হতো। আজকাল ওরা বড় হয়েছে,মেয়ে তার নিজের বাসায় ,দুই ছেলে আমাদের সঙ্গে থাকে ; ছোট ছেলে আদিব বলে সে রুমকির বাসায় গিয়ে টেলিভিশনে মজা করে আতশবাজি দেখবে।যতই বলি রাতে ‘হাই ওয়ে’ গাড়ি ড্রাইভ করবে না,এমন করে তাকায়,সে আর কি বলবো, কিছুই শুনে না,নিজের গাড়ি আছে, আপন মনে চলে যায় । এক সময় আমিও মায়ের পাখার নিচে ছিলাম,কোথাও যেতে চাহিলে মা বারবার প্রশ্ন করতো,”কখন আসবি,কে সঙ্গে যাচ্ছে ” ? সেদিন গুলি অনেক দূরে ফেলে আসছি, ফিরে তাকাই, আর ভাবি যদি ফিরে যেতে পারতাম।
সময় পার্থক্যের জন্য জাপান, ইংল্যান্ড ও প্রাচ্যের দেশগুলিতে প্রথম এই উৎসব শুরু হয় ,আমাদের সঙ্গে ওদের বেশ কয়েক ঘন্টা সময় পার্থক্য। আজ ৩রা জানুয়ারী২০২৫, রাতে বাহিরে তাকালে প্রতিটি বাড়িতে রং বেরংয়ের বৈদ্যুতিক আলো ঝলমল করতে দেখা যায়। কানাডাতে ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে বাড়িঘর,দোকানপাট বৈদ্যুতিক (রং বেরংয়ে) আলো দিয়ে সাজানো শুরু হয়,আমাদের দেশে বিয়ের সময় যেভাবে বাড়ি সাজানো হয় সেভাবেই কানাডা শহর বন্দর,বাড়ি ঘর সাজানো থাকে। সন্ধ্যা হলে বিভিন্ন বাড়িতে রং বেরংয়ের আলো জ্বলে উঠে এবং ভোর পর্যন্ত চলতে থাকে। মানুষের মনে ও খুশির আমেজ দেখা যায়। অন্ততঃ জানুয়ারী পুরা মাস ব্যাপী অনেকেই দেখা হলে “হ্যাপি নিউ ইয়ার” বলে সম্ভোদন করে এবং জবাবে ও সেই বার্তা একে অপরের সঙ্গে বিনিময় করে। এ দেশে খ্রীষ্টমাস উপলক্ষে টেলিভিশনে “হোম অ্যালোন ” একটা গসপেল মুভি প্রতি বৎসর দেখানো হয়। এই মুভি এত চমৎকার ১৯৯০ থেকে এ পর্যন্ত প্রতি বৎসর দেখে আসছি,যেন পুরানো হয় না ; ছেলেমেয়ে থেকে বৃদ্ধ সবার জন্য দেখার মতো। কানাডার ব্যবসায়ীগণ ডিসেম্বর মাসের খ্রীষ্টমাস ও নিউ ইয়ার্স উপলক্ষে জিনিস পত্রের মূল্য সারা বৎসরের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে কমিয়ে দিয়ে ক্রেতাদের সুযোগ করিয়ে দেয়। সে জন্য অনেকেই খ্রীষ্টমাস ও পরদিন ২৬সে ডিসেম্বর বক্সিং ডে- র জন্য অপেক্ষা করে। আমাদের দেশে সে যুগে (১৯৬০-১৯৭০) চৈত্র মাসের শেষের দিকে ব্যবসায়ীগণ জিনিসপত্রের মূল্য কমিয়ে দিয়ে ক্রেতাকে বকেয়া পাওনা আদায় করার সুযোগ দেয়ার সঙ্গে কিছুটা মিল খুঁজে পাই। আমরা ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উল্টা কাজ করি। রোজার ঈদ(ঈদুল ফিতর ) বা কোরবানির ঈদ (ঈদুল আজহা) র পূর্বে আমাদের ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়ে দুই-তিন গুন্ মুনাফা হাতিয়ে নিয়ে থাকে, যা পশ্চিমা দেশগুলির সঙ্গে কোনো মিল নেই।
আমাদের যুগে ১৯৬০-১৯৭০র দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ইংরেজি নব বর্ষে আতশবাজি,অফিস আদালত সাজিয়ে এ ভাবে সুন্দর করে উদযাপন বলতে কিছুই দেখি নি; তবে অফিস- আদালত ,স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি এই দিনটির জন্য বন্ধ থাকতো,তার বেশি কিছু জানি নি। যুগের সঙ্গে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে,আজকাল আমাদের দেশে ও বিদেশী কায়দায় আনুষ্ঠানিকতা,দোকানপাট, খাওয়াদাওয়া পরিলক্ষিত হয়। আমি ৪২ বৎসর বিদেশে বাস করি ,প্রতি ২-৩ বৎসর পর পর দেশে গেলে অনেক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি। আমাদের ঢাকা শহরে ধানমন্ডি,গুলশান,বনানী ও উত্তরা গেলে যে সব দোকানপাট নজরে পরে এবং খাওয়াদাওয়া,তার সবই বিদেশী কায়দায়,বিদেশী খাওয়া এবং অনেক ক্রেতা বা মেহমানের ভিড় ও থাকে । এর সঙ্গে মিল খুঁজে পাই, সেকালে এবং আজকের বাংলা নববর্ষ উদযাপন হয় ,এটা আমরা কখনও ভুলে যেতে পারি না । মনে পড়ে আমাদের ছোটকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আমরা বাংলা নববর্ষ ও শোভাযাত্রা দেখতে বাড়ি বা গ্রামের ছেলেদের নিয়ে মনসা, মেহরণ বা স্থানীয় মেলায় গিয়ে ঘুড়ি, বাঁশি,কদমা(মিষ্টি),বাতাসা কিনে বাড়ি এসে নিজে ও ভাইবোনদের নিয়ে আনন্দ করতাম,এ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, ভুলতে পারি না । সে যুগে গ্রামের বাজারে বিভিন্ন দোকান সুন্দর করে সাজানো হতো এবং ব্যবসায়ীরা হালখাতা পরিবর্তন করে খরিদ্দারদের মিষ্টিমুখ করিয়ে বকেয়া পাওনা আদায় করে নতুন খাতায় নাম লিখতো।
১৫৮৪ সালে মুঘল সম্রাট আকবর কর আদায়ের সুবিধার জন্য পুরাতন সৌর বাংলা বর্ষপঞ্জির আলোকে নতুন বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। মুঘলদের “হালখাতা মহুরত” নামে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কর আদায়ের ঐতিহ্য ছিল।আমার মনে পড়ে এ সব ল্যান্ডলর্ড যারা নৌকা নিয়ে গ্রামে গ্রামে এসে খাজনা আদায় করতো,অনেকে খাজনা দেয়ার ভয়ে চৌধুরীদের দেখলে পালিয়ে থাকতো। আমাদের সময় জমিদারি,চৌধুরী,মিঞা,ভূইয়াঁ এসব উঠে গিয়েছে, তবে নামের সঙ্গে অনেকেই এই পদবি ব্যবহার আজও করে , ল্যান্ডলর্ড এর ল্যান্ড না থাকলেও লর্ড উপাদি বা পদবি ভুলে যেতে পারে নি,তাই নামের সঙ্গে ব্যবহার করে “দেখো আমিতো ল্যান্ড লর্ড ছিলাম, ল্যান্ড না থাকলে ও লর্ড এখনও আছি” ।
আমার শৈশব-কৈশোর- অভাব,দুঃখ দুর্দশা ও হেলাফেলা ভাবে কেটেছে, অভাবী সংসার ; মাকে অনেক যন্ত্রনা দিতাম ,”পয়সা দাও, আমি অন্য ছেলেদের মতো ঘুড়ি,মুরলি বাঁশি,আতস-বাজি,কদমা, বাতাসা কিনবো,মা কোত্থেকে যেন হাতে দুই আনা বা এক আনা দিয়ে বলতো এই নে,সেই অভাবী সংসারের করুন কাহিনী কোনোদিন ভুলে যাই নি , মা যে আমাকে কতখানি ভালোবাসতো,তার চোখের জল দেখলে বুঝতে পারতাম,মা আমাকে পয়সা দিতে না পেরে অপরাধী মনে করতো,আজও সেদিন গুলি বেশি বেশি স্বরণ করি।
খ) ইংরেজি নববর্ষ আজকাল পৃথিবীর সব দেশেই অতি সুন্দরভাবে উদযাপিত হয়। সেদিন এক তানজিনিয়ান লোকের সঙ্গে আমি কফিশপে বসে এ নিয়ে আলাপ করতেছিলাম ,সে বলে তানজানিয়াতে, এ দেশের অর্থাৎ কানাডার মতোই মধ্যরাতের টোস্ট এবং আতশবাজি দিয়ে নববর্ষের উৎসব পালিত হয় । এ দেশের মতো কিছু লোক পাবলিক ইভেন্টগুলিতে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে উপভোগ করে , আবার অন্যরা পরিবার বা বন্ধুদের সাথে বাড়িতে টেলিভিশনে দেখে আনন্দ করে । কথা প্রসঙ্গে সে বলতে ছিল যে “বাংলাদেশে বিপ্লব এবং তোমাদের প্রধানমন্ত্রীকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। ” সে বলে তানজিনিয়াতে ও দুর্নীতি চরমে,তবে প্রেসিডেন্ট চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণ করতে,যদি ও সব ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না, বিভিন্ন পার্টির লোকেরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
আমার মনে পড়ে ১৯৮২-১৯৮৬ নাইজেরিয়া সরকারি (অর্থ মন্ত্রলায়,অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগ ) চাকুরী করতাম। সে সময় নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট: আলহাজি শেহু শাগাড়ী, দেশে অনেক কাজ হচ্ছে ,সড়ক ও নগর উন্নয়ন ও কৃষির উপর তিনি বিশেষ নজর দিয়েছিলেন , বাজার ভর্তি বিদেশী জিনিস পত্র, দাম ও বেশি নয়। বিদেশী নির্মাণ প্রতিষ্ঠান (কনস্ট্রাকশন ফার্ম) দেশের রাস্তা ও নগর উন্নয়নের কাজে ব্যস্ত ছিল। নাইজেরিয়া গ্যাস (পেট্রোল) উৎপাদন কারী দেশ, বিদেশিরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। হটাৎ ডিসেম্বর,১৯৮৩ সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিলে, ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বাজারে আর কিছুই পাওয়া যেত না। আমাদের দেশের মতোই ওই দেশের লোকদের স্বভাব ,যেমন ১৯৭৪-১৯৭৫ সনের দিকে আমাদের বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা যেভাবে সিন্ডিকেট তৈরী করে বাজার থেকে মালামাল সরিয়ে অভাব তৈরি করেছিল,ঠিক একই ভাবে নাইজেরিয়াতে ও কিছু পাওয়া যেত না। সে থেকে ১৯৮৬ সন পর্যন্ত আমি ওই দেশে পরিবার নিয়ে ছিলাম , অনেক অভিজ্ঞতা।
(চলবে ..)