ফেসবুক খুললেই বিভিন্ন রকম খবর চোখে পড়ে,”বাংলাদেশিদের জন্য ভারতে হোটেলে কোনো সিট পাওয়া যাবে না, বাংলাদেশিদের জন্য ভারতে কোনো ডাক্তারি চিকিৎসা নেই, ভারতের মালামাল বাংলাদেশে পাঠানো হবে না, এ জাতীয় বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অনেক আক্রমণাত্বক খবর আসতেই থাকে। আচ্ছা ! ভারত আমাদের দেশের রোগীদের চিকিৎসার জন্য যেতে দেবে না, আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা কি উন্নত করা যায় না ? আমাদের দেশে এত এত ডিগ্রিধারী বড়ো বড়ো ডাক্তার,যারা বিদেশ থেকে অনেক সাধনা করে পড়াশুনা করেছে , ওরা কি আমাদের দেশের জটিল রোগের চিকিৎসা করতে পারে না ? ভাবতে অবাক লাগে ! গত ৫৩ বৎসরে ও কি দেশে সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা হয় নি ?
কোনটা বিশ্বাস করবো আর কোনটা বিশ্বাস করবো না এ নিয়ে অনেক সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ি। দিল্লি থেকে বাংলাদেশী ভূতপূর্ব প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা (নিউয়র্ক,আমেরিকা) যে ভাইরাল বক্তব্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশী টেলিভশন ও পত্রপত্রিকায় যে খবর দেখি তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। অনেকের ধারণা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্ক একমাত্র আওয়ামী লীগ ও সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এই যে জুলাই-আগস্টের অভ্যুর্থানে এত এত লোক মারা গেলো,এত লোক আহত হলো, কতজন তাদের কথা বলে ?
১৯৭১ সনে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে টানাপোড়ন চলছে , যার কিছু আলোকপাত করলে হয়তো পরিষ্কার হবে :
১) অনেকেরই মনে থাকার কথা,ডিসেম্বর ১৬,১৯৭১ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলো,একটা ধ্বংস প্রাপ্ত দেশে অর্থনৈতিক করুন অবস্থা, দেশে অভাব আর অভাব। নিরাপত্তা জনিত কারণে ৯০ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য ভারতে নেয়া হলো,কেউ প্রতিবাদ করে নি বা করলেও কোনো কাজে আসেনি যে এদের মধ্যে অপরাধীদের এ দেশের মাটিতে বিচার করতে হবে । ধীরে ধীরে ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিলো,যাওয়ার কালে ক্যান্টনমেন্ট যথা ঢাকা, কুমিল্লা, চিটাগাং, সিলেট, যশোহর আরও ক্যান্টনমেন্ট বা ক্যাম্প থেকে কামান, গোলাবারুদ,মেশিনারিজ নিয়ে দেশকে নিরাপত্তাহীনতায় রাখা হলো, বিদেশী মিডিয়াতে দেখানো হয়েছে, যে সব কামান গোলাবারুদ, মেশিনারিজ নিয়ে গেছে তার মূল্য তখনকার সময় এক বিলিয়ন ডলারের ও বেশি। এ নিয়ে মেজর আব্দুল জলিল,মুক্তিযুদ্ধের জেনারেল ওসমানী, অসম আব্দুর রব,সিএসপি রুহুল কুদ্দুস এবং আরও অনেকে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করেছিল । মেজর আব্দুল জলিলকে গ্রেফতার ,সিএসপি রহুল কদ্দুস ও আরও অনেককে চাকুরিচ্যুত করা হয় । ভারত বিবেক খাটায় নি,একটা সদ্য স্বাধীন দেশ, প্রতিরক্ষার জন্য এ সব দরকার। বঙ্গবন্ধু হয়তো অসহায়,ভারতীয় সৈন্যদের দেশ থেকে তাড়াতে হবে,তাই এ নিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলেন নি,অথবা অন্য কোনো কারণে যা সাধারণ মানুষের জানার কথা নয় । দেশের সাধারণ মানুষও এ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল, কিন্তু কোনো কাজ হয় নি ।
২ ) দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম দিকে ভারত থেকে যে সব মেশিনারিজ বা মালামাল বাংলাদেশে পাঠানো হতো, তার অধিকাংশ নিম্নমানের। আমার আজও মনে পড়ে,বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশলী সংস্থার “ঢাকা স্টিল ওয়ার্কস লি:) কারখানার একটা ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যা রিপেয়ার করার মতো না, ১০০ বা তার ও অধিক শ্রমিক (Layoff ) বসিয়ে দেয়া হলো,এ নিয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা শুরু করে , প্রতিদিন মতিঝিল হেড অফিসে শ্রমিক নেতারা এসে প্রতিক্রিয়া ও পরিস্থিতি অস্থির করে তুলছে । জাপান বা ইউরোপিয়ান কোনো দেশ থেকে ট্রান্সফরমার আমদানি করতে গেলে সময়ের ব্যাপার, ভারত থেকে তাড়াহুড়া করে একটা ট্রান্সফরমার খরিদ করে বর্ডার দিয়ে নিয়ে এসে কারখানা চালু করতে চেষ্টা করা হলো,দেখা গেলো অকেজো ট্রান্সফরমার, অনেক চেষ্টা করে ও চালু করানো যাচ্ছে না,ভারত থেকে ইঞ্জিনিয়ার এসে ও বহু চেষ্টা করে ও তাদের ট্রান্সফরমার স্টার্ট দিতে পারে নি, সে বলে সড়ক পথে আনতে নষ্ট হয়েছে,তা আর ফেরত ও নেয় নি। একটা বাহির দেশের সঙ্গে কোনো মালামাল বা মেশিনারিজ পাঠাতে হলে তার কোয়ালিটি ভালোভাবে দেখে পাঠানো দরকার,যার সঙ্গে দেশের সুনাম জড়িত। পরে অনেক চেষ্টা করে কিছু টেকনিশান পুরানো ট্রান্সফরমার চালু করে, শ্রমিক ধর্মঘট উঠিয়ে নিয়ে কাজে যোগ দেয়।
৩ ) ভারত আমাদের প্রতিবেশী,বন্ধু রাষ্ট্র,এই দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য,লেনদেনের মধ্যে স্বচ্ছতা না থাকলে কি ভাবে চলে ?
আমেরিকা এবং কানাডা দুটা বন্ধুপ্রতিম দেশ,৫,৫২৫ মাইল অরক্ষিত বর্ডার; আমেরিকা একটি শক্তিশালী দেশ যার লোকসংখ্যা ৩৬ কোটি এবং কানাডার লোকসংখ্যা মাত্র ৪ কোটি।কানাডার ৮০% ব্যবসা আমেরিকার সঙ্গে, দুটি দেশ কি সুন্দর বন্ধুত্ব বজায় রেখে চলছে। অথচ আমাদের দেশ ভারতের সঙ্গে নানাহ সমস্যা নিয়ে টিকে আছে ।
৪ ) নদ-নদীর পানি নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন এবং তার বন্টন সম্পর্কে এই আইনে বিশদ ভাবে বর্ণনা রয়েছে,আমাদের বাংলাদেশের প্রায় সব কটা নদী হিমালয় বা ভারত থেকে প্রবাহ হচ্ছে। ভারত বাঁধ দিয়ে নদীর পানি নিজেদের ব্যবহারের জন্য অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে কৃষি কাজে ব্যবহার করে , শুস্ক মৌসুমে এক দিকে আমাদের প্রয়োজনে পানি দিচ্ছে না, আমাদের দেশের কৃষক পানির অভাবে ফসল ফলাতে পারছে না, অপর দিকে বর্ষা মৌসুমে আমাদের পানির প্রয়োজন নেই ,পানি ছেড়ে দিয়ে আমাদের দেশকে ভাসিয়ে দিচ্ছে।এইতো কিছু দিন হয় ত্রিপুরা গোমতীর পানি ছেড়ে দিয়ে আমাদের কুমিল্লা,চাঁদপুর,নোয়াখালী,ফেনী অঞ্চল ভাসিয়ে দিয়ে অমানবিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।ভারতকে আমাদের যেমন প্রয়োজন,ভারতের ও তাই ,শুধু নেবে,দেবে না -এটা তো এক তরফ ব্যবসা।
৫ ) ১৯৭৬ সনে আমাদের জাতীয় নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পানি আদায়ের লক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে “(Long march to Farakkah ) ফারাক্কা অভিমুখে লং মার্চ” এর ডাক দিয়েছিলেন, তার পরে ও এই নদী সমস্যার সমাধান হয় নি। ভারত আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায় , অপর দিকে পানির মতো জটিল সমস্যার সমাধান না করে সম্পর্কের টানাপোড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশের করিডোর ভারত ব্যবহার করছে, মংলা,চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ও ব্যবহার করে মালামাল তড়িৎ গতিতে ওদের আসাম,ত্রিপুরা,মেঘালয় নিচ্ছে ,আমরা আপত্তি করি না; অপরদিকে আমরা নেপাল,ভারত ও বাংলাদেশের চিকেন নেক ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা করতে চাই, আমাদের সে সুযোগ কতটুকু দিচ্ছে ? আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি দলগুলির সঙ্গে ভারতের কোনো সু- সম্পর্ক নেই ।
সংখ্যালঘু,স্পর্শকাতর সমস্যাকে বড়ো করে দেখিয়ে ভারত সব সময় আমাদের একটা চাপের মধ্যে রেখে যাচ্ছে।
এ দেশকে এগিয়ে নিতে হলে,দেশের হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ,খ্রিষ্টান,চাকমা সবাইকে ধর্ম বর্ণ ভুলে গিয়ে এক সারিতে দাঁড়িয়ে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে, ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ, শান্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনা করে সম্পর্কের উন্নতি করতে হবে,তবেই আমরা জাতি হিসাবে এগিয়ে যেতে পারবো।
সমাপ্ত