পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ কি কেউ আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে পারে, যেখানে সব মানুষ ফেরেস্তা সমতুল্য, সংখ্যালঘু লোকদের উপর একটু আধটু সমস্যা হয় না ?
কানাডার লোকসংখ্যা ৪ কোটি , যার ৫৩% লোক খ্রীষ্টান এবং বাকি অন্য ধর্মালম্বী। কানাডা একটি শান্তিপ্রিয় দেশ ; কিন্তু এখানেও কিছু না কিছু সমস্যা রয়েছে।এখানেও সময় সময় কিছু না কিছু দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ : গতকাল ছিল মুসলমানদের পবিত্র জুমার দিন, টরন্টো শহরের নর্থ ইয়র্ক ” তারিক ইসলামিক সেন্টার ” একটি বড়ো মসজিদ। এই মসজিদে টরোন্টোর মেয়র “অলিভিয়া চৌ ” মাথায় হিজাব পড়ে অতি চমৎকার বক্তব্য দেন; এ দেশে স্থানীয় মন্ত্রী,মিউনিসিপালিটি সদস্য এলাকায় কোথায় কি হচ্ছে , সময় সময় মসজিদ,মন্দির বা গির্জায় গিয়ে খোঁজখবর নেন। তা ছাড়া প্রতিটি জুমা,কমিউনিটি সমাবেশ বা উৎসবে পুলিশ ঘোরাঘুরি করে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এটা তাদের কর্তব্য এবং সামাজিক দায়িত্ব ও বটে।
২ ) আমাদের বাংলাদেশে কি স্থানীয় মন্ত্রী,মিউনিসিপ্যালিটির মেয়র, সদস্য বা পুলিশ জনগণের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখে ? যে যেখানেই বাস করুন না কেন,আপনার এলাকার সংসদ সদস্য,স্থানীয় কমিশনার এবং পুলিশ সদস্য যদি সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখে, তা হলে তাঁর বা তাঁদের এলাকার সামাজিক নানাহ অরাজকতা থেকে আপনারা নিরাপদ থাকতে পারেন।
৩ ) আমি যখন থেকে প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া আসা করি , মুসলমান ও হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে একত্রে বসা, পড়াশুনা, খেলাধুলা, হিন্দু বা মুসলমান বাড়ি গিয়ে আড্ডা দেয়া শুরু করি। আমাদের প্রতিবেশী গ্রাম : দোজানা, কিছু হিন্দু বাড়ি,ওদের বাড়িতে পূজা এবং বিয়েতেও হইচই করেছি। চৈত্র-বৈশাখ মাসে মনসা, ও বর্ষায় মেহরণ গ্রামে রথ দেখার জন্য বাড়ির কাজিনদের সঙ্গে যেতাম ,এ সঙ্গে মায়ের দেয়া পয়সা দিয়ে মেলা থেকে ঘুড়ি,মুরোলি বাঁশি, মিষ্টি কিনে খেতে খেতে বাড়ি এসে ভাইবোনের সঙ্গে শেয়ার ও ঘুড়ি উড়িয়েছি । এগুলি আমার জীবনে স্মৃতি হয়ে আছে। গত ৪২ বৎসর আমি পরিবার নিয়ে নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও বর্তমানে কানাডায় আছি ; বিদেশে এত এত বাংলাদেশী কোথায় পাবো ? তাই হিন্দু বা অন্য ধর্মের সহকর্মী বা বন্ধুদের বিয়ে বার্ষিকী, জন্ম- মৃত্যর সঙ্গে একত্ব হয়ে আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশ করেছি ।এক সময় ঢাকা আমাদের অফিস সেক্রেটারি বনিক বাবুর মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত ছিল, আমরা অফিস থেকে অফিসার ও কর্মচারী গিয়ে খাওদাওয়া ও তাঁর মেয়েকে আশীর্বাদ করেছি।
৪ ) ভারত- বাংলাদেশ সম্পর্ক শুধু প্রতিবেশী নয়,ভারত আমাদের বন্ধু প্রতিম দেশ ; যুগ যুগ ধরে দুই দেশের মানুষ একে অপরের সঙ্গে আত্মীয়ের সম্পর্ক বজায় রেখে বেঁচে আছে। দুই দেশের মানুষের ভাষা,সংস্কৃতি ও খাদ্য,সর্বোপুরি নাড়ির টান,উপেক্ষা করা যায় না। বৎসরের পর বৎসর ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ ধর্মকে ভুলে গিয়ে একে অপরের সুখ দুঃখে এগিয়ে এসেছে। আমরা যারা বিদেশে থাকি, ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মানুষ দেশ, ভাষা, ধর্ম ভুলে গিয়ে নিজেদের মধ্যে বন্ধুর সম্পর্ক গড়ে তুলি। এই তিন দেশের মানুষের একই শিকড়, ভিন্ন ভিন্ন ফুলে সজ্জিত একটি দেশ থেকে উৎপত্তি,ওটাই আমাদের মূল পরিচয়। বিদেশের মাটিতে আমরা কেউ কাউকে আলাদা জাতি বা ধর্ম হিসাবে দেখি না, একের বিপদে বা প্রয়োজনে অন্যরা এগিয়ে আসে । এই তিন দেশের নদীর উৎপত্তিস্থল সুদূর হিমালয় ও অপরাপর পর্বত , একের উপর দিয়ে অন্যকে আলিঙ্গন করেছে। আজও আমরা একের প্রতিবেশী হিসাবে কি দেশে, কি বিদেশে বাস করি এবং হাসিমুখে প্রানখুলে একে অপরের খোঁজ খবর নিয়ে থাকি। আমার বিশ্বাস ধর্মকে ধর্মের স্থানে সবাই রেখে দিয়ে একে অপরের সঙ্গে বন্ধু- সুলভ আচরণ করে ব্যবসা , কাজকর্ম করে এগিয়ে যাওয়া উত্তম । এতে আমাদের মধ্যে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। ভারতকে আমাদের দৈনন্দিন ব্যবসা, যোগাযোগ আরও অনেক অনেক কাজে প্রয়োজন। একইভাবে ভারতের ও আমাদের প্রয়োজন, এখানে বৈরীভাব রেখে চলা যায় না।
৫ ) ১৯৭১ সনের দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সঠিক পথে এগোয় নি। ঘন ঘন প্রশাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া এবং গঠনতন্ত্রের বার বার পরিবর্তন করা হয়েছে। দেশকে গণতন্ত্রের নামে আলাদা করা হলে ও পরে এই নীতি থেকে আমাদের শাসক বৃন্দ দূরে সরে পড়ে। “কেউ খাবে কেউ খাবে না ” এই নীতি কোনো দেশে থাকা উচিৎ নয়। আমাদের দেশে ধনী-গরিবের ব্যবধান আকাশ – পাতাল । এ দেশে ৮০% লোক দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। কিন্তু বাংলাদেশে ১০% থেকে ১৫ % স্বার্থান্বেষী মহলের আচরণের জন্য আজ দেশে এই অরাজকতা চলছে।এই মাত্র পাওয়া এক রিপোর্টে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বৎসর শাসনামলে প্রতি বৎসর ১৬ বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে পাচার হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সর্বশেষ ভাষণে স্বয়ং বলেছিলেন “তোমরা আমাকে বলো জাতির পিতা এবং বঙ্গবন্ধু,তোমরা তো আমার ই লোক,বাজার থেকে মালামাল সরিয়ে কৃত্তিম অভাব তৈরী করা,গুম,খুন -এ সব তো তোমরাই করছো -এখন তোমাদের পেছনে লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে দেয়া ব্যতীত আর কোনো পথ নেই। ”
৬ ) এইতো কয়েকদিন হলো, চিটাগাং আদালতের সামনে যে হত্যাকান্ড হলো , একজন Lawyer কে যে ভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হলো, এটা অমানসিক, লজ্জার ব্যাপার,এর জন্য হিন্দু “ইসকোন” দের দায়ী করা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গন থেকে কয়েকজনকে ধরা হয়েছে, এ মুহূর্তে তার প্রতিক্রিয়া দেখার বিষয়।
৭ ) গত ৫৩ বৎসরে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়েছে,এ অস্বীকার করার মতো না । ১৯৮২ আমি যখন সরকারি চাকুরী নিয়ে নাইজেরিয়া যাই, সেখানে দেখেছি পাকিস্তানিরা অনেক আগে থেকেই শিকড় গেড়ে বসে আছে। ওদের আচরণে মনে হয়েছিল,আমরা যেন ওদের ভাগের রুটি কেড়ে নিতে এসেছি। দেশ স্বাধীন হওয়াতে আমরা এ সুযোগ পেয়েছিলাম , ওখানে আমাদের ১০ গুন বেশি পাকিস্তানী লোক কিভাবে সুযোগ পেয়েছে তা অবাক হওয়ার মতো। পাকিস্তান আমলে সব সুবিধা করাচী এবং ইসলামাবাদ থেকে পেয়েছে,আমরা কোনো সুযোগ পাই নি । আমরা আজ বুক ফুলিয়ে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াই , এটা সত্যি গর্ব করার মতো।
১৯৮৬ সনে আমি নেউয়র্ক,আমেরিকা এলমহার্স্ট হসপিটালে ,আমার পাশেই এক মার্কিন (সাদা) মহিলা; অনেক কথার পর সে জিজ্ঞেস করে, তুমি কোন দেশের লোক ? আমি বলি “বাংলাদেশের “, বাংলাদেশ কোথায় তা সে জানে না। শেষে সে মন্তব্য করেছিল , ” বোধ হয় কোনো গরিব দেশ, সে জন্য চিনি না। ” আজ বাংলাদেশ অনেক পরিচিতি পেয়েছে। ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশকে বিশ্বের প্রতিটি কর্নারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তবে আমাদের অনেক সমস্যা :
ক ) আমাদের নিজেদের মধ্যে রেষারেষি চরমে ।
খ ) আমরা গণতন্ত্র বিশ্বাসী না,দেশ গণতন্ত্রের নাম স্বাধীন হলে ও দেশে গণতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নি,এটা আমাদের রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা।
সমাপ্ত