পূর্ব বাংলার পল্লী গ্রামে সে যুগে চাষীরা হয় পাট না হয় ধান বা চাল বিক্রি করে বাজার করে ঘরে ফিরত। গ্রামের অধিকাংশ লোকের জমি,বাগান বাড়ি,পুকুর ভরা মাছ ,গোয়াল ভরা গরু, হাঁসমুরগী ছিল; এ অবস্থায় পরিধানের কাপড় বা মশলা ছাড়া প্রায় প্রয়োজনের সব কিছুই বাড়িতে পাওয়া যেত ;মেহমান যতজন খুশি আসুক,কোনো ভাবনা ছিল না,মেহমানদারির জন্য বাজারে যেতে হতো না। এমন কি সে যুগে বিয়েশাদি হলে পুকুরের জিয়ানো মাছ,ঘরের গরু,ছাগল ও মুরগির মাংস , চাল,ডাল,তেল, খেজুরের গুড়; মেহমানদারিতে তেমন কোনো দুশ্চিন্তা হতো না। আমি নিজে দেখেছি পুকুর থেকে জ্যান্ত মাছ ধরে মেহমানদারী করতে।
বর্ষার মৌসুমে নৌকা করে বাজারে গেলে, আমরা ছোট ছেলেরা নৌকায় বসে থাকতাম,বাজার শেষ হলে বা বাজার করার এক ফাঁকে আখ,মুরলি,ডালের বড়া, বাদাম, এটাসেটা এনে খেতে দিতো , খুশি হয়ে মজা করে খেতাম । হাজীগঞ্জ বাজার ( ৬-৭ মাইল দূরে )নৌকা করে গেলে,বাড়ি থেকে নেয়া ভাত ও ডালের বড়া বা ভাজি মাছ নৌকায় বসে খেতাম। হাজীগঞ্জ বাজারে বড় মসজিদে নামাজ পড়া এবং পুলের উপর দাঁড়িয়ে ডাকাতিয়া নদীর দৃশ্য দেখতে ভালো লাগতো এবং বাজার থেকে আমাদের জন্য মাটির খেলনা বা বাঁশের বাঁশি কিনে দিতেন। বাবা চাচারা সামর্থানুযায়ী স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে আমাদের মানুষ করেছেন । বিয়ের সময় মেয়েদের সোনা- গহনা দিয়ে সাজিয়ে দিতো এবং জামাইকে সুন্দর কাপড়, আংটি বা সালামীর টাকা পকেট খরচের জন্য দিয়ে দিতো। মেয়ে চলে যাবে পালকি ভর্তি করে এটাসেটা এবং পিতলের কলসি ভর্তি করে মিষ্টি দিয়ে বিদায় করতো। মেয়ে ঘর ছেড়ে চলে যাবে সে জন্য সবাই কান্না করতো। মেয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে আসলে মুখের দিকে মাবাবা বা দাদা-দাদীরা তাকাতো এবং মেয়ে সুখে আছে কিনা বুঝে নিতো। কি ধনী কি গরিব সবাই প্রাণ দিয়ে ছেলেমেয়েদের ভালো বাসা দিয়েছে। নিজেরা না খেয়ে ছেলেমেয়েদের খাইয়ে মানুষ করেছে। কিন্তু আমরা ছেলেমেয়েরা মাবাবাকে তাদের বৃদ্ধ বয়েসে সেভাবে দেখাশুনা বা যত্ন করি নি।
সে যুগে আমাদের সেল ফোন,ডিভিডি, ভিডিও গেম, ল্যাপটপ,ইন্টেরনেট চ্যাট ছিল না তবে আমাদের গ্রামের ছেলেদের একে অন্যের সঙ্গে প্রকৃত বন্ধুত্ব ছিল, একে অপরের ভালো মন্দে খোঁজখবর নিয়েছি, আমাদের মেয়েরা একে অপরের সঙ্গে সই বা বান্ধবী করে নিতো। একের বাড়িতে অপরের আসা যাওয়া ও আপ্যায়ন এ সব ছিল।
২ )
সে যুগে পল্লীর ঘরে ঘরে হুঁক্কা ও তামাকের প্রচলন ছিল ; ধুমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর জানা থাকলে ও কেউ মান্য করতো না । আজকাল সারা পৃথিবীতেই মারাত্বক ধরণের নেশা ছড়িয়ে পড়েছে, সে যুগে তা ছিল না, লোকজন তামাক,বিড়ি বা সিগেরেটকে নেশা-ই মনে করতো না।
এই হুঁক্কা নিয়ে অনেক মজাদার গান আমাদের যুগে রচিত হয়েছে, পুরানো দিনের একটা গানের কলি মনে পড়লো :
“প্রাণের হুঁক্কারে কে তোর নাম রাখিলো ডাবা … “। এই গান এখনও শুনে থাকবেন , তবে হুঁক্কার প্রচলন সমাজ থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিয়েছে। এক সময় এই গান গ্রামের চাষী থেকে আরম্ভ করে যুবক ও বুড়োদের মুখে মুখে শুনা যেত,আজ ও এ জাতীয় গান আমি ‘উ-টুবে ‘ শুনে মনে মনে হাসি।
৩ )
ভোর হলেই চাষীরা গরু ও লাঙ্গল বা নিড়ানি নিয়ে মাঠে যাওয়া আর এক দৃশ্য, দুপুরে মাঠ থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় কাজে যাওয়া,মনের আনন্দে গান গাওয়া,সাথে ডাবা, তামাক বা বিড়ি নিত্য সঙ্গী ।
আমি নিজেও মাঠে কাজ করেছি,একবার তো অসতর্ক অবস্থায় চংগার নিচে পা ঢুকিয়ে দিয়ে ব্যথা পেয়েছি, তাছাড়া ১৯৬৫ র দিকে কলেজে পড়ি,বাড়িতে এসে নিজেদের ধান বা পাটক্ষেতে কাজ করেছি। জীবনে সব ধরণের কষ্ট ও ধর্য্য ছিল, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে পাঠকদের জন্য লিখতে চেষ্টা করি।
১৯৬০-১৯৭০র দিকে গ্রাম বাংলায় প্রায় প্রতিটি ঘরে হুঁক্কা বা ডাবা -র প্রচলন ছিল। পূর্ব বাংলার (পাকিস্তানের ) পল্লীর ঘরে ঘরে তামাক ও ডাবা আপ্যায়নের অংশ হিসাবে ধরা হতো।প্রায় প্রতি গ্রামে জমিতে তামাকের চাষ হতো এবং চাষীরা তামাক পাতা রোদে শুকিয়ে বাজারেএবং গুড় মিশানো তামাক বিক্রি,প্রতি ঘরে হুঁক্কায় ব্যবহার, নিজেরা ও প্রতিবেশী বন্ধু বা মেহমানদের আপ্যায়ন করানোর প্রচলন ছিল।
তামাক পাতা দিয়ে জর্দা তৈরী করে পান ও সুপারির সঙ্গে মিশিয়ে খেত ও এজন সে জনকে আন্তরিকতার সঙ্গে আপ্যায়ন করানো হতো। পান-শুপারি, চুন সঙ্গে সাদা বা জর্দা আপ্যায়নের উপাদান,অল্পতেই গ্রামের লোক খুশি হতো।
সে যুগের বাংলা বা হিন্দি মুভিতে পান খাওয়া নিয়ে বিভিন্ন দৃশ্য বেশ মজা করে দেখতাম , কোনো একটা হিন্দি সিনেমার গানের কলি মনে পড়ছে :
“ পান খায়ে চাইয়া হামারো,
সায়ালি সুরতীয়া ঠোঁট লাল লাল,
হায়ে হায়ে মলমলকা কোরতেপে সেন্ট লাল লাল,
হামনে মাঙ্গায়ি সুরমেদানি,
লে আয়া জালিম বানারসকা জর্দা…..। “
বড়ো চমৎকার হাসির গান ।
এই পান সুপারি নিয়ে শেফালী ঘোষের গাওয়া একটা বাংলা গান কৃষকের প্রাণ কেড়ে নেয় :
“যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম .. মহেশখালীর পান তারে বানাই খাওয়াইতাম।.. ” সে যুগে এ জাতীয় অনেক গান বাংলার পল্লীর মানুষের মুখে মুখে ছিল। পুরানো দিনের অনেক বাংলা বা হিন্দি মুভিতে হুঁক্কার দৃশ্য অনেকেই দেখে থাকবেন। রাজ- দরবারে বা গুন্ডা সর্দারের আসরে বাইজির নাচ ও হুঁক্কার দৃশ্য শোভা পেতো ; এ সব আমাদের পুরাতন ঐতিহ্য যা আজকাল ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছে।
তামাক পাতাকে গুঁড়া করে গুড়ের রস দিয়ে তৈরী করে টিন বা মাটির কৌটাতে রাখা এবং সারা বৎসর নিজেরা বা বাহিরের মেহমানকে আপ্যায়ন করানো হতো।
আমি নিজে ও শৈশবে বা যৌবনে দেশে থাকাকালীন কোনো কোনো সময় এক/দুবার দাদাদের কাছ থেকে হুঁক্কা নিয়ে জোরে টান দিয়ে দেখেছি। তবে কখনও পাকা নেশাখোরদের মতো নাক দিয়ে ধুয়াঁ ছাড়তে চেষ্টা করতাম না। সুদূর কানাডায়,আমার বাসায় নিজের কম্পিউটারের পার্শ্বে একটা পিতলের হুঁক্কা শোভা পাচ্ছে,এ দেশে অনেক মিডল- ঈস্টের(মধ্যপ্রাচ্যের) লোক যারা পাইপ (হুক্কা)র নেশা করে। আমার এক ইরাকি বন্ধু গিফট হিসাবে দিয়েছেন -যা সাজিয়ে রেখেছি, এ দেশে বিভিন্ন ধরণের মশলা তামাক পাওয়া যায়।
৪ )
টরন্টো শহরে মিষ্টি পান এবং পান সুপারি,জর্দা,মশলা বিক্রি হয়। অনেকেই বাহিরে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে,খাবার শেষে দোকান থেকে মিষ্টি মশলা পান না খেয়ে বাড়ি ফিরে না। আজকাল দাঁতের সমস্যা,ডেন্টিস্টের নিষেধ থাকায় পান খাই না । এ দেশে ডেন্টিস্টের কাছে দাঁত ক্লিনিং করতে গেলে সতর্ক বার্তা দিয়ে বলে ” পান সুপারি খাবে না “,এতে দাঁতে পাথর হয় এবং অকালে দাঁত নষ্ট হয় ।
সে যুগে গ্রাম্য বধূরা সকালে ঘুম থেকে উঠে পুকুরে রাতের থালাবাসন ও ডাবা/ হুঁক্কা পরিষ্কার করে ঘরে নিয়ে আসতো এবং ঘরের কর্তাকে সকালে চিড়ামুড়ি খেয়ে কাজে বের হওয়ার পূর্বে তামাক সাজিয়ে দিয়ে মনোরঞ্জন করতো। আবার এই ঘর সেই ঘরের অনেকে এই তামাক খাবার লোভ সামলাতে না পেরে একত্রে বসে রসের গল্প এবং হুঁক্কায় তামাক সাজিয়ে একের পর এক টান দিয়ে ধুঁয়া ছাড়তো। গ্রাম্য বধূরা হুঁক্কার পরিবর্তে পান সুপারি, সাদা, জর্দা,চুন সহ মুখ ভর্তি করে চিবুতে চিবুতে ঠোঠ লাল করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকতো এবং আজ ও এই অভ্যাস রয়েছে।
ধীরে ধীরে বাজারে বিড়ি আসলো , আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে বিড়ি পাতার (টেন্ডু পাতার ) গাছ দেখিনি,ওপার ভারত থেকে বিড়িপাতা এনে বিড়ি তৈরী করা হতো। আমার আজ ও মনে পড়ে ১৯৬৩- ১৯৬৭ র দিকে আমি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র , থাকতাম গোমতি নদীর ওপারে , রাতে ওই এলাকার লোক টেন্ডু পাতা ভারত থেকে এনে বিড়ি তৈরী করে বাজারে সরবরাহ করতো। পরবর্তীতে ভারতের বিড়িপাতা বন্ধ হলে কাগজের বিড়ির প্রচলন শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে সস্তা দরের ষ্টার সিগেরেট ও দামি সিগেরেট বাজারে বিক্রি এবং হুঁক্কার বাড়তি ঝামেলা থেকে লোকজন রেহাই পেলো।
যুগের সাথে সমাজের রীতিনীতি অনেক পাল্টিয়েছে, একদা বহুল ব্যবহৃত হুঁক্কা বাংলাদেশে হয়তো মিউজিয়ামে পাওয়া যাবে। তবে ধূমপান কি দেশ বা গ্রাম থেকে উঠে গেছে -তা ঠিক না, সমাজের বিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে টেন্ডু পাতার বিড়ি থেকে কাগজের বিড়ি এবং সিগারেট পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছে।
৫ )
সে যুগে সকালে ঘরে ঘরে চাউলের রুটি বানানো হতো,তখন পূর্ব বাংলায় গমের চাষ হতো না। সকলের ঘরেই চিড়া মুড়ি,খৈ বা পান্তা ভাত বা রুটি দিয়ে সকালের নাস্তা হতো এবং মুরুব্বিগণ নাস্তার পর হুঁক্কা নিয়ে বসতো। গ্রামের হাটেবাজারে চায়ের দোকানে যে আড্ডা বসতো তাতে এলাকার বিখ্যাত আজিজ বিড়ি বা করিম ভাই বিড়ির ব্যবহার হতো, সব লোক ধুম পান না করলে ও ধুঁয়া সহ্য করতে হতো। কানাডায় ধূমপান- বাস,ট্রেন বা স্কুল কলেজে নিষিদ্ধ, ঘরে বা অফিসের বাহিরে ধূমপান করে।
চলবে ..