ফ্লোরিডা থেকে:-

আমি হাঁটছি দ্রুত খাড়া সিডি বেয়ে নীচের দিকে, আমি ক্লান্ত , তৃষ্ণার্ত , আমার মধ্যে কি একটা তাড়া , আমাকে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। গন্তব্য কোথায় তা পরিস্কার নয়।
ছোটকালে আমাদের ইয়া বড় একটা লাল মোরগ ছিল , একেবারে রাজপুত্রের মত দেখতে, ওর কত সুন্দর ঝুটি ছিল। পাড়ার সমস্ত মুরগী গুলো ছিল ওর মন্দিরের পূজারী । মা একবার বলল মোরগটি মামা বাড়ী দিয়ে আসতে । তখন রিক্সা বা গাড়ী ঘোরা চলতোনা, ছিল রাজার বাঁধা দীর্ঘ পথ। ঝাউটিয়া থেকে গুলতলী, মাইল পাঁচ হাঁটার পথ। সেজো ভাইকে নিয়ে সূর্য্য ওঠার আগে বেড়িয়ে পড়লাম ।
পূব দিকে হাঁটা , আমরা হাঁটি আর লাল গোল সূর্যোদয় আমাদের চোখ ঝলসে দেয়। আমাদের বয়েস তখন অল্প,সবে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, আমাদের পতাকার বিস্তীর্ণ সবুজ ক্ষেতে উদীয়মান রক্তলাল সূর্য্যটি একটু কম লাল ছিল তখন কারন সেই সুর্যের মাঝখানে ছিল হলুদ বর্নের বাংলাদেশের ছোট একটি ম্যাপ। ততদিনে ম্যাপটি সূর্য্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আস্ত নতুন একটি দেশে পরিনত হয়েছে। সূর্য হয়েছে আরও প্রখর ,অত্যাচারী নীরোর মত।
তখন প্রতিদিনই খবর আসতো সর্বহারাদের বিভিন্ন যায়গায় গলা কাটার আর অন্যদিকে রক্ষীবাহিনীর ঘরের ছেলেদের ধরে নিয়ে যেয়ে অত্যাচার ও গুম করে ফেলার । আমাদের এলাকার কাকা ,খালু ,মামা ,ভাই, দিদি বলতাম যেসব হিন্দু মুরুব্বীদের তারাও খুব দ্রুত গতিতে সুনামগঞ্জ চলে যেতে লাগল। পরে শুনেছিলাম সুনামগঞ্জ ছিল একটি কোড মাত্র , তারা দেশান্তরীত হয়েছিল দলে দলে না পাকিস্তানী, না রাজাকার কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের ট্রেনিং প্রাপ্ত দেশপ্রেমিক শক্তি ও সূর্যের ভালোবাসার অজচ্ছলতায়। মুরুব্বীদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক কথা হতো, টের পেতাম তাদের শন্কা এবং অজানা সেই শন্কা পথ খুঁজে নিত আমাদের মধ্যেও।
আমাদের ভয় পাবার কোন কারণ ছিলনা কিন্তু ভয় পেতাম। ভয় হল একটা রোগ , মগজের কোন স্থানে এর জন্ম হয় কখনও কারনে, কখনও অকারনে। স্বাধীনতা হচ্ছে সবচাইতে বড় দায়িত্ব এবং সবচেয়ে বড় ভয়!
মোরগটি কখনও হাতে, কখনও কাঁধে ,কখনও মাথায় বয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুই ভাইয়ে হাত বদল করতাম। আমাদের মুরগী কূলের ভালোবাসার পাত্রটি ছিল অসম্ভব ভারী। তার রাজকীয় স্বভাব আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল , তাকে ধরায় কোন ব্যতিক্রম হলে বা তার অপছন্দ হলে সে ডানা ঝাপটে বা নখের আঁচড়ে অসম্ভব যন্ত্রনা দিত । তার ওপরে চোখ খুলতে পারছিলামনা সুর্যের অত্যাচারে । আফসোস করতাম কেন যে আমাদের মামা বাড়ীটি পূবদিকে না হয়ে পশ্চিম দিকে হয়নি। এ ছিল আমাদের মনের আজীবন কষ্ট, কারন সবসময়ই সূর্য তার স্বাধীন বিচরনে আমাদের মত নাগরিকদের যন্ত্রনা বাড়াতো। সকালে যখন মামা বাড়ী যেতাম তখন পূবের সূর্য এবং বিকেলে যখন বাড়ী ফিরতাম তখন পশ্চিমের সূর্য্য দাঁড়িয়ে থাকতো তার অফুরন্ত ভালোবাসার মেশিনগান হাতে ।
৭১ পূর্ব স্মৃতি যেহেতু কিচ্ছু মনে নেই একাত্তুর পরিবর্তী “স্বাধীনতা” “স্বাধীনতা” শব্দটি এত নৈমিত্তিক ছিল যে তার অর্থ না বুঝলেও এই সূর্য্যের অত্যাচার , অ-স্থানে মামা বাড়ী, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা বিপ্লব, গন বাহিনীর কচুর চাষ ও কর্তন , রক্ষবাহিনীর দেশরক্ষা , হিন্দুদের সুনামগঞ্জ গমন আমার মনে স্বাধীনতা শব্দটি এবং এই ঘটনাগুলোর মধ্যে কোন একটা যোগসূত্র তৈরী করে দিয়েছিল। আজও পর্যন্ত সবচাইতে মিস্টিরিয়াস শব্দ গুলোর মধ্যে একটি হল স্বাধীনতা। সে কখনও একটি শব্দ, কখনও মানুষ, কখনও প্রেত , বুলগাকভের মৃত্যুহীন শয়তান ভোলান্দ।
এখনও চোখ বুজলে আমার মনে হয় আমি সেই লাল , সুন্দর ঝুটির, রাজকীয় মোরগটি কাঁধে ও মাথায় নিয়ে হাঁটছি , যে পান থেকে চুন খসলে ,এমনকি না খসলেও ডানা ঝাপটে আমাকে চপেটাঘাত করে , কান ধরে উঠবস করায়, আঁচড়ে রক্তাক্ত করে দিয়ে শরীরে কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে : কু কারে কু !
আমি হাঁটছি আমার তৃষ্ণা পেয়েছে , আমি ঘেমে নেয়ে যাচ্ছি ,আমার গলা ফাটিয়ে লক্ষ মেশিনগানের আওয়াজে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করছে , আমি স্বপ্ন দেখছি আমার শিক্ষক হরেন্দ্র ঘোষ যে আমার পিতাকে ভাই বলতো, যার পিতা আমার পিতাকে হাতে খড়ি দিয়েছে, যার তিন তিনটি কন্যা বিবাহ যোগ্যা, যে পাকিস্থানের নির্যাতন সহ্য করে ভিটে মাটি ছেড়ে যায়নি , যে আমাদের সবার মতেই ৭১র রক্ত সমুদ্র সাঁতরিয়েছে , তার সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ নয়, বাংগালী নয়, শিক্ষক নয় , একজন হিন্দু,আপাদমস্তক হিন্দু, যাকে কানে ধরে উঠবস করাচ্ছে ছেলের বয়সী স্বাধীনতা।
আমি আমার সত্ত্বার উন্মত্ততার সুনামীতে ছটফট করছি , আমার আমার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ছি , আমার দাঁতের কামড়ে কামড়ে রক্তাক্ত দগদগে হয়ে গেছে কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত দুই পুরোবাহু, এক বুনো হিংস্র বরাহ তার সুতীক্ষ্ণ দাঁতে আমাকে স্ট্যাব করে চলেছে এক লেলিহান পৈচাশিকতায়।
হঠাৎ একটি স্পষ্ট কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, “অত অস্থির হলে চলবে কি ? আমি এর চেয়ে ও বেশী দেখেছি “।
তাকিয়ে দেখি আমার পাশে হাসি মুখে হাঁটছে একটি গর্দভ , কখন সে আমার সঙ্গী হয়েছে টের পাইনি । পরিস্কার মানুষের ভাষায় সে বলল “আমি লুসিয়াস , The golden ass!”
চলবে
শাহাব/ মে ১৮, ২০১৬

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন